প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
2082

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_২৩
#তানজিলা_খাতুন_তানু

মানুষটিকে দেখে অতসী চমকে উঠল। মানুষটি আরো কিছু বলার আগেই অতসী ওনার হাত ধরে রির্সোটের পেছন দিকে নিয়ে চলে আসলো।

– আরে কি করছিস তুই এইসব।
– আসতে নিলয়’দা, কেউ শুনে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
– কি বলছিস এসব তুই। আর তুই এইখানে কেন?
– আমার কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো, তুমি কবে দেশে ফিরলে?
– দুইমাস মতো হবে।

নিলয় আরো কিছু প্রশ্ন করত যাবে,তার আগে অতসী বলে উঠল..
– রির্সোটে কি করছ তুমি?
– আসলে মিষ্টার শেখ বাপির খুব ভালো বন্ধু তার মেয়ের বিয়েতেই এসেছি।
– জিনিয়া!
– হুমম, কিন্তু তুই এইখানে কেন?
– সে অনেক কথা, পড়ে সময় করে সবটা বলবো। তবে আমাকে একটা কথা দিতে হবে তোমাকে।
– কি কথা।
– তুমি আমাকে চেনো, এই কথাটা কাউকে বলা যাবে না।
– কিন্তু কেন?
– সব কেন ওর উত্তর হয় না নিলয়’দা। প্লিজ, যদি সত্যি আমাকে বোন বলে মনে করে থাকো তাহলে আমাকে চেনো বা আমার বিষয়কে কাউকে কিছু বলবে না। কাউকে মানে কাউকেই না।

নিলয় প্রচন্ড রকমের অবাক হলো অতসীর কথা শুনে। কিন্তু ভালো করেই বুঝল, নিদিষ্ট কিছু কারনেই অতসী ওকে বারন করছে। তাই অতসী কে আশ্বাস দিয়ে বলল…

– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কাউকেই কিছু বলব না।
– থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
– ওয়েলকাম বোনু।

অতসীর মুখে হাসি ফুটে উঠল, সেটা দেখে আমান ওহ হাসল। মেয়েটাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে, নিজের বোন না থাকার অভাবটা ওকে দিয়েই পূরন করতে চাই।

– আমি তাহলে আসছি।
– কোথায় যাবি।
– এইখানেই থাকব, এই বিয়ে বাড়িতেই। জিনিয়া আমার বান্ধবী হয়।
– ওহ্।

অতসী রির্সোট পেছন থেকে সামনের দিকে এসে, একজনকে বলল…
– জিনিয়াকে একবার ডেকে দেবে একটু।
– আচ্ছা।

অতসী জিনিয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। জিনিয়া যখন শুনলে একজন মেয়ে ওর খোঁজ করছে, ওর বুঝতে অসুবিধা হলো না অতসী এসেছে। তাড়াতাড়ি অতসীর‌ কাছে আসলো।

– ফাইনালি তুই আসলি। আমি খুব খুশি হয়েছি।
– হুমম।

জিনিয়া প্রচন্ড খুশি হয়ে অতসীর সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দেয়।

– অতসী উনি হলেন মিহানের মা। আর আন্টি ওহ আমার বন্ধু অতসী।
– অতসী!
– হুম।

অতসী নামটা শুনে উনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে অতসীর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন । আর নিজের মনে মনেই বলে উঠলেন…

– এই কি সেই অতসী। যাকে মিহান ভালোবাসত।

সকলের সাথে আলাপ করার সময়ে, অতসী আর মিহান দুজন দুজনের মুখোমুখি হয়। মিহান একপলক অতসী কে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়। তবে যেটুকু সময় তাকিয়ে ছিল, সেইটুকু সময়েই ওর চোখ অতসী কে অনেক কিছুই জানান দিচ্ছিল।

বিয়ে বাড়িতে অনেক ভীড়, অতসী মিহানের সাথে মুখোমুখি হবার সুযোগ পাচ্ছে না। একটু পরেই মেহেন্দির অনুষ্ঠান শুরু হবে। জিনিয়াকে রেডি করিয়ে দেবার ভার পড়েছে অতসীর কাঁধে। অতসী মেহেন্দি রঙের একটা লেহেঙ্গা পড়িয়ে জিনিয়াকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল।

– কি সুন্দর লাগছে তোকে।
– তুই রেডি হবি না?
– হুমম হবো। তোর হাতে মেহেন্দি করিয়ে দেবে কে?
– কেন তুই।
– আমি!
– হুমম।
– কিন্তু আমি তো পারি না।
– যা পারিস সেটাই করবো। চল এইবার।

জিনিয়া জোড় করেই অতসী কে মেহেন্দি করতে বসায়। অতসী নিজের মনের মতো করে মেহেন্দি করিয়ে দেয়, এবং মেহেন্দির মাঝে ছোট করে মিহান নামটা লিখে দেয়। জিনিয়ার কাজিন, মিহানের কাজিনরা সকলে মিলে নাচ-গান আনন্দ করছে। সকলেই খুব খুশি। অতসী দূরে দাঁড়িয়ে জিনিয়ার হাসি মুখের দিকে তাকাল, তারপর রির্সোটের ছাদে চলে যায়। ওহ ভালো করেই জানে, মিহান এইখানেই থাকবে।

– মিহান।

অতসীর মুখে নিজের নাম শুনে মিহান পেছনে ফিরে তাকাল।

– তুমি এইখানে।
– তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– আমার সাথে তোমার কি কথা।
– আমাকে সবটা বলো মিহান।
– কি বলবো।
– তোমার এই পরির্বতনের কারন কি? হঠাৎ করে বদলে গেলে কেন?
– বাদ দাও না এইসব। তুমি তো আমার কখনোই হবে না,তাহলে এইসব কথা জেনেও কোনো লাভ নেয়।
– লাভ-লোকসান আমি কিছু জানি না মিহান। তবে আমি সবটা জানতে চাই। আর একটা কি জানো, তুমি না বললেও তোমার বিষয়ে জানতে আমার বেশি সময় লাগবে না। তবুও আমি চাইছি সবকিছু তোমার মুখ থেকে শুনতে।
– আমি তোমাকে কোনো কিছু বলবো না অতসী। তোমার কোনো অধিকার নেয়, আমার বিষয়ে কিছু জানতে চাওয়ার।
– মিহান প্লিজ। আমি রিকুয়েস্ট করছি, কি হয়েছে সবটা বলো আমাকে।
– বললে কি তুমি আমার জীবনে ফিরবে!

অতসী আর কিছুই বলতে পারল না। মিহান আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে বলল…

– কোনো করুনা আমার চাই না অতসী। তুমি যদি আমাকে চাইতে, আমার হাতটা ধরে রাখতে পারতেন তাহলে আমি তোমাকে সবটা বলতাম। কিন্তু সেটা কখনোই হবে না,তাই আমার জীবন নিয়ে তোমাকে কিছুই জানতে হবে না। নিজের লাইফটাকে গুছিয়ে নাও অতসী। আমার কথা চিন্তা করো না।

মিহান চোখের কোনে পানি নিয়ে চলে যায়। অতসীর বারবার মনে হচ্ছে, একটা অনেক বড়ো ভুল হয়ে যাচ্ছে, মিহান আর জিনিয়ার সাথে অন্যায় হচ্ছে। কিন্তু কি সেটা সেটাই বুঝতে পারছে না। অতসী সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, তখনি মিহানের মা পেছন থেকে বলে উঠলেন…

– সবকিছু জানার আগ্রহ কখনো কখনো মানুষের বিপদ ডেকে আনে সেটা কি জানো।
– মানে?
– সবকিছু জানতে নেয়। আর সবকিছু জানার চেষ্টাও করতে নেয়।
– আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যা বলার ক্লিয়ার করে বলুন।
– তুমি সেই মেয়ে না, যার সাথে মিহানের রিলেশন ছিল।
– হুম।
-প্রাক্তনের বিয়েতে আসতে একটুও লজ্জা লাগলো না তোমার। আর তোমার আবার লজ্জা, লো ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে হলে আর যা হয়। (কথাটা বলেই তাচ্ছিল্যের হাসলেন উনি। )

কথাগুলো শুনে অতসীর রাগ আকাশ ছোঁয়া। তবে তার শিক্ষা নেয়, গুরুজনদের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলার। তাই শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,

– ক্লাস দিয়ে কোনো কিছুই যায় আসে না ম্যাডাম। আর তার সবথেকে বড়ো উদাহরণ হলেন মেয়ের আপনি।
– মানে কি বলতে চাইছ তুমি।
– ওই যে, আপনি হাই ক্লাসের হাই মানুষ তবুও আপনার মানসিকতাটা না একদম লো ক্লাস।

অতসীর কথা শুনে মিহানের মা একদম তেঁতে উঠল, উচ্চস্বরে বলে উঠল,
– হাউ ডেয়ার ইউ।

অতসী বাঁকা হেসে বলল,
– ডেয়ারটা আমার একটু বেশিই ম্যাডাম।আমাকে অপমান করতে আসবেন না। মানুষকে তার ক্লাস দেখে নয় তার মানসিকতা দেখে বিচার করবেন, তাহলে দেখবেন সম্মান পাচ্ছেন।

কথাটা বলে অতসী স্থান ত্যাগ করতে যাবে, তার আগে উনি বলে উঠলেন..

– তোমার মানসিকতা কতটা ভালো, সেটা ভালো করেই জানা আছে আমার। যেই দেখেছ মিহান বড়োলোকের ছেলে এমনি ওর গলাতে ঝুলে পড়তে চাইছিলে। ভাগ্য ভালো আমার ছেলেটা তোমার ফাঁদে পা দেয়নি।

অতসী এতক্ষন সবটা সহ্য করে শান্ত থাকলেও আর পারল না। ওহ ভালো করেই বুঝে গেছে, মিহানের মা মোটেও ভালো কথা শোনার মানুষ না। উনি যেরকম ওনার সাথে ঠিক সেইভাবেই কথা বলতে হবে। তাই অতসী আর একটু আগিয়ে গিয়ে মিহানের মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর ওনার চোখে চোখ রেখে বলল…

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_২৪
#তানজিলা_খাতুন_তানু

অতসী তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল,
– টাকার গরম আমাকে দেখাবেন না ম্যাডাম। অতসী খাঁন টাকার ধার ধারে না। আর আপনার ছেলে ঠিক কার ফাঁদে পা দিয়েছে আর ফাঁদে পা দেয়নি সেটা জানতেও না আমার বেশি সময় লাগবে না।

মিহানের মা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
– তুমি কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছ!
– আরে আমি কেন আপনাকে থ্রেট দিতে যাবো কেন, আমি তো শুধু কথার কথা বলেছি। আপনার এত গায়ে লাগছে কেন! তাহলে কি আপনি কোনো অন্যায় করেছেন?

অতসীর কথা শুনে মিহানের মা ঘামতে শুরু করল, তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে যেতে চাইল, এতে অতসীর সন্দেহ আরো গভীর হয়ে গেল।

– আরে কোথায় যাচ্ছেন।
– আমার কাজ আছে।
– পালিয়ে যাচ্ছেন!
– আরে পালাতে যাবো কেন?
– না এমনি বললাম। আর একটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি।
– কি?
– অতসী কখনোই কোনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি, আর করবেও না। তাই একটু সাবধানে থাকবেন কেমন।

অতসী ভাব নিয়ে চলে যায়। মিহানের মা অতসীর যাবার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল…
– এই মেয়েকে যতটা নরম ভেবেছিলাম তার থেকে কয়েকগুন বেশিই শক্ত। একে মোটেও সুবিধার লাগছে না,সাবধানে থাকতে হবে।

অতসী সোজা জিনিয়ার কাছে গিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল। তবে মনের মাঝে একটা খুঁতখুঁতে ভাব রয়েই গেল।

পরেরদিন..

বিয়ের আমেজ সকলেই খুব খুশি। জিনিয়াকে পার্লারের মেয়েরা এসে সাজিয়ে দিয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে। অতসী জিনিয়ার কাছে গিয়ে রুমের সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,

– জিনিয়ার সাথে আমার একটু কথা আছে। আপনারা যদি একটু বাইরে যেতেন।

জিনিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করতেই সকলে বেড়িয়ে গেল। জিনিয়া অতসীর দিকে তাকিয়ে বলল,

– কি বলবি আমাকে।

অতসী জিনিয়ার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,
– আমার তরফ থেকে তোর জন্য একটা ছোট্ট গিফট।
– এইসবের কোনো দরকার ছিল না।
– না দরকার ছিল।

জিনিয়া মুচকি হেসে প্যাকেটটা খুলতে লাগল। প্যাকেটের ভেতরে একটা বক্স ছিল, জিনিয়া বক্সটা খুলে দেখল একটা কানের ঝুমকো। জিনিয়া কানের ঝুমকোটা দেখে অবাক হয়ে বলল..

– এটা তো সুন্দর। আর দেখে তো‌ সোনার মনে হচ্ছে, এটা তুই কোথায় পেলি।

অতসী মুচকি হেসে বলল…

– তোর পছন্দ হয়েছে এটাই অনেক। আর বেশি কিছু জানতে নেয় তোকে।

অতসী জিনিয়াকে নিয়ে বিয়ের এইখানে যায়। মিহান বিয়ের সাজে কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে। জিনিয়াকে নিয়ে যেতেই সকলে চেঁচিয়ে উঠল, মিহান মাথা তুলে তাকিয়ে অতসীর দিকে তাকালো। হাসি মুখে অতসীকে খুব সুন্দর লাগছে, মিহান একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। ওর দিকে তাকানোর অধিকার যে ওর নেয়।

জিনিয়াকে বসানো হয়েছে। কলেজের অনেকেই এসেছে। শাহানা, মিতু সকলেই এসেছ। অতসীর পরনের শাড়িটা দেখে শাহানার বান্ধবী বলল…

– অতসীর গায়ের শাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে অনেক দামী। কি ব্যাপার বল তো।

শাহানা ভাবুক হয়ে বলে উঠলো…
– আমিও তো কিছুই বুঝতে পারছি না। অতসীর বিষয়টা কিরকম একটা গন্ডগোল লাগছে আমার।
– শাহানা তোর প্ল্যান তো কিছুই সাকসেসফুল হলো‌না।
– হুম। আমি তো চেয়েছিলাম আমার কেনা শাড়ি, লেহেঙ্গা পড়িয়ে অতসী কে অপমান করবো সবার সামনে। আমার দানের জিনিস পড়ে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। কিন্তু কিছুই হলো‌ না, অতসী সব প্ল্যানে পানি ঢেলে দিলো।
– হুম।

শাহানা ভেবেছিল অতসীর কাছে টাকা নেয়, ভালো কাপড় নেয়, ভালো কাপড় পড়ে আসতে পারবে না। শাহানা ওকে কাপড় দিয়ে সকলের কাছে নানান ভাবে অপমান করার উদ্দেশ্যে ছিল ওর। তবে তার কিছুই হয়ে উঠল না।

মিতু ফোনে কথা বলতে বলতে যাবার সময়ে কারোর সাথে ধাক্কা লেগে যায়। মিতু পড়ে যেতে গেলে নিলয় ওকে ধরে নেয়। মিতু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিলয়ের উদ্দেশ্য বলল..

– থ্যাঙ্ক ইউ।
– মোস্ট ওয়েলকাম ম্যাম।

মিতু মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে যায়। নিলয় ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল…

– হাসিটা একদম বুকে গিয়ে লাগল, ইশ্।

তখনি নিলয়ের কাঁধে কেউ হাত দিলো। নিলয় পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল, অতসী কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিলয় ওর দিকে তাকাতেই অতসী ভ্রু নাচিয়ে বলল…

– খবরটা কি। প্রেমে পড়লে নাকি!

নিলয় মাথা চুলকে হেসে উঠলো। অতসী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। নিলয় সেইদিকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। অতসী নিলয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল….

– হয়ে গেলো। আবার একজন প্রেমে পড়ে গেল,শুধু আমিই সিঙ্গেল হয়ে রইলাম।

অতসী আর শাহানা আবারো মুখোমুখি হলো। শাহানা ইচ্ছাকৃত ভাবেই অতসী কে খোঁচা মারতে শুরু করল।

– অতসী এত দামী শাড়ি পেলি কোথায়?

অতসী শাহানার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যাবে তখনি শাহানা আবারো বলে উঠল…

– কোনো বড়োলোক বাবার ছেলের গলাতে ঝুলে পড়লি নাকি। তার কাছ থেকেই বুঝি এত টাকা আসছে তোর কাছে।
– অতসী খাঁনের এতটাও খারাপ দিন আসেনি যে, টাকার জন্য কাউকে ব্যবহার করবে।
– তাহলে এত টাকা পাচ্ছিস তুই কোথায়?
– আমি সেই কৈফিয়ত তোকে দেব না আমি। আর আমার কথা তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই তোর চিন্তা কর, আমারটা আমিই ভেব না।

অতসী চলে যায়।‌শাহানা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল
– এর এতো তেজ কোথা থেকে আসছে!

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মিহান আর জিনিয়ার বিয়ের সময় শুরু হয়। তিনবার কবুল বলে মিহান আর জিনিয়ার গাঁটছড়া একসাথে বেঁধে যায়। জিনিয়ার চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

– তুই শেষমেশ ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েই গেলি জিনি। যত্ন করে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখিস কেমন।

জিনিয়া অতসী কে জড়িয়ে ধরল। অতসীর চোখ দিয়েও এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

রাতে…

সকলে চলে গেলেও অতসী বিয়ের জায়গাতেই বসে ছিল। ভালো লাগছে না কিছু। অতসীর কাঁধে কেউ একজন হাত রাখল, অতসী পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল নিলয় দাঁড়িয়ে আছে।

– অতু কি হয়েছে আমাকে বলবি না তো।
– কি বলবো নিলয়’দা।
– এতগুলো বছর আমি দেশে ছিলাম না। তোর সাথে কি হয়েছে আমি কিছুই জানি না। আমাকে না বললে আমি জানব কি করে।
– বাদ দাও না এইসব কথা। আঙ্কেল আজকে আসলো না কেন?
– কালকে আসবে, তোর সাথে দেখাও হয়ে যাবে। তখন কি পারবি বাপির কাছ থেকে সবটা লুকিয়ে রাখতে।

অতসী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যি জানা নেয়, কতদিন আর নিজের অতীত সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে। নিলয় ভালো করেই বুঝল, এই চাপা স্বভাবের মেয়ের কাছ থেকে কিছুই জানতে পারবে না। এই মেয়ে কিছুই বলবে না নিজে থেকে।

ওইদিকে…

ফুলে সাজানো ঘরে জিনিয়া হাজারো স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। ভালোবাসার মানুষটির জন্য অপেক্ষা করে চলেছে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মিহান ঘরে প্রবেশ করলো। জিনিয়া এগিয়ে মিহানকে সালাম করতে গেল, মিহান ওকে বাঁধা দিয়ে বলল…

– এইসবের কোনো দরকার নেয়। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
– আচ্ছা।

জিনিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল, মিহান সোফাতে বসে মাথায় হাত দিয়ে আছে।

– কি হয়েছে মিহান!

মিহান মাথা তুলে তাকিয়ে বলে উঠল…
– তুমি বিছানায় শুয়ে পড়ো, আমি সোফাতেই আছি।
– মানে? এইসব কি বলছো তুমি!

মিহান যে কথাগুলো বলল, তাতে জিনিয়ার পায়ের তলার মাটি সরে গেল।

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_২৫
#তানজিলা_খাতুন_তানু

মিহানের কথাগুলো জিনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কখনোই ভাবতে পারেনি মিহান ওকে ভালোবেসে নয় পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিয়ে করেছে।

– এইসব তুমি কি বলছ মিহান।
– হ্যাঁ সব ঠিক বলছি। আমি কখনোই তোমাকে ভালোবাসি নি। আর বিয়েটা আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই করেছি।
– বাধ্য হয়ে মানে?

মিহান জিনিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
– জিনিয়া আমাকে মাফ করে দিও। আর পাঁচটা স্বামী -স্ত্রীর মতো সম্পর্কটা আমি করতে পারব না।
– তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন?
– ওই যে বললাম পরিস্থিতি।
– কিসের পরিস্থিতি। যদি নাই বা ভালোবাসতে তাহলে কেন এত স্বপ্ন দেখিয়েছিলে, আমার জীবনটা এইভাবে নষ্ট করে দিলে কেন।

মিহান কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে বসে আছে। জিনিয়া কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মিহানের সবকিছুই কিরকম বিরক্ত লাগছে, মনে হচ্ছে জিনিয়াও নাটক করছে। সহ্য হচ্ছে না কোনো কিছু। মিহান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জিনিয়া মিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল…

– কোন অপরাধের শাস্তি পাচ্ছি আমি। ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েও যে পেলাম না আমি।

মিহান যাবার মতো কোনো জায়গা পেল না তাই ছাদের উদ্দেশ্যেই রওনা দিলো। ছাদে উঠে দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর মেয়েটাকে অনেকটা অতসীর মতো লাগছে। মিহানের ভালো লাগছিল না,তাই পেছন ফিরে চলে যেতে যাবে তখনি অতসী বলে উঠল…

– আবার পালিয়ে যাচ্ছো মিহান।

মিহান পেছনে ঘুরে তাকালো না, ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। অতসী মিহানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো…

– জিনিয়াকে একে রেখে তুমি ছাদে কি করছ? আজকে তো তোমাদের বাসর রাত।
– যে বিয়েটাই মানি না তার আবার বাসর রাত।

তাচ্ছিল্যের হেসে উত্তর দিলো মিহান।

– পাগলামী করো‌ না মিহান। জিনিয়া তোমার স্ত্রী।

মিহান গর্জে উঠে বলে উঠল…
– মানি না আমি এই বিয়ে।
– মিহান।

অতসী চমকে উঠছে মিহানের এই রূপ দেখে। এতদিন মিহান কে চেনে তবে কোনো দিন মিহান কে এতটা রেগে যেতে দেখেনি। মিহান রাগে চোখ লাল করে অতসীর দুই কাঁধ ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল…

– আমিও মানুষ অতসী, আমিও মানুষ। আমারও কষ্ট হয়, বড্ড কষ্ট হয়। জীবনে যা যা চেয়েছি কখনোই সেটা পাইনি। নিজের প্রিয় মানুষগুলো সবসময়েই আমাকে ছেড়ে চলে যায়, আমি আর পারছি না আমার দমবন্ধ লাগছে অতসী।
– মিহান শান্ত হও। কি হয়েছে আমাকে সবটা বলো।

মিহান অতসী কে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল…
– রাত হয়েছে অনেক। তুমি ঘরে যাও।

মিহান ছাদের কিনারে গিয়ে সিগারেট ধরালো। যন্ত্রনাগুলো কখনোই পেছন ছাড়তেই চাই না। অতসীর কিছু একটা মনে পড়াতে তাড়াতাড়ি করে জিনিয়ার ঘরের দিকে রওনা দিলো।

জিনিয়া মেঝেতে বসে কেঁদে চলেছে, অতসী ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে ওর সামনে বসে বলল…

– এই জিনি কি হয়েছে কাদছিস কেন?

অতসীর কন্ঠস্বর শুনে জিনিয়া মাথা তুলে তাকিয়ে ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।‌ অতসী বুঝল, মিহানের কান্ডে জিনিয়া আঘাত পেয়েছে।

জিনিয়াকে শান্ত করে অতসী বলল…

– কি হয়েছে সবটা বল আমাকে।

জিনিয়া অতসী কে সবটা বলল। অতসী ঠাঁই বসে রইল, ভাবতেই পারেনি মিহান সরাসরি কথাগুলো জিনিয়াকে বলবে।

– আমি তোকে ঠকিয়ে মিহান কে কেড়ে নিয়েছিলাম তাই হয়তো আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমাকে মাফ করে দিস অতসী।

অতসী জিনিয়াকে আবারো জড়িয়ে ধরে বলল..
– তোর আর মিহানের প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেয়। আমি চাই তোরা দুজন একসাথে খুব ভালো থাক।

জিনিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অতসী ওকে শান্ত করে, ঘুম পাড়িয়ে দিলো। জিনিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অতসী চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগল, মিহানের কথাগুলো। অতসী ভালো করেই বুঝতে পারল, মিহান নিজে থেকে ওকে কিছুই বলবে না।

পরেরদিন…

জিনিয়ার প্রচন্ড মন খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। অতসী জিনিয়ার কাছে গিয়ে বলল…

– জিনি, তোর আর মিহানের ঝামেলার বিষয়ে কাউকে কিছু বুঝতে দিস না। বিষয়টি সবাই জানলে আরো ঝামেলার সৃষ্টি হবে।
– হুমম।
– নিজেকে স্বাভাবিক কর।

অতসীর কথা শুনে, সকলের কথা চিন্তা করে জিনিয়া স্বাভাবিক হলো। মুখের কোনে মেকি হাসি ফুটিয়ে তুললো। আজকে বৌভাতের অনুষ্ঠান, আগামীকালের থেকে বেশি লোকজন এসেছে। জিনিয়া স্টেজে পুতুলের মতো বসে আছে, কারোর সাথে কথা বলতে গেলে মেকি হাসি ফুটিয়ে তুলছে। যদিও বিষয়টি অতসী ছাড়া কেউই বুঝতে পারল না। অতসী জিনিয়ার মেকি হাসির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল..

– আমরা প্রতিটা মানুষই কতই না নিখুঁত অভিনেতা। বুকের মাঝে যতই কষ্ট থাকুক না কেন আমরা কখনোই কাউকে বুঝতে দিইনা। এমন একটা ভাব করে যেন কতই না হ্যাপি আছি।

অতসীর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তবুও অভিনয় করে যেতেই হচ্ছে। কষ্টগুলো কখনোই কারোর সাথে শেয়ার করতে পারেনি, তাই তো গুমরে গুমরে ম’রে।

বৌভাতের অনুষ্ঠানে মিতুও এসেছে। মিতু অতসীর পাশে দাঁড়িয়ে বলল..

– কেমন আছো অতসী?
– হুম ভালো তুমি।
– হুম ভালো।
– মিষ্টিবুড়ি কেমন আছে?
– হুম আছে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।
– ওহ।

মিতু কিছু একটা বলবে বলে উশখুশ করে চলেছে, কিন্তু বলতে পারছে না। অতসী সেটা বুঝতে পেরে বলল…

– কিছু কি বলবে?
– হুম।
– বলো।
– একটা কথা তোমাকে জানানোর ছিল।
– কি কথা।
– দাদাভাইয়ের বিয়ের কথা চলছে। মা চাইছে দাদাভাইয়ের বিয়ে দিতে।

কথাটা শুনে অতসী একটা ধাক্কা খেল। তবুও মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল…
– ভালো খবর তো। মিষ্টিবুড়ি একটা মা পাবে।

অতসীর কথা শুনে মিতু আহত হলো। অতসীর কাছ থেকে অন্য কিছু কথা আশা করেছিল, কিন্তু সেটা না হওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অতসীর ডাক পড়াতে অতসী মিতুর কাছ থেকে চলে যায়। মিতু মনে মনে বলল…

– যেটার জন্য এতকিছু করলাম, সেটা কি আদৌও সম্ভব হবে!

অতসী জিনিয়ার কাছে যেতেই জিনিয়া করুন কন্ঠে বলল…

– অতসী আমি আর মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে থাকতে পারছি না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
– তাহলে আমি এতগুলো বছর কিভাবে আছি! (বিরবির করে)
– কিছু বললি ‌
– না। একটু সহ্য কর, আর কি করবি।
– হুম।

অতসী জিনিয়াকে বুঝিয়ে স্টেজ থেকে নামবে তখনি মিহানের সাথে দেখা হলো। উনি বাঁকা হেসে বললেন..

– শেষমেশ মিহান আর জিনিয়ার বিয়ে হয়েই গেল। তুমি কিছুই করতে পারলে না।
– করার ইচ্ছা থাকলে অনেককিছুই করতে পারতাম। আমি যদি একবার হ্যাঁ বলতাম,তাহলে মিহান কখনোই এই বিয়েটা করত না। কিন্তু আমি সেটা করিনি, আমি চেয়েছিলাম মিহান আর জিনিয়া ভালো থাকুক। তবে আপনি আপনার ছেলের জীবনটা নিজের হাতে শেষ করে দিচ্ছেন, সেটা কিন্তু আমি বুঝে গেছি।

অতসীর শেষ কথাটা শুনে মিহানের মা একটু ঘাবড়ে যায়।

– কি বলতে চাইছ তুমি।
– মিহানের হঠাৎ পরির্বতন হয়ে যাওয়ার কারনটা কিছুটা আমার কাছে পরিস্কার।

মিহানের মা বুঝতে পারেনি, মিহানের বিয়ে পরেও অতসী বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি করবে।

– এইসবের মধ্যে একদম আসতে যেয়ো না অতসী।
– আমি যে না চাইতেও সবটার সাথে জড়িয়ে গেছি, তাই এখন আর কিছুই করার নেই। সবটা না জানা পর্যন্ত আমি সরছি না।
– কি চাও তুমি।
– সত্যিটা জানতে।
– কত টাকা দিলে তুমি এইসব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে বলো।
– আমি আগেও বলেছি আবার এখনও বলছি আমাকে টাকার গরম দেখাবেন না একদম।

মিহানের মা আরো কিছু বলতে যাবে,তখনি পাশ থেকে একজন বলে উঠল…

– আরে মামনি তুই এইখানে?

অতসী ও মিহানের মা দুজনেই ওনার দিকে তাকালো। মানুষটির চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় ও আনন্দের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। অপর দিকে অতসীর মুখ ভীত হয়ে আছে, নিজের অতীত সামনে আসার ভয় পাচ্ছে অতসী। আর মিহানের মা কিছুই না বুঝে দুজনেরই মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা বোঝার চেষ্টা করছে।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে