প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০১

0
256

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
ক্যাটাগরি : কমেডি, রোমান্টিক
পর্ব – ১

‘আমার বউ তুই। আমার বউকে দিয়ে আমি যা খুশি তা-ই করাবো তাতে তোর কী? তুই এখন আমার রুম গোছাবি, ফ্লোর মুছবি, বিছানার চাদর পাল্টাবি। সবশেষে ওয়াশরুম পরিষ্কার করবি। বুঝতে পারছিস? যদি না করিস, বাসরঘর ছেড়ে আজ রাতের জন্য আমি নাইটক্লাবে চলে যাব। একশো মেয়ের সাথে নাচব। কথা ক্লিয়ার না কি ভেজাল আছে?’

রাগে কিড়মিড় করতে করতে আঙুলে বারকয়েক তুড়ি মেরে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী প্রাণেশাকে কথাগুলো বলে অক্ষম আক্রোশে ফেটে পড়ল অনির্বাণ। যুতমতো বকতে না পারার কারণে মেজাজ কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেল। কাজ দিয়েছে মাত্রই, সেটা না করে নবপরিণীতা তার সাথে তর্কাতর্কি করছে। মানা যায়? এমন বদ কিসিমের মেয়েকে কেন ‘কবুল’ বলে বিয়ে করল, এটাই এখন তার আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াল। প্রাণেশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অনির্বাণের চোখমুখে রাগ ও হিংস্রতা ফুটে উঠতে দেখল। স্বামী নামক প্রাণীটির কথাগুলো হজম করতে পারল না বিধায় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠে বলল,

‘তোমার সাথে বাসর করার জন্য আমি যেন হাত-পা ছুঁড়ে কেঁদে মরছি। বের হও রুম থেকে। কাছে আসবে তো তোমার রুমের সবকিছুকে ফুটবলের মতো পোটলা বানিয়ে লাত্থি দিয়ে গোলগোল খেলব।’

একেই তো মাথায় ভেতরে থাকা মগজটুকু ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগ টগবগ করে ওথলাচ্ছে, প্রাণেশার কথায় সেটুকু যেন এখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। মস্তিষ্ক ধিকিধিকি করে জ্বলেজ্বলে উঠল। সহ্যের বাইরে চলে গেল সবকিছু। প্রাণেশার এই বেয়াদবি হজম কর‍তে না পেরে অনির্বাণ জোরেশোরে এক লাথি মারল ফ্লোরে। সারাদিনের কথা মনে করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘তোকে আমি কোনোদিন বউ হিসেবে মানব না। তুই একটা বেয়াদব। ডাইনী। কালনাগিনী। শাঁকচুন্নি। শেওড়াগাছের ভূত। সেই ছোটোবেলা থেকে জ্বালাচ্ছিস। তা-ও সুখ পাসনি? এখন আরও জ্বালানোর পায়তারা করছিস? বের হ আমার ঘর থেকে। এক্ষুণি বের হ। ভূতনী কোথাকার।’

‘প্রতি নিঃশ্বাসে যে মিথ্যে বোলো, তোমার লজ্জা হয় না? ছিঃ… একটু আগেই বলেছ, আমি তোমার বউ। বিয়ের পর বউয়েরা স্বামীর ঘরে থাকে। স্বামীর ঘরই তাদের ঘর হয়। যেহেতু আমি তোমার বউ, এই ঘর এখন আমার। এর মালিকানাও আমার। বকাবকি না করে ঘুমোতে দাও। তোমার মতো পালোয়ানের সাথে যুদ্ধ করার মতো অ্যানার্জি আপাতত নেই। ভালোমতো ঘুমোই, সকালে উঠে যুদ্ধ করব। গুড নাইট।’

অনির্বাণ দমে গেল না। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বলল,
‘বউ হওয়ার শখ হয়েছে না? বাসর করবি আমার সাথে? জীবনটা আমার ছ্যাঁড়াবেঁড়া বানিয়ে বউ সেজে থাকতে তোর লজ্জা হলো না? এই ছ্যাঁড়াবেঁড়া জীবন এখন আমি জোড়া লাগাব কী করে?’

‘তোমার ছ্যাঁড়াবেঁড়া জীবন কীভাবে জোড়া লাগাবে সেটা তো তুমি ভালো জানবে। আমি কী করে বলব? আমি কি সূঁই-সুতো যে বলা মাত্রই সেলাই হয়ে জোড়া লাগিয়ে দেব?’

‘উফফ…প্রাণেশা, খামোখা রাগ বাড়াচ্ছিস আমার। যা এখান থেকে।’

‘যাব না। কী করবে? আমি এই ঘরেই ঘুমাব। পারলে আটকে দেখাও।’

কথা শেষ করে জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটল প্রাণেশা। আপাতত যুদ্ধের সমাপ্তি টেনে পরনের বেনারসি পাল্টাতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। কারণ এখন যদি কথার ইতি না টানে, এই যুদ্ধ সকাল পর্যন্ত চলবে। তা-ই বিরতি দিয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে, লেডিস টি’শার্ট ও ট্রাউজার পরে বাইরে এসে দেখল, অনির্বাণ তখনও ঝিম মেরে চেয়ারে বসে আছে। তাকে দেখে অনির্বাণ বলল,

‘তুই আমার ঘর থেকে যা, প্রানেশা। যাওয়ার বেলা তোর কাপড়চোপড়ও নিয়ে যাবি। এইমুহূর্তে তোকে আমার অসহ্য লাগছে। প্লিজ, লিভ…।’

সম্পর্কে দু’জনে চাচাতো ভাই-বোন হলেও বড়ো হয়েছে একসাথে, একই বাড়িতে। সেই সুবাদে রোজ ঝগড়া হতো, তর্কবিতর্ক হতো, কথা কাটাকাটি হতো তবে কখনও গায়ে হাত পর্যন্ত এগোত না। এইদিকটা খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যেত দু’জনে। দু’জনেই ভীষণ ঝগড়ুটে। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয় এদের ঝগড়াঝাটি। তবে বর্তমানের সিচুয়েশনটা সম্পূর্ণ আলাদা। গত দুই বছর ধরে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসার সুবিধায় বাড়ির বাইরে গিয়ে ঢাকা শহরে নিজের আলাদা জগৎ তৈরী করে সেখানেই থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে অনির্বাণ। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাড়ি আসে না। গতকাল এসেছিল, প্রাণেশার বিয়ের খবর শোনে। প্রাণেশা ভীষণ মেজাজী, ঘাড়ত্যাড়া, রগচটা, খামখেয়ালী ও ছন্নছাড়া মেজাজের মেয়ে। জীবনে ঘর-সংসার কী, কেন হয়, এসব নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সারাদিন পুরুষ মানুষের মতো শার্ট-প্যান্ট পরে বাইরে ঘোরাঘুরি করে, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দেয়, ট্যুরে যায়। আলাদা কাজের মধ্যে একটা কাজ করে, নিয়ম করে বিভিন্ন ধরনের চারাগাছ রোপণ করে। ভার্সিটি যাওয়া-আসার পথে রোজ একেকটা ফুলের চারা অথবা ঔষধি গাছ নিয়ে আসে। সেটা বাড়ির আঙিনায় রোপণ করে নিয়মিত তার যত্ন নেয়। এভাবে এই কয়েক বছরে অসংখ্য নাম না জানা ফুলেদের গাছ ও ওষধি গাছে লাগিয়ে বাড়ির আঙিনা সাজিয়ে নিয়েছে সে, একদম নিজের মতো করে। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান এই গাছেদের দিকে। অন্য কোনোদিকে মনোযোগ নেই। দিতেও রাজি নয় সে। ছন্নছাড়া স্বভাবের কারণেই বিয়ের নাম শুনলেই কাজিনদের বলত,

‘দূর বিয়ে করে কী হবে? দেখিস, আমি কোনোদিন বিয়েই করব না। এই গিন্নিপনা আমাকে দিয়ে হবে না।’

প্রাণেশা অনার্স শেষ করেছে কিছুদিন আগে। ভালো রেজাল্টও করেছে। তাই বাড়ির মুরব্বিরা আলাপ-আলোচনা করে তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন তারই প্রিয় বন্ধুটির সাথে। কিন্তু বিয়ের দিন তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু লাপাত্তা। বরের গোষ্ঠীশুদ্ধ সবার ফোন নম্বর একসাথে বন্ধ। কারও সাথেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। এদিকে দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল প্রায়। শেষবেলা ফোন এলো, পাত্র পালিয়েছে তার পছন্দের মানুষকে নিয়ে। সেটা শোনে দুঃখ পেয়ে কেঁদেকেটে গাল ভাসিয়ে দেয়ার বদলে বেনারসি খুলে সমবয়সী ও বয়সে ছোটো সব কাজিনদের নিয়ে উরাধুরা নাচানাচি শুরু করেছিল প্রাণেশা। যেন বিয়ে ভাঙেনি বরং তার রং লেগেছে। বাড়ির সবাই তার এতসব আচরণে রীতিমতো বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। বিয়ে ভাঙলে আশেপাশের মানুষজন খারাপ কথা শুনাবে এইভেবে অনির্বাণের বাবা, প্রাণেশার বাবা, ও বাকি দুই চাচা মিলে নিজেদের সম্মান বাঁচাতে নিজেদের বাড়ির মেজো ছেলে শেখ অনির্বাণ সৈকতের ঘাড়ের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিতে, কোনোপ্রকার পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই, বিয়ে পরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর তাতেই ঘরের প্রত্যেকটা সদস্যের ওপর রেগেমেগে ব্যোম হয়ে গিয়েছিল অনির্বাণ। মুখের ওপর তর্ক করতে পারেনি, বড়ো ভাই, বাবা ও চাচাদের খুব সম্মান করে চলে সে। তাদের কথা মেনে চলার চেষ্টা করে। তাছাড়া বাড়ির সম্মান, বাবা-চাচাদের সম্মান, এসব ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। কবুল বলে প্রাণেশার মতো ঘাড়ত্যাড়া, আধা ব্যাটাছেলে মেয়েকে বউ বানিয়ে নিজের ঘরেই জায়গা দিতে বাধ্য হলো। প্রাণেশা তার থেকে পাঁচ বছরের ছোটো হলেও নিজেকে সে সবসময় বড়ো ও পণ্ডিত দাবী করে। যে মেয়ে ঘর বোঝে না, সংসার বুঝে না, কাছের মানুষদের মূল্য বুঝে না, তাকে বিয়ে করে এখন কপাল চাপড়াতে হচ্ছে তার। সে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলা মানুষ। কোনো ধরনের অসচেতনতা, অকারণ ঝুটঝামেলা, তর্কবিতর্ক পছন্দ করে না। এজন্য ভীড় এড়িয়ে চলে, ঝামেলা এড়িয়ে চলে, একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। অথচ এখন… বাড়ির সবার এই উদ্ভট আচরণ, হুকুম ও প্রাণেশার মেজাজ, একসাথে এতকিছু তার বিরক্তি বাড়িয়ে দিল। কয়েকঘণ্টাতেই অস্থির হয়ে গেল সে। বেয়াদব মেয়েটা কথা এড়িয়ে গেল দেখে বিরক্তির স্বরে অনির্বাণ বলল,

‘আমি তোকে যেতে বলেছি, প্রাণেশা।’

আজকের সারাদিনের ধকলে প্রাণেশা যথেষ্ট ক্লান্ত। তার রুমের সব কাপড়চোপড় এই রুমে এনে সাজানো হয়েছে। কাজিনগুলোই সাজিয়েছে। এগুলো এখন রুমে নিয়ে গিয়ে পূণরায় সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা ঝামেলা। এত কাজ করার শক্তি নেই। করে অভ্যস্ত নয় সে। আপাতত তার বিশ্রাম দরকার। তাই সে হাই তুলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফুলে ফুলে সাজানো বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল। এত হুকুম পালন করা কোনোকালেই অভ্যাসে নেই তার। করতে বাধ্যও নয়। তাই নিজের মর্জি মতো, চোখের ওপর হাত রেখে অনির্বাণকে বলল,

‘বাতি নেভাও।’

অনির্বাণ বিরক্ত হলো। কেউ তার কথা বোঝারই চেষ্টা করছে না। এই মেয়েটাকে কী করে সে বউ হিসেবে মেনে নিবে? কীভাবে সারাজীবন একঘরে থাকবে? এ তো সারাদিন পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে। নাকের ডগায় রাগ ঝুলিয়ে রাখে। সবসময় খিটমিট খিটমিট করে। এত বদরাগী বউ তার কপালে কীভাবে আসলো? তাছাড়া, সম্পর্ক! এগুলোর মূল্য এই মেয়েটা বুঝবে তো? তার কাছে তো সবকিছুই খামখেয়ালী। নয়তো কোনো মেয়ে নিজের বিয়ে ভাঙলে ডিজে গান বাজিয়ে নাচে? পুরোদিনের কথা ভাবতে গিয়ে রাগে সমস্ত শরীরে জ্বলুনি শুরু হলো অনির্বাণের। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,

‘এ্যাই নির্লজ্জ। তুই আমার বিছানায় শুয়েছিস কেন? বললাম না, তোকে আমি বউ হিসেবে মানি না। কথা কানে যায় না? নেমে আয় বিছানা ছেড়ে, নয়তো ভালো হবে না।’

চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘নামব না। কী করবে?’

‘ঘর পরিষ্কার করাবো। এখানে থাকতে হলে ঘর পরিষ্কার করতে হবে। দেখছিস না, চারিদিকে কাঁচাফুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে? চোখ কি কানা? কপালের নিচে থাকা চোখ কি উপরে নিয়ে হাঁটিস? কানি কোথাকার।’

দু’জনার তর্কাতর্কি শুরু হয়েছিল এই ঘর গোছানো নিয়েই। অনির্বাণ রুমে এসে প্রাণেশাকে বলেছিল, সম্পূর্ণ রুম পরিষ্কার করতে। কিন্তু প্রাণেশা শুনেনি। সোজা বারন করে দিয়েছিল। সেই থেকে শুরু হওয়া তর্ক এখনও একই জায়গায় এসে দাঁড়াল দেখে বিরক্ত প্রাণেশা থেতে উঠে বলল,

‘থাকলাম না এখানে। ক্ষতি কী? সকালে উঠে সবাই যখন দেখবে, আমি আমার রুমে ঘুমিয়েছি। বাবা ও চাচ্চুদের হাতের উদোমকেলানি ঘাড়ে নিও। ঠিক আছে?’

অনির্বাণ আঁৎকে উঠল। প্রাণেশা চলে যাচ্ছিল। দরজার কাছে যেতেই হেঁচকা টানে তাকে বিছানায় ফেলে দিল অনির্বাণ। তাড়াহুড়ো করে বলল,

‘তুই এখানেই ঘুমা। পারলে আমার ঘাড়ে উঠে ঘুমা। তা-ও ঘরের বাইরে যাস না।’

নিজের কপাল নিজেই পুড়াল অনির্বাণ। দাঁত কেলিয়ে হাসলো প্রাণেশা। ভুবন জয় করা হাসি। ফুলেভরা বিছানার চাদরটা তুলে অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘সকালে উঠে ধুয়ে দিও এটা। কেমন? পারলে বাড়ির বাকিদের কাপড়চোপড়ও ধুয়ে দিও। মাসশেষে মোটা অংকের টাকা দেব। কাজ করবে আর টাকা দেব না? জানোই তো, এত কিপটামি আমার দ্বারা হয় না। আমি আবার ভীষণ দয়ালু। কারও কষ্ট একদমই সহ্য করতে পারি না।’

অনির্বাণ ঠোঁট কামড়াল শুধু। কী ডেঞ্জারাস মেয়ে! কৌশলে তাকে জব্দ করে নিল। এই বয়সে এসে বাবা ও চাচাদের হাতের উরাধুরা কেলানি খেতে চায় না সে। ছাত্রজীবনে অনেক খেয়েছে। শেষবার খেয়েছিল দশম শ্রেণীতে, টেস্টে ধরা খেয়ে। এরপর প্রিন্সিপালকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কতশত অনুরোধ করে ফাইনাল এ্যাক্সাম দিতে পেরেছিল। বাপরে… কী কেলানিটাই না খেয়েছিল! মনে পড়লে এখনও তার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। সবার একটাই অভিযোগ ছিল, ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া ছেলে কী করে টেস্টে ফেইল করে? তারা কি আর জানত, ওই বয়সে প্রেমের ভূত চেপেছিল মাথায়! যতসব নষ্টের গোড়া তো তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা! আহা, সেকী ভুলা যায়? পিছনের কথাগুলো মনে পড়ে যাওয়াতে দুঃখী দুঃখী চেহারা বানিয়ে চাদরটা ওয়াশরুমে রেখে, ফ্রেশ হয়ে এলো অনির্বাণ। এরমধ্যেই অন্য একটা চাদর বিছানায় বিছিয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে প্রাণেশা। দেখে শরীর জ্বলে উঠল পূণরায়। বলল,

‘তুই চাদর পেলি কোথায়?’

চোখ বন্ধ রেখে প্রাণেশা উত্তর দিল,
‘আলমারি থেকে বের করেছি।’

‘তুই ওটাতে হাত দিয়েছিস? কেন? ওখানে আমার কত ব্যক্তিগত জিনিস রাখা আছে।’

ব্যক্তিগত জিনিস দিয়ে অনির্বাণ কী বুঝিয়েছে সেটা চোখে ভাসাতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল প্রাণেশা। বলল,
‘হ্যাঁ, দেখেছি তোমার ব্যক্তিগত জিনিস।’

প্রাণেশার হাসি দেখে রাগ যেন আরও বেড়ে গেল অনির্বাণের। বলল,
‘হাত দিয়েছিস?’

‘ছিঃ… হাত দিতে যাব কেন?’
নাকমুখ কুঁচকে তাকাল প্রাণেশা। উলটো ঘুরে হাসি আড়াল করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।

অনিবার্ণ বলল,
‘তুই আর ওটাতে হাত দিবি না।’

‘একশোবার দেব।’

‘মাথা ফাটিয়ে ফেলব কিন্তু।’

চট করে বিছানায় উঠে বসল প্রাণেশা। হাতের ইশারায় অনির্বাণকে কাছে ডেকে বলল,
‘ফাটাবে? এসো। এক্ষুণি ফাটাও। এরপর কয়েকমাস জেলে থাকবে। আমি আরামসে এখানে থাকব। হবে না?’

অনির্বাণ ফের বলল,
‘তোকে আমি মেরেই ফেলব।’

‘ভূত হয়ে ঘাড় মটকাব।’

‘উফফ আল্লাহ, এ আমি কার পাল্লায় পড়লাম?’

‘কেন? বেয়াদব, ভূতনী, শাঁকচুন্নি, এসবের পাল্লায়। একটু আগেই না বললে? এরমধ্যেই ভুলে গিয়েছ?’

কপালে হাত দিয়ে বিরক্তিকর ভাব প্রকাশ করল অনির্বাণ। আলমারি লক করে চাবি নিজের কাছে লুকিয়ে ফ্লোরে বিছানা বিছিয়ে একটা বালিশ ও নকশিকাঁথা নিচে ফেলে, বাতি নিভিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বালিশে মাথা ঠেকাল। প্রাণেশা তার এসব কাণ্ডকারখানা দেখে মিটিমিটি হেসে বলল,

‘ভালো করেছ, ফ্লোরে শুয়েছ, এখানে আসলে আমি তোমার ঘাড় মটকেই দিতাম। শেষে দেখা যেত, বাড়ির সবারই ঘাড় আছে শুধু তোমার ঘাড়টাই নেই। হা হা হা…।’

অনির্বাণ কোনো আওয়াজ করল না। ঘুমানোর ভান ধরে চুপ করে পড়ে রইল। প্রাণেশা বালিশে মাথা ঠেকিয়ে অনির্বাণকে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে গুনগুনিয়ে গাইল,

‘তুমি দিও না গো, বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া। আমি বন্ধ ঘরে, অন্ধকারে, যাব মরিয়া।’

গান গেয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনল প্রাণেশা, টের পেল কিছুক্ষণ পরই। অনির্বাণ সোজা হয়ে বসে আবছা আলোতে প্রথমে তার পরিণীতাকে দেখল। এরপর বাতি জ্বেলে ঘোরলাগা চোখে চেয়ে চেয়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,

‘পরের লাইনটা যেন কী?’

প্রাণেশা পরের লাইন মনে করার চেষ্টা করল। এরমধ্যেই অনির্বাণ বলল,
‘মনে পড়ছে না?’

ভয়মিশ্রিত মনে দু’দিকে মাথা নাড়ল প্রাণেশা। অনির্বাণ চোরা হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বিছানায় হাত রেখে প্রাণেশার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘তুমি ভয় কেন পাও, প্রাণসজনী আমায় দেখিয়া। তোমায় প্রেম সোহাগে রাখব আমার বুকে জড়াইয়া।’

প্রাণেশা ঢোক গিলল। হাতের আলতো ছোঁয়াতে অনির্বাণকে ছুঁয়ে দূরে সরানোর চেষ্টায় বলল,
‘না… প্লিজ। দূরে যাও। আ… আমি ঠিক আছি। আমার ভয় লাগছে না। তুমি বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ো।’

অনির্বাণ দূরে গেল না। আরও কাছে এসে আঙুলের আলতো স্পর্শে প্রাণেশার লাল হয়ে যাওয়া গাল ছুঁয়ে চোখেমুখে ফুঁ দিয়ে বলল,

‘তুই-ই তো কাছে ডাকলি। দূরে যা-ই কী করে বল?’

‘প্লিজ… তোমার দোহাই লাগে। তুমি যাও।’

‘উঁহুম… যাব না। আজ তো আমাদের বাসর। ইশারায় যখন কাছে ডাকছিসই, আদরটা শুরু করতেই পারি। কী বলিস?’

‘প্লিজ… মেজো ভাইয়া। যাও…।’

‘ভাইয়া?’

প্রাণেশা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
‘ভাইয়া’ই তো ছিলে।’

‘এখন তো আর ভাইয়া নই। একান্তই ব্যক্তিগত মানুষ হয়ে গেছি। ফের ভাইয়া ডাকলে তোর ঠোঁটদুটো আমি সেলাই করে দেব, প্রাণ…।’

‘তুমি দূরে যাও, প্লিজ।’

‘দূরে যাওয়ার মুডে নেই আপাতত। আমি এখন রোমান্সের মুডে আছি।’

অনির্বাণ আরেকটু কাছে এগোলে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল প্রাণেশা। পরক্ষণেই চিন্তাভাবনা করে ফেলল কিছু। যখন দুজনের মাঝখানে একইঞ্চি সমান দূরত্ব রইল না, তখনই দু’হাতে অনির্বাণের চুল ধরে ঝাঁকুনি দিল। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল অনির্বাণ। জোরপূর্বক হাত ছাড়িয়ে নিতেই দেখল, কতগুলো ছোটো ছোটো চুল প্রাণেশার হাতের মুঠোতে। চুমুর বদলে চুল ছেঁড়া! রেগেমেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রাণেশা রুমের দরজা খুলে বাইরে দৌড় দিল। দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার দিয়ে বলল,

‘বাবা গো, মা গো, কে কোথায় আছো গো, জলদি এসো। আমার ঘরে ডাকাত এসেছে। ও মা, ও বাবা… আমাকে বাঁচাও। হতচ্ছাড়া ডাকাত আমায় মেরে ফেলল রে…।’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে