প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৪

0
100

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৪

সন্ধ্যে হওয়ার পরপরই বাড়ির ছোটোরা অনিবার্ণকে নাজেহাল করে দিচ্ছে বিয়ের পরবর্তী ট্রিট চেয়ে। অনির্বাণ কোনো একসময় বলেছিল, বিয়ে যদি করে – তাহলে তার বিয়ের দিনই ভাই-বোনদের সবাইকে নিয়ে জম্পেশ খানাদানা হবে। কথাটা অনির্বাণ ভুলে গেলেও বাড়ির ছোটোরা ভুলেনি। অবশ্য সবার মনেও ছিল না। মনে করিয়ে দিয়েছে প্রাণেশার একমাত্র ছোটো ভাই রাফিয়ান। বিশেষ করে রামিশা ও রাদিনের কানে ট্রিটের ভূত চাপিয়ে দিয়ে সে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে হাঁটছে। আর ওই দুটো ট্রিট কী, সেটা না বুঝলেও ট্রিটের নাম নিতে নিতে অনির্বাণের পেশীবহুল দুই বাহুতে ঝুলে আছে। বসা থেকে দাঁড়াতে গেলেই দুটো দু’দিকে লটকে গিয়ে বার বার বলছে,

‘দাও না, দাও না, ট্রিট দাও না, দুলাভাই।’

শুনতে শুনতে কানে পোকা ঢুকে গেল অনির্বাণের। কাল সকালে চলে যাবে আর রাতেই কি না এদের জ্বালাতন। জীবনটা তার শেষ। জীবনের সব শান্তিও শেষ। এই একগাদা ছেলেমেয়ে কি না এখন তার শালা-শালী। দুঃখে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল তার। ওদেরকে শাসাতে বলল,

‘এ্যাই, কীসের ট্রিটরে? ট্রিটের কী বুঝিস তোরা? পড়াশোনা নাই তোদের? দিনরাত খালি খাওয়া-দাওয়া।’

রাদিন বলল,
‘ট্রিট না দিলে ছাড়ব না তোমায়। ট্রিট তুমি দিবেই।’

‘ঘোড়ার ডিম দেব। হাত ছাড় আমার। আমি কি দোলনা, তোরা এভাবে ঝুলে আছিস? ছাড়রে ভাই।’

‘ভাই না তো। শালা বলো। তুমি আমার দুলাভাই তো।’

মাটিতে মাথা ঠুকে কাঁদলেও মনে হয় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না অনির্বাণ। ছোটোবেলা থেকে যারা তাকে মেজো ভাইয়া বলে ডাকত, এখন এসে ওদের মুখ থেকে দুলাভাই ডাক শুনলেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই দুলাভাই, দুলাভাই ডাকটা তার পছন্দ নয় বলেই সে প্রায় ধমকে উঠে বলল,

‘খবরদার আমাকে দুলাভাই ডাকবি না। আমি তোদের দুলাভাই নই। আমাকে মেজো ভাইয়া ডাক।’

‘না… তোমাকে আমরা দুলাভাই ডাকব। এ্যাই, রামিশা ডাক দুলাভাই।’

শুরু হলো রামিশার ডাক। ও দুলাভাই, ও দুলাভাই এইভাবে একই ডাককে সে একশোবার রিপিট করছে। কোন ভূত চেপেছিল ঘাড়ে যে, প্রাণেশাকে বিয়ে করে এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। সে কেন দুলাভাই হবে? তাও আপন কাজিনদের! অসহায় কণ্ঠে অনির্বাণ বলল,

‘আচ্ছা, হাত ছাড়। তোদেরকে ট্রিট দেব। তোরা গিয়ে তোদের ভাবীকে রাজি করা। গিয়ে বল যে, মেজো ভাইয়া বলেছে আধঘণ্টার মধ্যে তৈরী হতে। রাতে বাইরে ডিনার করতে যাবে। বলবি তো?’

রামিশা ভাবুক নয়নে তাকিয়ে রইলো। কাকে ভাবী ডাকবে? বুঝল না বিধায় কিছু বলতেও পারল না। রাদিন বলল,
‘ভাবী কে?’

‘কে আবার? তোদের আদরের বোন, প্রাণেশা। যদি আজ ট্রিট চাস, তাহলে এক্ষুণি প্রাণেশাকে ভাবী ডেকে আয়।’

রাদিন গালমুখ ফুলিয়ে বলল,
‘সোনাপুকে ভাবী কীভাবে ডাকব?’

‘ভাইকে দুলাভাই যেভাবে ডাকিস, আপুকে ভাবী সেভাবেই ডাকবি। যা ফুট…। ভাবী না ডেকে আমার কাছে আসবি তো, দুটোকে কান ধরে এখানেই ওঠবস করাবো। কথা ক্লিয়ার?’

এরপর দুটোকে কানপড়া দিল অনির্বাণ। রামিশা ও রাদিন বিড়বিড় করতে করতে প্রাণেশার রুমের দরজার কাছে গেল। বাইরে থেকে দরজা আটকানো দেখে রাদিন ডাক দিল,

‘ভাবী দরজা খুলো। ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।’

সেইযে লজ্জায় দরজা আটকেছিল, আর খুলেনি। ঘর থেকে বেরও হয়নি। রুমের ভেতর বসেবসে নিজের পছন্দের কাজটা করছিল প্রাণেশা। আচমকা ভাবী ডাক শোনে, অস্ফুটস্বরে সেই ডাক বিড়বিড়াল একবার। কানে নিল না। আবারও রাদিনের কণ্ঠে ‘ভাবী’ ডাক ভেসে আসাতে হাতের কাজ ফেলে দরজা খুলতেই দেখল, পিচ্চিদুটো দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখোমুখি হয়ে বলল,

‘কে ভাবী?’

রাদিন স্পষ্টকণ্ঠে উচ্চারণ করল,
‘তুমি-ই তো ভাবী।’

‘আমি তোর ভাবী হলাম কবে?’

‘এখন থেকে।’

‘কে শিখিয়েছে তোকে এই কথা?’

কিছুটা ধমকে ওঠেই প্রশ্ন করল প্রাণেশা। রাদিন ও রামিশা দুটোই ভয় পেয়ে একটা আরেকটার হাত চেপে ধরল। রাদিন উঁকি দিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফার দিকে দৃষ্টি দিতেই সেদিকে চোখ দিয়ে, কার শেখানো কথা এসব, সেটা বুঝে গেল প্রাণেশা। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমার হাতে যে কঞ্চি থাকে, সেটা দেখেছিস তো?’

রাদিন কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
‘কী করবে ওটা দিয়ে?’

‘তোদের পিঠ ভাঙব। আর যদি আমাকে ভাবী ডাকিস, রোজ সকালে নিয়ম করে একশোবার কান ধরে ওঠবস করবি, তা-ও বাড়ির সবার সামনে। মনে থাকবে?’

প্রাণেশাকে এমনিতেই ভয় পায় ওরা। এই কথাতে আরও ভয় পেল। ভাবী ডেকে বিপদ বাড়াতে রাজি নয় ওরা, তাই জান বাঁচাতে দৌড়ে আবার অনির্বাণের সামনে গেল। ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আরাম করে আধশোয়া হয়ে টেলিভিশন দেখছিল অনির্বাণ। পিচ্চিদের আবার সামনে দেখে বলল,

‘ভাবী ডেকে এসেছিস তো?’

রাদিন বলল,
‘সোনাপু তো কঞ্চি দিয়ে মারবে।’

‘এখন আমি তোদেরকেই আছাড় মারব। আজ থেকে নিয়ম করে প্রাণেশাকে চব্বিশ ঘণ্টায় আটচল্লিশ বার ভাবী ডাকবি। বুঝা গেছে?’

ধমক খেয়ে দু’জনেই ফুঁপিয়ে উঠল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে রাদিন বলল,
‘যদি মারে?’

‘মারুক। মার খেয়েও ডাকবি। ডাকা মিস করা যাবে না।’

দুটোতে ঠিকঠাকমতো কাজ করতে পারে কি না সেটাই দূর থেকে দেখছিল রাফিয়ান। ওদের দিয়ে যে কোনো কাজ হবে না, উলটে ট্রিট মিস যাবে, সেটা বুঝে শেষবেলা সে-ই এলো। সামনে এসে নির্ভয়ে বলল,

‘তুমি কিন্তু বলেছিলে ট্রিট দেবে, এখন কথা পাল্টাচ্ছ।’

অনির্বাণ বলল,
‘আমি মোটেও কথা পাল্টাচ্ছি না। ট্রিট আমি দেব, কিন্তু ওদেরকে বল, তোর বোনকে গিয়ে ভাবী ডাকতে।’

‘সোনাপু যে কত মেজাজী সেটা তুমি জানো, দুলাভাই।’

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো রাফিয়ান। অনির্বাণ নিজের চুল টেনে ধরে বলল,
‘খবরদার আমাকে দুলাভাই ডাকবি না।’

‘বোনের স্বামী তো দুলাভাই-ই হয়, তাই না?’

‘বোনের স্বামী দুলাভাই হলেও বাড়ির ছেলে দুলাভাই হয় না। মাথায় ঢুকিয়ে নে এটা।’

‘বাড়ির ছেলে হও কী অন্যকিছু, আমার তাতে কী আসে যায়? আমার বোনের স্বামীকে আমি দুলাভাই ডাকব, এটাই শেষ কথা। একটু আগে ওদের বলেছি, এখন গিয়ে মিষ্টিপু, ছোটাপু, সেজো ভাইয়া ও লম্বু ভাইয়াকে বলব, সবাই যেন তোমাকে দুলাভাই ডাকে।’

নিজের বোনের কথা আসাতে অনির্বাণ বলল,
‘আইশা কেন আমাকে দুলাভাই ডাকবে?’

‘ছোটাপু না ডাকলেও মিষ্টিপু, সেজো ভাইয়া ও লম্বু ভাইয়া ঠিকই দুলাভাই ডাকবে।’

আগুনের পাত্রে খানিকটা ঘি ঢেলে মিষ্টি করে আবারও হাসলো রাফিয়ান। সে খুব একটা ছোটো নয়, এইবছর টেনে উঠেছে। আইশা, মাইশা ও রেদোয়ান তার চেয়ে তিন বছরের বড়ো। ওরা এইচএসসি দিয়েছে। বোন দু’জনকে রাফিয়ান ছোটাপু ও মিষ্টিপু বলে ডাকে আর রেদোয়ানকে লম্বু ভাইয়া ডাকে। ওদের মধ্যে রেদোয়ান ও আইশা কমার্সের স্টুডেন্ট ও মাইশা সাইন্সের। প্রাণেশার তুলনায় ওরা সবাই যথেষ্ট ভালো পড়াশোনাতে। একেকজন দুষ্টুমি করলেও মেপে মেপে করে। আজ অনির্বাণকে ক্ষ্যাপাতেই এই বুদ্ধি এঁটেছে রাফিয়ান। যেহেতু অনির্বাণ সকালে চলে যাবে, ট্রিট নেয়ার সুযোগ এখনই। এরপর আর কবে আসবে ঠিক নেই। সে জম্পেশ খানাদানা মিস করার ছেলে নয়। তা-ই এই দুষ্টুমি। তার হাসি দেখে ফুঁসে উঠে অনির্বাণ সোফার কুশন হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গেলে, তার আগেই নিজের রুমের দৌড় দিল রাফিয়ান। যাওয়ার আগে আরও দু’চামচ ঘি বাড়িয়ে দিতে গানের সুরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

‘দুলাভাই, দুলাভাই, ও আমার দুলাভাই।’

অনির্বাণও একইভাবে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘শয়তানের চ্যালা… নেক্সট টাইম যদি তোকে আমার সামনে দেখি, শালা-দুলাভাই সম্পর্ক কেমন হয়, বুঝিয়ে দেব।’

ওদের এই দুষ্টুমিষ্টি খুঁনসুটিময় মুহূর্ত বাড়ির বড়োরা উপভোগ করছিলেন। ছোটো ছোটো ছেলেরা ঘরকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে বলেই বাড়িতে এত আনন্দ, এত সুখ। এই দুষ্টুমি সবাইকে আনন্দ দিলেও অনির্বাণকে খুব ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। বেচারা নিজেকে ‘দুলাভাই’ মানতেই পারছে না। তা দেখে বাড়ির সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এদিকে সবার হাসি দেখে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল অনির্বাণ। চোখ গরম করে মা-চাচীদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘শুধু তোমাদের জন্য আমি আজ এই সিচুয়েশনে পড়েছি। অসহ্য…। ছোটোরাও আমাকে পঁচাচ্ছে।’

***

সব কাজিনেরা একসাথে বসেছে ওদের বাড়ির হলরুমে। যেখানে শুধু ওদেরই আড্ডা ও হৈচৈ চলে। রাফিয়ানের একটাই কথা, ট্রিট আজকে তার চাই-ই চাই। মাইশা ও রেদোয়ান তাতে লাফ দিয়েছে। ওরা আবার জমজ ভাই-বোন। কিন্তু আইশা মানতে নারাজ। ভাইদের একেকটা ভীষণ রাগী। ওদের কাছে ট্রিট চাওয়া মানে বকুনি খাওয়া। ওদের এই মিটিংয়ে সবচেয়ে নীরব সদস্য নাহিয়ান। যে মাইশা ও রেদোয়ানের বড়ো ভাই। আবার আরিয়ান ও অনির্বাণের চেয়ে বয়সে ছোটো। ফ্রিতে কাচ্চি পেলে আছে, না পেলে নাই, তবে খাওয়ার জন্য এত যুদ্ধেও সে নাই। তাই নীরব শ্রোতা হয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে চাকরীর বিজ্ঞাপন দেখছে। সে ও প্রাণেশা একই বয়সের। ফার্স্টক্লাস পেয়ে ইকোনমিকস্-এ অনার্স শেষ করেছে নাহিয়ান। আপাতত ছোটোখাটো একটা পার্টটাইম জব দরকার। পাশাপাশি মাস্টার্স শেষ করার চিন্তা তারমধ্যে বেশি। বিয়ের হুলস্থুলেও খুব একটা গায়ে মাখেনি, এই ট্রিটও গায়ে মাখল না। নিজের মতো করে কাজে ব্যস্ত হয়ে রইল। আইশা নখ কামড়াতে কামড়াতে বলল,

‘ট্রিটের ভূত মাথা থেকে সরিয়ে ফেলো সবাই। নাহলে বকা খেতে হবে।’

রাফিয়ান মোটেও ছাড়ার পাত্র নয়। বসেবসে ভাবছিল, দুলাভাইয়ের থেকে ট্রিট কীভাবে আদায় করবে। হঠাৎই আইশার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এ্যাই ছোটাপু, তুমি তো প্রাণেশাপুকে ভাবী ডাকতে পারো। একবার ভাবী ডেকে এসো, ট্রিট কনফার্ম হয়ে যাবে।’

আইশা দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘না ভাই। আমি ওসবে নাই। শেষে আমার ভাইয়ের বউ কঞ্চি দিয়ে আমার পিছন পিছন দৌড়াতে শুরু করবে।’

এতক্ষণ কাজে ডুবে থাকলেও রাফিয়ান ও আইশার এইসব কথা শোনে হো হো শব্দে হেসে উঠল নাহিয়ান। ল্যাপটপ বন্ধ করে ওদের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বলল,

‘সামান্য একটা ট্রিটের জন্য ভাইয়াকে দুলাভাই আর আপুকে ভাবী ডাকতেই হবে? ট্রিট না খেলে হয় না, রাফি?’

রাফিয়ান বলল,
‘তুমি কি দলে থাকতে চাও না?’

‘থেকে লাভ? এক প্লেট কাচ্চি? ওটা তো বড়ো ভাবীই ভালো রান্না করতে পারে। বকাঝকা খেয়ে ট্রিট নেয়ার চেয়ে বড়ো ভাবীকে গিয়ে বল, বাড়ির সবাইকে স্পেশাল কাচ্চি রান্না করে খাওয়াবে।’

‘তুমি এভাবে দল পাল্টাতে পারো না, সেজো ভাইয়া।’

‘আশ্চর্য কথা তো! আমি কেন দল পাল্টাতে যাব? আমি কি তোদের বলেছি, এই দুলাভাই ও ভাবী ডাকার দলে আমার নাম লেখা? তোরাই তো কোথা থেকে একেকটা বুদ্ধি বের করিস আর ধরা খাস।’

মাইশা বলল,
‘তুমি একদম মেজো ভাইয়ার দলে যাবে না। ভাইয়া বলেছে, বিয়ের পর ট্রিট দিবে। এখন কেন দিচ্ছে না?’

নাহিয়ান বলল,
‘শখের বিয়ে হলে ঠিকই ট্রিট দিত। এটা তো আর শখের বিয়ে না। এটা হচ্ছে আইক্কাওয়ালা বাঁশের বিয়ে। বাঁশের বিয়েতে কেউ কেন ট্রিট দিবে?’

ওরা যেন এই কথা মানতেই পারল না। রেদোয়ান জোর দিয়ে বলল,
‘সবাই এসো আমার সাথে। আজ প্রাণেশাপুকে ভাবী ডেকে ট্রিট নিয়ে তবেই ছাড়ব। নয়তো আমাদের এই মিশন চলছে, চলবেতে নাম লেখাবে।’

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই প্রাণেশার দরজায় নক করল। অল্প আওয়াজে ঠোকা দিয়ে বুকে ফুঁ দিল আইশা। সবাই ঠেলেঠুলে তাকেই সামনে রেখেছে। যেন বকা খাওয়াতে পারে। এদিকে সম্পর্কে প্রাণেশা তার ভাবীই হবে, তবুও মনে ভয়। তার এই ভয়মিশ্রিত পাংশু মুখ দেখে রাফিয়ান বলল,

‘ছোটাপু, দেরী করছ কেন? ডাক দাও। রাত তো শেষ হয়ে যাচ্ছেরে ভাই। কাচ্চি কখন খাব?’

আইশা বিরক্তিকর মেজাজে চেয়ে বলল,
‘তোর শখ থাকলে তুই ডাক। আমাকে কেন বকা খাওয়াতে চাইছিস?’

‘আরেহ্ ভাই বকা না, ট্রিট খাবে। ডাক দাও। কিচ্ছু হবে না। তুমি তো আপুর ননদিনী হও। তোমাকে কেন বকা দিবে?’

বকা খেলে খাবে, একবার ভাবী ডেকে তারপর দৌড় দিবে, এরকমটাই সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও দরজায় ঠোকা দিল আইশা। ভেতর থেকে প্রাণেশা বলল,

‘কে ওখানে?’

আইশা বলল,
‘ভাবী আমি। তোমার একমাত্র ননদিনী।’

দরজা বন্ধ থাকায় প্রাণেশার রি’অ্যাক্ট দেখল না আইশা। তবে দরজা খোলার পর আদরের ভাবীর মুখোমুখি হতে গিয়েই মাইশার হাত খামচে ধরল সে। প্রাণেশা সবাইকে দেখে চোখ নাচিয়ে আইশার মুখের দিকে চেয়ে বলল,

‘কী ব্যাপার, ননদিনী? কী আবদার আমার কাছে?’

বোনের মুখে ননদিনী ডাক শুনে, সব কথা গুলিয়ে ফেলল আইশা। কী বলতে এসেছিল সেটাও ভুলে গেল। মাইশা ওর হাতে জোরে চাপ দিয়ে বলল,

‘ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বল…।’

আইশা তোতলানো কণ্ঠে বলল,
‘অনেক আগে… মেজো ভাইয়া বলেছিল, সে বিয়ে করলে সবাইকে ট্রিট দিবে।’

প্রাণেশা নিজের নখের নেইলপালিশে ফুঁ দিয়ে আইশার ভয় ভয় চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তো?’

‘না… মানে, যেভাবে হোক, বিয়ে তো হয়ে গেছে। তুমি এখন এই বাড়ির মেয়ে নও, বউ হয়ে গেছো। আর আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাবী। সেই হিসেবে, বিয়ের পরবর্তী ট্রিট তো দিতেই পারো।’

প্রাণেশা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘আমি ট্রিট দেব? আমার দেয়ার কথা ছিল?’

তখুনি রেদোয়ান বলল,
‘আরেহ্, তুমি কেন দিবে? ট্রিট তো ভাইয়া দিবে। তুমি শুধু ভাইয়ার সামনে আমাদের ভাবী হয়ে যাও। ভাইয়ার পকেট ফাঁকা করার দায়িত্ব আমরা নেব। হবে আমাদের, ভাবী?’

অনির্বাণকে আরেকদফা বাঁশ দেয়ার সুযোগটা ঝটপট লুফে নিল প্রাণেশা। ড্রয়িংরুমের দিকে উঁকি দিয়ে বলল,
‘অফকোর্স। তোদের ভাবী হতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু…।’

মাইশা বলল,
‘কিন্তু কী?’

‘আমাকে বকা খাওয়াতে পারবি না। সব ধরনের বকা ও বাঁশ থেকে বাঁচাবি তো তোরা?’

সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে, অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে উপর থেকে প্রাণেশা বলল,
‘তুমি না কি বলেছ, ভাবী ডাকলে ওদেরকে ট্রিট দেবে? ওরা আমাকে ভাবী ডেকেছে। আমিও ওদেরকে ননদ-দেবর মেনে নিয়েছি। এখন ওদেরকে ট্রিট দাও।’

এই অসম্ভব যে এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে, ভাবতে পারেনি অনির্বাণ। প্রাণেশার থেকে স্বীকারোক্তি শোনেও যেন বিশ্বাস হলো না। নিচ থেকেই বলল,

‘তাহলে ওদের বল, আমাকে যেন দুলাভাই না ডাকে।’

প্রাণেশা ওদেরকে এই কথা বুঝাতে গেলে, রাফিয়ান বলল,
‘আমি কিন্তু দুলাভাই-ই ডাকব।’

শব্দ করে হেসে ফেলল প্রাণেশা। ভাইকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘তোর যা মন চায়, তুই তা-ই ডাকবি। আমরা কেউ কিচ্ছু বলব না, তাই না রে?’

সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। প্রাণেশা বলল,
‘যাও… ঝটপট রেডি হও সবাই।’

আবারও নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকাতে গেলে, আইশা বলল,
‘তুমিও রেডি হয়ে নাও, ভাবী। যেহেতু তোমাকে ঘিরেই ট্রিট হবে, তুমি না গেলে কেমন দেখাবে!’

একটু জোরে বলাতে কথাটা অনির্বাণের কানেও গেল। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসছিল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, মুরব্বিরা কেউ এদিকে নেই। রান্নাঘরে শুধু রূপকথা ও কাজের মেয়েটা। প্রাণেশাকে লজ্জায় ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারল না। তা-ই নিজের রুমে প্রবেশের আগে একটু গলা উঁচিয়ে বোনকে শুনিয়ে বলল,

‘আমার বউটাকে বল, ট্রিটটা যেহেতু বিয়ে উপলক্ষে, সে যেন একটা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বউ সাজে। বউকে দেখে যদি বউ বউ ফিল না আসে – ট্রিট তো জমবে না…রে আপুনি।’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে