প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০২

0
182

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২

অনির্বাণের ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে আটটায়। এতবেলা অবধি ঘুমানোর অভ্যাস নেই। গতকাল রাতে প্রাণেশা তার চুল ছিঁড়ে দৌড় দেয়ার পর আর মেয়েটার নাগাল পায়নি। তাতেই ঘর কাঁপানো হাসিতে পেট ফুলে উঠেছিল তার। প্রাণেশাকে ভয় দেখিয়ে রুম থেকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এইভাবে কাছে এগিয়েছিল সে। বউ হলেই তাকে ছুঁতে হবে এমন কোনো বাড়তি আকাঙ্খা তার মধ্যে ছিল না। ছিল শুধু প্রাণেশাকে দূরে সরানোর চিন্তা। শান্তিতে ঘুমানোর চিন্তা। যার কারণে ইচ্ছাকৃতভাবেই কাছে এগিয়ে এরকম একটা সিচুয়েশন তৈরী করেছিল সে। প্লান সাকসেসফুল হওয়াতে শান্তির একটা ঘুম হয়েছে। এসব চিন্তা করে একা একাই হাসছিল অনির্বাণ। হাই তুলতে তুলতে বেলকনিতে এসে দাঁড়াতেই দেখল, ভাঙা একটা গাছের নিচে ছোটো চাচা শেখ শওকত আলমের ছেলে ও মেয়েকে কান ধরিয়ে ওঠবস করাচ্ছে প্রাণেশা। হাতে একটা কঞ্চি। রাগত্ব মুখ। জ্বলন্ত দৃষ্টি। ভাই-বোন দুটো বেশ ভয় পাচ্ছে প্রাণেশার এই দৃষ্টি। ভয়েই কাঁচুমাচু হয়ে তারা কান ধরে ওঠবস করছে আর ফুঁপাচ্ছে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে বড্ড মায়া হলো অনির্বাণের। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ওদেরকে এই শাস্তি কেন দিচ্ছিস, প্রাণেশা?’

প্রাণেশা চোখ কটমটিয়ে বলে উঠল,
‘সেটা তোমাকে কেন বলব? তুমি কে? কাজের মাঝখানে বিরক্ত করছ কেন? যাও এখান থেকে।’

পরপর রাগী চোখে ভাই-বোন দুটোর দিকে চেয়ে ধমকে উঠে বলল,
‘এই তোরা ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? কান ধর। নয়তো দিলাম।’

‘দিলাম’ শুনেই ওরা চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রাণেশা হা হয়ে ওদের কান্না দেখছিল। কারণ এখন অবধি কঞ্চি দিয়ে একটা আঘাতও সে দেয়নি। শুধু ভয় দেখাতেই কঞ্চি হাতে রাখা। এদিকে দূর থেকে ওদের কিছু একটা ইশারা করল অনির্বাণ। প্রাণেশা না বুঝলেও ভাই-বোন দুটো ঠিকই বুঝে নিল। সাউন্ড দিয়ে কান্না শুরু করল। অনির্বাণ তখন সুযোগ পেয়ে বলল,

‘তোর তো সাহস কম না। তুই ওদের গায়ে হাত দিচ্ছিস? ওরা এখনও ছোটো। এসব শাসনের কী বুঝে?’

প্রাণেশা ফুঁসে ওঠে বলল,
‘কিছু বুঝে না, শুধু বুঝে গাছের ডালে চড়ে গাছ ভাঙতে। এইটুকু একটা গাছ, এটার ডালে চড়ার কী দরকার ছিল? একটা গাছের দাম কত জানো? সেটাকে যত্ন করে বড়ো করার কষ্ট বুঝো? বুঝবে কী করে? জীবনে কোনোদিন একটা গাছ লাগিয়েছ? অলস কোথাকার।’

‘এ্যাহ… আসছে। জ্ঞান দিতে। অলস তো তুই। অকর্মাও তুই। কাজের মধ্যে পারিস ওই একটাই। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, তোর তো দিনরাত রান্নাঘরে থাকার কথা। তুই কেন পুরুষের মতো হাঁটাচলা করবি? আধা ব্যাটাছেলে একটা।’

‘আমি কী করব, কী করব না, সেটা আমি বুঝব। তুমি মাথা ঘামানোর কে?’

‘আমি কে, জানিস না? কবুল বলে যে আমার গলায় ঝুলেছিস, সেটা কি ভুলে গিয়েছিস? আমি তোর স্বামী। এখন থেকে আমার সব কথা মেনে চলবি। নয়তো…।’

প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘আমি তোমার গলায় ঝুলিনি। যা হয়েছে তাতে আমার হাত ছিল না। এজন্য তুমি যদি ভাবো, রোজ রোজ অফিস যাওয়ার আগে, রান্নাবান্না করে তোমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে পতীসেবা করব, তাহলে ভুল ভাবছ। প্রাণ মরে গেলেও হাত-পা পুড়িয়ে তোমার জন্য রান্না করবে না।’

‘তোর হাতের রান্না খাওয়ার চেয়ে কচুগাছে দঁড়ি বেঁধে ঝুলে যাওয়া বেটার।’

অনির্বাণ যেভাবে কৌতুক করে বলল, প্রাণেশাও ঠিক একইভাবে বলল,
‘তাহলে যাও, ঝুলো। বাড়ির ওইপাশে পরিত্যক্ত ঝোপঝাড় আছে। ওখানে অসংখ্য কচুগাছও আছে। তোমার যেটা ভালো লাগে, তুমি সেটাতেই ঝুলে পড়ো। খামোখা আমার কাজে বিরক্ত করো না।’

কোনোমতেই প্রাণেশাকে থামানো গেল না। এদিকে বাচ্চাদুটো সমানে কেঁদে চলেছে। এ পর্যায়ে সে প্রাণেশাকে প্রায় ধমকে উঠে বলল,
‘ওদের ওপর টর্চার করিস না, প্রাণেশা। ব্যাপারটা ভালো দেখাচ্ছে না। তুই কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস।’

‘ওরা আমার গাছ নষ্ট করেছে। ওদেরকে এত সহজে ছেড়ে দেব না।’

‘তুই এত ছোটোলোক। সামান্য একটা গাছের জন্য অবুঝ বাচ্চাদের ওপর টর্চার করছিস? ছিঃ… প্রাণ।’

ছোটোলোক শব্দটা শোনে রাগে, দুঃখে, কষ্টে, অপমানে প্রচণ্ড কান্না পেল প্রাণেশার। তার এত যত্নের গাছ, এত প্রিয় গাছ। এই দারুচিনি গাছটা সংগ্রহ করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল তাকে। খুঁজেই পাচ্ছিল না। এই পাঁচ বছরে গাছটা যথেষ্ট বড়ো হয়েছিল। তবে এতটা শক্তপোক্ত হয়নি। গতকাল সবাই বিয়ের ঝামেলায় ব্যস্ত ছিল, সে নিজেও ব্যস্ত ছিল বিয়ে ভাঙার প্লান নিয়ে। মাঝখান দিয়ে বিচ্ছু দুটো কখন যে খেলার ফাঁকে তার শখের ও যত্নের গাছটা ভেঙে ফেলেছে, কেউ দেখেনি। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর বাগানে পানি দিতে এসে এই দৃশ্য দেখে কষ্টে হাউমাউ করে কেঁদেছিল প্রাণেশা। কে করেছে এই কাজ, সেটা খুঁজতে গেলে বিচ্ছু দুটো লুকাতে চাইছিল। তাতেই তাদের কাণ্ডকারখানা বুঝে গিয়েছিল সে। আর এজন্যই শাস্তি দিচ্ছে যেন পরবর্তীতে এই ধরনের ভুল তারা না করে।

কান্নার আওয়াজে শওকত আলম বাগানে এসে দুই বাচ্চার কাঁদোকাঁদো মুখ ও প্রাণেশার রাগী মুখ, ফোলা ফোলা চোখ ও ভেজা গাল দেখে ঘটনা কী তার আন্দাজ করতে পেরে সামনে গিয়ে বললেন,

‘ওরা কি আবারও গাছ ভেঙেছে?’

উপরনিচ মাথা দুলিয়ে ভাঙা দারুচিনি গাছটা দেখিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘সপ্তাহে একদিন একটা না একটা গাছ ওরা ভাঙবেই। তুমি ওদের হাত-পা বেঁধে দাও, চাচ্চু। পুরো বাগানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে ওরা।’

শওকত আলম নিজের ওয়ানে পড়ুয়া মেয়ে রামিশা ও থ্রিতে পড়ুয়া ছেলে রাদিনের দিকে রাগী মেজাজে তাকিয়ে শাসনের সুরে বললেন,

‘তোমরা কিন্তু কাজটা ঠিক করো না। খেলতে গেলে গাছ ভাঙে কী করে? সাবধানে খেলা যায় না? তাছাড়া খেলার জন্য ঘরভরা খেলনা আছে। বাগানে এসে খেলতে হবে কেন তোমাদের? গাছ কত উপকারী এটা জানো না? এভাবে যদি প্রতিদিন একটা করে গাছ নষ্ট করো, পরিবেশের কত ক্ষতি সেটা বুঝতে পারো না?’

কথার ফাঁকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এইটুকু গাছে কে উঠেছে?’

রাদিন ফটাফট আঙুলটা বোনের দিকে ঘুরিয়ে নিল। রামিশা বলল,
‘আমি ইচ্ছে করে উঠিনি, আব্বু। ভাইয়াই তো আমাকে গাছে উঠা শেখাতে চাইল।’

দোষ যে দু’জনের সেটা বেশ বুঝতে পারলেন শওকত আলম। প্রাণেশাকে বুঝাতে বললেন,
‘তুই মন খারাপ করিস না, মা। ওরা আর গাছ ভাঙবে না। আমি বুঝিয়ে বলছি।’

এরপর পকেট থেকে বেশকিছু টাকা বের করে প্রাণেশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘নাশতা খেয়ে আজই গিয়ে নিজের পছন্দমতো কয়েকটা চারাগাছ কিনে আনবি।’

চাচ্চুর কথা মেনে নিলেও ভাঙা গাছের জন্য যে যন্ত্রণা বুকে চেপে বসলো, সেটুকু থেকে মুক্তি মিলল না। মনের যন্ত্রণা হালকা করতে ভাই-বোন ও চাচ্চুকে বিদায় করে, ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল প্রাণেশা। ভাঙা গাছটা হাতে তুলে, জায়গাটা পরিষ্কার করে, অন্যসব গাছে যত্ন করে পানি ঢেলে ঘরে ফিরতে গিয়েই অনির্বাণের বেলকনির দিকে চোখ পড়ল। তখনও ওখানেই দাঁড়িয়েছিল অনির্বাণ। প্রাণেশার কাণ্ডকারখানা দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই আদেশের সুরে অনির্বাণ বলল,

‘নাশতা খেয়ে ঝটপট তৈরী হ। আমিও তোর সাথে যাব।’

***

নার্সারি থেকে নিজের পছন্দমতো বেশ কয়েকটা ফুলের গাছ কিনল প্রাণেশা। মশলাজাতীয় গাছ পেল না। ঔষধি গাছ আগামী সপ্তাহে আসবে। অনির্বাণ শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। গাছ কেনা শেষ হলে, টাকা পরিশোধ করে, সবগুলো গাছ একটা ভ্যানগাড়িতে তুলে, চালককে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দু’জনে বাইকে উঠতে যাবে, অমনি বেশ কিছুটা দূরের একটা দামী রেস্টুরেন্টের দিকে চোখ গেল অনির্বাণের। কতক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রাণেশাকে বলল,

‘ওটা তোর বন্ধু সাফওয়ান না?’

প্রাণেশাও সামনের দিকে দৃষ্টি দিল। সাফওয়ান একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ভীষণ খুশি খুশি মেজাজে রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়েদারের সাথে মিলিয়ে চমৎকার করে ছবি তুলছে। সাফওয়ান ছবি তুলে দিচ্ছে আর মেয়েটি পোজ নিচ্ছে। দৃশ্য দেখে অনির্বাণের মনোযোগ সরিয়ে নিতে ঝটপট তার চোখ থেকে চশমা সরিয়ে নিল প্রাণেশা। বলল,

‘দূর, চশমা পরেও ভুল দেখছ। ওটা সাফওয়ান নয়।’

অনির্বাণ মুহূর্তেই সামনে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি আবছা হয়ে গেল। দূরের কিছু আর ঠিকমতো দেখা গেল না। সবকিছু ব্লার দেখল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

‘তুই চশমা নিলি কেন? ওটা সাফওয়ানই। আমি ভুল দেখিনি।’

দূরের জিনিস অস্পষ্ট দেখলেও কাছের সব পরিষ্কারই দেখে অনির্বাণ। হাত বাড়িয়ে প্রাণেশার হাত থেকে চশমাটা কেড়ে নিয়ে সেটা চোখে পড়ে দৌড় দিল রেস্টুরেন্টে দিকে। প্রাণেশা বোকা বোকা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, পরমুহূর্তেই অনির্বাণের মেজাজ বুঝে নিজেও পিছন পিছন দৌড় দিল। চেঁচাতে চেঁচাতে বলল,

‘খামোখা দৌড়াচ্ছ। ওটা সাফওয়ান না রে ভাই। সাফওয়ানের আত্মা।’

পরক্ষণেই ‘ভাই’ ডাকাতে জিহ্বাই কামড় দিল। কাহিনী যা হওয়ার তা-ই হলো। রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়েই সাফওয়ানের কলার চেপে ধরল অনির্বাণ। বলল,

‘তোমার এত বড়ো সাহস, আমার বাড়ির ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলো? মেয়ে নিয়ে ঘুরবে, ঘুরো। আমাদের বাড়ির ইজ্জতের দিকে কেন হাত বাড়িয়েছিলে? তাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে তোমার লজ্জা হয় না?’

সাফওয়ান প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল অনির্বাণের এই কাণ্ডে। পরবর্তীতে ঘটনা কী, সেটা বুঝতে পেরে বলল,
‘আরেহ্ ভাই, ছাড়ুন। আমি আপনার বাড়ির ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলিনি। প্রাণেশা যতটা আপনার কাজিন, ততটা আমার ভালো বন্ধুও। আর বন্ধু হিসেবে আমার কর্তব্য, ওর চাওয়া না চাওয়ার মূল্য বোঝা। আমি জাস্ট এটুকু করেছি।’

দৌড়ে এসে জোরপূর্বক সাফওয়ানের কলার থেকে অনির্বাণের হাত ছাড়িয়ে নিল প্রাণেশা। জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘তুমি তো পাবনার পাগলের চেয়েও কম যাও না। একটা মানুষের সাথে কেউ এইরকম আচরণ করে?’

অনির্বাণের মেজাজে আগুন। নিজেকে সামলাতে পারছে না সে। যতবারই মনে হচ্ছে, প্রাণেশার বিয়ে ভেঙে এই ছেলে তাদের বাড়ির মান-সম্মান নষ্ট করে দিতে চাইছিল, ততবারই মেজাজটা চিড়বিড়িয়ে উঠছে। এখন প্রাণেশার হাতের টান খেয়ে রাগ যেন তার ফুলেফেঁপে উঠল। চিৎকার করে বলল,

‘ওর মতো দুই পয়সার ছেলের সাহস হয় কী করে, তোকে নিয়ে এই ধরনের ড্রামা করার? বিয়ে যদি না-ই করবে, দশজন জানিয়ে বিয়ের দিনতারিখ পাকা করেছিল কেন? বেইমান, মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ একটা। ওকে আমি জেলে দেব।’

ঝটপট ফোন বের করে নিজের পরিচিত একজন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে চাইল অনির্বাণ। প্রাণেশা টান মেরে ফোন নিজের হাতে এনে বলল,

‘শান্ত হও। ওর কোনো দোষ নেই। যা হয়েছে সব আমার ইচ্ছেতে হয়েছে।’

অনির্বাণ বড়োসড়ো একটা ধাক্কা খেল। বিস্মিতস্বরে বলল,
‘মানে!’

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল প্রাণেশা। সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি তো জানোই, এই বিয়েশাদী নিয়ে আমার কোনো স্বপ্ন নেই, আগ্রহ নেই, মাথাব্যথাও নেই। সবাই যখন বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল, নিজেকে বাঁচাতে ও আর আংকেল-আন্টির সাহায্যে এই প্লানটা করেছিলাম, যেন বিয়ে ভাঙার পর আর কেউ কোনোদিন বিয়ে নিয়ে আমাকে জোরাজুরি না করে।’

অনির্বাণ যেন শূণ্যে থেকে হোঁচট খেল। প্রাণেশার এই কথা তার বিশ্বাস হলো না দেখে যাচাই করতে বলল,
‘তার মানে তুই জানতি, বিয়ের দিন ও আসবে না?’

‘হ্যাঁ, জানতাম।’

‘তাহলে আমার ওপর চেপে বসেছিস কেন? এখন আমি কী করব? তুই তো ঘর-সংসার বুঝবি না। আমিও তোকে বউ মানতে পারব না। এখন আমার উপায় কী? এই ঝামেলায় আমি কেন জড়িয়ে গেলাম? তোর ফাঁদে তো আমার পা দেয়ার কথা ছিল না। আমি কেন ফেঁসে গেলাম?’

অনির্বাণের এই কথায় সাফওয়ানও যথেষ্ট অবাক হলো। কাহিনী কী, জানতে চেয়ে বলল,
‘আপনার ওপর চেপে বসেছে মানে?’

মেজাজে আগুন নিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘সেটা তোমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করো। বিয়ের ভাঙার নাটক করতে গিয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে।’

‘বুঝলাম না।’

প্রাণেশা ফেকাসে কণ্ঠে বলল,
‘কাল যখন তোর বাড়ি থেকে ফোন গেল, তুই পালিয়েছিস, তখন মান-সম্মান বাঁচাতে বাবা ও চাচ্চুরা মিলে আমাদের সিঙ্গেল জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আই মিন, আমরা এখন শুধু কাজিন নই, হাসব্যান্ড এন্ড ওয়াইফ।’

সাফওয়ানের চোখদুটো গোলগোল হয়ে গেল। সে কতক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে দু’জনকে দেখল, এরপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তার সেই হাসি দেখে প্রাণেশার শরীর জ্বলে গেল। বলল,

‘হাসবি না শয়তান। তোর জন্যই এটা হয়েছে।’

সাফওয়ান তব্দা খেয়ে মুখে হাত চেপে বলল,
‘আমার কী দোষ? তুই-ই তো প্লান সাজালি। তোর প্লানে তো শেষ পর্যন্ত ‘কবুল’ বলার কথা ছিল না। বললি কেন?’

‘না বলে উপায় ছিল? সবাই আমাকে চেপে ধরে কবুল বলিয়েছে।’

পরক্ষণেই অনির্বাণের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
‘এইযে সামনে থাকা একটা জ্যান্ত গাধা। তার মাথায় কোনো বুদ্ধিই নাই। আরেহ্ ভাই, কেউ চেপে ধরলেই কেন কবুল বলতে হবে? সদর দরজা তো খোলা ছিল, দৌড় দিতে পারল না? এই গাধার জন্য এখন আমার জীবনটা শেষ।’

উত্তর যেন ঠোঁটের কোণে ঝুলেছিল অনির্বাণের। ফটাফট বলল,
‘তুই দৌড় দিতে পারিসনি? আমি তো তোর প্লানের কথা জানতাম না। তুই যখন জানতি, তাহলে ভাগলি না কেন? মাথামোটা কোথাকার। নিজে তো বাঁচতে পারলি না, আমাকেও বাঁচতে দিলি না। কী যে করব! দূর…।’

সত্যিটা জানার পর মেজাজের বারোটা বেজে গেছে অনির্বাণের। প্রাণেশার যদি বিয়ে ভাঙারই ইচ্ছে ছিল, তাহলে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করল কেন! কেনই বা তার জীবনেই প্রবেশ করল! এই মেয়েকে নিয়ে ঘর-সংসার কীভাবে হবে? চিন্তা করতে গিয়ে অস্থির হয়ে গেল অনির্বাণ। নিজের আচরণের জন্য লজ্জিত হয়ে সাফওয়ানকে বলল,

‘তুমি কিছু মনে করো না, সাফওয়ান। এই গাধী আমাকে আগে কিছু বলেনি। তাই তোমাকে এখানে দেখে রি’অ্যাক্ট করে ফেলেছি। ভেবেছি, ওর জীবন নষ্ট করে…।’

লজ্জায় আর কথা বলতে পারল না অনির্বাণ। জেনে-বুঝে প্রাণেশা তাকে এরকম একটা সিচুয়েশনে ফেলল! কী লজ্জাজনক ব্যাপার হলো এটা। নির্দোষ একটা মানুষকে বকে দিল। সে কথা এড়িয়ে যাওয়ার বাহানায় খানিকটা দূরে গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য একটা লেমন জুস কিনে, তাতে চুমুক দিয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইল। সাফওয়ান তখন প্রাণেশাকে বলল,

‘বিয়ে করলি অথচ কিছু জানালি না। এখন ট্রিটটা অন্তত দিয়ে যা। নয়তো ছাড়ব না। বকা খাইয়েছিস। তার শোধ তুলে ছাড়ব।’

প্রাণেশা পাংশুমুখে বলল,
‘তোর কি ধারণা, আমি খুব জমিয়ে ঘর-সংসার করব? ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে ডিভোর্সের কথা উঠবে। নিশ্চিত থাক। যদি ডিভোর্স না হয়, তাহলে ট্রিট দেব।’

এরপর সাফওয়ানের গার্লফ্রেন্ডের সাথে অল্পস্বল্প গল্প করে ওদেরকে বিদায় দিয়ে অনির্বাণের সামনে এসে বলল,
‘বাড়ি যাবে না?’

অনির্বাণ কাটকাট গলায় বলল,
‘তুই যা।’

‘বেরিয়ে এসেছি দু’জন। যাব একা?’

‘তাতে তোর কী? তুই তো একা পথ চলে অভ্যস্ত। এমন তো না যে, আমি সঙ্গে না গেলে বাড়ি পৌঁছাতে পারবি না।’

‘একা গেলে সবাই কী ভাববে?’

‘সবার জন্য চিন্তা হয় তোর? যদি চিন্তা হতো, এরকম একটা থার্ডক্লাশ প্লান করে আমার ঘাড়ে চেপে বসতি না।’

‘এখন কী চাইছ তুমি? ডিভোর্স?’

অনির্বাণ হেসে বলল,
‘তুই কী চাস?’

‘আমি কী চাই, সেটা তুমি জানো।’

‘তাহলে আর কী? সময়মতো পেয়ে যাবি। তোর মতো আধপাগলকে নিয়ে ঘর-সংসার করার ইচ্ছে আমার নেই।’

প্রাণে কটমট চোখে চেয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। অনির্বাণের সেদিকে দৃষ্টি ছিল না। সে জুস রেখে, সামনে থাকা পত্রিকায় চোখ ডুবিয়ে রেখেছিল। হুট করেই প্রাণেশার মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসল। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে একগাদা খাবার কিনল। অনিবার্ণ একবার সামনে তাকিয়ে দেখল, প্রাণেশা নেই। ভেবে নিল চলে গেছে। সে নিজের মতো করে জুস খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দিয়ে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল। একটা সময় অনির্বাণের সামনে এসে আঙুলের মধ্যে বাইকের চাবি ঘুরিয়ে, জুসের গ্লাসের কাছে কাগজ রেখে প্রাণেশা বলল,

‘বিল পেমেন্ট করে আসো।’

সামনে তাকিয়ে চমকে গেল অনির্বাণ। বলল,
‘তুই যাসনি?’

‘তোমাকে বাঁশ না দিয়ে যাব না।’

বাঁশটা কেমন বুঝল না অনির্বাণ। তবে সামনে থাকা কাগজ খুলে লম্বা একটা লিস্ট দেখে আঁৎকে উঠে বলল,
‘এত খাবার কে খেল?’

প্রাণেশা রাস্তার দিকে বসে থাকা কয়েকজন ভিখারি দেখিয়ে বলল,
‘ওনারা খাচ্ছেন। আমাদের বিয়ের ট্রিট। বিল দিও কেমন? আমি যাচ্ছি।’

অনির্বাণ কিছু বলার আগেই আঙুলের প্যাঁচে থাকা চাবি দেখিয়ে রহস্যময়ী হাসি হেসে বাইক স্টার্ট করে হাওয়ার বেগে উড়ে গেল প্রাণেশা। অনির্বাণ দৌড়ে এসেও নাগাল পেল না। তার বাইক, অথচ মেয়েটা তাকেই ফেলে রেখে চলে গেল। এরমধ্যেই রেস্টুরেন্টের ওয়েটার এসে বিল চাইলে পকেটে হাত দিয়ে আরেকদফা বাঁশ খেল অনিবার্ণ। তার ক্রেডিটকার্ড, মানিব্যাগ কিচ্ছু পকেটে নেই। কারও হেল্প নেয়ার জন্য টেবিল থেকে ফোন নিতে এসে দেখল, ফোনটাও নেই। জীবনে এরকম বেজ্জতির সামনে পড়েনি সে। আজ পড়ে ভীষণ লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো তার। কপাল চাপড়ে বিড়বিড়াল,

‘উফফ আল্লাহ, এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি! এখন কী হবে! বিল পেমেন্ট করব কী করে?’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে