প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-১১

0
111

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১১

নির্ধারিত সময়েই কুইজ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একক ও দলীয়ভাবে। প্রাণেশা দুটো বিভাগেই অংশ নেয়ার জন্য ফর্ম ফিলাপ করেছিল। প্রথমদিনের কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সেরা দশজনের একজন হয়েছে প্রাণেশা। যদিও প্রথম হতে পারেনি তবে দ্বিতীয় হয়েছে। আর দ্বিতীয় দিনের কুইজে সকাল থেকে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ চলছে। একটা দলকে হারিয়ে অন্য দলকে জিতিয়ে নেয়ার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এই সেগমেন্টে দলীয়ভাবে একেকটা কলেজের তিনজন করে ছাত্রছাত্রী সুযোগ পাচ্ছে। তারমধ্যে মেহেরপুর সরকারি কলেজের হয়ে দলে থাকছে প্রাণেশা, সাফওয়ান ও ওদের আরও এক সঙ্গী রিক্তা। যে দলের সাথে লড়াই চলছে, তারা রংপুর থেকে এসেছে। প্রতিটা রাউন্ডে খেলতে খেলতে রংপুরের পয়েন্ট হলো বেশি, মেহেরপুরের কম। বাকি শুধু শেষ রাউন্ডের খেলা। ‘কুইক কুইজ’ রাউন্ড। এক মিনিটের মধ্যে এই রাউন্ডে যারা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের উত্তর দিবে, তারাই হবে এই সেগমেন্টের বিজয়ী। প্রাণেশার বুক ধড়ফড় করছে। কী হয়, কী হয়, এরকম একটা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে সামনে। ভয়ে চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। একটুর জন্য হেরে যাবে? মেনে নিতে পারছে না। একমনে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। যখন ‘কুইক কুইজ’ রাউন্ড শুরু হলো, সঙ্গে সঙ্গে ‘কুইকপ্রেস বাজার’এ আঙুল ছুঁইয়ে রাখল সবাই। স্ক্রিনে প্রশ্ন আসা মাত্রই বাজারে শব্দ তুলল প্রাণেশা। উত্তরটা ঠোঁটস্থ থাকায় ঝটপট উত্তর দিল। এভাবে যে কয়টা প্রশ্ন এলো, ভাগ্যগুণে বেশিরভাগ প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর প্রাণেশা একা দিল, বাকিরা যে যেটা পারল দিল, যারা পারল না, ছেড়ে দিল। নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পর ‘মেহেরপুর সরকারি কলেজ’ টিমকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হলো। এবং দিনশেষে প্রাইজমানি, সার্টিফিকেট, বই, ক্রেস্ট ও মেডেল প্রধান করে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানো হলো। পুরস্কার বিতরণী শেষে দলীয়ভাবে সবাই ছবি তুলে নিজেদের আনন্দ ও সুখকে বাকিদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। ঠিক পাঁচটে বাজার পনেরো মিনিট আগেই সমস্ত আয়োজন শেষে সাফওয়ান ও রিক্তাকে নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে এলো প্রাণেশা। অনির্বাণকে দর্শকসারিতে প্রথমে দেখলেও পরবর্তীতে কাছেপাশে দেখেনি। পুরস্কার বিতরণীর সময়ও সেখানে সে উপস্থিত ছিল না। গেটের বাইরে এসেও তার চিহ্নটি খুঁজে পেল না। এমনকি গাড়িটাকেও আশেপাশে দেখা গেল না। এখনও তার হাতে পুরস্কার, গলায় মেডেল। প্রিয়জন যদি এইমুহূর্তে সামনে না থাকল, তাহলে আনন্দ কই? এত এত আনন্দ ও উদ্দীপনা সবটাই মাটি হয়ে যেতে লাগল। সাফওয়ান ও রিক্তা বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে প্রাণেশাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে সাফওয়ান বলল,

‘কী রে, তোর সঙ্গী কই? ট্রিট দিবে বলে কি হাওয়া হয়ে গেল?’

অস্থির চোখে চারপাশে তাকিয়ে অনির্বাণকে না পেয়ে প্রাণেশা বলল,
‘কী জানি! ওখানেই তো ছিল।’

রিক্তা বলল,
‘আরেহ্ ছাড়, ভাইয়া কিপটার জম। যখনই দেখলেন বউয়ের জেতার চান্স আছে, অমনি কেটে পড়েছেন।’

প্রাণেশা ফুঁসে উঠে বলল,
‘মোটেও এরকম কিছু নয়। নিশ্চয়ই জরুরী কোনো কাজে গেছে। দেখ, ওর গাড়িটাও নেই।’

সাফওয়ান বলল,
‘হয়েছে থাক, আর বরের হয়ে সাফাই গাইতে হবে না। বলেছিলি না, এক সপ্তাহের মধ্যে ডিভোর্সের কথা উঠবে? তুই ঘর-সংসার করবি না, কাউকে ভালোবাসবি না, হ্যানত্যান আরও কতকিছু। এখন তো দেখছি, দিব্যিই ঝুলে আছিস। ছাড়ার নাম নিচ্ছিস না। ঘর বাঁধার যদি ইচ্ছেই ছিল, আমাকে দিয়ে হুদাই নাটক সাজানোর দরকার ছিল না। এখন তোর বাড়ির সবার কাছে আমি খারাপ। ভাবত, কেমনটা লাগে?’

বন্ধুর বর্তমান পরিস্থিতি আসলেই খারাপ। আগে প্রাণেশার বাড়ির সবাই সাফওয়ানকে পছন্দ করত আর বিয়ে ভাঙার পর থেকে ওর নাম শুনলেই সবাই রেগে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখলে তো রক্ষে নেই। সেদিন প্রাণেশার বাবা কী বাজে ব্যবহার করেছেন! মনে পড়লে এখনও শরীর ঘিনঘিন করে তার। একটা মানুষ মেয়েকে পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে এত কেন বাড়াবাড়ি করেন? ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। সম্পর্কটা প্রাণেশার সাথে বলেই আজেবাজে কথাও হজম করে নেয়। কী করবে? বন্ধুত্ব তো! এত সহজেই কি এই সম্পর্ককে ফেলনা ভাবা যায়? সাফওয়ানের মন-মেজাজ যে খিঁচড়ে গেছে সেটা বুঝেই পাশে থাকা বাদামওয়ালার কাছ থেকে কিছু বাদাম কিনল প্রাণেশা। রাস্তায় দাঁড়িয়েই খেতে লাগল সবাই। বাকিরা বাদাম পছন্দ করে বলেই কেনা। সাফওয়ান বাদাম দেখে বলল,

‘এইটুকু? স্বামীর টাকা বাঁচানোর ধান্ধা? হবে না। জম্পেশ ট্রিট চাই?’

প্রাণেশা বলল,
‘রাগ করছিস কেন? খা। অনি আসুক… ট্রিট দিবেনে।’

‘বাকির নাম ফাঁকি। তাড়াতাড়ি আসতে বল।’

‘ট্রিট ছাড়া আর কিছু বুঝিস না, না?’

‘না বুঝি না।’

ফোন বের করে অনির্বাণের নম্বরে কল করতে গিয়েই দেখল, পার্কিংস্পটে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তেই ডোর খুলে নেমে এসেছে অনির্বাণ। হাতে একগুচ্ছ নানান মিশেলের ফুল। কোনো কাহিনী ছাড়াই ফুলগুলো বাড়িয়ে দিল প্রাণেশার দিকে। হাসিমুখে বলল,

‘কংগ্রাচুলেশনস্ মিসেস্ অনির্বাণ সৈকত।’

প্রাণেশা ফুলগুলো হাতে তুলে ঠোঁটে প্রশান্তিময় হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’

হাতের ক্রেস্ট, প্রাইজমানি, বই অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘দেখো…।’

দু’চোখে একরাঁশ মুগ্ধতা নিয়ে সব পুরস্কার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল অনির্বাণ। সেগুলো গাড়ির পিছনের সিটে রেখে, সাফওয়ান ও রিক্তাকে বলল,

‘আমি চাইছি, বিয়ের ট্রিটটা আজকেই দিতে। তোমরা কি যাবে আমার সাথে?’

সাফওয়ান বলল,
‘শুধু বিয়ের না, আজকেরও। দুটো ট্রিট জমা হলো।’

‘জমা বলছ কেন? এখুনি এসো।’

বিকেলের শেষভাগ। আর আধঘণ্টার মধ্যেই আস্তেধীরে বেলা ডুবে যাবে। সে ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
‘স্যরি, ভাইয়া। আজ আর হবে না। এখন রওনা না দিলে পৌঁছাতে শেষরাত হবে। বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।’

রিক্তাও বলল,
‘হ্যাঁ, একদম। ট্রিট জমা থাকুক। কোনো একদিন সম্পূর্ণ ঢাকা শহর ঘুরে দেখাবেন। আজ আসি।’

তাড়া দিয়ে ওরা প্রাণেশার থেকে বিদায় নিল। বিদায়বেলা বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরল রিক্তা। বলল,
‘সুখে থাকিস।’

অনির্বাণকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভার্সিটির কমনরুমের ওয়াশরুমে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে ফেলল প্রাণেশা। বাড়তি পোশাক আগে থেকেই সঙ্গে ছিল। পোশাক পরিবর্তন করে, ছাঁইরঙা টি’শার্ট ও গোল্ডেন কালারের লেডিস্ গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরে আগের রূপে ফিরে, গাড়ির সামনের সিটে বসলো। অনির্বাণ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করলে প্রাণেশা জানতে চাইল,

‘তখন কি ফুল আনতে গিয়েছিলে?’

অনির্বাণ বলল,
‘শুধু ফুল নয়, স্পেশাল কিছু। পিছনে দেখ…।’

ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে একটা শপিংব্যাগ দেখে হাত বাড়িয়ে সেটা নিজের কাছে টেনে আনলো প্রাণেশা। ব্যাগ খুলে দেখল, ভেতরে একটা দলিল রাখা। চমকে গিয়ে বলল,

‘কী এটা?’

অনির্বাণ ড্রাইভ করতে করতে বলল,
‘বাংলা ভুলে গিয়েছিস না কি? পড়ে দেখ।’

ভয়ে ভয়ে দলিলটা মেলে ধরল প্রাণেশা। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে তার। ডিভোর্সপেপারস কি না! কিন্তু না… অন্যকিছু। এটা তাদের বিয়ের কাবিননামা আর এর নিচে পুরনো একটা দলিলের সাথে নতুন আরেকটা দলিল। তাতে কিছু লেখা। সে-ই লেখা পড়তে গিয়েই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল প্রাণেশার। দেনমোহরের টাকার সাথে মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট যোগ করে নতুন একটা জমি কেনা হয়েছে। সেই জমির মালিকানা কি না প্রাণেশার নামে। প্রাণেশা যখন বিস্মিত দৃষ্টি দিয়ে কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল, তখুনি তার দিকে কলম বাড়িয়ে দিয়ে অনির্বাণ বলল,

‘সাইন কর।’

চোখ তুলে প্রশ্ন করল প্রাণেশা, ‘কেন?’

‘তোর জিনিস তুই বুঝে নিবি না?’

‘এটা আমার হলো কবে?’

‘এখুনি হবে। দেড় বছর আগে এটা কিনেছিলাম নিজের নামে। বিয়ের পর তো তোকে কিছু দেয়া হয়নি। দেনমোহরের টাকাটাও বাকি ছিল। ভেবেছিলাম, কোনো এক স্পেশাল দিনে দেব। আজ সেই স্পেশাল দিন। যা কিছু আমার, সবকিছুর সাথে তুই জড়িয়ে আছিস। এটায় কেন থাকবি না?’

‘আমি জমি দিয়ে কী করব?’

অনির্বাণ হেসে ফেলল। প্রাণেশা বলল,
‘হাসছ কেন? আমার তো জমির দরকার নেই।’

‘দরকার আছে কি নেই, সেটা তো জমি দেখলে বুঝবি। এখন ঝটপট সাইন কর, প্রাণ।’

অনির্বাণের কথা অনুযায়ী সাইন করে দলিলটা জায়গামতো রেখে দিয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখল প্রাণেশা। অনির্বাণ বলল,

‘গাল ফুলিয়ে আছিস কেন? এমনদিনে কেউ গাল ফুলায়?’

‘আমি তোমার মতিগতি কিছুই বুঝছি না।’

অনির্বাণ একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘কাছে আয়।’

প্রাণেশা নড়েচড়ে বসলো। হুকুম পালনে সদা তৎপর এইটুকু বুঝাতে কাছেও এলো। অনির্বাণ তাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে, কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘যা কিছু স্বপ্ন আছে, ইচ্ছে আছে, আমায় বলিস প্রাণ। জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে হলেও তোর স্বপ্ন ও ইচ্ছেদের আমি পূরণ করব।’

‘কেন?’

‘কোনো একদিন নিজের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলাম, আমার বউয়ের সব ইচ্ছে ও স্বপ্নদের যথাযথ মূল্যায়ন করব। যেদিন থেকে তুই আমার বউ হলি, সেদিন থেকে তোর ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে, তোর স্বপ্নই আমার স্বপ্ন হয়ে গেল। এখন তো শুধু একটা একটা করে তোর সব ইচ্ছে ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া বাকি।’

‘তোমার নিজের কোনো ইচ্ছে নেই, স্বপ্ন নেই?’

‘নিজেকে নিয়ে আপাতত নেই। কিন্তু আমার বউকে নিয়ে আমার ইচ্ছে ও স্বপ্নের শেষ নেই। বউ পাশে থাকলে সব ইচ্ছে ও স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে, ইনশা’আল্লাহ্।’

প্রাণেশা চোখ পাকিয়ে বলল,
‘বউ কি চলে যাচ্ছে?’

ধীর অথচ শান্তগলায় অনির্বাণ বলল,
‘আমি যেতে দেব না কি? যাওয়ার নাম নিলেই কঠিন শাস্তি দেব।’

‘কী শাস্তি?’

অনির্বাণ কৌতুকের সুরে বলল,
‘ঠ্যাং উপরে রেখে মাথা নিচে ঝুলিয়ে দেব। দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হবে তাই না?’

প্রাণেশা কটমটিয়ে তাকাল। অনির্বাণ শব্দ তুলে হেসে উঠে বলল,
‘রাগ করলে তোকে কিন্তু দারুণ লাগে। অবশ্য তোর চেহারায় এখন একটা বউ বউ ভাব ফুটে উঠেছে। রাগী অথচ ভীষণ মায়াবী। এমন করে তাকালে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাবে, বউ।’

***

টেলিভিশনে নিউজ দেখে, বাড়ির সবার মুখ থেকে মেয়ের জিতে যাওয়ার খবর শোনেও কোনোপ্রকার ভালো-খারাপ মনোভাব প্রকাশ করেননি সামিউল আলম। এর মানে এই না যে, তিনি খুশি হোননি। হয়েছেন। সেই খুশিটা অন্য সবার মতো প্রকাশ করতে পারছেন না। সবাই যেভাবে প্রাণেশার মেধার প্রশংসা করছে, সেভাবে তিনি করতে পারেন না। তাছাড়া যতবারই মনে হচ্ছে, ডাক্তার না হয়ে প্রাণেশা চরম ভুল করেছে, বাবার স্বপ্নকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে, ততবারই তিনি রেগে যাচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন। বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা যখন খুশিটা একে-অন্যের সাথে ভাগ করতে অসময়ে কফির নিয়ে আড্ডায় বসলো, তখুনি তিনি চিৎকার করে বললেন,

‘এত খুশি হওয়ার মতো কিছু হয়নি। এই ধরনের কুইজে যে কেউ বিজয়ী হতে পারে।’

সেজো ভাই শরীফুল আলম বললেন,
‘যে কেউ পারলে বাকিরা পারল না কেন? ওখানে কি একটা কলেজের স্টুডেন্ট এসেছিল? পঞ্চাশেরও অধিক জেলার স্টুডেন্ট এসে অংশগ্রহণ করেছে। তারমধ্যে সেরা হয়েছে আমাদের মেহেরপুর। সেটা কেবলই, আমাদের বাড়ির মেয়েটির জন্যই। শেষকটা প্রশ্নের উত্তর যদি সবার আগে না দিত, নিশ্চিত হার লেখা ছিল কপালে।’

সামিউল আলম একরোখা মেজাজে বললেন,
‘তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হলো? ওখানে আমি থাকলে এরচেয়ে ভালো খেলতাম।’

‘তাই? তাহলে যাওনি কেন?’

‘সেই কৈফিয়ত তোমাকে দেব কেন?’

শরীফুল কেশে গলা পরিষ্কার করে রূপকথাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। রূপকথা কফির কাপ নিয়ে সামনে এলো। সবার দিকে একেকটা কাপ বাড়িয়ে দিয়ে, সামিউল আলমের কাপ তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘কে জিতল, কে হারল, এই বিচারে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আসল কথা হচ্ছে, আমাদের প্রাণেশা শুধু নিজের নয়, পুরো জেলা ও দেশের কাছে নিজের কলেজকে জিতিয়ে দিয়ে সবার কাছ থেকে বাহ্বা কুড়াচ্ছে। আমি বলি কী, আজ যেহেতু একটা খুশির দিন, এইদিনে এত রাগারাগি না করে তুমি এখুনি প্রাণেশাকে একটা ফোন দাও। শুভেচ্ছা জানাতে নয়, কেমন আছে এইটুকু জানতে। আজ কতদিন হলো, ও বাড়িতে নেই। আমরা সবাই খোঁজ নিলেও তুমি ওর খোঁজ নাওনি, চাচ্চু। এটা কি তুমি ঠিক করলে?’

সামিউল আলম গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ভালো যে থাকবে, সেটা তো নিশ্চিত। অনি ওর অসম্মান করবে না।’

‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক বলেছ। অনি এই সম্পর্ককে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখছে। শুধু অনি একা নয়, প্রাণেশাও। এ যাবৎ যা কিছু ওর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়েছ, কোনোকিছুর দিকেই কিন্তু মন বসেনি। একমাত্র বিয়েটা পবিত্র বন্ধন বলেই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ‘কবুল’ বলে সেই সম্পর্কটার মধ্যে এখন অবধি নিজেকে আটকে রাখতে পেরেছে। চাইছেও। কারণ ও বিয়েটাকে সম্মান করে। অনিকে সম্মান করে। বাড়ির সবার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। এইটুকু যদি না করত, কবেই বাড়ি ছেড়ে পালাত।’

‘এতই যদি বিয়ের প্রতি সম্মান, তাহলে বিয়ের দিন এত কাহিনী কেন করল?’

রূপকথা এই কথাগুলো বলতে চায় না, কিন্তু কিছু করার নেই। প্রাণেশার ভয়টা পরিষ্কারভাবে সবার সামনে উঠে না এলে, সবাই মেয়েটাকে শুধু ভুল বুঝেই যাবে। সে নতমুখী হয়ে বলল,

‘চাচ্চু, মাফ করো। একটা কথা না বলে উপায় নেই।’

সামিউল আলম আগের মতোই নির্বিকার ভাব নিয়ে বললেন,
‘কী?’

‘ওর আসলে সম্পর্ক নিয়ে একটু ভীতি ছিল। বৈবাহিক সম্পর্কে যদি স্বামী ও স্ত্রীর একে-অন্যকে ঘিরে সম্মান না থাকে, যতই শিক্ষা-দীক্ষা ও ধন-সম্পদ থাকুক না কেন, ওই সংসারে সুখ আসে না। দশজনের সামনে হয়তো সুখী সাজা যায়, কিন্তু মানসিক শান্তিটা আসে না। যার কাছে যাবে, তার কাছে যদি মানসিক শান্তিটা না পায়, তাহলে বিয়ে করে লাভ কী, চাচ্চু?’

এতটুকু বলে বড়ো করে নিঃশ্বাস নিল রূপকথা। এরপর আবারও বলল,
‘পড়াশোনা নিয়ে তো কম অত্যাচার সহ্য করেনি। বিয়ের পরও যদি ওর স্বামী নামক প্রাণী ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও নিজস্ব সিদ্ধান্তকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তাহলে ওই মানুষকে জীবনে জড়িয়ে ওর লাভটা কী? আবারও জোর করে সবকিছুকে পড়াশোনার মতো সহজ ভেবে জীবন কাটিয়ে দেয়া? এতে হয়তো ও সারাজীবন তোমাদেরকে বুঝাত, ও সুখী। কিন্তু বাস্তবে সেটা হতো না। ও কতটা অসুখী হতো, সেটা ও ছাড়া আর কেউ জানত না। যে সংসারে সম্মান নেই, ইচ্ছে ও সিদ্ধান্তের মূল্য নেই, মানসিক শান্তি নেই, সেখানে সারাজীবন কাটবে কী করে? এই ভয়েই ও বিয়ে করতে চাইত না। কারণ ও নিশ্চিত ছিল, সবকিছুকে জোর করে মেনে নিয়ে দিন কাটাতে গিয়ে সুখী হওয়ার ভান করাটাই ওর জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে গেছে। যা কিছুই হবে, সবটাই জোরপূর্বক হবে। কোনোকিছুতেই সে তার নিজের ইচ্ছেদের মেলে ধরতে পারবে না। নিজের মনের ভাবটা প্রকাশ করতে পারবে না। এমন হলে মানুষ ভালো থাকে, চাচ্চু? এভাবে ভালো থাকা যায়?’

রূপকথা সরাসরি কিছু না বললেও, কারও নাম না তুললেও কী বলতে চাইছে, কী বুঝিয়েছে, সেটুকু বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল সামিউল আলমের কাছে। তিনি চোখ ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখ নামিয়ে ফেললেন তাহমিনা আহমেদ। রূপকথা টপিকটা ওখানেই থামিয়ে দিল। আইশা-মাইশার রুম থেকে আরুশির কান্না ভেসে এলে সে মেয়েকে সামলানোর অজুহাতে দূরে সরে গেল। এদিকে সামিউল আলম গম্ভীরমুখে ভেবেই চলেছেন। তার এতসব রাগ ও স্ত্রীর ওপর দাম্ভিকতা, চিৎকার-চেঁচামেচি যে বাড়ির সবাই-ই নোটিশ করত, এইটুকু ভেবেই বিব্রতবোধ করলেন, তবে মনের অবস্থা বাইরে টেনে আনলেন না। ছোটো ভাই শওকত আলম ততক্ষণে প্রাণেশাকে কল দিয়ে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি ভীষণ আমুদে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। সবার কথা ভালোমন্দ আলাপ হওয়ার পরে শওকত আলম আচমকাই বলে উঠলেন,

‘মেজো ভাইজানও আমার সামনেই বসা। কথা বলবি?’

ওপাশ থেকে প্রাণেশা কী বলল, সেটুকু না শুনেই ভাইয়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন শওকত আলম। এরপর তিনি সাতেও নাই, পাঁচেও নাই, এমন একটা ভাব নিয়ে সোফা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। যাওয়ার বলা স্ত্রীকে আদেশ করলেন, তার কফিটা যেন রুমে পাঠানো হয়। এদিকে ফোন কানে ঠেকিয়ে কী কথা বলবেন, ভেবেও পেলেন না সামিউল আলম। দাঁত কামড়ে বসে রইলেন। তার এই ভাবভঙ্গি দেখে কেউ আর সামনে রইল না। সবাই-ই যে যার কাজের অজুহাত দেখিয়ে দূরে সরে গেল। শুধু পাশে রইল আরিয়ান। সে একদৃষ্টিতে মেজো চাচ্চুকে দেখে গেল। তিনি রাগেন না কি বকা দেন, এটাই দেখতে থেকে গেল সে। অনেকক্ষণ পর কণ্ঠস্বর নরম করে সামিউল আলম বললেন,

‘কেমন আছিস, প্রাণ?’

ওপাশ থেকে শুধু প্রাণেশার ফুঁপানি এলো। এখনও ওরা গাড়িতেই। অনির্বাণ ড্রাইভে ব্যস্ত। কোথায় যাচ্ছে, কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে, গেলেই বুঝতে পারবে। ড্রাইভ সামলানোর ফাঁকে যখন স্ত্রীর দিকে চোখ গেল, তখুনি দেখল বেচারী ফোন কানে চেপে ফুঁপাচ্ছে। আশ্চর্যান্বিত মনোভাব নিয়ে কাছে টেনে চোখের পানি মুছে দিল। প্রাণেশা তখন ভাঙা গলায় বলল,

‘আমি ভালো আছি, বাবা। তুমি কেমন আছো?’

সামিউল আলম গভীর করে শ্বাস টেনে বললেন,
‘এইতো, আছি একরকম।’

ওপাশ থেকে প্রাণেশা ছটফটিয়ে উঠল,
‘একরকম কেন, বাবা? শরীর খারাপ?’

‘না… শরীর ঠিক আছে। তোরা বাড়ি কবে ফিরবি?’

‘ওর তো এখন কাজের চাপ বেশি। জানি না কবে যেতে পারব।’

‘ওহ…। ঠিক আছে। যখন সময় পাবি, চলে আছিস।’

প্রাণেশা অস্ফুটস্বরে ডাকল,
‘বাবা…।’

‘বল… শুনছি।’

‘তুমি খুশি তো? রাগ নেই তো আমার ওপর?’

উত্তরে কী বলবেন, ভেবে পেলেন না সামিউল আলম। কখনও মেয়ের আনন্দে আনন্দিত হোননি, কিন্তু আজ হয়েছেন। অথচ সে কথা বলতে পারছেন না। কথা খুঁজে না পেয়ে বললেন,

‘তোর মায়ের সাথে কথা বলবি?’

‘আগে বলো, রেগে নেই তুমি?’

‘তুই ছাড়া বাড়িটা ভীষণ ফাঁকা লাগছেরে, মা।’

‘বারে, এখন আসি কী করে? বিয়ে দিয়ে পর করে দিয়েছ না?’

‘পর করলাম কোথায়? দূরে তো পাঠাইনি। কাছেই রেখে দিয়েছি।’

প্রাণেশা কান্নারত মুখে ভীষণ আবেগে বলে উঠল,
‘আই মিস ইউ, বাবা।’

সামিউল আলম উত্তরে বললেন,
‘শিগগির বাড়ি আয়।’

‘আসব, বাবা। খুব শিগগির আসব। মা কোথায়?’

ফোন হাতে নিয়ে তিনিও ড্রয়িংরুম ত্যাগ করে স্ত্রীকে খুঁজতে চলে গেলেন। আরিয়ান মুখ টিপে হেসে নিজের রুমে চলে এলো। তখুনি মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকল রূপকথা। স্বামীকে ইশারা করে বলল,

‘কথা হয়েছে?’

আরিয়ান নির্ভার হেসে বলল,
‘যতটুকু হয়েছে যথেষ্ট।’

রূপকথা মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে হাতে খেলনা ধরিয়ে দিল। আরিয়ান মেয়ের পাশে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘আ’ম সো প্রাউড অফ ইউ, রূপ।’

রূপকথা মুচকি হাসলো। আরিয়ান স্ত্রীর দুটোহাত নিজের হাতের মুঠোয় আটকে বলল,
‘সম্মান করি বলে, মুখফুটে এই কথাগুলো বলতে পারিনি কোনোদিন। তবে আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম চাচ্চুকে বোঝানোর। হয়তো আমার বুঝানো ও তোমার বলার মধ্যে পার্থক্য ছিল।’

‘ছাড়ো…। এসব নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আমাকে একটু হেল্প করো তো।’

‘কীসের হেল্প?’

‘আমি প্রাণেশাকে বলেছি, দু’জনকে গিফট দেব। কী গিফট দেব সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না।’

আরিয়ান বলল,
‘চাচ্চুর রাগকে পানি করে দিয়েছ। এটাই তো বিশাল একটা গিফট।’

‘ধুর… ফাজলামি করো না। সিরিয়াসলি বলছি, কিছু একটা দেয়া উচিত ওদের। দুই ঝগড়ুটে এক ছাদের নিচে থাকতে রাজি হয়েছে, ভাবা যায়? স্পেশাল কিছু তো দিতেই হয়।’

দু’জনে মিলেই ভাবছিল, কী গিফট দেয়া যায়! এরমধ্যেই রূপকথার ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই দেখল, প্রাণেশা লিখেছে –

‘থ্যাংক ইউ, ভাবী। থ্যাংক ইউ সো মাচ্। তোমার এই সুইট সুইট কাজের জন্য একটা উড়ন্ত চুম্মাহ।’

রূপকথা অবাক হলো। রিপ্লাইতে লিখল,
‘তুই জানলি কী করে?’

‘মা বলেছে।’

প্রাণেশার ম্যাসেজ আরিয়ানও দেখেছে। সে বউয়ের ঠোঁটের কোণের হাসি দেখে বলল,
‘ননদিনীর কাছে থেকে একটা চুমু পেয়েই এত খুশি? আমার থেকে চাও না?’

ফোন বিছানায় রেখে আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরল রূপকথা। মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
‘তোমার থেকে একটা নয়, বেহিসাবী চুমু চাই। একদিন নয়, সারাজীবন চাই। সময়ে-অসময়ে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, কারণ-অকারণে চাই। তুমি কিপটামি করলেও আমি মানব না। একদিন মিস করলে পরেরদিন ঠিকই আমি, আমার সব অধিকার ও ভালোবাসা সুদে-আসলে আদায় করে নেব। বুঝেছ?’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে