#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩
বিল না মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ি ফিরতে পারবে না, এটা বেশ বুঝল অনির্বাণ। হাতে সামান্য খুচরো পর্যন্ত নেই। রাগে মেজাজ এখন সপ্তাকাশে। প্রাণেশা সামনে থাকলে সম্পর্কের দিক ভুলে গিয়ে জোরসে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় দিয়ে বসত। কিন্তু মেয়েটাই তো পালালো। তা-ও আবার এরকম একটা লজ্জাজনক বাঁশ দিয়ে, বিব্রতকর অবস্থায় রেখে। কোনোমতে এখান থেকে সম্মানের সাথে উদ্ধার হতে পারলে, বাড়ি গিয়ে ইচ্ছামতো শাস্তি দিবে, এইটুকু মনস্থির করে উপায় খুঁজতে লাগল অনির্বাণ। ওয়েটার তার মনোভাব বুঝল না। সে তাড়া দিয়ে বলল,
‘বিল পেমেন্ট করুন, স্যার।’
অনির্বাণ খিটমিট মেজাজে বলল,
‘করছিরে ভাই। আপনার টাকা নিয়ে আমি পালাব না। একটু সময় দিন।’
ওয়েটার কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনির্বাণ তাকে আবার ডেকে বলল,
‘আপনার ফোনটা একটু দিবেন?’
ওয়েটার তার বিপদ ও সম্মান বুঝল কি না কে জানে। তবে নিজের ফোন বাড়িয়ে দিয়ে টেবিল মোছা শুরু করল। ঠোঁট কামড়ে নিজের বড়ো ভাই শেখ আরিয়ান শামস্ এর নম্বরে ডায়াল করল অনির্বাণ। রিসিভ হতেই লজ্জিত কণ্ঠে বলল,
‘ভাইয়া, আমি অনি…। একটা হেল্প লাগবে।’
ভাইয়ের কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে ওপাশ থেকে আরিয়ান বলল,
‘কী হেল্প?’
‘আমার পনেরো হাজার টাকা লাগবে। আমি বাসায় গিয়ে দিয়ে দেব। ইজ্জতের ব্যাপার। প্লিজ বাঁচাও।’
‘কী হয়েছে? তুই না প্রাণেশাকে নিয়ে বেরিয়েছিলি?’
‘হ্যাঁ, ও-ই তো বাঁশটা দিল।’
‘বাঁশ?’
সব কথা খুলে বলল অনির্বাণ। শোনে ওপাশে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল আরিয়ান। কৌতুকের সুরে বলল,
‘একদিনেই যদি পকেটের এই অবস্থা হয়, সারাজীবন ওকে সামলাবি কীভাবে, ভাই?’
অনির্বাণ দিকদিশা হারিয়ে বলল,
‘তোমরাই তো আমাকে বুঝলে না। এখন বলছ, সামলাব কী করে? ঘাড়ে চাপানোর আগে এটা ভাবোনি যে, প্রাণের সাথে আর যা-ই হোক, ঘর-সংসার হবে না। ভালো করেই জানো ও একটা মিচকে শয়তান। বদের হাড্ডি। কেমন বিপদে ফেলেছে দেখেছ? ইজ্জত নিয়ে টানাটানি।’
ভাইয়ের দুঃখে কষ্ট হওয়ার বদলে মাত্রাতিরিক্ত হাসি পেয়ে বসলো আরিয়ানের। ফোনের ওপাশে এত শব্দ করে হাসছিল সে, সে-ই হাসি অনির্বাণের মুখটা চুপসে দিয়েছে। সে মুখভার করে চুপ করে ছিল। সমাধান দিতে আরিয়ান বলল,
‘ওখানে কারও বিকাশ অ্যাকাউন্ট থাকলে, নম্বরটা টেক্সট কর। আমি টাকা পাঠাচ্ছি।’
‘থ্যাংক ইউ, ভাইয়া। আমি বাড়ি গিয়েই ফেরত দিয়ে দেব।’
‘দূর… ফেরত দিতে হবে না। নম্বর দে, কুইক। আমার মিটিং আছে।’
ওয়েটারের বিকাশ নম্বরটাই আরিয়ানকে দিয়ে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল অনির্বাণ। এরমধ্যেই টাকা চলে এলে, দশ হাজার টাকা বিল মিটিয়ে, বাকি টাকা পকেটে রেখে রেস্টুরেন্টের বাইরে পা রাখতেই ভিখারীদের সামনে পড়ে গেল সে। দলবেঁধে সবাই তার সামনে এসে, প্রশংসা ও দোয়া করে ভাসিয়ে দিল। সবচেয়ে বেশি যে দোয়া করল, তা হলো –
‘তোমার বউটা খুব সুন্দর, বাজান। ওমন সুন্দর মনের মানুষ আইজকাল দেখাই যায় না। আল্লাহর কাছে দোয়া করুম রোজ। ভালো থাইকো দু’জনে।’
এ জাতীয় দোয়া ও প্রশংসা শুনলে লজ্জাই লাগে। লজ্জা থেকে বাঁচতে ওনাদের পাশ কাটিয়ে একটা সিএনজি থামিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল অনির্বাণ।
***
নতুন যে চারাগাছ এনেছিল, সেগুলোই বাড়ির আঙিনায় রোপণ করছিল প্রাণেশা। যেহেতু তার আর কোনো কাজ নেই, তা-ই আস্তেধীরে, সময় নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা করছিল। মাথা নুইয়ে কাজ করছিল বলে বাগানের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে অনির্বাণের প্রবেশটা সে দেখতে পেল না। অনির্বাণ ঘরে প্রবেশ করেই চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে প্রাণেশাকে খুঁজল। এদিক-ওদিক কোথাও নেই। বকাঝকা পরে দেবে, এইভেবে ফ্রেশ হতে নিজের রুমে প্রবেশ করেই বিছানার ওপর রাখা নিজের ক্রেডিটকার্ড, মানিব্যাগ ও মোবাইল দেখে নিশ্চিত হলো, প্রাণেশা বাড়িতেই আছে। কিন্তু চিন্তা বাড়ল, মোবাইল নাহয় হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল বলে ওটা প্রাণেশার হাতেই ছিল। মানিব্যাগ ও ক্রেডিটকার্ডের নাগাল মেয়েটা পেল কী করে? পকেট কাটলো? সন্দিহান মনে নিজের প্যান্টের পকেট চেক করল অনির্বাণ। কোনোদিকে ছেঁড়াফাটা নেই, অথচ সবকিছু প্রাণেশার দখলে! কীভাবে? ভাবতে ভাবতে যখন কোনো সমাধান পেল না, চোখেমুখে বিরক্তি ও রাগ নিয়েই সবকিছু গুছিয়ে রেখে, টাওয়েল ও পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে বের হতেই প্রাণেশার মা, তার মেজো চাচী, তাহমিনা আহমেদের মুখোমুখি পড়ে গেল। তিনি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো কিছু বলতে বা জানতে এসেছেন। এতকিছু না ভেবে হাসিমুখে বলল,
‘কিছু বলবে, চাচিম্মা?’
তাহমিনা আহমেদ গম্ভীর চেহারা নিয়ে শুধু উপরনিচ মাথা নাড়লেন। অনির্বাণ সেই চেহারা খেয়াল করে চেয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘বসো এখানে। তারপর বলো।’
তিনি বসলেও কিছু বলতে পারছিলেন না, কেবলই আনমনে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছিলেন। অনির্বাণ সেই ভাবনারত চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কী বলতে এসেছ, নির্ভয়ে বলো। আমি তোমার ছেলের মতো। আমার সামনে কোনো সংকোচ করো না।’
তাহমিনা আহমেদ বিষণ্ণতায়ভরা কণ্ঠে বললেন,
‘প্রাণের এই উদ্ভট কাজকর্ম আমাকে খুব চিন্তা ফেলেছে, অনি। এই জেদ, এই রাগ, এসব কীভাবে এলো, মাঝেমধ্যে ভেবে পাই না আমি। মেয়েটাকে বুঝাবো, সেই সুযোগও আসে না। দু’মিনিট সময় দেয় না কাউকে। সবসময় ওর এই খামখেয়ালী আচরণ মেনে নেয়া যায় না। আমরা সবাই অতিষ্ঠ। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। কিন্তু ও… সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছে। বিয়েটাকেও সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। কেন বল তো?’
অনির্বাণ কী বলবে ভেবে পেল না। এমন না যে, প্রাণেশাকে সে খুব ভালো বুঝে। একেবারেও বুঝে না, এটাও নয়। তবে এইরকম চলাফেরাটা খুব চিন্তার। প্রাণেশা খুব যে বেয়াদব, উচ্ছৃঙ্খল কিংবা মারকুটে এমটাও নয়। তার একটাই সমস্যা, সে নিজের মতো করে বাঁচতে ভালোবাসে। নিজেকে সময় দিতে ভালোবাসে। নিজের কথা ও ইচ্ছেদের গুরুত্ব দিতে ভালোবাসে। এইটুকুতে যদি আঘাত চলে আসে, তাহলেই একটু রাগ, একটু জেদ ও গোসসা দেখায়। একটু ভেবেচিন্তে অনির্বাণ বলল,
‘ও কি কাউকে ভালোবাসতো?’
‘না না, এমনটা হলে রূপ ও তানি নিশ্চয়ই জানত।’
তানিশা হচ্ছে প্রাণেশার বড়ো বোন। আর রূপকথা হচ্ছে এই বাড়ির বড়ো ছেলে আরিয়ানের বিবাহিতা স্ত্রী। তাদের দু’বছরের একটা মেয়েও আছে। বাড়ির গুরুজনদের সাথে সম্পর্ক যেমনই হোক, রূপকথার সাথে প্রাণেশার সম্পর্কটা গলায় গলায়। প্রাণেশার বিষয়ে যদি কেউ বেশি জানে, সেটা একমাত্র রূপকথা। এরপর তানিশা। তানিশা খুব কমই বোনকে জানে, বুঝে। রূপকথার মতো করে বুঝে না। বিয়ের পর থেকে বোনকে সে সময় দিতে পারে না। নিজের স্বামী ও সংসার নিয়েই সে ব্যস্ত। চাচিম্মার কথায় মাথা নেড়ে অনির্বাণ বলল,
‘বিয়ের ব্যাপারটা কি ওর ওপর জোর করে চাপিয়ে দাওনি?’
তাহমিনা আহমেদ খানিক সময় চুপ থেকে বললেন,
‘ওর চেয়ে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ওর নিজেরই সবকটা বান্ধবী বিয়ে করে সন্তানের মা হয়ে গেছে। শুধু ও-ই উল্টাপাল্টা লজিক দেখিয়ে বিয়ে বানচাল করে দিতে চায়। আমি নিশ্চিত, গতকালকের বিয়েটা ও ইচ্ছে করেই ভেঙেছে।’
অনির্বাণ সামান্য হেসে বলল,
‘ঠিক ধরেছ। তোমার মেয়ে প্লান করে বিয়েটা ভেঙেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাকসেসফুল হয়নি। কারণ তোমরা মুরব্বিরা আমাকে বলিরপাঠা হিসেবে পেয়েছ।’
‘ওমন করে বলিস না, অনি।’
‘ছাড়ো…। তুমি ভাবীর সাথে কথা বলেছিলে প্রাণের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে?’
‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। ও তো বলল, প্রাণেশা কাউকে ভালোবাসে না। এমন কেউ নেই ওর জীবনে।’
‘তাহলে বিয়ে নিয়ে ওর এত আপত্তি কেন!’
‘সেটাই তো ভাবছি, বাপ। গতকাল রাতে নিজের ঘরে ঘুমালো। সকালে উঠে জানতে চাইলাম, ঘরে কখন এলো। বলল, ও না কি এই বিয়েটাই মানে না। তাই তোর ঘরে থাকবে না। এখন আমি কী করব? তুই তো জানিস, ওর বাবা কতটা রাগী। কিছু হলেই লোকটা শুধু আমার ওপর চোটপাট করে।’
দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য দেবরকে ডাকতে এসেছিল রূপকথা। দরজায় দাঁড়াতেই দু’জনের কথা তার কানে এলো। কাছে এসে বলল,
‘তোমরা এই আধপাগলকে নিয়ে পড়ে আছো? ওর চিন্তা বাদ দিয়ে খেতে এসো। সবাই অপেক্ষা করছে। এমনিতেই আজ অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।’
ঠিক সময়ে খাবার টেবিলে সবাইকে না দেখলে অনির্বাণের বাবা খুব রাগারাগি করবেন। নির্দিষ্ট সময়ে খাবার টেবিলের সামনে উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই এই ঘর-সংসার সামলাচ্ছেন বাড়ির গিন্নীরা। দেরী হলে বাড়ির মুরব্বি মানুষটা কষ্ট পাবেন দেখে চেয়ার ছাড়লেন তাহমিনা আহমেদ। অনির্বাণকেও তাড়া দিলেন। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপকথাও বেরিয়ে যাচ্ছিল। কী ভেবে যেন, কিছু পথ পিছিয়ে এলো সে। অনির্বাণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছছিল। রূপকথা বলল,
‘তুমি কি কাল ঢাকায় চলে যাবে?’
অনির্বাণ উত্তর দিল,
‘হ্যাঁ, ভাবী। কাজের চাপ আছে।’
‘প্রাণেশাকে সাথে নিবে?’
একটু ভেবে অনির্বাণ বলল,
‘যেতে চাইলে নিব, নয়তো এখানেই থাকবে। কিন্তু সমস্যা তো একটাই, ও ডিভোর্স চাইছে।’
প্রাণেশার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন কিছু না, এটা আর কেউ না জানলেও রূপকথা খুব ভালোমতো জানে। সে এই কথা শোনে দেবরকে বলল,
‘ও চাইলেই তুমি ডিভোর্স দিয়ে দিবে? এত সহজ সব? সম্পর্ককে এতটা মূল্যহীন তোমরা কেন ভাবছ, অনি?’
অনির্বাণ হেসে বলল,
‘আমি না তো, তোমার ননদিনীর ইচ্ছে। স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব ওর ইচ্ছের মূল্য দেয়া।’
এই কথাতে রূপকথা একটা নাটুকে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
‘তোমরা কে-কবে ওর ইচ্ছের মূল্য দিয়েছ বলো তো?’
অনির্বাণ একটু থমকাল। টাওয়েল হাতে নিয়ে রূপকথার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘ও যা করছে, নিজের ইচ্ছেতেই করছে। সবকিছুকে ফেলনা ভাবছে। জীবনে কোনোকিছুর গুরুত্ব ওর কাছে নেই। ও শুধু নিজেকেই ভালো রাখতে জানে। আর কিছু নয়। ওকে দিয়ে ঘর-সংসার, ভালোবাসা এগুলো আশা করা বোকামি।’
রূপকথা ফের হেসে বলল,
‘ঠিকই বলেছ, ওর কাছে এগুলো আশা করা বোকামি। ও নাহয় সম্পর্কের মূল্য বুঝে না। তুমি তো বুঝো। একটা সুন্দর সম্পর্ককে গোড়া থেকে যত্ন করে গড়ে তোলার আগে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছ? সময় নিয়ে সম্পর্কটার ব্যাপারে একটু পজেটিভ ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেয়া উচিত নয় কী?’
উপরনিচ মাথা ঝাঁকিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘অবশ্যই উচিত। এবং আমি সেটা চাই। কিন্তু এর মানে এই না যে, আমি তোমার ননদিনীকে ভালোবাসি! এই সম্পর্কটা পবিত্র। পবিত্র বলেই, এটা আমার কাছে মূল্যবান। ভীষণ যত্নের ও আকাঙ্খার। তাই আমি এর মূল্য দেব। যেমন করেই হোক, জড়িয়ে গেছি একসাথে। আলাদা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। ও মাথামোটা হলে কী হবে? আমি তো আর সেটা নই। যা করব, ভেবেচিন্তেই করব, ভাবী। তুমি টেনশন নিও না।’
এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রূপকথা। নির্ভার হাসি দিয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম।’
ফিরে যেতে গিয়ে রূপকথা আবারও অনির্বাণের সামনে এসে বলল,
‘আগামীকাল যাওয়ার আগে আমাকে আধঘণ্টা সময় দিও তো। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা শেয়ার করব।’
গুরুত্বপূর্ণ কথা কী, কেন, কাকে নিয়ে, এসব কিছুই প্রশ্ন করল না অনির্বাণ। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে।’
***
দুপুরে খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত হলেও বাচ্চাদের যারা স্কুল-কলেজে পড়ে তারা ও কর্মজীবীরা ব্যতীত সবাই-ই নিজ নিজ আসনে বসে খাওয়ার আয়োজন শুরু করেছেন। প্রাণেশা তখন কাঁদামাটিতে মাখামাখি হয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে। একসাথে অনেকগুলো গাছ রোপণ করে যথেষ্ট ক্লান্ত সে। ঘরে পা রাখতেই রূপকথা বলল,
‘সেই কখন ডাকলাম। এখন এলি? যা তাড়াতাড়ি গোসল করে খেতে আয়।’
অনির্বাণের বাবা শেখ শাফিউল আলম সব সন্তানকেই স্নেহের চোখে দেখেন। তাদের ভালো-মন্দের খোঁজখবর যেমন নেন, তেমনই ভুলত্রুটি দেখলে শাসনও করেন। সকালে তার মেজো ছেলে ও প্রাণেশা একসাথে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির সবাই সেটা দেখেছে। কিন্তু ফিরেছে আগে-পরে। অনির্বাণ একটু আগেই মা-চাচীদের বলছিল, প্রাণেশা কীভাবে তার পকেটের বারোটা বাজিয়েছে আজকে। যদিও সে কৌতুক করে বলছিল, সবাইকে হাসানোর জন্য। তা শোনে সবাই হো হো করে হাসলেও শাফিউল আলম গম্ভীর মেজাজ ধরে বললেন,
‘তোমরাই মেয়েটাকে রাগিয়ে দাও। নয়তো ও ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করে না। নিশ্চয়ই অনি এমনকিছু বলেছে, যার কারণে ও ক্ষ্যাপে গিয়ে উদ্ভট আচরণ করেছে।’
প্রাণেশাকে নিয়ে বাবার এই সাপোর্ট দেখে খাওয়া থামিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘আমি মোটেও ওকে রাগাইনি। ওর শিরা-উপশিরায় শয়তানি লুকানো। তুমি দেখতে পাচ্ছ না।’
কাছে ছিল বিধায় প্রাণেশাও এই কথা শুনল। রেগেমেগে ব্যোম হয়ে ডাইনিংয়ের সামনে এসে বলল,
‘আর তুমি যে ওখানে, সামান্য ক’টা গাছের মূল্য নিয়ে বিক্রেতার সাথে দর কষাকষি করছিলে, সেটা বুঝি দোষের না?’
কোনোকিছু কিনতে গেলে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা দামাদামি হয়ই, নার্সারিতে গিয়ে সেরকমটাই হয়েছিল। এই মেয়েটা সেটা নিয়েও যে মেজাজ দেখাবে, তা কি সে জানত? নিজের দিক স্পষ্ট করতে অনির্বাণ বলল,
‘এটা নরমাল ব্যাপার, প্রাণেশা। একটু এদিক-ওদিক হয়। তাইবলে তুই আমাকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে ক্রেডিটকার্ড ও মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়ে আসবি? এটা কোন ধরনের বাচ্চামো?’
প্রাণেশাও একইভাবে বলল,
‘আমি মোটেও বাচ্চামো করিনি। লোকটা চা খেতে দিয়েছিল। চা খাওয়ার ফাঁকে ভ্যানচালককে ভাড়া দিয়ে, তুমি তোমার মানিব্যাগ ও বাইকের চাবি টেবিলের ওপর ফেলে রেখেছিলে। পরবর্তীতে সাফওয়ানকে দেখে দৌড় দিতে গিয়ে ওটা নিতে ভুলে গেছো। দরকারী জিনিস যেখানে সেখানে ফেলতে নেই। ওগুলো সবসময় খেয়ালের সাথে সঙ্গে রাখতে হয়। তাই তোমাকে এটা বুঝাতেই সবকিছু নিয়ে ওড়াল দিয়েছি। যদি ওগুলো আমি না তুলতাম, নির্ঘাত চুরি হতো। মনে করে দেখো, তুমি যখন লেমন জুস খাচ্ছিলে, আমি তোমার চোখের সামনে বাইকের চাবি ঘুরিয়েছি। তুমি তা-ও বুঝোনি। এটা কি আমার দোষ?’
এই ভুলটা কী করে হলো? যদি এরকমই হয়, তাহলে তো এখানে প্রাণেশার দোষ নেই। দশ হাজার টাকা লস দেয়ার সাথে সাথে লাখ টাকার বাইক ও মহামূল্যবান ক্রেডিটকার্ট বাঁচিয়ে দিয়েছে। বুঝতে পেরেও নিজের ভুল স্বীকার করল না অনির্বাণ। খাওয়ার মুখে নিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘হয়েছে আর দুই নম্বরি করতে হবে না। আমার পকেট ফাঁকা করেছিস। তারজন্য অবশ্যই তোকে আজ শাস্তি পেতে হবে।’
শাস্তি কী সেটা খুব ভালোভাবে জানে প্রাণেশা। সবার মতো একটু শাসাবে, বকা দিবে, কিছু সময় মেজাজ দেখাবে, এরপর সব ঠাণ্ডা। এসব বকা শোনে শোনে অভ্যস্ত সে। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো, হাউমাউ করে কাঁদত, কিন্তু এখন আর কষ্ট হয় না। সয়ে গেছে। সে দোষী হলেও বকা শুনবে, দোষী না হলেও বকা শুনবে, ফেইল তকমা গুছিয়ে ভালো রেজাল্ট করলেও বকা শুনবে, এলোমেলো কাজকারবারের জন্যও বকা শুনবে। বকা তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে গেছে। সে ছাড়তে চাইলেও ওগুলো তার পিছু ছাড়ে না। তাই অনির্বাণের এই কথাগুলোকে খুব একটা পাত্তা দিল না। হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। সময় নিয়ে গোসল করে, প্রতিদিনের মতো টি’শার্টের সাথে লেডিস্ জেগিংস্ পরে খাবার টেবিলে এলো। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ শুধু রূপকথা বাকি ছিল। ননদিনীকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,
‘তোকে সবাই যতটা অজ্ঞান ও অকর্মা ভাবে, আদতে তুই ততটা অজ্ঞান ও অকর্মা নোস। তুই যে একটা বুদ্ধিমতী ও যথেষ্ট মেধাবী মেয়ে সেটা আজ প্রমাণ করে দিয়েছিস।’
রূপকথার কথার অর্থ পুরো বুঝল না প্রাণেশা। চোখ তুলে তাকিয়ে প্লেট সামনে ধরে বলল,
‘ভাত দাও।’
ভাত-তরকারি সব ননদিনীর প্লেটে তুলে দিল রূপকথা। নিজেও নিল। পাশের চেয়ারে বসে হাস্যরসের মাধ্যমে বলল,
‘স্বামীর জিনিসের মূল্য বুঝতে শিখেছিস দেখে শান্তি শান্তি একটা ফিলিংস্ হচ্ছে।’
ঠোঁট কামড়ে কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করল প্রাণেশা। বুঝে, স্মিত হেসে বলল,
‘একই রক্ত। আলাদা নয়। একই হবে। বুঝেছ?’
‘না-ও হতে পারে। পজেটিভ ভাবতে দোষ কী?’
‘পজেটিভ তো কতকিছুই ভাবলাম, ভাবী। লাভ হলো কী? সে-ই একটা কথা, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি তাহলে করবটা কী, বলবে? ভালো রেজাল্ট আনতে পারি না, ঠিকমতো কোনো কাজকর্ম করতে পারি না, ঘরকন্নার কোনো কাজ জানি না। সামান্য এককাপ চা-কফি নিজে বানিয়ে খেতে পারি না, কাউকে খাওয়াতেও পারি। মেধা, বুদ্ধি, স্পেশালিটি বলতে কিচ্ছু নেই আমার মধ্যে। যা আছে, সব আলস্য। বাড়ির অন্যরা যা পারে, যেভাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, আমি সেভাবে পারি না। এটা কি শুধু আমার চেষ্টার ব্যর্থতা না কি…।’
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল প্রাণেশা। হয়তো বকতে বা শাসন করতে, কোনো এক কারণে অনির্বাণ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। তাতেই ভেতরের কথা গিলে নিতে বাধ্য হলো সে। একনলা ভাত মুখে নিয়ে, সেটুকুই পেটে চালান করল। একটু একটু করে খাওয়া-দাওয়ার মাঝেই নিজেকে ব্যস্ত রাখল। কোন কথা, কেন গিলে নিল, সেটা অনির্বাণ না বুঝলেও রূপকথা ঠিকই বুঝল। সে খেতে খেতে দেবরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কিছু বলতে এসেছ?’
অনির্বাণ মাথা নেড়ে প্রাণেশার দিকে ইশারা করে বলল,
‘তোমার ননদিনীকে বলে দিও, আজ রাতের জন্য যেন আমার রুমে আসে। কাল যেহেতু চলে যাব, যাওয়ার আগে কিছু স্পেশাল ফিলিংসের দরকার আছে।’
মুখের ভাত শেষ করে, আরেকটু ভাত-মাছ মুখে তুলেছিল প্রাণেশা। অনির্বাণের কথা শোনে কাশির সাথে সেটুকু আর পেটের ভেতরে গেল না, বিষমের সাথে নাকমুখ জ্বলে উঠে অসহ্যকর একটা পরিস্থিতি তৈরী হলো। অনির্বাণ পাশেই ছিল। পিঠে হাত ম্যাসাজ করে একগ্লাস পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘আহা, এইটুকুতেই নার্ভাস?’
পানি খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘আমি কেন তোমার ঘরে থাকব?’
‘বারেহ্, আমার বউ না তুই?’
প্রাণেশা কটমট চোখে চেয়ে চেয়ে বলল,
‘যাব না আমি তোমার ঘরে।’
‘জরুরী কিছু কথা বলব, প্রাণ।’
‘যাব না মানে, যাব না। মাথায় ঢুকিয়ে নাও।’
‘না গেলে কী করব জানিস?’
প্রাণেশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে, অনির্বাণ তাকে জব্দ করতে, একটু মাথা নুইয়ে, একদম বউয়ের কানের কাছে ঠোঁট এনে, ফিসফিসিয়ে বলল,
‘তোর নিচের ঠোঁটের ঠিক বামপাশে কালো একটা তিল আছে। গতরাতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল, তিলটা ছুঁয়ে দেখি। তুই তো একটা মাথামোটা, বেকুব, তাই আমার ইচ্ছের মূল্য দিসনি। এখন কথার মূল্য না দিলে, লাজ-লজ্জা ও অনুমতির দিক ভুলে গিয়ে, দীর্ঘ সময়ের একটা স্পেশাল চুমু দেব ঠোঁটে। তখন মুখটা কোথায় লুকোস, সেটাও দেখে ছাড়ব। বুঝেছিস?’
প্রাণেশার মনে হলো, এক্ষুণি এখান থেকে না পালালে মান-ইজ্জতের দিকে ফিরেও তাকাবে না অনির্বাণ। লজ্জায় তাকে ফেলবেই। যতটুকু খেয়েছে, সেটুকুই যথেষ্ট। সে খাবার রেখে হাত ধুয়ে, নতমুখেই দৌড় দিল। ওর দৌড় দেখে রূপকথা ও অনির্বাণ শব্দ করে হেসে উঠল। রূপকথা বলল,
‘কী যে করো না তোমরা। কী দরকার ছিল, বেচারীকে এইভাবে পঁচানোর? দেখলে তো, খাবারটাও খেল না।’
অনির্বাণ সিঁড়ির দিকে চোখ রেখে বলল,
‘এখন না খেলে রাতে ঠিকই খাবে।’
‘ও তোমার সামনে আসবে আর?’
‘না আসলে আমি ওর রুমে যাব।’
রূপকথার হাসি আর থামলো না। হাসতে হাসতেই বলল,
‘দেখব কেমন পারো। ওই দেখো, দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।’
আসলেই তাই। এরমধ্যেই প্রাণেশা নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিয়েছে। মুখে হাসি ধরে রেখে অনির্বাণ বিড়বিড়াল,
‘শুধু কি বিয়েতেই ওর অ্যালার্জি না কি স্বামীর আদরেও অ্যালার্জি? আদর করতে চাইলে আমার আনরোমান্টিক বউটা এইভাবে পালিয়ে যায় কেন?’
***
চলবে…