প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব-১১+১২+১৩

0
2391

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_১১
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আদৃত কফির মগটা তুলে এক চুমুক দেবার পর মুখ থেকে নিজে থেকেই বেড়িয়ে এলো..
– নাইস।

নিজের কান্ড দেখে আদৃত নিজেই অবাক হলো। নিত্য দিনের খাওয়া ব্ল্যাক কফি খেয়ে নাইস বলছে ওহ, ভূতে ধরেছে নাকি।

– আমি কি করছি এইসব!

ঘটনা এইখানেই শেষ নয়। দিনে দিনে অতসী আদৃতের পরিবারের সাথে মিশে যেতে থাকল। আদৃত অতসীর কথা‌তেই বাড়িতে একটা সার্ভেন্ট রাখে, ছেলের কাজে আদৃতের মা আপত্তি করলেও পরে কিছু বলেননি। সত্যিই হাঁটুর ব্যথা নিয়ে কাজ করতে সমস্যা হয় খুব।

রাতে খাবার টেবিলে হঠাৎ করেই আদৃতের মা কথা তুললেন…

– অতসী মেয়েটা বড্ড লক্ষী। আমাদের আরুকেও বড্ড বেশি ভালোবাসে।
– মা শুধু তাই নয়। ডিপার্মেন্টে ফার্স্ট হয়েছে, অথচ মেয়েটা কোথাও টিউশনি পড়ে না। খুব মেধাবী ছাত্রী। আর স্বভাবও খুব ভালো।

মিতুর কথা শুনে আদৃতের মা হাসলেও আদৃতের মনে প্রশ্নের উদয় হলো…

– বোন, তুই কি ওনাকে আগে থেকে চিনতি?
– নারে দাভাই। ওর আর আমার ডির্পামেন্ট তো আলাদা। আরুর সূত্রেই ওর সাথে পরিচয়, তখনি জানতে পারি ও আমাদের কলেজেই পড়াশোনা করে।
– ওহ্।

মিতু আদৃতের থেকে সত্যিটা আড়াল‌ করে গেল। চাইলেই সবকিছু সত্যি বলতে পারত, কিন্তু বললো না। এর পেছনে কি কারন লুকিয়ে আছে?

ক্লাবে বসে একের পর এক ম*দ খেয়ে চলেছে মিহান। বাড়িতে বলে এসেছে, বন্ধুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করবে আজকে। অথচ ক্লাবে বসে একের পর এক ম*দ খেয়ে চলেছে, টাকা উড়িয়ে যাচ্ছে।

মিহানের বন্ধু জিৎ বলল…
– কিরে ভাই আজকে এত খাচ্ছিস কেন?
– বুকের ভেতরে না খুব জ্বালা করছে।
– কিন্তু কেন?
– ওই অতসী।
– কেন রে ওই ভিখারী কে আবার ভালোবেসে ফেললি নাকি?

সুমন কথাটা বলে হেসে উঠল। মিহান সুমনের শার্টের কলারটা ধরে বলল…

– খবরদার ওকে কেউ ভিখারী বলবি না। সি আজ মাই কুইন। অতসী মিহানের রানি বুঝেছিস তোরা।

জিৎ আর সুমন হতভম্ব হয়ে যায় মিহানের কথা শুনে। জিৎ ওর দিকে তাকিয়ে বলল…

– কি বলছিস এইসব তুই মিহান। তুই তাহলে সত্যি অতসী কে ভালোবাসিস।
– ইয়েস আই লাভ অতসী। আমি অতসী কে খুব খুব ভালোবাসি। জানিস যেইদিন প্রথম ওকে দেখেছিলাম সেইদিনই ওকে ভালোবেসে ফেলি।
– তাহলে কেন ব্রেকাপ করলি ওর সাথে। কেন জিনিয়ার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লি তুই। ( সুমন)
– স্বার্থ। সবকিছুর পেছনে অনেক বড়ো স্বার্থ লুকিয়ে আছে, অনেক বড়ো স্বার্থ। একবার মিটে গেলেই আমি আমার অতসীকে নিজের করে নেব,নিজের করে নেব।

পাগলের প্রলাপ বকতে বকতে মিহান অচেতন হয়ে যায়। সবগুলো কথাই ছিল অতসী কে ঘিরে। জিৎ আর সুমন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে।

– আগে চল ফিরে যায়। তারপর কথা বলছি।

জিৎ এর কথার‌ সাথে সুমন সহমত হলে দুজনে মিহান কে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। জিৎ আর সুমন মিহানের ছোটবেলার বন্ধু, অনেক ছোটবেলা থেকেই চেনে ওকে। মিহান আগে খুব ভালো‌ছিল, কিন্তু বড়ো হবার সাথে সাথে হয়ে উঠেছে বেপরোয়া।

জিৎ আর সুমন মিহানকে নিয়ে সুমনের বাড়িতে নিয়ে গেল। সুমনের বাড়িতে কেউ নেয়, ওর বাবা মা দাদুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে। ওরা মিহান কে বিছানায় শুইয়ে দিল।

– জিৎ কি হচ্ছে বল তো‌। আজকে মিহান কিসব বলল।
– আমিও তো বুঝতে পারছি না। তবে মাতাল অবস্থায় কোনো মানুষ মিথ্যা বলে না, তাহলে কি সত্যিই মিহান অতসী কে ভালোবাসে?
– বুঝতে পারছি না কিছু। যদি সত্যিই ভালোবাসে তাহলে অতসীর সাথে ব্রেকআপ করে জিনিয়ার সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ল কেন?
– আমার ভয় লাগছে খুব সুমন। অতসীর জীবনের জন্য আমার খুব ভয় লাগছে, মেয়েটাকে আবার কি সমস্যায় পড়তে হয় কে জানে?
– হুমম।

জিৎ আর সুমন অতসীর জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ল।

অতসী আরুকে পড়াচ্ছে,তখনি মিতু উঁকি দিয়ে বলল…

– অতসী। যাবার আগে একবার আমার রুমে আসবে প্লিজ।
– আচ্ছা।

মিতু খুশি হয়ে চলে গেল। অতসী আরুকে পড়াতে লাগল। আদৃত মিতুর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখনি দেখল মিতু অনেকগুলো শাড়ি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে।

– কি রে কি করছিস এতগুলো শাড়ি নিয়ে।
– আরে দাভাই। আমাকে একটা শাড়ি পছন্দ করে দে না।
– কেন?
– আমি পারছি না। প্লিজ..

আদৃত মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা শাড়ির মধ্যে থেকে একটা শাড়ি বেছে দিয়ে বলল.
– এই নে।

মিতু খুশি হয়ে শাড়িটা নিয়ে বলল…

– সত্যি তোর পছন্দের কোনো তুলনা হয় না। এইটা অতসী কে খুব মানাবে, থ্যাঙ্কু।

আদৃতের ভ্রু কুঁচকে গেল।

– অতসী কে মানাবে মানে?
– আরে দাভাই কালকে আমাদের কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠান আছে। তাই ওকে একটা শাড়ি গিফট করবো।
– কিন্তু কেন, আর ওই বা তোর থেকে কেন নেবে বল তো?
– তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
– বাদ দে। অতসী কে কেন শাড়ি দিতে চাইছিস।
– আসলে দাভাই, আমি অতসীর ব্যাপারে যেটুকু জানি তাতে আলাদা করে কিছু কিনতে যাওয়াটা ওর পক্ষে অসম্ভব। তাই ভাবছিলাম একটু…
– ওকে।

আদৃত ঘরের বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর, অতসী মিতুর দরজায় টোকা মারল।

– আসবো।
– হ্যাঁ আসো।

অতসী ভেতরে ঢুকে বিছানায় ছড়িয়ে থাকা শাড়িগুলোর দিকে একনজর তাকিয়ে বলল…

– কিছু দরকার।
– হ্যাঁ। আসলে কালকে তো নবীনবরণ অনুষ্ঠান, কি পড়বে তুমি?
– যাবার কোনো প্ল্যান নেয়। তুমি যাবে তো।
– হুমম। একটা শাড়ি পছন্দ করে দাও না প্লিজ।

অতসী একটা শাড়ি পছন্দ করে দিল।

– থ্যাঙ্কু।
– ওয়েলকাম।
– একটা কথা বলবো।
– বলো।

মিতু আদৃতের দেওয়া শাড়িটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল…
– কালকে এই শাড়িটা পড়বে প্লিজ।
– মাফ করো মিতু। আমি নিতে পারব না।
– প্লিজ।

মিতু অনেকবার অতসীকে রিকুয়েস্ট করল, শেষে বাধ্য হয়েই অতসী শাড়িটা নিতে রাজি হলো। তবে একটা শর্ত দিল…

– আমি তোমার এই শাড়িটা নিচ্ছি ঠিকই, তবে ফেরত নিতে হবে কিন্তু।
– আচ্ছা।

অতসী মিতুর দেওয়া শাড়িটা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

পরেরদিন…

কলেজটা নানান সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে। নতুন রুপে সেজে উঠেছে। সকলেই নানা রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি পড়ে সেজে উঠেছে। মিতু অতসীর পছন্দ করে দেওয়া শাড়িটা পড়ে সুন্দর করে সাজল।

– মনি।
– বলো মামনি।
– তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমার আন্টিও এইরকম সাজবে তাই না।
– হুম গো।
– আমি আন্টিকে দেখব মনি।
– আচ্ছা। আমি দাভাইকে বলব, তোমাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমাকে এখুনি চলে যেতে হবে, আমি গেলাম
– আচ্ছা।

মিতু চলে‌ যাবার পর থেকেই আরু আদৃতের কাছে বায়না করতে থাকল। আরুর বায়নার কাছে হার মেনে আদৃত যেতে রাজি হলো, তবে মনের মাঝে কোথাও একটা কাউকে একজনকে দেখতে চাওয়ার সুপ্ত বাসনা ছিল।

অন্যদিকে…

অতসী মিতুর দেওয়া শাড়িটা পড়ে, চুলগুলোকে খোঁপা করে চোখে হালকা করে কাজল আর পিংক কালারের লিপষ্টিক পড়ে নিল। আয়নায় একপলক নিজেকে দেখে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

মিহান কলেজে যাওয়া থেকেই বারবার গেটের দিকে দেখছে, কখন অতসী আসবে সেই অপেক্ষায় আছে।

#চলবে….

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_১২
#তানজিলা_খাতুন_তানু

মিহানের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে অতসী কলেজের গেট দিয়ে প্রবেশ করল। অতসী কে এই প্রথম শাড়িতে দেখল মিহান, নিজে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে আসলো…

– বিউটিফুল।

মিহান অতসীর দিকে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল,তখনি জিনিয়া ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

– কেমন লাগছে আমাকে।

মিহান জিনিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখল, শাড়িতে ওকেও খুব সুন্দর লাগছে। তবে অতসীর থেকে সুন্দর না।

– সুন্দর।
– শুধু সুন্দর! চলো দুজনে একটা সেলফি তুলি।

মিহান জিনিয়ার কাজে বিরক্ত হলো। সামনে তাকিয়ে অতসী কে দেখতে না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, জিনিয়ার কথাতে রাজি হয়ে গেল। অতসী স্টেজের কাছে যেতে মিতুর সাথে দেখা হয়ে গেল।

– অতসী। তোমাকে না কি সুন্দর লাগছে, আমি ছেলে হলে আজকেই তোমাকে তুলে নিয়ে চলে যেতাম।
– তোমাকেও খুব সুন্দর লাগছে।
– হুমম, পেত্মীর আবার সুন্দর।

মিতুর কথাতে অতসী হেসে উঠল। অতসীর মুখের মিষ্টি হাসিটার দিকে মিতু একনজরে তাকিয়ে থাকল।

– কি দেখছ?
– তোমার হাসিটা তোমার মতোই মিষ্টি।
– তাই।
– হুমম।

অতসী আর মিতুকে হাসি,গল্প সবটাই খেয়াল করছিল জিনিয়া। মিহান একটা ছবি তোলার পরেই নিজের বন্ধুদের কাছে চলে যায়,ফলে জিনিয়া একা হয়ে যায়। স্টেজের দিকটাই যেতেই দেখল অতসী আর একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আবার মাঝে মধ্যে হাসছে ওহ। দূর থেকে অতসী কে ভালো করে লক্ষ্য করতে থাকে জিনিয়া।

মিতুর কিছু দরকার পড়াতে ওহ একটু চলে যায়। অতসী একাই দাঁড়িয়ে থাকে, তখনি এন্ট্রি নেয় আমাদের শাহানা।

– কিরে ভিখারীনি, এত দামী শাড়ি কোথা থেকে পেলি তুই। তোর কাছে তো একটা ৫০০ টাকা দামী শাড়ি কেনার ওহ পয়সা নেয়।

শাহানার কথাতে বিরক্ত হয় অতসী। মেয়েটা একটু সুযোগ পেলেই ওর সাথে ঝামেলা করতে শুরু করে দেয়।

– আজকে অনুষ্ঠানের দিন আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ কোনো সিনক্রিয়েট করো না।
– তোর ভালো লাগা, খারাপ লাগাতে তো কিছুই যায় আসে না। তোর জন্য আমাকে সেইদিন অনেকগুলো কথা শুনতে আমি তোকে কিছুতেই ছে*ড়ে দেব না।
– এই তুমি কি চাও বলো তো?
– তোমার স*র্ব*নাশ।

শাহানার কথা শুনে অতসী ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা কেন যে অতসী কে নিজের চরম শ*ত্রু মনে করে কে জানে।

কলেজের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। সকলেই খুব আনন্দ করছে, অতসী দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। ইশ্ সকলে কত আনন্দ করছে, কিন্তু অতসী কোন একটা কারনে করতে পারছে না।

অতসী আনমনা হয়ে কিসব ভেবে চলেছে তখনি ওর হাতে টান পড়ল।

– আন্টি।

অতসী আরোহীর গলা শুনে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল, আরু দাঁড়িয়ে আছে। অতসীর মুখে আনমনেই হাসি ফুটে উঠল, নিচু হয়ে বসে আরুকে জিজ্ঞেস করল…

– আরে মিষ্টিবুড়ি তুমি।
– হুমম। আন্টি তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। একেবারে মা মা।

অতসী চমকে উঠল। আরুর মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হলো, আরুর গালে চুমু দিয়ে বলল…

– তাই।
– হুমম।
– তা তুমি এইখানে,কার সাথে এসেছ।
– বাপি এসেছে আমার সাথে। ওই তো…

অতসী আরুর ইশারা শুনে সামনে তাকিয়ে দেখল, আদৃত দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে তাকিয়ে। অতসী আদৃতের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখটা নামিয়ে নিল। আদৃত আরোহীকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে কথা বলতে লাগল ওর সাথে।

আদৃত দূর থেকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন ওদের দেখল।

তারপরে একটু এগিয়ে এসে বলল…

– শুনুন একটু।
– হ্যাঁ বলুন।
– আমার একটু কাজ পড়ে গেছে। আমাকে একটু বের হতে হবে, আপনার কাছে মিষ্টি একটু থাকলে কি আপনার সমস্যা হবে!
– আরে না। আপনি যান, মিষ্টি থাকলে আমার ভালোই লাগবে।
– আচ্ছা আসছি।

অতসীর কাছে আরুকে রেখে আদৃত চলে গেল। অতসী আরুর সাথে কথা বলতে লাগল। শাহানা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই লক্ষ্য করছিল, মেয়েটা কে সেটা জানতে বড্ড আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে এগিয়ে গেল। আরুর পাশে বসে বলল…

– হাই পিচ্চি।
– হ্যালো।
– তোমার নাম কি পিচ্চি।
– আরোহী।
– খুব সুন্দর নাম। আচ্ছা তোমার বাড়িতে কে কে আছে।
– আমি মনি, বাপি আর দিদুন।
– ওহ। অতসী তোমার কে হয়।
– অতসী আন্টি তো আমার খুব ভালো আন্টি‌, আর আমাকে টিউশন ওহ পড়ায়।
– ওহ্।

অতসী শাহানা আর আরুর কথাবার্তায় কিছু বলল না। চুপচাপ শুনতে লাগল ওদের কথা। শাহানা ওকে অপছন্দ করলেও বাচ্চাদের তো ভালোবাসতেও‌ পারে।

ওদের কথাবার্তার মাঝে মিতু ওইখানে আসে।

– অতসী।

মিতুর কন্ঠস্বর শুনে তিনজনে ওর দিকে তাকাল। আরু দৌড়ে গিয়ে মিতুকে জড়িয়ে ধরল।

– মনি।
– আরে আরু সোনা তুমি কখন আসলে।
– একটু আগে।
– ওহ।
– মামনি দাদাভাই কোথায় গেল?

মনির প্রশ্ন শুনে অতসী নিজে থেকেই বলল…

– উনি একটু দরকারি কাজে বেড়িয়ে গেছেন। তাই আমার কাছে মিষ্টিকে রেখে গেছেন।
– ওহ্।

ওদের কথাবার্তা শুনে শাহানার ভ্রু কুঁচকে গেল। সবটাই কেমন জানো গন্ডগোল‌ লাগছে ওর কাছে। শাহানা সিদ্ধান্ত নিল, বিষয়টা আরো একটু খতিয়ে দেখবে।

আদৃত ফিরে এসে অতসীর‌ পাশে দাঁড়াল। অতসী পেছনে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, আদৃত ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

– আপনি চলে এসেছেন।
– হুমম।

আদৃতকে আর কিছু বলতে না দেখে অতসী চুপ করে গেল। অতসী সামনের দিকে তাকিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আদৃত মৃদু স্বরে বলল…
– শাড়ি আর খোলা চুল বাঙালী মেয়েদের অন্যতম সাজ।

অতসী চমকে উঠল। আদৃতের দিকে তাকিয়ে দেখল আদৃত মুচকি হাসছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, আদৃত ওকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে। অতসী কিছু না বলে, চুপ করে রইল। আদৃত আবারো বলল…

– মেয়েদের কিন্তু কোনো অধিকার নেয়, তাদের শরীর দেখিয়ে ছেলেদের আকৃষ্ট করার।
– মানে?
– ব্লাউজটা…

আর‌ কিছু বলল না আদৃত। অতসী কিছু না ভেবে নিজের চুলটা খুলে দিল। নিজের ঘন কেশ গোটা পিঠ ছড়িয়ে কোমড় ছাড়িয়ে গেল।

– অসাধারণ।

আদৃত অতসীর চুলের প্রতি মুগ্ধ হলো। অতসী আদৃতের দিকে তাকিয়ে বলল…

– কি বলছেন এইসব আপনি।
– কিছু না। মিতু..
– আরে দাদাভাই তুমি ফিরে এসেছ।
– হুম বাড়ি যাবি।
– হুম।
– আচ্ছা চল।

আদৃত আরু আর মিতুকে নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর, অতসীও বেড়িয়ে যায়। শাহানা জিনিয়ার কাছে যায়।

– জিনিয়া।
– কি বলো।
– একটা কথা জানার ছিল বলব।
– বলো।
– অতসীর ব্যাপারে আমার কিছু তথ্য লাগবে।
– কিন্তু কেন?
– পড়ে বলব। প্লিজ‌ বলো।
– অতসীর‌ কে*উ নেয়, ওহ একাই একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। টিউশনি পড়িয়ে চালায়। এইটুকুই জানি ওর বিষয়ে আমি।
– আর কিছু জানো না।
– না।

শাহানা হতাশ হলো।

– ওই বাচ্চাটার সাথে অতসীর বিষয়টা কিরকম একটা যেন লাগছে। মিতুর বিষয়ে খোঁজ নিলেই কিছু একটা জানতে পারব।

শাহানা মিতুর বিষয়ে কিছু তথ্য কালেক্ট করার চেষ্টা করল। বেশি কিছু জানতে না পারলেও মোটামুটি কিছু তথ্য জানতে পারল।

শাহানার বান্ধবী তিস্তা বলল…
– শাহানা তুই হঠাৎ করে মিতুর বিষয়ে এতকিছু জানতে চাইছিস কেন?
– দরকার আছে খুব।
– কি দরকার।
– পড়ে জানতে পারবি সব।

তিস্তার ভ্রু কুঁচকে গেল। শাহানা বাঁকা হেসে চলে গেল। তিস্তা নিজের মনে বিরবির করে বলল…

– শাহানা আবার কি করতে চলেছে। আবার কি ঝড় তুলবে কে জানে?

পরেরদিন সকালটা, একটু অন্যভাবেই শুরু হলো। অতসী কলেজে গিয়ে দেখল সকলে কিরকম একটা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অতসী ক্লাসে রুমে ঢুকতেই জিনিয়া বলে উঠল…

– ছিঃ অতসী। তোর এত লো*ভ, শেষে‌ তুই কিনা…

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_১৩
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– ছিঃ অতসী। তোর এত লো*ভ।

জিনিয়ার এইরকম কথা শুনে অতসীর মেজাজ গরম হয়ে গেল। তবুও নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে বলল…

– কি বলতে চাইছিস তুই।
– হ্যাঁ ঠিক বলছি। তোর এত লোভ। এখনো তুই মিহানের পেছনে পড়ে আছিস, তুই কি আমাদের সুখে থাকতে দিবি না।
– সুখে।

তাচ্ছিল্যের হাসল অতসী। তারপর জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে‌ বলে উঠল…

– আমি কারোর সুখে ভাগ বসায়নি জিনি। প্রতা*রনা তোরা করেছিস, তুই আর মিহান। তোর মিহান কে জিজ্ঞেস করবি, কে আমার পেছনে পড়ে ছিল। আমি নিজে থেকে মিহানের জীবনে আসিনি, মিহান ভালোবাসার জন্য আকুতি মিনতি করেছিল, পায়ে পর্যন্ত ধরতে গিয়েছিল। ক্ষনিক ওর মায়াতে পড়ে গিয়েছিলাম, রিলেশনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভালো মিহানের মতো ছেলেকে মন থেকে ভালোবাসিনি, নয় তো কেঁদে কেঁদে জীবন শেষ হয়ে যেত। এইসব কথা বাদ দে, তখন কি যেন বললি আমার লোভী! জিনি তুই এতদিন আমার সাথে ছিলিস কিন্তু এখনো আমাকে চিনতে পারলি না। আমার যদি অর্থের লোভ থাকত না, তাহলে আজকে আমার জীবনে এইদিনটা আসত না, তোদের কারোর সাহস হতো না আমাকে অপমান করার। অর্থের লোভ নেয় বলেই তোরা সাহস পাচ্ছিস আমার সাথে এইভাবে কথা বলার।
– মানে!
– সবকিছুর মানে জানতে নেয়। কিছু কথা অজানাই থাকুক। আর একটা কথা, যে জিনিস আমি একবার ছেড়ে দিই সেটা কখনোই দ্বিতীয় বার নিজের জীবনে ফেরায় না। চিন্তা করিস না,তোর মিহান কে আমি তোর থেকে কেড়ে নেব না। আরে তুই যদি প্রথমেই বলে দিতি তাহলে আমি না মিহানের লাইফ থেকে অনেক দূ*রে চলে যেতাম। কিন্তু তোরা আমার সাথে প্রতারনা করলি,আমার বিশ্বাসকে নিয়ে খেলা করলি। আর তার ক্ষমা নেয়, আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু প্রতা*রকদের নয়।

জিনিয়া অতসীর কথাগুলো চুপ করে শুনতে থাকল। বরাবরই একটু চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে জিনিয়া, কিন্তু রাগ উঠলে কি করে নিজেই জানে না। আজকে শাহানার মুখে মিহান আর অতসীর নামে কিছু কথা শুনে সহ্য করতে পারিনি, অতসীকে রাগের চোটে দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে। এখন নিজের কাছে নিজেকেই ছোট মনে হচ্ছে।

– জিনি আমি তোর খারাপ চাই না। আমি জানি তুই সত্যি মিহান কে খুব ভালোবাসিস। তাই তোকে একটা কথা বলতে চাই, হয়তো তুই বিশ্বাস করবি না,তবে একটু খোঁজ নিলেই সবটা জানতে পারবি।
– কি কথা।
– সকলের চোখের সামনে থাকা মিহান আর ভেতরে মিহান টা সম্পূর্ণ আলাদা। মিহানের অনেক খারাপ অভ্যাস আছে, যদি পারিস মানুষটাকে ভালো করে তুলিস। ভালো থাকিস।

অতসী কথাটা বলে কিছুটা চলে যেতে গিয়েও পিছিয়ে এসে জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরল। জিনিয়া হতভম্ব হয়ে গেছে অতসীর এই কাজে।

অতসী জিনিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল…

– সরি রে। ভালো থাকিস।

জিনিয়া খেয়াল করল, অতসীর চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। জিনিয়ার মনের মাঝে প্রশ্নের উদয় হলো…

– কি হয়েছে অতসীর। ওকে এইরকম লাগছিল কেন?

শাহানা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছিল। ও ইচ্ছা করেই জিনিয়াকে অতসীর বিরুদ্ধে উ*স্কে দিয়েছিল, যাতে ওদের ঝামেলা হয়। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না,উল্টে অতসী জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরল কেন! সেটাও বুঝল না। এগিয়ে এসে জিনিয়াকে জিজ্ঞেস করল..

– অতসী তোমাকে জড়িয়ে ধরল কেন?

জিনিয়া শাহানার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর কিছু একটা ভেবে বলল,
– তেমন কিছুই না। আর একটা কথা, আমার আর অতসীর মাঝে নতুন করে কিছু ঝামেলার সৃষ্টি করতে এসো না। আর অতসীর ক্ষ*তি করার চেষ্টাও করো না, করলে কিন্তু আমি তোমাকে ছে*ড়ে দেব না।

জিনিয়া কথাগুলো বলে চলে যায়। শাহানা তব্ধা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কি হলো কিছুই বুঝল না।

ওইদিকে…
অতসী ক্লাসরুমে না গিয়ে সোজা প্রিন্সিপ্যালের রুমে গেল।

– মে আই কাম ইন স্যার।

অতসী কে দেখে প্রিন্সিপ্যাল স্যার খুশি হয়ে যায়। ভেতরে আসতে বলে।

– কেমন আছো অতসী।
– ভালো আছি আপনি।
– ভালোই। কি খবর, তুমি এইখানে। কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি‌।
– না স্যার। একটা হেল্প লাগবে আমার।
– কি হেল্প?
– আসলে স্যার আমি অন্য কলেজে ট্রান্সপার হতে চাইছি।

অতসীর এইরকম সিদ্ধান্তে প্রিন্সিপ্যাল স্যার খুব অবাক হলেন।

– এনি প্রবলেম। কোনো প্রবলেম থাকলে বলতে পারো। আমি সমাধান করতে চেষ্টা করব।
– কোনো সমস্যা নয় স্যার। প্লিজ একটু হেল্প করুন।

প্রিন্সিপাল স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

– কিন্তু অতসী সেটা যে পসিবল নয়। তুমি অলরেডি এডমিশন হয়ে গেছ, আর সব কলেজের এডমিশন ওহ মোটামুটি সব কমপ্লিট হয়ে গেছে। এখন অন্য কোনো কলেজে তো তুমি যেতে পারবে না।

অতসীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবুও স্যারের কাছে রিকুয়েস্ট করে আসে, যদি সম্ভব হয় উনি যেন অতসী কে বলেন।

অতসীর ক্লাস করার মতো মানসিকতা নেয়, তাই বেড়িয়ে পড়ল কলেজ থেকে। আনমনা হয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে, কোনো কিছুই কানে আসছে না। নিজের জীবনটাকে বি*ষা*ক্ত মনে হচ্ছে খুব। ভাবনায় ডুবে আছে, তখনি অনেকগুলো মানুষের চিৎকার শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখল, একটা ট্রাক তুমুল বেগে এগিয়ে আসছে। অতসী নিজের জীবনের মায়া ছেড়ে দিলো, চোখ বন্ধ করে উপর ওয়ালাকে স্মরন করতে লাগল। তখনি একটা হাত অতসী কে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অতসী মিটমিট করে সামনে তাকাল, পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। চোখের সামনে স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল, অতসী আর কিছু ভাবতে পারল না জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

অতসীর যখন জ্ঞান ফিরল, তখনি হসপিটাল বেডে নিজেকে দেখল। হাতে স্যালাইন চলছে,অতসী ওঠার চেষ্টা করল। তখনি নার্স এসে ওকে উঠতে বারন করল…

– আরে আপনি উঠছেন কেন?
– আমি এইভাবে কিভাবে আসলাম। আর এইখানে আমাকে কে আনলো।
– আমি..

চেনা কারোর কন্ঠস্বর শুনে অতসী সামনে তাকালো।
আদৃত দাঁড়িয়ে আছে, পরনে শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

– আপনি।
– হুম। নার্স ওনার ডিসচার্জের ব্যবস্থা করুন। আমি ওনাকে নিয়ে যেতে চাই।
– ওকে।

নার্স বেড়িয়ে যায়। অতসী আদৃতকে কিছু প্রশ্ন করার আগেই আদৃত বলল…

– প্রশ্ন করার অনেক সুযোগ পাবেন। এখন চুপ করে থাকুন, আগে ঠিক করে সুস্থ হয়ে নিন,তারপরে সব প্রশ্নের উত্তর দেব ওকে।

আদৃত বেড়িয়ে যায়। রাস্তায় একটা ট্রাক তারপরে আর কিছুই মনে পড়ল না অতসীর। অতসী চোখ বন্ধ করে বিরবির করে বলল…
– কি হত, যদি সবকিছু মু*ক্তি দিয়ে চলে যেতাম।

মুক্তি বললেই মু*ক্তি মেলে না।জীবনে প্রতিটা ক্ষন, প্রতিটা সময়েই লড়াই করে বাঁ*চতে হয়।

আদৃত অতসীকে হসপিটাল থেকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। অতসী এতটাই নিজের ভাবনাই ব্যস্ত ছিল, যে কোথায় যাচ্ছে সেইদিকে খেয়াল করেনি।

– চলে এসেছি। নেমে পড়ুন।

অতসী বাইরে তাকিয়ে দেখল আদৃত ওকে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে।

– এইখানে আনলেন কেন?
– থাকবেন বলে।
– কি?
– এত প্রশ্ন করা আমার পছন্দ নয়। চুপচাপ ভেতরে চলুন, নাহলে জোড় করতে বাধ্য হব।

অতসী কি করবে ভেবে পেল না। এখন জোড়াজুড়ি কিংবা তর্ক করার মতো ইচ্ছাশক্তি নেয় তাই আদৃতের কথা মেনে ভেতরে প্রবেশ করল। আদৃতের সাথে অতসী কে দেখে মিতু আর ওর মা একটু অবাক হলো।

– অতসী তুমি এখন। (মিতু)
– আজকে থেকে অতসী এইখানেই থাকবে।

আদৃতের কথা শুনে সকলেই চমকে উঠে ওর দিকে তাকাল।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে