#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_১৪
#তানজিলা_খাতুন_তানু
আদৃতের কথা শুনে সকলেই ওর দিকে তাকাল। আদৃত সকলের তাকানো দেখে বলল..
– আজকে অতসী একটা বড়ো এ*ক্সিডে*ন্টের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
– কি বলছিল দাদাভাই এসব। (মিতু)
আদৃত সংক্ষেপে সবটা বলল সবাইকে। আদৃতের মায়ের বুকটা কেঁপে উঠল, অতসী কে আদর করে জড়িয়ে ধরলেন।
– একটু দেখে চলবি না। যদি কিছু হয়ে যেত।
আদৃতের মায়ের কথা শুনে অতসীর চোখ ভরে আসলো। চোখ দুটো পানিতে চিকচিক করতে দেখে আদৃতের মা বলল…
– আরে কি হলো, তোর চোখে পানি কেন?
– কতদিন পর কেউ এইভাবে শাসন করল।
– পাগলি মেয়ে একটা। আমি তো তোর মায়ের মতোই, আজ থেকে তুই আমাকে মামনি বলবি ঠিক আছে।
– আচ্ছা।
আদৃত ওদের ভালোবাসা দেখে মুচকি হেসে বলল….
– মা ওকে নিয়ে ভেতরে যাও। আর ওর জন্য কিছু খাবার ব্যবস্থা করো। ডাক্তার বলেছে অত্যাধিক চিন্তা, মানসিক চাপ আর অনেকক্ষন কিছু না খেয়ে থাকার জন্য অজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
মিতু অতসীর খাবার ব্যবস্থা করল। আদৃতের মা এমনিতেই অতসী কে পছন্দ করত, আজকে আরো আপন করে নিলেন। অতসী প্রথমে রাজি ছিল না এই বাড়িতে থাকার জন্য, আদৃতের মায়ের কথা আর আরুর জেদের বশে অতসী শেষে থাকতে রাজি হয়ে যায়।
অতসীর জন্য একটা ঘর খুলে দিলো। বাড়িতে অনেকগুলো রুম, বেশি কেউ থাকে না বলে রুমগুলো প্রায় সময়েই ফাঁকাই থাকে। অতসী রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। তখনি আদৃত দরজায় কড়া নাড়ল।
– আরে আপনি আসুন।
আদৃত ভেতরে আসলো না, দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বলল…
– রুমটাতে কেউ থাকত না বলে বেশি কিছু দিয়ে সাজানো নেয়। আপনি আপনার মতো করে সাজিয়ে নেবেন,আর কিছুর প্রয়োজন পড়লে বলবেন আমি এনে দেব। আর একটা কথা, মিতুকে নিয়ে গিয়ে আপনার দরকারি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে আসবেন আর ওই বাড়ির ভাড়াটা দিয়ে আসবেন।
একদমে কথাগুলো বলে আদৃত চলে যেতে যাবে, তখনি অতসী বলল…
– আমার একটা কথা ছিল।
– কি?
– আমি কিন্তু এই বাড়িতে এমনি এমনি থাকতে পারব না।
– মানে?
– ভাড়া নিতে হবে।
আদৃত অতসীর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
– কি বলছেন আপনি এইসব।
– ঠিক বলছি। যদি ভাড়া নেন তবেই আমি থাকব নাহলে নয়।
আদৃত ভালো ভাবেই বুঝল অতসী নাছোড়বান্দা, কিছুতেই এমনি এমনি এই বাড়িতে থাকতে রাজি হবে না। তাই বলল…
– আপনি মিষ্টিকে টিউশনি পড়ান তো।
– হুম।
– তারজন্য মাইনে নেন তো।
– হুম।
– এইবার থেকে মিষ্টিকে পড়ানোর জন্য আপনি কোনো মাইনে পাবেন না, তার বদলে এই বাড়িতে থাকবেন ঠিকাছে।
আদৃতের প্রস্তাব শুনে অতসী তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আদৃত অতসীর উত্তরের আশা না করেই বেড়িয়ে গেল, অতসী বিরবির করে বলল…
– লাভ হলো না লোকসান হলো।
আরু তো খুব খুশি, বলেই দিয়েছে অতসীর সাথে ঘুমাবে। অতসী ফ্রেশ হবে উশখুশ করেই চলেছে, কিন্তু কি পড়বে তার জন্য ফ্রেশ হতে পাচ্ছে না।
– মিতু।
– হ্যাঁ বলো।
– আমি শাওয়ার নেব একটু।
– হ্যাঁ নাও।
– কিন্তু কি পড়ব। আমি তো কিছুই আনিনি। (মন খারাপ করে বলল)
– ওহ্ ।
মিতু চিন্তিত হয়ে গেল। অতসীর তুলনায় মিতুর শরীর স্বাস্থ্য একটু ভালো, অতসী ওর জামা গায়ে দিলে ফকফক করবে, আর একটা মানুষ ঢুকে যাবে।
মিতু চিন্তিত হয়ে মায়ের কাছে যায়।
– মা।
– হ্যাঁ বল।
– অতসী শাওয়ার নেবে বলছে কিন্তু কি পড়বে।
– তোর জামা দিয়ে দে।
– হ্যাঁ, আমার জামা ওর গায়ে হবে বলে তোমার মনে হয়।
উনি একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হলেন। একটু ভেবে বললেন….
– চল আমার সাথে।
– কোথায়?
– চল না।
আদৃতের মা মিতুকে টেনে নিয়ে সোজা আদৃতের ঘরে গেলেন। আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে দিলেন।
– মা!
– এইগুলো দিয়ে আয়, ব্লাউজটা মনে হয় অতসীর গায়ে হয়ে যাবে।
– কিন্তু মা, এইগুলো তো ভাবির। দাদাভাই যদি কিছু বলে।
– কিছু বলবে না। তুই দিয়ে আয়।
– আচ্ছা।
মিতুর মায়ের আদেশে অতসী কে গিয়ে শাড়িটা দিতেই অতসীর মুখ কুঁচকে গেল।
– আবার শাড়ি।
– কিছু করার নেই, এইটা ছাড়া তোমার মাপের আর কিছুই নাই।
– হুম।
অতসী হতাশ হয়ে শাড়িটা নিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেল। হসপিটালে ঘুরে এসেছে,গা কিরকম একটা করছে। অতসী শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলোকে মুছতে ছিল তখনি দরজায় টোকা পড়ল…
অতসী ঘুরে তাকাতেই আদৃত থমকে গেল, আধভেজা এলোমেলো চুল, চুলগুলো থেকে এখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে, আর পরনে ওর স্ত্রী রুহির শাড়ি। অতসী তাকিয়ে দেখল আদৃত কিরকম একটা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, আর হাতে অনেকগুলো প্যাকেট। অতসী নিজের শাড়ির আঁচলটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলল…
– কিছু দরকার কি?
আদৃত অতসী কথাতে ধ্যান থেকে ফিরে এসে বলল…
– আপনার জন্য কিছু ড্রেস এনেছিলাম, রেখে গেলাম।
আদৃত প্যাকেটগুলো রেখে একপ্রকার পালিয়ে গেল। অতসী কিছুই না বুঝে ওর যাবার দিকে তাকিয়ে রইল।
আদৃত নিজের ঘরে ঢুকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকল। অতসীকে ওই অবস্থাতে দেখে ওর মনের মাঝে অন্যরকমের একটা অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার কারন কি অতসীর গায়ে রুহির শাড়ি থাকা! নাকি অন্য কিছু।
আদৃতের কিরকম একটা পাগল পাগল লাগতে শুরু করে দিয়েছে। একটা অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। মিতু আদৃতকে খেতে ডাকতে এসে দেখল, আদৃত চুলগুলোকে মুঠো করে ধরে বসে আছে।
– এই দাদাভাই। তুই ঠিক আছিস।
– হুম।
– মা খেতে ডাকছে চল।
– যাচ্ছি,তুই যা।
মিতু চলে যেতে যাবে, তখনি আদৃত ওকে পেছন ডাকল…
– মিতু শোন।
– হ্যাঁ বল।
– অতসী কে রুহির শাড়ি কে দিয়েছে?
– মা। কেন?
– না কিছু না, তুই যা।
মিতু চলে যেতে, আদৃত উঠে গিয়ে আলমারি খুলল। আলমারি ভর্তি রুহির শাড়ি, রুহির শাড়ি কিনতে বড্ড ভালোবাসত। আদৃত চাকরি পাবার পর, রুহির কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেনি। পছন্দ হলেই শাড়ি কিনে আনত। এইখানের বেশিরভাগ শাড়িই নতুন, রুহি অনেক শাড়িই একবারো পড়েনি। আদৃত শাড়িগুলো কাউকে দিতে দেয়নি, এমনকি মিতুকেও পড়তে দেয়নি। মিতু শাড়ির কথা বললে নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছে। আজকে রুহির শাড়ি অতসী কে পড়তে দেখেও কিছু বলল না কেন?
আদৃত খেতে গিয়ে দেখল, অতসী আরুকে খাইয়ে দিচ্ছে। দুজনে পুরো মা-মেয়ে মনে হচ্ছে, আদৃত নিজের ভাবনাতে নিজেই অবাক হলো। খেতে বসেও ঠিক মতো খেতে পারল না,বারবার চোখ অতসীর দিকে চলে যাচ্ছে। শেষে আদৃত না খেয়েই উঠে চলে যায়।
– আরে কি হলো খেয়ে যা।
– খিদে নেয়।
আদৃতের এইরকম ব্যবহারের কারনটা কেউ না বুঝলেও আদৃতের মা ঠিকই বুঝলেন। সকলের খাওয়া হয়ে যাবার পর, একটা প্লেটে খাবার নিয়ে ছেলের ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন।
– আদৃত বাবা।
মায়ের গলা শুনে আদৃত তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। মায়ের হাতে খাবারে প্লেট দেখে আদৃতের মুখে হাসি ফুটে উঠল। কথাতেই বলে, মায়ের থেকে ভালো তার ছেলেমেয়েকে কেউ বোঝে না। সত্যিই তাই।
আদৃতের মা ভেতরে ঢুকে ছেলেকে পাশে বসিয়ে, খাইয়ে দিতে দিতে বললেন…
– জানিস বাবা। আমাদের জীবনের গতি একজনের হাতে ধরা আছে, আমাদের ভাগ্য আগে থেকেই ওনার কাছে লিখিত আছে। যেদিন তুই রুহিকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলিস, সেইদিন আমি কোনো আপত্তি না করেই মেনে নিয়েছিলাম। কারন তোদের ভাগ্য জোড়া ছিল আমার মানা না মানাতে কিছুই হবে না। রুহির আসা এবং চলে যাওয়াটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, তবে তার জন্য তুই নিজের জীবনটাকে থামিয়ে রাখবি এটা কিন্তু ঠিক নয়। বাবা অনুভূতি বলে কয়ে আসে না, যদি তোর জীবনে আবার কখনো অনুভূতি আসে তাহলে পিছিয়ে না গিয়ে সেটাকে অনুভব কর। দ্বিতীয়বারের মতো জীবনকে সুযোগ দিয়ে দ্যাখ না কি হয়।
কথার মাঝেই আদৃতের খাওয়া হয়ে যায়। আদৃতের মা ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে চলে যান। মায়ের কথাগুলোকে আদৃত ভাবতে থাকে, মা কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেল সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না আদৃতের।
#চলবে….
#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_১৫
#তানজিলা_খাতুন_তানু
অতসী আগের বাড়িতে গেছে জিনিসপত্র গুছিয়ে আনতে। অতসী কে জিনিসপত্র গোছাতে দেখে বিট্টু বলল…
– দিদি তুমি কোথায় যাচ্ছো।
– আমি আর এই বাড়িতে থাকব না।
– কেন দিদি?
অতসী কি উত্তর দেবে খুঁজে পেল না। এই বাড়িতে না থাকার তো সঠিক কোনো কারন নেই।
– তুমি যদি চলে যাও তাহলে আমাকে পড়াবে কে?
অতসীর বড্ড কষ্ট হলো। কি করবে কিছুই বুঝতে পারলো না, ছেলেটাকে তো কথা দিয়েছিল। এখন কি কথা রাখতে পারবে না। বিট্টু মন খারাপ করে চলে গেল। অতসী বসে রইল।
অতসী অনেক ভেবে আদৃতের নম্বরে কল লাগাল।
– হ্যালো কে?
– আমি অতসী বলছি।
– হ্যাঁ বলো।
– বলছিলাম যে, আমি ওই বাড়িতে থাকতে পারব না।
– কিন্তু কেন? আমি তো আপনার সব কথাই মেনে নিয়েছি, তাহলে অসুবিধা কোথায়?
– আসলে…
অতসী আদৃতকে সবটা বলল। আদৃত সবটা শুনে বলল…
– এটার জন্য এত চিন্তার কি আছে। আচ্ছা বলুন আপনি কটা টিউশনি করান।
– আরুকে নিয়ে তিনটে।
– কখন কখন পড়ান।
– সকালে একটা আর বিকালে দুটো।
– তাহলে সমস্যা কোথায়।
– মানে!
– আপনি বিকালে আরুর পরির্বতে ওই ছেলেটিকে পড়িয়ে আসবেন। আর রাতে একটু আরুকে দেখিয়ে দেবেন।
– কিন্তু।
– আরুকে দেখার জন্য আমি আছি,মিতু আছে। ওকে নিয়ে আপনার এত চিন্তা করতে হবে না, আর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আর একটা টিউটর রেখে দেব।
– মানে কি, আপনি আমাকে ওই বাড়িতে রাখার জন্য এতটা জোড়াজুড়ি করছেন কেন?
আদৃত অতসীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল…
– বাড়ির ঠিকানাটা দিন, আমি আপনাকে গিয়ে নিয়ে আসছি।
– আমি যেতে পারব।
– দরকার নেয়। আমি এইটুকু করতে পারব, আপনি ঠিকানা দিন।
আদৃতের কন্ঠে অতসী স্পষ্ট অধিকারবোধ শুনতে পেল। আদৃতের কথা ফেলতে পারল না,ঠিকানা দিয়ে দিল।
– আপনি গুছিয়ে রাখুন। আমি গিয়েই নিয়ে আসব।
– আচ্ছা।
অতসী সবকিছু গুছিয়ে নিল। গত ৩ বছর ধরে এই বাড়িতে আছে, মায়ায় জড়িয়ে গেছে এই বাড়িটার। নিজের মতো করে সাজিয়েছিল, আজকে সবটা ছেড়ে চলে যেতে হবে। অতসী বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে শুনে সকলেরই মন খারাপ, বিট্টু তো কেঁদেই দিয়েছে।
– আরে পাগলা কাঁদছিস কেন? আমি আমার দেওয়া কথা রাখব, আমি তোকে প্রতিদিন পড়াতে আসব চিন্তা করিস না।
– তোমাকে খুব মিস করব।
– আমিও।
অতসী বাড়ি ওয়ালার হাতে ভাড়াটা দিয়ে দিয়ে বলল…
– কাকু এই মাসের ভাড়াটা।
– মা তুই এই বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিস কেনো? তোকে ছাড়া যে আমার বাড়িটা পুরো ফাঁকা হয়ে যাবে। তোর কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে।
– না কাকু, এমনিতেই চলে যাচ্ছি। আর আমি তোমার কাছে চির ঋণী থাকব, সেইদিন তুমি আমাকে আশ্রয় না দিলে কি হতো কে জানে।
– মারে তুই তো আমার মেয়ের মতোই। আমার আরেকটা মেয়ে। যেখানেই থাকিস,ভালো থাকিস, আর এই বুড়ো বাপটার কাছে আসিস একবার।
অতসী কেঁদেই দিল। এই মানুষগুলো ওকে এতটা ভালোবাসত, সেটা আগে বুঝতে পারেনি। সেইদিন এই বাড়ির মালিক ওকে ঘরভাড়া না দিলে হয়তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, আর ন*রপ*শুদের শি*কার হতো। মানুষটির কাছে চিরকৃতজ্ঞ অতসী।
আদৃত দেখল, অতসীকে সকলে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের চোখেই পানি, আদৃত বড্ড অবাক হলো।
– অতসী।
আদৃতের কন্ঠস্বর শুনে অতসী সামনে তাকিয়ে দেখল, আদৃত দাঁড়িয়ে আছে।
– দেরি হয়ে যাচ্ছে চলুন।
– হুমম।
– আসছি, ভালো থেকো সবাই।
অতসী সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সকলে স্বাভাবিক থাকলেও, আদৃত কে দেখে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল। ছেলেটা কে, অতসীর সাথে কি সম্পর্ক, অতসী কোথায় গিয়ে থাকবে ব্লা ব্লা।
অতসী এগিয়ে গিয়েছিল, তখনি বাড়ি ওয়ালা কাকু ডাকল।
– অতসী।
ডাক শুনে অতসী দাঁড়িয়ে পড়ল,সাথে আদৃত ও। কাকু এগিয়ে এসে, বাড়ি ভাড়ার টাকাটা ভেতর দিয়ে বললেন…
– মারে তোকে কোনদিন কিছু দিতে পারিনি, আজকে এই টাকাটা নিয়ে যা।
– কিন্তু কাকু ওটা তো ভাড়া।
– আমি জানি। আমার উপহার হিসাবে নিয়ে যা।
অতসী বাধ্য হয়েই নিলো। এই কথাটার উপরে না বলার সাধ্য ওর নেয়।
– তুই কি ওনাদের বাড়িতেই থাকবি!
– হুম।
– অতসী, তুই যা আমার ওনার সাথে কিছু কথা আছে।
– আচ্ছা।
অতসী চলে গেল। আদৃত বুঝতে পারছে না,উনি আবার ওকে কি বলবে।
– বাবা তুমি আমার ছেলের বয়সী, আমার ছেলের মতোই। আর অতসী কে আমি নিজের মেয়েই মানি, ওহ তো তোমাদের বাড়িতে থাকবে দেখে রেখো মেয়েটাকে। মেয়েটাকে তিনবছর ধরে দেখছি ওর মতো ভালো মেয়ে আর হয় না,ভালো রেখো মেয়েটাকে।
– অবশ্যই আঙ্কেল। অতসী কে আমার পরিবারের সবাই খুব ভালোবাসে, আশা করি ওর কোনো অসুবিধা হবে না।
– হুম ধন্যবাদ।
– আসছি।
আদৃত অতসীকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আদৃত গাড়ি ড্রাইভ করছে, আর অতসী পাশে বসে আছে।
– কাকু আপনাকে কি বলল।
অতসীর প্রশ্ন শুনে আদৃত ভাবল ওর সাথে একটু ফাজলামি করা যাক।
– বলল অতসী কে ভালো রেখো।
– মানে?
– উনি ভেবেছেন, তুমি আমার জি.এফ। হবু বউ তাই বললেন খেয়াল রাখতে।
অতসী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। কি রিয়াকশন দেবে ভুলে গেছে। হঠাৎ করেই গোটা মুখে একটা লাল আভা ছড়িয়ে গেল, অতসী লজ্জা পেল ভীষণ রকমের।
জানলার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকল। অতসীর অবস্থা দেখে আদৃত মুচকি হাসল।
অন্যদিকে…
অতসীর কথাগুলো জিনিয়াকে স্থির থাকতে দিল না। বারবার মনের মাঝে প্রশ্ন জাগছে অতসী কিসের ইঙ্গিত দিলো।
– না,এইভাবে বসে থাকলে চলবে না। আমাকে খোঁজ নিতে হবে মিহানের বিষয়ে।
জিনিয়া মিহানের পেছনে একটা লোক লাগিয়ে দিল।
– মিহান কখন কোথায় যায়, কি করে সবটার ইনফরমেশন আমার চাই।
– ওকে ম্যাম।
জিনিয়ার কেন বারবার মনে হচ্ছে অতসীর সাথে ওহ অন্যায় করছে।
আদৃতের কথামতোই অতসী কাজ করতে শুরু করল। নিয়মিত বিট্টুকে টিউশনি পড়াতে যেত,তবে বাড়ি ফিরে শরীর আর চলত না। তাই বেশিরভাগ সময়েই আরুকে পড়াতে পারত না, আরু মিতুর কাছেই পড়ে নেয়।
আগামীকাল কলেজের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। অতসী এইসবে রীতিমতো বিরক্ত, রোজ রোজ অনুষ্ঠান ভালো লাগে না।
– ধ্যাত আবার অনুষ্ঠান, আমি যাবো না।
– অতসী এটা তো বললে চলবে না। ডিপার্মেন্টে তুমি ফার্স্ট হয়েছে তার জন্য পুরস্কৃত করা হবে আর তুমি যাবে না। এটা কি রকম কথা, তোমাকে যেতেই হবে।
– কিন্তু।
– কোনো কিন্তু নয়।
রাতের বেলা। খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবার পর অতসী বই নিয়ে বসল। কয়েকদিন একদমই পড়াশোনা করতে পারেনি সবকিছুর জন্য। পড়াশোনায় একটু মন লেগেছে তখনি দরজায় টোকা পড়ল, অতসী একটু বিরক্ত হয়েই দরজা খুলতে এগিয়ে আসলো। দরজা খুলে দেখল কেউ নেয়। অতসীর মেজাজ এইবার আকাশ ছোঁয়া, পড়াশোনায় বাঁধা পড়লেন ভীষন রকমের রাগ ওঠে ওর। বিরক্ত হয়ে দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনি চোখ পড়ল, দরজার সামনে রাখা একটা শপিং ব্যাগের দিকে। অতসী কৌতুহলী হলো, কি মনে করে ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
অতসী ব্যাগটা খুলে দেখল ভেতরে একটা সুন্দর শাড়ি। আর তার সাথে একটা চিরকুট…
#চলবে…
#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_১৬
#তানজিলা_খাতুন_তানু
অতসী চিরকুটটা খুলে দেখ,দেখা আছে..
“এই যে মিস, কালকে তো আপনার জীবনে একটা বিশেষ দিন আপনাকে আপনার সফলতার জন্য পুরস্কৃত করা হবে। আর আপনি কি বলছিলেন যাবেন না! কালকে চুপচাপ শাড়িটা পড়ে সুন্দর করে সেজে চলে যাবেন। আমি আপনার মুখে কালকে বিজয়ীর হাসি দেখতে চাই,বুঝেছেন!”
অতসীর বুঝতে অসুবিধা হলো না শাড়ি আর চিরকুট কে পাঠিয়েছে। অতসী চিঠিটা পড়ে নিজের মনেই প্রশ্ন করল…
– উনি কি আমাকে আদেশ করছেন নাকি অধিকার দেখাচ্ছেন!
অতসীর আর পড়াশোনা করা হলো না। চিরকুট আর শাড়িটা আলমারীতে রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরেরদিন…
কলেজে আবারো উৎসবের আমেজ। আজকে বাৎসরিক অনুষ্ঠান, অনেক অতিথী আসবেন। মিহানের কলেজ শেষ হয়ে গেছে তবুও আজকে কলেজে এসেছে। অন্য কিছু বাহানা হলেও আসল কারন তো অতসী কে দেখা। জিনিয়া ডিপার্মেন্টে থার্ড হয়েছে আর একটা ছেলে সেকেন্ড হয়েছে।যেহেতু তিনজনকে পুরস্কৃত করা হবে তাই জিনিয়াও পাবে।
কলেজে মিহান কে দেখে জিনিয়া একটু অবাক হলো। ওহ জানত না আজকে মিহান ও আসবে।
– আরে মিহান তুমি।
– হুম। দেখতে আসলাম, তুমি প্রাইজ পাবে আর আমি আসবো না হতে পারে।
মিহানের কথা শুনে জিনিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ছেলেটা এতটা ভালোবাসে ওকে, নিমিষেই একটা প্রশান্তি খেলা করে গেল মনের মাঝে। মিহান জিনিয়ার সাথে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু বারবার চোখটা এদিক ওদিক করেই চলেছে। দুটো চোখ অতসী কে একপলক দেখার জন্য আকুল হয়ে আছে। আগে প্রতিদিন কলেজ আসলে অতসীর সাথে দেখা হয়ে যেত, কিন্তু এখন কলেজ শেষ প্রতিদিন আসতেও পারে না আর দেখাও হয় না।
ওইদিকে…
অতসী আদৃতের দেওয়া শাড়িটা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলোকে বাঁধতে থাকল। তখনি অতসীর মনে পড়ল, আদৃতের বলা সেইদিনের কথা গুলো। কি মনে করে অতসী চুলগুলোকে আর বাঁধলো না, ছেড়েই রাখল। চোখে হালকা করে কাজল, গোলাপি রঙের লিপস্টক পড়ে বেড়িয়ে পড়ল।
শাড়িটা ঠিক করতে করতে বসার ঘরে এসে বলল…
– মিতু তোমার হলো। আমি রেডি কিন্তু।
সামনে তাকিয়ে দেখল ২ জোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আদৃতের মা অতসী কে দেখে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন…
– একটু দাঁড়াও আমি আসছি।
উনি ভেতরে চলে্ গেলেন। গোটা ড্রইং রুমে আদৃত আর অতসী দুজনেই। আদৃত দূর থেকে দাঁড়িয়ে অতসী কে দেখতে ব্যস্ত আর অতসী একরাশ লজ্জা, অস্বস্তি নিয়ে নিজের নখ খুঁটতে ব্যস্ত। এর মাঝেই আদৃতের মা ফিরে আসলেন, হাতে একটা বাক্স। অতসী কে সোফাতে বসিয়ে, বাক্স থেকে একটা হার আর বালা জোড়া পড়িয়ে দিলেন। অতসী হা করে তাকিয়ে রইলেন ওনার দিকে…
– মামনি কি করছ এইসব।
– খালি খালি লাগছিল তাই পড়িয়ে দিলাম।
– কিন্তু।
– পড়তেই দিয়েছি, পুরো দিয়ে দিইনি। এসে না হয় ফেরত দিয়ে দিস।
আদৃত দাঁড়িয়ে সবটাই দেখল, ওহ মনে মনে বলল…
– সবকিছুই ঠিক আছে, একটা নাকফুল হলে পুরোই বউ বউ লাগবে।
আদৃত নিজের ভাবনা দেখে নিজেই আনমনে হেসে উঠল। এই মেয়েটা ওকে পাগল করেই ছাড়বে উঁহু।
মিতু রেডি হয়ে আসতেই অতসী বলল..
– চলো এইবার।
– দাদাভাই আর আরু যাবে তো আমাদের সাথে।
অতসী আদৃতের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। অতসী চট করেই চোখটা নামিয়ে নিল। আদৃত গাড়ি বের করতে চলে গেল। অতসী লজ্জার হাত থেকে রক্ষা পেল, কিন্তু আবারো বিপত্তি বাঁধল। মিতু আর আরু পেছনে বসবে বলল, অতসী পেছনে বসতে গেলেই আদৃত ক্ষেপে গিয়ে বলল…
– আমাকে কি ড্রাইভার মনে হয় আপনাদের।
মিতু করুন চোখে অতসীর দিকে তাকাল, মিতুর রিকুয়েস্টে শেষে অতসীই সামনে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল, নিজের গতিতে। অতসী নিজের মনে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত, আদৃত গাড়ি চালানোর মাঝে মাঝে আড়চোখে অতসী কে দেখে চলেছে। মিতু পেছনে বসে সবটাই খেয়লা করছে আর মুচকি হাসছে।
জিনিয়ার সাথে কথা বলার মাঝে মিহানের চোখ পড়ল অতসী একটা বড়ো গাড়ি করে পাকিং সাইটে যাচ্ছে। মিহানের জানার আগ্রহ সৃষ্টি হলো, জিনিয়াকে কিছুই না বলে পাকিং সাইটের দিকে দৌড়ে চলে গেল। পেছন পেছন জিনিয়াও গেল,তবে ধীরে ধীরে শাড়ি পড়ার কারনে জোরে যেতে পারল না।
ওইদিকে…
মিতু আর আরু আগেই নেমে গিয়েছে কিন্তু অতসী নামার আগেই আদৃত গাড়ি নিয়ে সোজা পাকিং সাইটে চলে যায়।
– এইটা কি করলেন আপনি।
– কি করলাম।
– নামতে দিলেন না,কেন।
আদৃত কোনো উত্তর দিলো না। গাড়িটা সাইট করে, অতসীর দিকে না তাকিয়েই বলল…
– বড্ড মায়াবী লাগছে, দেখবেন আবার কেউ না মায়াতে পড়ে যায়।
– কেন পড়লে কি হবে!
চট করেই উত্তর দিলো অতসী। আদৃত রক্তচক্ষু করে ওর দিকে তাকিয়ে, ওর হাতটা ধরে নিজের দিকে একটু টেনে নিয়ে এসে বলল…
– আমি নিজের জিনিসে কারোর নজর স*হ্য করি না, যেটা আমার সেটা আমারই। বুঝেছেন!
হাতটা ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেল আদৃত। তবে অতসী ঠাঁই বসে রইল। আদৃত কি বলে গেল তার উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত অতসী।
– এই যে ম্যাডাম আপনি কি বসে থাকবেন। নামুন একবার।
অতসী আদৃতের কথা শুনে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে আনমনা হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল, তখনি শাড়ির সাথে পা পেঁচিয়ে পড়ে যেতে গেলেই আদৃত ধরে নিল। দৃশ্যটা মিহান দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল, নিমিষেই ওর মুখ লাল হয়ে উঠল, অতসী কে হারানোর ভয় মনের মাঝে জমা শুরু করল। জিনিয়া মিহানের পেছনে পেছন এসে ওই একই দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। আদৃতের বুকের খুব কাছে অতসী, আদৃত দুই হাত দিয়ে ওকে আগলে রেখেছে, দুজন দুজনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুজনের ধ্যান ফিরতেই দুজন দুজনের থেকে সরে দাঁড়াল। আদৃত একটু মজা করেই বলল…
– দেখে হাঁটবেন না, আর একটু হলেই তো পড়তেন। নাকি মনটা আমার কাছে রেখে এসেছেন।
– আপনাকে তো আমি…
– আদর করবে।
কথাটা বলে আদৃত হাসতে হাসতে চলে যায়। অতসী আদৃতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল…
– এই লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে, নাকি আমাকে পাগল বানানোর প্ল্যানে আছেন!
মিহান অতসীর সাথে মুখোমুখি হবার সুযোগ পায়নি, তাই ওর সাথে কথা বলতেও পারেনি। মিহান ছটফট করে চলেছে অতসীর সাথে একদন্ড কথা বলার জন্য, কিন্তু পারছে না। জিনিয়া মিহানের ছটফট করাটা দূর থেকে লক্ষ্য করে চলছে, আর মনের মাঝে একটা প্রশ্নের উদয় হচ্ছে…
– মিহান কি তাহলে অতসীকে ভালোবাসে!
অতসী হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কারোর সাথে ধাক্কা লেগে যায়। মাথা না তুলেই অতসী বলে উঠল..
– সরি।
ওপর মানুষটি অতসীর কন্ঠস্বর শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল…
– বোন!
#চলবে….