প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৫

0
147

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৫

‘এ্যাই লম্বু, যা তো, গিয়ে দেখ ওরা সবাই তৈরী হলো কি না।’

পুরুষ মানুষ বলে সব ভাইদের তৈরী হতে বেশি সময় লাগল না। আধঘণ্টায়ই সবাই তৈরী হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হয়েছে কিন্তু যাকে নিয়ে এই ট্রিট তারই খবর নেই। এতক্ষণ ধরে কী এমন সাজগোজ করছে যে, সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কোনো আয়োজিত অনুষ্ঠান কিংবা জন্মদিন পার্টিতে কখনও ভারী সাজপোশাকে সাজতে দেখা যায়নি প্রাণেশাকে। যেখানে বাড়ির অন্য বোনেরা মেকাপ ও জামাকাপড় সিলেক্ট করা নিয়ে হৈচৈ শুরু করে, সেখানে প্রাণেশা থাকে নির্বিকার। কোনোকিছু ধরাছোঁয়াতে যেমন থাকে না, তেমনই সাজগোজের ব্যাপারেও খুব একটা মাথা ঘামায় না। একদম শেষমুহূর্তে বাড়িতে যা পরে তা-ই পরে হাজির হয়ে যায়। এই নিয়ে তাহমিনা আহমেদের দুঃখের শেষ নেই। মেয়ের জন্য প্রতি ঈদে তিনি শাড়ি-থ্রিপিস, জুয়েলারি কিনেন অথচ প্রাণেশা সেসব পরে না। হাতে নিয়ে পছন্দ-অপছন্দ কিছুই জানায় না। নতুন কাপড় পেলে মুচকি হেসে সেগুলো তুলে রাখে আলমারিতে। যে-ই মেয়ের সাজগোজ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, আজ তার এত দেরী দেখে অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে অনির্বাণ। এজন্যই রেদোয়ানকে হুকুম করেছে, একবার গিয়ে দেখে আসতে বোনেরা ও তার বউয়ের তৈরী হওয়া আর কতদূর। ভাইয়ের আদেশ শুনে রেদোয়ান সবেমাত্র পা ফেলেছিল উপরে গিয়ে চেক করবে, তখুনি নিজের রুমের দরজা খুলে সব বোনদের বের করে দিয়ে, প্রাণেশার হাত ধরে তাকে খুব সাবধানে রুমের বাইরে এনে দাঁড় করালো রূপকথা। রেদোয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,

‘ওইতো, ভাবী চলে এসেছে।’

প্রাণেশা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হিলটা খুব বিরক্ত করছে তাকে। আঙুলে ব্যথা পাচ্ছে। শাড়ি পরার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু রূপকথার আদুরে কথায় না পরে উপায়ও ছিল না। এই মানুষটার কথা অগ্রাহ্য করার সাহস প্রাণেশার নেই বলেই অনুরোধ করা মাত্রই ঘাড় নেড়ে শাড়ি পরতে গিয়েছে। সব কাজে রূপকথাই তাকে সাহায্য করেছে। সাজগোজ কমপ্লিট করে এখন বাইরে এসে আবারও শেষ একবার প্রাণেশার সম্পূর্ণ সাজটা দেখছিল রূপকথা। দেখা শেষ হলে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

‘খুব তো বলতি, শাড়ি পরলে তোকে দেখতে খারাপ লাগবে। কই, এখন তো মোটেও খারাপ লাগছে। একদম বউ বউ লাগছে। মনে হচ্ছে জলজ্যান্ত একটা পরী নেমে এসেছে এই আনন্দপুরীতে।’

লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো প্রাণেশার। এইভাবে পঁচানোর মানে কী! সে অনভ্যস্ত হাতে শাড়ির এদিক-ওদিক টানছিল। গতকালকে শাড়ি পরে কী যে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ভারী শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘণ্টার পর বসে থাকা কি চাট্টিখানি কথা! যে পরে সে-ই জানে, গরম কতপ্রকার! এখনও ঠিক সেরকমই অনুভূতি হচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে, শরীরের এখানে-ওখানে সবখানে চুলকাচ্ছে। এটা ছিঁড়ে ফেলে যদি দৌড় দিতে পারত, তাহলেই বোধহয় একটু স্বস্তি পেত। কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়। রূপকথার আদুরে কথার ফাঁকে কড়া আদেশ ও অভিমান মিশানো একটা কথাও ছিল,

‘শাড়ি না পরলে তুই আমার সাথে আর কথা বলবি না।’

দুনিয়ার সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেও কষ্ট হবে না প্রাণেশার। কষ্ট হবে, এই বিশ্বস্ত মানুষটা যদি তারওপর রাগ ও অভিমান পুষে রেখে দিন কাটায়। তাই তার আদেশ হোক কি অনুরোধ, কথা রাখতেই, খুবই সাদামাটা ডিজাইনের এই মেরুন রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়েছে। মুখেও দিয়েছে দামী দামী প্রসাধনী। যদিও হালকা মেকাপ তবুও এই শাড়ি ও মেকাপ তার প্রচণ্ড অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। এরমধ্যে আবার সবার অবাককরা দৃষ্টি দেখে কোনদিক দিয়ে পালানো যায় সে-ই পথ খুঁজছিল। দুর্ভাগ্য, সেটাও আজ পেল না। কোনোদিকে ফাঁক নেই, যেদিক দিয়ে সে আরামসে পালাতে পারবে। তার এতসব লজ্জা ও অস্বস্তিকে পাত্তা দিল না রূপকথা। মিটমিটে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে হাত ধরে আস্তেধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে সাহায্য করল। প্রাণেশা শুধু পারল না হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিতে। সবার সামনে দাঁড়ানোতে লজ্জা আরও ঝেঁকে ধরল প্রাণেশাকে। সে চোখ তুলে উপরের দিকে তাকাতেই পারল না। তবে না তাকিয়েই বুঝল, কেউ একজন দু’চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে তাকে দেখে। আশ্চর্য! এমনটা কেন! ভেবে পেল না প্রাণেশা। ঠোঁট কামড়ে নতমুখেই দাঁড়িয়ে রইল সে। রূপকথা বলল,

‘চাচিম্মা, সাজটা কি ঠিক আছে? আর কিছু লাগবে?’

তাহমিনা আহমেদ মেয়ের সামনে এসে দু’চোখ ভরে মেয়েকে দেখে, স্নেহের পরশে সম্পূর্ণ মুখ ছুঁইয়ে, কপালে আদর দিয়ে বললেন,
‘এখন মনে হচ্ছে আমার মেয়েটা একদম স্বয়ংসম্পূর্ণা। কোনো ত্রুটি নেই। আমরা তো তোকে সবসময় এইভাবেই দেখতে চাই, প্রাণ।’

এইটুকু আদরে দু’চোখ ভাসিয়ে কাঁদার কথা ছিল প্রাণেশার। কিন্তু সে কাঁদল না। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের পানি কন্ট্রোল করে, নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইল। মা-চাচীরা আজ খুব প্রশংসা করছেন প্রাণেশার। রূপের, সাজের, সাজপোশাকের, সবকিছুর। শোনেও সেইসব প্রশংসায় আজ আর মনের কোণে আবেগ জমা হলো না। সবকিছুই নিছক সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তন ভেবে মেনে নিল। সবাই যখন প্রাণেশাকে এই রূপে ও সাজে দেখে অবিরত প্রশংসা করছিলেন, বিরক্ত হয়ে রাফিয়ান বলে উঠল,

‘সোনাপুকে তো চব্বিশ ঘণ্টাই দেখো। আগে যা ছিল এখনও তা-ই আছে। খামোখা আটকে রেখে দেরী করাচ্ছ। মনে হচ্ছে, রাত আজ এখানেই শেষ হবে।’

রাফিয়ানের গলার আওয়াজে অনির্বাণ নিজেও সহজ হলো। কতক্ষণ পর তার ঘোর কাটল, সেটা সে নিজেও বুঝল না। শুধু অনুভব করল, তার সামনে থাকা দৃশ্য ও নারীটি যেন কোনো রূপকথার রাজ্যের রাজকন্যা। শাড়ি-গয়না, মেকাপ, খোঁপায় আবার নিজেদের বাগানের অলকানন্দা ফুল, সবমিলিয়ে প্রাণেশার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ হয়ে মনের পর্দায় ধরা দিল। অথচ এর আগে কোনোদিন এই মেয়েকে সে এভাবে দেখেনি, এত মুগ্ধ হয়নি, এত শান্তি পায়নি। সবটাই কি তবে বৈধ সম্পর্কের ভারী ও দামী সিলমোহরের কারণে? ভেবে কোনো কূল পেল না অনির্বাণ। মুগ্ধতা কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সময় লাগল তার। চশমা পরেও সে যেন ভুল ও অবিশ্বাস্য কিছু দেখে নিল আজকে। আর এই দেখাটাই তার মনকে টালমাটাল করে দিল। মেয়েলী পোশাক-আশাকের যে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য ও গুণ আছে, সেটা মন স্বীকার করতে বাধ্য হলো। না চাইতেও দৃষ্টি সরিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘দেরী হচ্ছে। তোরা গিয়ে গাড়িতে বোস্। আমি মনে হয় রুমে চাবিটা ফেলে এসেছি। এক্ষুণি ওটা নিয়ে আসছি।’

অনির্বাণের পালিয়ে যাওয়া আর কেউ বুঝতে না পারলেও নাহিয়ান ঠিকই বুঝে নিল। গা দুলানো হাসিতে মুখ ভরে উঠল তার। চেপে রাখতে চেয়েও পারল না। হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলল,

‘বউয়ের এই রূপ দেখে মেজো ভাইয়া পালিয়েছে। এখন শুধু অজ্ঞান হওয়া বাকি।’

আশ্চর্যান্বিত মনোভাব নিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাল প্রাণেশা। তাকে কি দেখতে এতটাই খারাপ লাগছে যে, এইভাবে সরে যেতে হলো! কেউ তার রূপের, গুণের ও মেধার প্রশংসা না করলেও যেমন কষ্ট হয় না, করলেও সেসব নিয়ে খুব একটা আনন্দ-ফুর্তিও হয় না। তবে আজকের এই দৃশ্যটা খুবই চোখে লাগল। ঠোঁট কামড়ে বলল,

‘ভাবী, আমার মনে হয় শাড়িটা চেঞ্জ করে আসা উচিত। কেউ আমাকে দেখে বিব্রত বা বিরক্ত হোক, আমি সেটা চাই না।’

আসলেই গাড়ির চাবি ফেলে এসেছিল অনির্বাণ। ওটা হাতে নিয়ে নিচে নামতে গিয়েই প্রাণেশার কথাগুলো কানে বাজল। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,

‘এই নিয়ে আর একটা কথা বলবি তো, এমন চড় দেব, আক্কেলদাঁতসহ সবগুলো দাঁত খসে পড়ে যাবে। যা পরেছিস সেটাই যথেষ্ট। এখন চুপ করে গাড়িতে এসে বোস।’

***

অনির্বাণ ড্রাইভ করছে। পাশে বসেছে নাহিয়ান। পিছনে বাকি সবকটা বসেবসে বকবক করছে। সবার মধ্যে নীরব শুধু প্রাণেশাই। না কোনো কথা শুনছে, না কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে। মন খারাপ না কি মন ভালো সেটাও বুঝার উপায় নেই। লুকিং গ্লাসে বেশ কয়েকবার প্রাণেশার মুখখানি দেখল অনির্বাণ। তখনও জানালার কাঁচ খুলে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে প্রাণেশা। বৈরী হাওয়ায় উড়ছে তার সামনের ছোটো ছোটো চুল। খোঁপা করা থাকলেও ছোটো ছোটো চুলকে বেঁধে রাখা যায়নি। ওগুলো সামনের দিকেই ছিল। কপাল ও গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। আকাশ ফেটে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও নেমেছে। হাত বাড়িয়ে সেই বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে প্রাণেশা। বৃষ্টির স্পর্শ শুধু শরীর নয়, মনজুড়েও শীতলস্পর্শ ছুঁইয়ে মনের সব অবসাদ দূর করে দিল। আচমকাই অনির্বাণ ধমকে উঠে বলল,

‘হাত বাইরে বের করছিস কেন, প্রাণ?’

সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতটা ভেতরে নিয়ে কাঁচ তুলে দিল প্রাণেশা। ভয়ে নয়, অন্যমনস্কতার কারণে। খুব করে খেয়াল করছে, বিয়ের রাত থেকে অনির্বাণ তাকে ভাই-বোনের সামনে অথবা একা পেলেই প্রাণ ডাকছে, নয়তো আগে প্রাণেশা ডাকত। প্রথম যখন এই কথা শুনে হৃদপিণ্ড ধড়ফড়িয়ে উঠেছিল, এখনও তাই হলো। আজ কেন যেন তার কোনো তর্কে যেতে ইচ্ছে করছে না, তা-ই শান্ত হয়ে সিটে হেলান দিয়ে চুপ করে রইল। অন্য সময় হলে এই ধমকের তোয়াক্কা করত না সে, ঠিকই এর পালটা জবাব দিত। অনির্বাণ নিজেও যেন প্রাণেশাকে এত শান্তশিষ্ট মেজাজে মেনে নিতে পারল না। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলল,

‘শরীর খারাপ?’

ঝটপট দু’দিকে মাথা নাড়ল প্রাণেশা। অনির্বাণ আরও কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। শহরের নামী-দামী রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছেছে ওরা। পার্কিং প্লেসে গাড়ি থামিয়ে, ডোর খুলে একে একে সবাইকে নামালো। সব কাজিনেরা এলেও আসেনি রূপকথা, আরিয়ান ও তাদের ছোট্ট রাজকন্যা। বড়ো ভাই এখনও অফিসে। আর ভাবী, তাকে ছাড়া বাড়ির বাইরে পা-ও ফেলবে না। অগত্যা তিনটে মানুষকে ফেলে বাকিদের নিয়েই আসতে হলো। গাড়ি থামার সাথে সাথে ওরা সবাই ছুটে বের হলো। নাহিয়ান সবাইকে ধরে ধরে রেস্টুরেন্টের ভেতরে গেল। সবাই নেমে চলে গেলেও নামতে গিয়ে বিপদে পড়ল প্রাণেশা। হিলের সাথে শাড়িটা আটকে গেল। সেটা খুলতে গেলে দামী শাড়িটাও সামান্য ছিঁড়ে গেল। অনির্বাণ বলল,

‘একটা শাড়ি কী করে সামলাতে হয়, তা-ও জানিস না?’

প্রাণেশা রাগত্বস্বরে বলল,
‘না জানি না। কেন? কোনো সমস্যা? সবাইকে সবকিছু জানতে হবে কেন?’

‘রাগ করছিস কেন? আমি এতকিছু মিন করে বলিনি। এমনিই বলেছি।’

একপা বাইরে দিয়ে শাড়ির প্রতিটা ভাঁজ ঠিক আছে কি না সেটা দেখে নিয়ে নামতে যেতেই হাত বাড়িয়ে দিল অনির্বাণ। তার কেন যেন মনে হলো, এই মেয়ে পা ফেলতে গেলেই পড়ে যাবে। হলোও তাই। রাগ দেখিয়ে অনির্বাণের হাত ধরেনি প্রাণেশা। তাতেই নিচে পা দেয়া মাত্রই পায়ে মোচড় খেল। বিরক্তিতে পায়ের জুতো খুলে ডাস্টবিনে ফেলে এলো। হিল ফেলে দিয়ে শান্তি পেল সে। গাড়িতে থাকা নিজের ব্যাগপ্যাক টেনে এনে ভেতরে থাকা লেডিস্ স্যু বের করে সেটা পায়ে দিল। শাড়ির সাথে স্যু! ঠিকঠাক মানালো কি না কে জানে! সেই হিসেব মিলাতে গেল না অনির্বাণ। বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে বলল,

‘জুতা ফেলে দিলি কেন?’

প্রাণেশা সহাস্যে বলল,
‘যা আমার জন্য নয়, আমি তা পরি না।’

‘ওহ…। আচ্ছা, চল। এভাবেই ঠিক আছে। হিল পরার দরকার নেই। বাই দ্য ওয়ে… তোকে শাড়িতে অনেক প্রিটি লাগছে।’

খোঁচা দিল না কি প্রশংসা করল, সেসব ভেবে দেখল না প্রাণেশা। চোখ পাকিয়ে বলল,
‘তা-ই?’

‘ইয়াপ।’

মুচকি হেসে এই শব্দটা উচ্চারণ করে নিজের চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে রেস্টুরেন্টের সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগল অনির্বাণ। পাশে তাকিয়ে দেখল, প্রাণেশা আশেপাশে নেই। চমক তো বটেই, সেইসাথে ভয়ও পেল। পিছন ফিরতেই আরও বেশি চমক খেল। প্রাণেশা গাড়ির ভেতরে। দৌড়ে এসে জানালায় ঠোকা দিয়ে বলল,

‘আবার গাড়িতে কেন? কিছু নিতে ভুলে গিয়েছিস?’

গাড়ির কাঁচ খুলে দাঁত কেলিয়ে হাসলো প্রাণেশা। শাড়ি দেখিয়ে বলল,
‘এটা চেঞ্জ করতে এসেছি।’

অনির্বাণ আঁৎকে উঠল। মুখটা তার হা হয়ে গেল। বলল,
‘তুই গাড়ির ভেতরে কাপড় চেঞ্জ করবি?’

‘হ্যাঁ, তো?’

‘ছিঃ… কমনসেন্স বলে যে কিছু একটা আছে, সেটাও তোর মধ্যে নেই।’

প্রাণেশা এত কথা কানে নিল না। শাড়িটা তাকে জ্বালিয়ে মারছে। এরমধ্যে হিলে তার পায়ের আঙুল ছিঁলে গেছে। এত সাজগোছ ও পরিপাটি তাকে থাকতে হবে না। সে যেমন চলে অভ্যস্ত, যেভাবে শান্তি ও স্বস্তি, সেভাবেই নিজেকে আবিষ্কার করতে গিয়ে, ফটাফট শাড়ি-ব্লাউজ খুলতে যাচ্ছিল এরমধ্যেই অনির্বাণ পড়িমরি করে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘এ্যাই, এ্যাই, সাবধানে। জ্যান্ত একটা পুরুষ মানুষ তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তুই…। একটু তো লাজলজ্জা নিজের মধ্যে রাখ। এত নির্লজ্জ হলে চলে?’

প্রাণেশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই পরনের কাপড়চোপড় খুলে, ভেতরে থাকা নীলাভ সবুজ রঙের লম্বা সাইজের ফুলহাতা লেডিস্ টি’শার্ট ও নেভি ব্লু রঙের জেগিংস্ দেখিয়ে বলল,

‘আমার না একদমই লজ্জাশরম নেই। ওসব কেমন করে আসে, কীভাবে আসে, কতটা আসে, সেটাও আমি জানি না। আমি শুধু নির্ভেজাল জামা-কাপড় পরতে পছন্দ করি।’

বলতে বলতে খোঁপায় গুঁজে রাখা ফুল ও গয়নাগাটি সব খুলে ফেলল প্রাণেশা। ব্যাগে থাকা ভেজা টিস্যু ও পানির বোতল বের করে গাড়িতে বসেই মুখের সব প্রসাধনী তুলে নিয়ে, ডোর খুলে বাইরে এসে অনির্বাণের সামনে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে দু’হাত আড়াআড়িভাবে বেঁধে গাড়িতে হেলান দিয়ে বলল,

‘এখন প্রিটি লাগছে?’

মঙ্গলগ্রহে থাকা অ্যালিয়েন নামক প্রাণী দেখলেও এতটা অবাক অনির্বাণ হতো না, যতটা অবাক হলো প্রাণেশার এইসব উদ্ভট কাজকর্ম দেখে। সে বিশ্বাসই করতে পারল না, এই মেয়ে শাড়ির নিচে টি’শার্ট ও জেগিংস্ পরে এতক্ষণ গাড়িতে বসেছিল কীভাবে! গরম লাগেনি? চোখদুটো তার গোলগোল হয়ে রইল। কোনোমতে উচ্চারণ করল,

‘মানে কী এসবের? শাড়ির নিচে এসব কেন? শাড়ি যদি ভালোই লাগে না, তাহলে ওটা গায়ে জড়িয়েছিলি কেন?’

প্রাণেশা সবকটা দাঁত করে হেসে হেসে বলল,
‘ভাবীর কথা রাখতে।’

অনির্বাণ অভিমানী কণ্ঠে বলল,
‘শুধু ভাবীর কথাই? আর কারও না?’

‘আর কার কথা রাখব? আর কে আছে, যে আমাকে বুঝে? আমার জন্য ভাবে? আমার নিঃসঙ্গ ও কষ্টকর মুহূর্তে আমাকে সময় দেয়? সাপোর্ট দেয়? আছে এমন কেউ? নেই। কেউ নেই।’

অনির্বাণকে ভাবনারত অবস্থায় রেখে প্রাণেশা রেস্টুরেন্টের ভেতরে পা রেখেই ভয়ানক পর্যায়ের রেগে গেল। এত রাগ যে, তার দুটো হাত মুঠোবন্দী হয়ে গেল। মুঠোবন্দী হাত নিয়ে প্রায় ছুটে গিয়ে অচেনা ছেলেটার মুখের একপাশে ধুম করে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। সাথে সাথে ছেলেটা ছিঁটকে পড়ল দূরে। ভীতিগ্রস্ত মন নিয়ে লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ল আইশা। মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরল মাইশাকে। দু’জনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল। আর প্রাণেশা, সামনে পড়ে থাকা ইতরটাকে সাইজ করতে কলার ধরে টেনে তুলে বলল,

‘বোলতার বাসায় ঢিঁল ছুঁড়েছিস। কামড় তো তোকে খেতে হবে চান্দু। একবার কামড় খেলে বুঝবি, মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া হাতে ঠিক কতক্ষণ বোলতার বিষ থাকে।’

সবাইকে নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে ওয়াশরুমে গিয়েছিল নাহিয়ান। পিচ্চিদুটো দুষ্টুমি করছিল। সেই দুষ্টুমি সামাল দিচ্ছিল রাফিয়ান। আর রেদোয়ান গিয়েছিল কয়েকটা পোজ নিতে যেন ফেসবুকে ছবি আপলোড দিতে পারে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সবার পছন্দের খাবার অর্ডার দিয়ে ভাই-বোনের সামনে আসতে আসতে কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে গেছে এখানে। দৃশ্য দেখে দ্রুতই ছুটে এলো নাহিয়ান। বলল,

‘কী করছিস, প্রাণেশা? এটা পাবলিক প্লেস! এখানে কেউ মারামারি করে? ঘটনা কী ঘটেছে সেটা আগে বল।’

মেয়ে দুটোকে দেখে ইতর শ্রেণীর ভদ্রবেশী অমানুষটা সুযোগ নিচ্ছিল সবে। কেবলই আইশার পিছনে স্মুথলি নিজের লালসার হাতটা ছুঁয়েছিল মাত্র। সেটাই নজরে পড়ে গিয়েছিল প্রাণেশার। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। রেগে গিয়ে স্থান, কাল, পরিস্থিতি সব ভুলে গিয়ে ছেলেটাকে কয়েকটা দিয়ে ঠাণ্ডা হলো। হুলুস্থুল দেখে মানুষ জড়ো হলো মুহূর্তেই। অনির্বাণও দৌড়ের ওপর ভেতরে প্রবেশ করল। নাহিয়ানের প্রশ্নের উত্তরে প্রাণেশা বলল,

‘ও আইশার গায়ে হাত দিয়েছে। এক্ষুণি পুলিশকে ইনফর্ম কর। ইতরটাকে জেলে ভরে দে।’

ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে চাইলে, যারা দৃশ্যটা দেখেছে তারা সাক্ষী দিল। যা সত্যি তা-ই বলল। অনির্বাণ সব কথা রিসেপশনে জানালে কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা নিল। প্রাণেশার এই ধরনের কাজগুলোই তার বাবা-মায়ের পছন্দ নয়। অন্য মেয়ে হলে এই দৃশ্য হজম করে সম্মান বাঁচাতে মুখ লুকিয়ে এখান থেকে চলে যেত। কিন্তু প্রাণেশা বলেই দৃশ্যটা উলটো হয়। এই দৃশ্যগুলো দেখলে নিজে যে মেয়ে ও পুরুষের তুলনায় যথেষ্ট দুর্বল এইটুকু ভুলে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। আশ্চর্যজনকভাবে অনির্বাণ আজ আবিষ্কার করল, দশজনের মধ্যে একজন যদি এরকম নাহয়, সময়মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে না। এখানে তো কত পুরুষ ছিল, তাদের ভাইয়েরাও ছিল, কেউ দেখেনি দৃশ্যটা। দেখলেও প্রতিবাদ করেনি। অথচ তার বউ সবকিছু দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে প্রতিবাদও করল। পুরো ভাবনাটা যতখানি আনন্দ দিল, তারচেয়ে বেশি স্বস্তি, শান্তি ও সুখ দিল। কতক্ষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে ধীর অথচ স্পষ্টস্বরে বলল,

‘যে কাজ আমার করার কথা, সেটা তুই করলি! তা-ও আবার এতগুলো মানুষের সামনে! এরজন্য অবশ্যই আমার পক্ষ থেকে তোর একটা স্পেশাল গিফট পাওনা রইল। যাওয়ার আগে দিয়ে যাব। হবে না?’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে