প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৭

0
166

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৭

রাত থেকে বার বার অদ্ভুত এক অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রাণেশা। সেই অনুভূতি একপশলা বৃষ্টির ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের সাথে। ঝুমঝুম বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শরীর-মন। যে মনে কখনও ভালোবাসার জন্ম হয়নি, যে মনে কোনো পুরুষ কখনও নিজের আধিপত্য জাহির করতে পারেনি, যে মন এতদিন রিক্ত-শূণ্য ছিল, আজ সে মনেই ক্ষণে ক্ষণে অনির্বাণের চেহারাটা উঁকিঝুঁকি মারছে। যতবারই ঘুমানোর চেষ্টায় চোখ বন্ধ করেছে ততবারই ঘুমের বারোটা বেজে গেছে ওই একটুকরো মিশ্র অনুভূতিকে অনুভব করতে গিয়ে। কেবলই মনে হচ্ছে, অনির্বাণ তার সামনে, কাছে, নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে। আর তাতেই ঘুম উড়ে গিয়ে একঝাঁক লজ্জায় কাবু হচ্ছে সে। সম্পূর্ণ রাত যখন এভাবেই কেটে গেল, নিজেকে শাসাতে, বকতে, বুঝাতে শেষরাতে বিড়বিড় করল,

‘তুইও অভদ্র হয়ে যাচ্ছিস, প্রাণ। ছিঃ… কীসব লজ্জাজনক ভাবনা এগুলো!’

শেষমুহূর্তে অনেক কষ্টে দু’চোখের পাতায় ঘুম টেনে এনে বেলা নয়টা পর্যন্ত ঘুমালো। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ ও রূপকথার ডাক শুনে ঢুলুঢুলু চোখে বিছানা ছেড়ে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে বলল,

‘এত সকালে ডাকলে কেন? রাতে ঘুম হয়নি একটুও।’

রূপকথাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে আবারও বিছানায় এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ল প্রাণেশা। রূপকথা দরজায় দাঁড়িয়ে ওর এই আলসেমি দেখে পিছনে থাকা অনির্বাণকে বলল,

‘তোমার বউ জীবনেও পাল্টাবে না। ওর ঘাড়ের সব ভূত তাড়াতে হলে, রোজ তিনবার কঞ্চি দিয়ে পিটাতে হবে।’

অনির্বাণ শব্দ করেও হাসতে গিয়ে থেমে গেল। রূপকথা বলল,
‘ভেতরে এসো।’

প্রাণেশা আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। তা-ই তাকে আর ডাকল না রূপকথা। অনির্বাণকে নিয়ে রুমে এসে জানালার কপাট খুলে পর্দা সরিয়ে প্রাণেশার রুমের একপাশে থাকা কেবিনেট ও শোকেসের লক খুলে ভেতরে থাকা জিনিসপত্রের দিকে আঙুল তুলে বলল,

‘দেখো, তোমার বউয়ের অর্জন।’

সম্পূর্ণ কেবিনেটের ওপর থেকে নিচে চোখ বুলালো অনির্বাণ। সঙ্গে সঙ্গে দুটো চোখে বিস্ময় নেমে এলো। এরপর শোকেসের দিকে চোখ ফেলল। তাতেও বিস্ময় বাড়ল বৈ কমল না। সবশেষে রুমের এককোণে ফেলে রাখা বেশকিছু পুঁতির হ্যান্ডব্যাগের দিকে চোখ গেল। টি-টেবিলে রাখা একটা অসম্পূর্ণ হ্যান্ডব্যাগ দেখে বুঝল, সদ্য হাত দিয়েছে এটায়, কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। বিস্ময় নিয়ে সে যখন সবকিছুতে চোখ বুলাচ্ছিল, রূপকথা ফের কেবিনেটের ভেতর থেকে খয়েরী ও সোনালী রঙের দশ থেকে পনেরোটা ক্রেস্ট বের করে একটা অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘এগুলো সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পেয়েছে। যখনই কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করত, ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতোই।’

বিস্মিত চোখে ক্রেস্টে চোখ বুলালো অনির্বাণ। তাতে লেখা, একুশে ফেব্রুয়ারীতে মঞ্চনাটকে অভিনয় করে, সেরা অভিনেত্রী হওয়ার প্রথম পুরস্কার এটা। তখন প্রাণেশা অষ্টম শ্রেণীতে ছিল। এভাবে ছাব্বিশে মার্চ, পনেরো ই অগাস্ট ও ষোলোই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একেকটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মঞ্চনাটক, নৃত্য ছাড়াও, ক্রিকেট, ব্যাটমেন্টনসহ নানাজাতের খেলায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হওয়া প্রাইস। সাথে কিছু মেডেল। সবশেষে দেখল, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রাণেশার অর্জিত সেই ‘চ্যাম্পিয়নস ট্রফি’। হাতে নেয়ার পর তার মনে হলো, এ জীবনে এতগুলো অর্জন তার কখনও হয়নি। পড়াশোনা বাদে অন্য কোনোকিছুর দেখে মনোযোগ দেয়ার সময় হয়নি তার। অথচ প্রাণেশা, জীবনে কত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। যতবার অংশগ্রহণ করেছে হাতভরা পুরস্কার নিয়ে ফিরেছে। সবকিছু দেখা শেষ হলে রূপকথা বলল,

‘বাড়ির কেউ কখনও ওর এই খেলাধুলা ও অর্জনকে গুরুত্ব দেয়নি। সবারই ধারণা, এসব খামোখা। এগুলো দিয়ে কী হবে? গিফটের আশায় ডুকরে কাঁদা মেয়েটিও গিফট পেয়েছে, কিন্তু সেই গিফট তার হাতে এমনি-এমনি আসেনি। অনেক কষ্টে অর্জন করতে হয়েছে। ওর এই কষ্ট, অর্জন, এসবের কোনো গুরুত্ব নেই কারও কাছে।’

ধীরপায়ে প্রাণেশার সম্পূর্ণ রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখল অনির্বাণ। শোকেসের পাশে দাঁড়িয়ে একপাশে থাকা ত্রিশ থেকে চল্লিশটা বই দেখছিল। একটা হাতে এনে দেখল, রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাস। দু’একটা পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। রূপকথা বলল,

‘এই বইগুলো কিছু ট্যুরে গিয়ে সেখানে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রতিযোগিতা থেকে প্রাপ্তি। আর কিছু ওর নিজের সংগ্রহ।’

এরপর হ্যান্ডব্যাগটা হাতে তুলে বলল,
‘এই কাজটা ও নিজে করে। লুকিয়ে-চুরিয়ে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে। অনলাইন বিজনেস আছে ওর। এগুলো সারাদেশে সেল হচ্ছে। তবে, এই বিজনেসের খবর কেউ জানে না। কেউ এসবের খোঁজও রাখে না।’

অনির্বাণ এতটাই চমকাল যে ওর মুখের কথারা হারিয়ে গেল। নিশ্চুপে একটা একটা করে বউয়ের সব অর্জন দেখে বলল,

‘তুমি জানলে কী করে?’

রূপকথা বলল,
‘এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার প্রায় ছ’মাস পর, প্রথমবার যখন অসুস্থ হয়েছিলাম, সারারাত ও আমার পাশে ছিল। তখন রাত জেগে এই হাতের কাজগুলো করত। মিথ্যুকটা প্রথমে স্বীকার করেনি। কিন্তু সে রাতে আমি অসুস্থ থাকার পরও আধোঘুমে আধোজাগরণে ওর এই কাজগুলো দেখেছি। সেদিনের পর অন্য এক প্রাণেশাকে আবিষ্কার করে ভীষণ অবাক হয়েছি, জানো? ওইদিন থেকে নিজের ভেতরে থাকা কষ্টগুলো একটু একটু করে আমার কাছে শেয়ার করেছিল ও।’

ধীরেধীরে সবকিছু আবারও গুছিয়ে রেখে রূপকথা বলল,
‘টপ রেজাল্ট হয়নি বলে ওর কোনো কাজে কেউ ওকে সাপোর্ট করেনি। সবার ধারণা ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। শুধু কি অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেটটাই সব, অনি? একটা মানুষের অভ্যন্তরীণ যে গুণ, সেটার কি কোনো মূল্য নেই? শিক্ষাদীক্ষা অনেকেরই থাকে, ক’জনের সব বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার মতো পর্যাপ্ত মনের জোর, বুদ্ধি ও মেধা থাকে বলো তো? বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কতজন নিজের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ গুণকে যাচাই করার মাধ্যমে সেরা স্থানে নিয়ে দাঁড় করাতে পারে? যারা পারে, তারা কি খুবই সাধারণ কেউ হয়? একদম তুচ্ছ হয়? এতকিছু অর্জনের পরও ও কেন সবার কাছ থেকে অকর্মা, অলস, গাধী, তকমা পাচ্ছে?’

একদৃষ্টিতে ঘুমন্ত প্রাণেশার দিকে তাকিয়ে রইল অনির্বাণ। দেখতে দেখতে চোখের কোণের বিস্ময়েরা মুগ্ধতায় রূপ নিল। আর কতবার মেয়েটার কাজে সে মুগ্ধ হবে? অনি নিজেও বোধহয় এটা জানে না। প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে রূপকথা বলল,

‘তুমি কি এখুনি বের হবে?’

অনির্বাণ হাতের ঘড়ি দেখে বলল,
‘না… আরও ঘণ্টা-দেড়ঘণ্টা পর।’

‘আমি নাশতা সাজাচ্ছি। খেয়ে যেও।’

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল অনির্বাণ। রূপকথা বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে পর্দা টেনে দরজার দুটো কপাট আস্তে করে আটকে দিয়ে চলে গেল। গুটিকয়েক পা ফেলে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে, ফাঁকা জায়গায় বসে, খানিকটা ঝুঁকে স্ত্রীর স্নিগ্ধ-সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে, আলগোছে গালে আঙুল ছুঁয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে অনির্বাণ ডাক দিল,

‘প্রাণ…। আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে বিদায় দিবি না?’

এত কাছে এসে ডাক দেয়াতে সেই ডাক প্রথমে ঘুমঘোরে ঘটে চলা স্বপ্নই মনে হলো প্রাণেশার। হাত বাড়িয়ে কাছে থাকা বালিশ টানতে গিয়ে, অনির্বাণের পিঠ ছুঁয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে প্রাণেশা বলল,

‘বিরক্ত করো না তো। ঘুমাতে দাও।’

‘এতবেলা অবধি ঘুমায় না, সোনা। প্লিজ…। ওঠে পর এখন।’

‘আহা… কেন কানের কাছে বকবক করছ? তুমি তো দেখছি, আমাকে আর শান্তিতে ঘুমাতে দিবে না। সেই রাত থেকে জ্বালাচ্ছ। যাও তো। তোমার বকবকানির জন্য সারারাত ঘুমাইনি আমি।’

প্রাণেশার সম্পূর্ণ কথা বুঝতে না পেরে অনির্বাণ বলল,
‘আমি আবার কখন তোকে বিরক্ত করলাম?’

‘করেছই তো। চোখ বন্ধ করলেই সামনে চলে আসছ।’

‘তুই কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিস? আমি আসলে তোর স্বপ্নে না, সত্যি হয়েই সামনে এসেছি। চোখ মেলে তাকা একবার। দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।’

এবার হাতের স্পর্শটা আরেকটু দাবিয়েই গালে ঠেকাল অনির্বাণ। ঠোঁট নামিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল,
‘এরপর কি মনে হচ্ছে, আমি স্বপ্নে এসে বিরক্ত করছি?’

স্বপ্ন না কি সত্যি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা পরখ করতে জোরপূর্বক চোখ খুলল প্রাণেশা। নিঃশ্বাসেরও অতি নিকটে অনির্বাণকে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে, যথাসম্ভব দূরে সরে গিয়ে কম্পনরত কণ্ঠে বলল,

‘তুমি এখানে কখন এসেছ?’

‘ভাবীর সাথেই এসেছি।’

আরামের ঘুমের বারোটা বেজে যাওয়াতে প্রাণেশা যথেষ্ট বিরক্ত হলো। চোখেমুখে হাত ঢলে বলল,
‘এখানে কী চাই?’

‘বউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম।’

‘আর কতবার বলব আমি তোমার বউ না? আমাকে বউ ডাকবে না। আমার এই ডাকটা অসহ্য লাগে। প্লিজ, যাও এখান থেকে।’

অন্যসময় হলে হয়তো এই কথাতে প্রচণ্ড মন খারাপ হতো, রাগ হতো, ঝগড়া করতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু এই বিদায়ী মুহূর্তে এসে কোনোপ্রকার মন খারাপ, রাগ ও ঝগড়াঝাটিকে মনে জায়গা দিতে ইচ্ছে হলো না অনির্বাণের। সে হাত বাড়িয়ে প্রাণেশার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘আমি চলে গেলে তোর খারাপ লাগবে না?’

প্রাণেশা ঝটপট উত্তর দিল,
‘একদমই না। তুমি কে হও আমার?’

‘কে হই, জানিস না?’

‘জানি… কিন্তু মানি না।’

‘মানতে অসুবিধা কী?’

‘জানি না রে, ভাই।’

‘আবার ভাই? এবার কিন্তু খুব খারাপ হচ্ছে।’

প্রাণেশা এত আহ্লাদীর মেজাজে নেই। কাঁচাঘুম ভাঙাতে মেজাজ একদম তুঙ্গে। কন্ট্রোল করতে না পেরে বলল,
‘ভাইকে ভাই ডাকব না তো কী ডাকব?’

এতক্ষণ শান্ত মেজাজে কথা বললেও প্রাণেশার এই ভাই-ভাই ডাক শুনে প্রচণ্ড রাগ হলো অনির্বাণের। সে ধরে রাখা হাতটা শক্তভাবে চেপে রেখে রাগকে সামলে নিয়ে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,

‘যখন ভাই ছিলাম তখন ভাই ডেকেছিস। এখন তো আর ভাই নই। এখন অন্যকিছু ডাক।’

প্রাণেশা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘অন্যকিছুটা আবার কী?’

অনির্বাণ দুষ্টু হেসে বলল,
‘জান, বেইবি, ডার্লিং, সুইটহার্ট, মাই লাভ, এসব।’

‘ওরে বাবা, এসব ডাকতে হবে?’

‘হ্যাঁ, এসবও যদি না পারিস তাহলে ডাকবি, ‘ওগো শুনছ’। এই ডাকে একটা আদর-আদর ফিলিংস লুকিয়ে আছে।’

প্রাণেশা দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে খিটমিট মেজাজে বলল,
‘খেয়েদেয়ে কাজ নেই তো আমার। বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিই। যাও তো এখান থেকে। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’

অনির্বাণকে এড়িয়ে দ্রুতপায়ে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে যেতে চাইল প্রাণেশা। অনির্বাণ বলল,
‘একটু দাঁড়া।’

পিছন ফিরে প্রাণেশা বলল,
‘কী?’

অনির্বাণ কাছে এলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রাণেশাকে বেকায়দায় ফেলতে বলল,
‘গতরাতে যে স্পেশাল গিফট দিলাম। রিটার্ন গিফট দিবি না? যেহেতু চলেই যাচ্ছি। একটা কিছু তো গিফট দিতেই পারিস।’

প্রাণেশার দম আটকে আসার যোগাড় হলো। দু’হাতে নিজের পরনের জেগিংস্ খামচে ধরে বলল,
‘আমার কাছে কিছু নেই।’

‘যা আছে, তা-ই দে।’

‘কী আছে?’

অনির্বাণ আরেকটু কাছে এসে, মাথা ঝুঁকিয়ে দু’হাতে প্রাণেশার দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে থেকে বলল,

‘গুডবাই কিস।’

এমন আবদার শুনে ভীমড়ি খাওয়ার যোগাড় হলো প্রাণেশার। চরম বিস্ময় নিয়ে, দ্রুত’পা পিছিয়ে যেতে চাইল। দুটো হাত বাঁধা থাকার কারণে পিছনে যেতেও পারল না। অনির্বাণ তাকে নিজের দিকে টেনে দু’হাতের ফাঁকে আগলে নিয়ে বলল,

‘আমি চাইলেই তোকে সঙ্গে নিতে পারতাম, কিন্তু এখুনি তোর মনের ওপর জোর দিতে চাইছি না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না। তুই আমার স্ত্রী, প্রাণ। তাই তোর প্রত্যেকটা ইচ্ছে-অনিচ্ছের মূল্য আমি দেব। বিয়ের আগ অবধি তোকে নিয়ে এরকম ফিলিংস আমার ছিল না। অন্যসব কাজিনের মতোই তোকে দেখে এসেছি। কিন্তু যখন ‘কবুল’ বললাম, তখুনি আবিষ্কার করলাম, তুই আমার আত্মার চেয়েও আপন কেউ হতে যাচ্ছিস। আমি জানি, যা কিছু হয়েছে সেসব তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে। তবুও এই সম্পর্কটাকে আমি ভুল বা বোঝা ভাবতে পারছি না। আর এজন্যই ভাঙন আমি চাইছি না। তবে তুই যদি চাস, সেটাও করব।’

প্রাণেশা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। কথার কোনো উত্তর দিতে পারল না। এরমধ্যেই হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলো। তার থেকে খানিকটা দূরে চলে গেল অনির্বাণ। ঘড়িতে সময় দেখে বলল,

‘সাড়ে নয়টা বাজে। আর আধঘণ্টা সময় আমি আছি। কিছু বলার থাকলে এই সময়ের মধ্যেই বলে ফেল। ঢাকায় ফিরে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে এত সহজে আর এমুখো হব না।’

প্রাণেশাকে পর্যাপ্ত সময় ও স্পেস দিয়ে স্টাডি টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে, ফোন হাতে নিয়ে তাতে চোখ ডুবিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘আধঘণ্টার বেশি আমি এক সেকেন্ডও বসব না।’

ধপ করে বিছানায় বসে দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরল প্রাণেশা। আধঘণ্টায় কী সিদ্ধান্ত জানাবে? কী বলবে? সে সম্পর্ক ভেঙে দিতে চায়? আসলেই কি চায়? সম্পর্ক নিয়ে মনের ভেতর যেসব ভীতি, সেটুকুর কারণেই তো বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে ভীষণ ভয় হতো তার। এরমধ্যে কোনো কাজকর্ম পারে না। বিয়ে হলেও ঘর-সংসার যে তার হবে না, এটুকু সে নিশ্চিত ছিল। স্বামী-সংসার কেমন হয়, বিবাহিত জীবনে কত জ্বালা-যন্ত্রণা হয়, সেটা নিজের বাবা-মা ও বন্ধুবান্ধবদের বিয়ের পরবর্তী জীবন দেখে বুঝা হয়ে গেছে তার। এজন্য এরকম পরিস্থিতিতে জড়াতে চায়নি সে। কিন্তু ভাগ্য! তাকে জড়িয়ে দিল। তা-ও আবার অনির্বাণের সাথে। প্রতিটা মিনিট যত এগোচ্ছে, প্রাণেশা এসব জটিল ও কঠিনসব বিষয়াদি নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেতে শুরু করেছে সে। সবকিছুর পরেও দু’দিনের এই সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটুকুর ছাপ এখনও তার মনের সর্বত্র জুড়ে আছে। চাইলেও দূরে সরানো যাচ্ছে না। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ভাবতে লাগল কী করবে! এতসব ভাবনার ভীড়ে সেকেন্ড, মিনিট পেরিয়ে গিয়ে অনির্বাণের দেয়া নির্দিষ্ট সময়ের দ্বারে এসে পৌঁছাতে লাগল মিনিটের কাঁটা। এখনও ত্রিশ সেকেন্ড বাকি ছিল। সময় দেখে উঠে দাঁড়াল অনির্বাণ। একবার প্রাণেশার দিকে তাকাল। তারপরই ফোন পকেটে রেখে, দুটো হাতও গুঁজে রাখল সেথায়। ম্লানমুখে বলল,

‘গুডবাই…।’

কয়েক’পা হেঁটে দরজার সামনে দাঁড়াল অনির্বাণ। পিছন থেকে প্রাণেশা বলল,
‘দাঁড়াও।’

দুরুদুরু বুকে সামনের দিকে পা ফেলল প্রাণেশা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘তুমি কি সত্যিই চাও, এই সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হোক?’

অনির্বাণ বলল,
‘মিথ্যে মনে হওয়ার কারণ?’

প্রাণেশা ঢোক গিলল। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। কথা আসছে না। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘আসলে আমার একটু সময় চাই।’

‘কতদিন?’

‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘ঠিক আছে। যখন বুঝতে পারবি, তখন ফোন করে বলিস। এখন আসছি।’

অনির্বাণ চলে যেতে চাইলে, প্রাণেশা তার হাতের বাহু আঁকড়ে ধরে, সাহস নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টায়, মনে মনে কথা গুছিয়ে নিতে চাইল। অনির্বাণ বলল,

‘কিছু বলবি?’

উপরনিচ মাথা নেড়ে প্রাণেশা বলল,
‘হ্যাঁ।’

‘কী?’

‘একটু আগে কী বলছিলে তুমি?’

কাঁপাকাঁপা গলায় এইটুকু বলেই থেমে গেল প্রাণেশা। অনির্বাণ বলল,
‘কোথায় কী বললাম?’

‘বলেছিলে কিছু একটা।’

‘স্যরি… মনে করতে পারছি না।’

প্রাণেশা মনে সাহস ধরে রেখে বলল,
‘চোখ বন্ধ করো।’

‘কেন?’

‘দরকার আছে।’

‘কেন’র উত্তর না দিলে চোখ বন্ধ হবে না।’

‘সময় নষ্ট করো না তো। চোখ বন্ধ করতে বলেছি, বন্ধ করো।’

‘করব না। চোখ খোলাই থাকবে। কী বলতে চাস, বল। একদম চোখে-চোখ রেখে বলবি।’

প্রাণেশা বিপদেই পড়ল। কিন্তু ভয়ের দ্বার ধারল না। যেভাবে সাহস নিয়ে কাছে এসেছিল, সেভাবে সাহস নিয়েই দু’হাতে অনির্বাণের গলা জড়িয়ে ধরে, নিচের দিকে নামিয়ে অধরোষ্ঠ দখল করে নিল। ব্যাপারটা ঘটল মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যবধানে। প্রথমে এই স্পর্শে থমকাল অনির্বাণ। পরক্ষণেই এই মহামূল্যবান মুহূর্তটাকে স্মৃতির পাতায় বন্দী করতে নিজেও তাকে আঁকড়ে ধরল। সময় কোনদিক দিয়ে, কত মিনিট অতিক্রম করল, কেউই সেটা খেয়াল করল না। দীর্ঘক্ষণ পর মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে কপালে কপাল ঠেকিয়ে প্রাণেশা বলল,

‘তুমি গুডবাই কিস চেয়েছিলে।’

অনির্বাণ হেসে উঠল। দুষ্টুমি করে বলল,
‘হুট করে এত কাছে এলি কেন? এখন তো তোকে ছেড়ে যেতে ভীষণ কষ্ট হবে আমার। থাকব কী করে আমি?’

প্রাণেশা মন খারাপের সুরে বলল,
‘আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ।’

দুষ্টুমি রেখে সিরিয়াস হলো অনির্বাণ। দু’হাতের পাতায় প্রাণেশার ঘুমঘুম মুখশ্রী আগলে নিয়ে কপালের মধ্যিখানে ভরসার ন্যায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘নিচে আয়। একসাথে নাশতা করব।’

অনির্বাণ আগে নিচে এলে, তার পনেরো মিনিট পর প্রাণেশা এলো। নাশতা খেতে বসার পর রূপকথা আড়চোখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে প্রাণেশার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘মিটমাট হয়েছে?’

প্রাণেশা কেশে উঠল। দৌড়ে পালাতে চাইলে, অনির্বাণ তাকে আটকে দিল। আবারও চেয়ারে বসালে রূপকথা শব্দ করে হেসে উঠে বলল,

‘এ কী রে, তুই লজ্জা পাচ্ছিস?’

প্রাণেশা অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ভাবী প্লিজ।’

সবাই নাশতা খেয়ে যে যার কাজে চলে গেছে সে-ই সকালে। বাকি ছিল পিচ্চি দুটো আর রাফিয়ান ও রেদোয়ান। তারাও আজ সুযোগ পেয়ে বেলা অবধি ঘুমিয়েছে। এখন উঠে এসে নাশতা করছে। দুলাভাইকে দেখে আবারও রাফিয়ান গতকালকের মতোই অনির্বাণকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টায় বলল,

‘সোনাপু, দুলাভাই তো কাল খুব গলা উঁচিয়ে বলছিল, তোমাকে কিছু একটা গিফট দিবে। কী দিয়েছে দেখি? সুন্দর কিছু, দামী কিছু?’

সব গিফট যে আর টাকা দিয়ে কিনতে হয় না, এটা এদেরকে কে বুঝাবে? লজ্জায় যেন আজ তার না-ই হওয়ার দিন। আশ্চর্য, তার এত লজ্জা এলো কোথা থেকে! আগে তো এমন ছিল না। সবই অনির্বাণের স্পেশাল গিফট’এর ফল। দূর…। সকালটাই মাটি। এমনকিছু বিড়বিড়িয়ে প্রাণেশা তার ভাইকে বলল,

‘তুই দেখে কী করবি?’

রাফিয়ান বলল,
‘কেন? দেখলে দোষ কী?’

‘সব গিফট সবাইকে দেখাতে হয় না। তোদের এসব দেখতে হবে না। আমি ওটা লুকিয়ে রেখে দিয়েছি।’

মুখ ভেঙাল রাফিয়ান। খাওয়ার মুখে তুলে অভিমানী একটা ভাব দেখাল। রাদিন বলল,
‘সত্যিই মেজো ভাইয়া তোমাকে গিফট দিয়েছে?’

প্রাণেশা কাটকাট গলায় বলল,
‘হ্যাঁ, দিয়েছে। তো?’

‘আমাকে দেখাও না, সোনাপু।’

‘একবার বলেছি না, তোদের এসব দেখতে হবে না। কথা কানে যাচ্ছে না?’

ধমক খেয়ে কেঁপে উঠল রাদিন। তবুও আগ্রহী মেজাজে বলল,
‘দেখালে তোমার জিনিস আমি নিয়ে নেব না কি? কিপ্টুস মেয়ে।’

প্রাণেশা হা হয়ে তাকিয়ে রইল। রামিশা বলল,
‘একবার দেখাও না, সোনাপু। আমিও চাচ্চুকে বলব, আমাকেও একটা গিফট দিতে।’

রেদোয়ানও বলল,
‘সামান্য একটা গিফটই তো। দেখালে ক্ষতি কী? ওরা তো আর তোমার জিনিস কেড়ে নিচ্ছে না।’

ওদের সবার আগ্রহ দেখে প্রাণেশার মাথায়ও দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। বলল,
‘কী দিয়েছে জানতে চাস তোরা?’

সবাই উপরনিচ মাথা নাড়ল। প্রাণেশা নিজের দু’হাত দু’দিকে মেলে ধরে বলল,
‘এই সাইজের একটা ঘোড়ার ডিম।’

রেদোয়ান ও রাফিয়ান তার দুষ্টুমি টের পেয়ে মুখ বাঁকিয়ে নাশতা খেতে লাগল। রামিশা অবাককরা দৃষ্টি মেলে বলল,
‘সত্যিই, সোনাপু? এত্তবড়ো ঘোড়ার ডিম?’

প্রাণেশাও উত্তর দিল,
‘হ্যাঁ, অনেক বড়ো।’

‘ডিমটা কোথায় রেখেছ, সোনাপু? আমায় দেখাবে?’

‘বাগানে আছে। দেখে আয়।’

রামিশা সত্যি সত্যিই ঘোড়ার ডিম দেখতে বাগানের দিকে দৌড় দিল। বাকিরা হো হো শব্দে হেসে উঠল। অনির্বাণ উঠে দাঁড়িয়ে মা-চাচীদের থেকে বিদায় নিয়ে রাফিয়ানের সামনে এসে বলল,

‘শালাবাবু, তোর কপালেও এমন গিফট জুটবে, যদি তুই আমাকে দুলাভাই ডাকা বন্ধ করিস। আর নয়তো জীবনেও ওই গিফট তুই ছুঁয়ে দেখতে পারবি না। সারাজীবন আইবুড়ো থেকে যাবি।’

রাফিয়ান চেয়ার ছেড়ে তেড়ে এসে অনির্বাণকে ধরতে যাবে, তার আগেই চিলের মতো উড়ে গেল অনির্বাণ। ব্যাকপ্যাক নিয়ে বাইকে চেপে বসলো। চাবি ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে একবার হাসলো শুধু। প্রাণেশা তাকে বিদায় দিতে এগিয়েছিল। হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকেই রূপকথার ঠাট্টার শিকার হলো। তাকে দেখে রূপকথা দুষ্টুমির ছলে গাইল,

‘সোনাবন্ধু তুই আমারে, করলিরে দিওয়ানা। মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না।’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে