প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব-৮+৯+১০

0
2292

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৮
#তানজিলা_খাতুন_তানু

অতীত…

আদৃত সবেমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও কিছু নম্বরের জন্য গর্ভমেন্ট কলেজে চান্স পেল না। বাধ্য হয়েই আদৃতের বাবা ওকে একটা প্রাইভেট কলেজে ভর্তি করালেন। প্রাইভেট কলেজ মানেই অনেক খরচ, আদৃতের বাবা একজন প্রাইভেট কোম্পানির সামান্য কর্মচারী। চাকরি থেকে যা টাকা আসে, তাতে পরিবার ভালো ভাবেই চলে যায় কিন্তু আদৃতের কলেজের খরচা চালাতে পরিবারকে একটু হলেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবুও আদৃতকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওর পরিবার ওর পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন।

তিনটে বছর,
পরিবারের উপর দিয়ে অনেক কষ্ট বয়ে যেতে থাকে। তবে সবকিছুই আদৃতের আড়ালে। আদৃতের বাবা মা ওকে এইসব বিষয়ে কিছুই জানায় নি। একমাত্র ছেলের স্বপ্ন পূরণ করতে, নিজেরা সবকিছুই সহ্য করতে থাকে। সবকিছু নিজের গতিতেই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই আদৃতের বাবা ব্রেন স্ট্রো*ক করে মা*রা যান। পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বাবাকে হারিয়ে আদৃত নিজের জীবনের গতি হারিয়ে ফেলে। মাকে ডেকে বলে…

– মা আমি আর পড়াশোনা করতে চাই না। একটা কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই।

আদৃতের মা ছেলের এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। যে ছেলের পড়াশোনার জন্য এতদিন এত কষ্ট করলেন, আর এখন আদৃত পড়াশোনা ছেড়ে দেবে এটা কিছুতেই হতে পারে না।

– না বাবা এটা করিস না। তোর বাপির ইচ্ছা ছিল,তুই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বি। তার শেষ ইচ্ছাটা এইভাবে নষ্ট করিস না।
– কিন্তু মা। আমার পড়াশোনার অনেক খরচ, সংসার খরচ কিভাবে কি চলবে।
– আমি একটু কষ্ট করে ঠিক চালিয়ে নেব,তুই চিন্তা করিস না।
– কিন্তু কিভাবে মা?
– আমি হাতের সেলাইয়ের কাজ জানি, পড়াশোনাও জানি,যা হোক একটা না হয় করে নেব।

মায়ের জেদের কাছে হার মেনে পুনরায় পড়াশোনা করতে রাজি হয়ে যায় আদৃত। আদৃতের মা একটা কে.জি স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে জয়েন করেন। পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ, আবার টিউশনি পড়াতে শুরু করেন। কে.জি স্কুলের টিচারদের মাইনে খুব কম,তাতে আদৃতের পরিবারের চলবে না,তাই বাধ্য হয়েই ওর মাকে টিউশনি পড়াতে হতো।

অন্যদিকে…
আদৃত পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি পড়াতে শুরু করে। পড়াশোনা, টিউশনি সব মিলিয়ে দূর্বিষহ জীবনে একজন মন ভালো করার মানুষ আসে। আদৃত না চাইতেও তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।

– কি হয়েছে আদৃত এইভাবে মন খারাপ করে আছো কেন?
– রুহি তুমি তো সবটাই জানো। বাবা চলে যাবার পর, আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে ঠিক কি কি যাচ্ছে। তুমি আমার সাথে থাকলে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না।
– এইভাবে বলো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– কিন্তু তোমার পরিবার আমার মতো একটা ছেলের সাথে তোমার বিয়ে কিছুতেই দেবে না।
– আমি মানিয়ে নেব। এত চিন্তা করো না।
– হুম।

আদৃতকে চিন্তা করতে বারন করলেও রুহি নিজেই মনে মনে সবকিছু নিয়ে চিন্তিত ছিল। রুহি বাবা আদৃতদের কলেজের ৩০% শেয়ার হোল্ডার। পাশাপাশি আরো অনেক কলেজেই শেয়ার আছে। আদরের দুলালী, উল্টো দিকে আদৃত বেকার, আর না আছে বাবার সেরকম কিছু। রুহির পরিবার আদৌও এই সম্পর্ক মেনে নেবে কিনা,তাই নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ওহ।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো একটা বছর। আদৃতের পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলেও চাকরি পাইনি এখনো। অন্যদিকে, রুহির পরিবার ওকে বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করছে লাগল। পরিবারের জেদের কাছে হেরে গিয়ে শেষমেশ আদৃতের কথা বলে দেয়।

– আমি একজনকে ভালোবাসি।

রুহির কথাটা ওর পরিবারের সকলের কাছে বজ্রাঘাতের মতো লাগল।

– কি বলছিস তুই মা। তুই কাকে ভালোবাসিস। (রুহির মা)
– আমি আদৃত বলে একজনকে খুব ভালোবাসি মা। ওকে ছাড়া আমি বাঁ*চব না।
– ছেলে কি করে? (গম্ভীর কন্ঠে বলল)
– ইঞ্জিনিয়ার।
– কোথায় চাকরি করে? কত টাকা ইনকাম। (রুহির দাদা জিজ্ঞেস করলো)
– এখনো কোথাও চাকরি করে না।
– তারমানে তুমি একজন বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছ? (রুহির বাবা)
– বাবা,একটু অপেক্ষা করো। ও খুব তাড়াতাড়িই চাকরি পেয়ে যাবে।
– আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। রুদ্র তুমি মত তাড়াতাড়ি একটা ছেলে দ্যাখো,, এই সপ্তাহের ভেতরেই রুহির বিয়ে হবে।
– বাবা! (রুহি)
– রুদ্রর মা রুহি না বাড়ির বাইরে যায়। সেইদিকে খেয়াল রেখো।

রুহির মা মাথা নাড়লেন। রুহির বাবা আর দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রুহি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।

– মা প্লিজ আমার সাথে এইরকম করো না। আমি আদৃতকে ছাড়া বাঁ*চব না।
– মারে আমার কিছু করার নেই। যা হচ্ছে মেনে নে।

কান্নায় ভেংগে পড়ল রুহি। ওর ফোন নিয়ে নিয়েছে, বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রুহি কিছুতেই আদৃতের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। আদৃতের অবস্থা খুবই খারাপ। রুহির সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছে না, ফ্যামিলি প্রবলেম আর তার উপরে রুহির হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে যাওয়া আদৃতকে বড্ড চিন্তিত হয়ে উঠেছে।

রুহির জন্য পাত্র ঠিক হয়ে যায়। এবং খুব তাড়াতাড়ি রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করার সিদ্ধান্ত নেয় ওর পরিবার। রুহি কিছুতেই রাজি হয় না, কান্নাকাটি করতে থাকে।

– মা প্লিজ।‌ আমার সাথে এইটা করো না। প্লিজ মা।

রুহি ওর মায়ের পা ধরে কাঁদতে থাকে।‌ রুহির মা নিজের মেয়ের কান্না দেখে সহ্য করতে পারে না।

– মা, প্লিজ‌ এইরকম করো না। আমি অন্য কারোর‌ সাথে সুখে থাকব না।
– রুহি মা এইরকম করিস না। মেনে নে।
– প্লিজ মা প্লিজ।

হাত জোড় করে কেঁদে উঠল রুহি। কাঁদতে কাঁদতে সব সাজগোজ নষ্ট হয়ে গেছে। রুহির মা কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। মেয়ের কষ্টটা দেখতে পারল না,শেষে বলে উঠল..

– তুই পালিয়ে যা আদৃতের সাথে।
– মা সত্যি বলছো।
– হুমম। অনেক দূরে চলে যা তুই।

রুহির মা ওর হাতে ওর ফোনটা দিয়ে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সুযোগ করে দিলো। রুহি মাকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির বাইরে চলে গেল। বাইরে বেড়িয়ে এসে বলল…

– আদৃত।
– এতদিন কোথায় ছিলে? কি হলো তুমি ঠিক আছো তো।
– হুমম। তুমি তাড়াতাড়ি কাজি অফিসের সামনে আসো।
– কিন্তু কেন?
– এত প্রশ্ন করার কিছু নেয়। তাড়াতাড়ি আসো, নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
– আচ্ছা।

আদৃত রুহির কথা শুনে, বাড়িতে কাউকে কিছু না‌ বলে। বাড়ির বারিয়ে বেড়িয়ে সোজা কাজি অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

এইদিকে…

রুহির বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার কথা কথাটা গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে গেল। রুহির বাবা প্রচন্ড রকমের রেগে বলে উঠলেন…

– তোমার এতো বড়ো সাহস তুমি। আমার কথা অমান্য করে এই বাড়ি থেকে রুহিকে পালাতে সাহায্য করেছ।
– আমার মেয়ে আদৃতকে ভালোবাসে। আমি কিছুতেই ওদের আলাদা করতে দেব না।
– কাজটা ভালো করলে না। তোমাকে এর ফল ভোগ করতেই হবে।
– আমি আমার মেয়েদের জন্য সবকিছু সহ্য করতে রাজি আছি।

রুহির বাবা রেগে বেড়িয়ে গেলেন। রুহির মা প্রার্থনা করে বললেন…

– দোয়া করি মা। তোরা খুব সুখে থাকিস। তোর বাবার জেদের কবলে পড়ে তোর জীবনটা না নষ্ট হয়ে যায়।

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৯
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আদৃত আর রুহির বাড়িটা দুটো আলাদা জেলায়। আদৃত পড়াশোনার সূত্রে অন্য‌ শহরে থাকত, রুহির সাথে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায়। তারপরে বন্ধুত্ব, প্রনয়ের সৃষ্টি হয়।

অন্য জেলা। আদৃতর আসতে অনেকটা সময়ে লাগল, রুহি অপেক্ষা করে আছে।

২ঘন্টা পর…

– রুহি রুহি। কি হয়েছে এত রাতে তুমি আমাকে ডেকে পাঠালে কেন? কি হয়েছে।
– আজকেই আমাকে বিয়ে‌ করতে হবে আদৃত।
– কি বলছো তুমি এসব।
– হ্যাঁ ঠিক বলছি। বাবা আমার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছে, প্লিজ আদৃত আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না।
– আমাকে বিয়ে করলে তুমি ভালো থাকবে না, তুমি ফিরে যাও রুহি।
– আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না। বিয়ে করব না। আমি নিজেকে শে*ষ করে দেব।

আদৃত রুহির গালে একটা থাপ্পর মারল।

– একদম এইসব কথা বলবে না। আমি ভালোবাসি তোমাকে।
– হুমম। চলো দেরি হয়ে যাবে।
– হুমম।

আদৃত আর রুহির ইসলাম মতে বিয়ে হয়ে যায়। রেজিস্ট্রি করতে অনেক ডকুমেন্টস দরকার, এখন এইসব কিছু নেয়। একপ্রকার জোর করে বিয়েটা সম্পন্ন হয়।

– আদৃত তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে চলো।এই শহরে থাকলে বাবা ঠিক আমাদের খুঁজে বের করে নেবে।
– আচ্ছা।

আদৃত আর রুহি রওনা দিলো। ওইদিকে গোটা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রুহির দেখা মিলল না। রুহির বাবা আকরাম খাঁন প্রচন্ড পরিমানে রেগে উঠলেন…

– রুহি কাজটা তুমি ঠিক করলে না। এর পরি*নাম তোমাকে ভো*গ করতেই হবে। যেদিন তোমার দেখা আমি পাবো, সেইদিনই তোমার শে*ষদিন হবে।

আকরাম খাঁনের রাগ ক্ষোপ দেখে রুহির মা ঢোক গিললেন। আকরাম খাঁন প্রচন্ড হিং*সা পরা*য়ন, প্রতি*শোধ পরা*য়ন। ওনার আত্মসম্মানে আ*ঘাত লাগলে তার পরি*নাম কি ভয়া*নক হতে পারে সেটা ভেবেই উনি ভয় পাচ্ছেন।

আদৃত রুহিকে নিয়ে বাড়ি যায়। আদৃতের মা ছেলের বিয়েটা সহজেই মেনে নিলেন, জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে শুরু করলেন। আর তার পরেই তাদের জীবনে আরোহীর আগমন ঘটলো তার রুহি ওদেরকে ছেড়ে চলে গেল..

আদৃত নিজের অতীত ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজেরই খেয়াল নেয়। সকালে ঘুম ভাঙল মিতুর ডাকে।

– দাদাভাই। তুই এইখানে ঘুমিয়ে আছিস কেন?
– এমনিতেই। মিষ্টি উঠেছে।
– হুমম। তিনি তো রেডি হয়ে স্কুলেও চলে গেছে।
– এত ফার্স্ট।
– তোর মেয়ে তো।
– হুমম।

অতসী সকালে টিউশনি পড়িয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। যদিও কলেজে যাবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কলেজের এক্সাম সামনেই তাই যেতেই যে হবে। কলেজে ঢুকে ক্যান্টিনে গিয়ে বসতেই ছোট্টু ওর‌ কাছে আসলো।

– অতসী দিদি, তুমি এতদিন পর।
– হুমম, এক কাপ চা দিবি।
– আচ্ছা আনছি।

অতসী নিজের ফোনটা বের করে নিয়ে বসলো। ফোনটা পড়াশোনা বাদে আর কোনো কিছুতেই কাজে লাগে না। আপন বলতে কেউই নেয়, কেউই ফোন করে না। ফোনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অতসী।

– অতসী।

চেনা কন্ঠস্বর শুনে অতসী মাথা তুলে তাকালো। সামনে মিতু দাঁড়িয়ে আছে দেখে, অতসী বলল…

– তুমি?
– হ্যাঁ। প্রশ্নের উত্তরটা জানতে আসলাম।
– কি প্রশ্ন।
– আরুকে পড়ানোর‌ কথাটা।

অতসী সবকিছুর মাঝে এইসব কথা ভুলেই গিয়েছিল।

– আমার অনেকগুলো টিউশনি আছে, এর মাঝে আরুকে পড়ানোটা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই যদি ওর জন্য তুমি অন্য কাউকে টিউটর হিসেবে নাও,সেটাই ভালো হবে।

মিতু আশাহত হয়ে পড়ল।

– অতসী আর একবার ভেবে দ্যাখো প্লিজ।
– আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। আর কিছু বলার নেয় আমার।

অতসী ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে গেল। মিতু অতসীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে কিছু একটা বলল। জীবন আবারো কোন খেলা দেখাবে কে জানে!

অতসী ক্লাসে গিয়ে সবার আগে মুখোমুখি হলো জিনিয়ার। জিনিয়া ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।

– জিনিয়া।

এতদিন পর অতসীর মুখে নিজের নাম শুনে কিরকম একটা আবেগ প্রবণ হয়ে উঠল জিনিয়া। তবুও নিজের জেদের কাছে হার মেনে চুপ করে রইল।

– তোমার সাথে কিছু কথা ছিল আমার।

‘তুমি’ ডাকটা শুনে জিনিয়া অতসীর মুখের দিকে তাকাল।

– মিহান, মিহানকে আগলে রেখো। না হলে দেখবে কোনদিন পাখি ফুরুত করে গায়েব হয়ে যাবে।
– কি বলতে চাইছিস তুই?
– কথাটা মাথাতে রেখো।

অতসী শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। জিনিয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। অতসী বদলে গেছে অনেক। এই বদলের আসল কারন কি?

মাঝে কেটে যায় ১ টা মাস।

অতসী আরুর সাথে ফোনে কথা বললেও ওদের বাড়িতে যায়নি আর। কলেজের এক্সাম নিয়ে প্রচন্ড বিজি ছিল। পরীক্ষা শেষ হবার পর অতসী টিউশনি পড়াতে গিয়ে একটা খা’রাপ সংবাদ শুনল।

– অতসী। তোমাকে আর পড়াতে আসতে হবে না।
– কিন্তু কেন দিদি।
– ওর জন্য নতুন টিউটর ঠিক করা হয়েছে। এই নাও তোমার আগের মাসের মাইনে।

হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে সরাসরি চলে যেতে বললেন। অতসী আশাহত হয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল।একটা টিউশনি চলে যাওয়া মানে কিছু টাকা কমে যাওয়া। যেটা হলে অতসীকে প্রবলেমে পড়তে হবে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা টিউশনি জোগাড় করতেই হবে।

অতসী মন খারাপ করে রিকদের বাড়িতে পড়াতে গেল।

– কি ব্যাপার অতসী। তোমার মন খারাপ কেন? (রিকের মা।)
– আসলে ভাবি একটা টিউশনি চলে গেছে। আবার নতুন একটা টিউশনি জোগাড় করতে হবে।
– ওহ।
– আচ্ছা ভাবি তোমার চেনা কেউ আছে কি।
– আমি দেখছি। ঠিকাছে।
– হুমম।

অতসীর মনটা কিছুটা ভালো হয়ে যায়।

রাতে…

অতসী নিজের বন্ধ ডাইরির পাতা খুলে একটা ছবির উপরে হাত বোলাতে লাগল। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।

– আমার জীবনটা এতটা দূর্বিষহ না হলেও হতো। আমার জীবনটাও অনেক সুখের হতো, যদি না স্বার্থপর মানুষগুলো নিজের প্রয়োজনে কাউকে প্রিয়জন করত।

অন্যদিকে..

খাঁন ভিলা…
জমজমাট হাসিখুশিতে ভরা পরিবার থেকে হারিয়ে গেছে সমস্ত হাসি। রাতে খাবার টেবিলে সকলেই খেতে বসল।

আকরাম খাঁন খেতে বসে প্রশ্ন করলেন…
– আজকের মেনু কি?

আকরাম খাঁনের বউমা উত্তর দিলো।

– রাইস, চিংড়ির মালাইকারি..

পুরোটা শেষ করার আগেই আকরাম খাঁনের স্ত্রী ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। বউমা সামিয়া কিছু বুঝতে না পেরে বলে উঠলেন…
– কি হলো মা। আপনি কাঁদছেন কেন?

উনি কিছু না বলেই খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে গেলেন। আকরাম খাঁনের মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে আছে, সামিয়া কিছুই বুঝতে পারল না।

– আমার খিদে নাই। তোমরা খেয়ে নাও।

আকরাম খাঁন উঠে চলে গেলেন। সামিয়া নিজের স্বামীর দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকালেন। রুদ্রও মন খারাপ করে নিজের স্ত্রীকে বলে উঠলেন…

– তুমি তো তোমার বিয়ে হওয়া থেকেই দেখছ এই বাড়িতে কখনো চিংড়িমাছ রান্না হয়নি। তাহলে আজকে এত পাকামো করে রান্না করতে গেলে কেন?
– কেন কি সমস্যা।
– এই বাড়ির সকলের প্রিয় একজন চিংড়ি মাছ খেতে খুব ভালোবাসত। তার অনুপস্থিতিতে এই বাড়ি থেকে চিংড়ি খাওয়ায় উঠে গেছে সবার।
– কে সে?

রুদ্র কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায়। সামিয়া বিরবির করে বলল…
– এই বাড়ির মানুষগুলো কিরকম একটা রহস্যে ভরপুর। কেউ কেউ হাসে না, যেন ওদের জীবনে আনন্দ বলেই কিছুই নেয়। সবার এত বিষন্নতার কারন কি?

সামিয়া কি কখনো জানতে পারবে, এই মানুষগুলোর না হাসার কারন!

#চলবে…

#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_১০
#তানজিলা_খাতুন_তানু

অতসীর একটা টিউশনি চলে যাওয়াতে একটু সমস্যার মধ্যে যেতে হচ্ছে। তিনটে টিউশনি পড়িয়ে যে টাকাটা পেত, সেটা দিয়ে ওর জীবন মোটামুটি ভাবে চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু এখন কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, সবকিছু হিসাব করে চলতে হচ্ছে। হতাশ হয়ে রিককে টিউশনি পড়াতে গেল। মেজাজটা এমনিতেই অনেকটা খারাপ ছিল, তার উপরে রিক অঙ্কে ভুল করছিল, তাতে অতসীর মেজাজটা আরো খানিকটা খারাপ হয়ে গেল।

– এসব কি হচ্ছে রিক। এইরকম করলে পড়াশোনা করতে হবে না,পড়াশোনা কোনো ছেলেখেলা নয়।

অতসীর কাছে বকুনি খেয়ে রিকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। অতসী আগে কখনো এইরকম করেনি, ভুল হলে বুঝিয়ে বলেছে, ঠিক করে দিয়েছে। অতসীর এইরকম ব্যবহারে রিক প্রচন্ড কষ্ট পেল। রিকের মা অতসীর রাগান্বিত কন্ঠ শুনে ঘরের ভেতরে আসলেন।

– রিক তোমাকে আজকে আর পড়তে হবে না,তুমি বাইরে যাও। তোমার ম্যামের সাথে আমার কিছু কথা আছে।

মায়ের আদেশ শুনে রিক অতসীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নীচু করে চলে গেল। অতসীর মেজাজটা এখনো প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। রিকের মা অতসীর সামনে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন, অতসী এক ঢোকে পানিটা শেষ করে হাঁপাতে লাগল।

– কি হয়েছে অতসী। তোমাকে আগে কখনো এইভাবে রিয়াক্ট করতে দেখিনি, কোনো সমস্যা?
– ভাবি তোমাকে তো বললাম, আমার একটা টিউশনি চলে গেছে। একটা টিউশনি চলে গেছে মানে, আমার অর্থে টান পড়ছে, আমার নিত্য দিন চালানো কষ্টকর হয়ে উঠছে। সবকিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলাম তাই রিকের উপরে একটু রিয়াক্ট করে ফেলেছি।
– আমি তোমার দিকটা বুঝতে পারছি না। আর তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।
– কি নিউজ।
– আমি একটা টিউশনের খোঁজ পেয়েছি। একটা মেয়েকে পড়াতে হবে। তুমি কি পড়াবে?
– হ্যাঁ। তুমি ঠিকানা বা ফোন নম্বরটা দাও।
– আজকে কি তোমার কোনো কাজ আছে?
– না।
– তাহলে আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি,তুমি গিয়ে দেখা করে আসো। যত তাড়াতাড়ি টিউশনিটা পাবে,ততই লাভ।
– হুমম।

রিকের মায়ের থেকে ঠিকানাটা নিয়ে অতসী বেড়িয়ে পড়ল। টিউশনিটা পেয়ে গেলে অতসীর খুব ভালো হতো। উপর ওয়ালাকে ডাকতে ডাকতে ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এতটাই সবকিছু নিয়ে চিন্তিত ছিল যে, ঠিকানাটা ভালো করে খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে হয়তো, যেত না।

বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থমকে গেল অতসী। বাড়িটা আর কারোর নয় আরোহীদের। অতসী মিতুকে নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছিল, আবার সেই বাড়িতেই যাবে। অতসী ফিরে যাবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু তারপরেই ভাবল টিউশনিটা খুব দরকার। এখন যদি নিজের জেদ দেখিয়ে না করে,তাহলে ক্ষতিটা ওরই হবে।

অতসী কলিং বেল বাজাতে মিতু এসে দরজা খুলে দিলো। অতসী কে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

– অতসী।
– হুমম। আরোহীর টিউশনি করাতে আমি রাজি।
– সত্যি।
– হুমম।
– আচ্ছা ভেতরে আসো তুমি। আরু শুনলে খুব খুশি হবে।

অতসী কে ভেতরে‌ বসিয়ে মিতু আরুকে ডেকে আনলো। আরু তো অতসী কে দেখে খুব খুশি হয়ে যায়,জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে।

– আন্টিকে পেয়ে মনিকে ভুলে যাচ্ছো কিন্তু আরু।
– না মনি আমি কাউকে ভুলিনি। আমি সবাইকে ভালোবাসি।
– তাই
– হুমম।
– আচ্ছা শোনো, তোমার অতসী আন্টি এবার থেকে তোমাকে টিউশনি পড়াবে। তুমি কিন্তু গুড গার্ল হয়ে পড়াশোনা করবে।
– আচ্ছা।
– মিষ্টিবুড়ি তুমি কি আজকে থেকেই পড়াশোনা করবে, না কালকে থেকে করবে।
– আজকেই করব।
– আচ্ছা।

মিতু অতসী আর আরুকে ঘরে নিয়ে গিয়ে,ওকে পড়াতে বলল। তারপর নিজে সোজা মায়ের ঘরে গেল।

– মা।
– হ্যাঁ মিতু মা বল।
– মা আমি অতসী কে আরুর টিউশন টিচার হিসেবে রেখেছি।

মিতুর মা একটু অবাক হলেন মেয়ের কথা শুনে।

– মা।
– হুমম। তোদের দুই ভাইবোনের উপরে আমার বিশ্বাস আছে। আমি তোদের কোনো সিদ্ধান্তকেই অস্বীকার করিনি। তবে যা করিস ভেবে চিন্তে করিস। মা ম*রা মেয়েটাকে একটা মা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোর দাদা তো রাজি হচ্ছে না কিছুতেই।
– হুমম।

বিষয়টা নিয়ে শুধু ওর্ মা নয় মিতুও চিন্তিত। মিতুর বিয়ে হয়ে যাবার পর যে আরু বড্ড একা হয়ে পড়বে। ওর দেখাশোনার জন্য তো একটা লোকের প্রয়োজন, মিতুর মা নিজে অসুস্থ কখন কি হবে কে জানে।

দিন নিজের গতিতে চলতে থাকে। অতসী প্রতিদিন আরুকে পড়াতে আসে, কলেজের পরীক্ষা হয়ে গেছে তাই আর কলেজ যায়নি। কয়েকদিন পর নতুন ক্লাসে এডমিশন,তারপরে আবার ক্লাস চালু হবে।

আদৃত এইসব কিছুর কিছু জানে না। একটা কাজে শহরের বাইরে গেছে, অতসীর আরুকে পড়ানোর বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানে না।

অতসী টিউশনি পড়াতে এসে ফেঁসে গেছে। মিতু আর আরু একটু মার্কেটে গেছে, বাড়িতে মিতুর মা একাই রয়েছেন। অতসীর সাথে উনি কথা বলছেন। তখনি কলিং বেলের শব্দ হলো।

– অতসী মা একটু দরজাটা খুলে দেবে। আমার হাঁটুতে সমস্যা উঠতে পারি না সহজে।
– আচ্ছা আন্টি।

অতসী উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে দেখল, আদৃত দাঁড়িয়ে আছে। আদৃত অতসীর দিকে একনজর তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। হঠাৎ করেই সবকিছুতে এই মেয়ের চলে আসাটা কিরকম একটা অদ্ভুত লাগছে আদৃতের কাছে।

– মা কেমন আছো।

আদৃতের কথা শুনে ওর মা মাথা তুলে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল…
– ঠিক আছি। তুই কেমন আছিস বাবা।
– ভালো। মিতু আর মিষ্টি কোথায়?
– একটু মার্কেটে গেছে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে,আমি তোর জন্য গরম কফি করছি।
– আচ্ছা।

আদৃত নিজের ঘরে চলে গেল। অতসী দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই খেয়াল করছিল। আদৃতের মা ছেলের জন্য কফি বানানোর জন্য সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু পা বাড়াতে পারলেন না। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছেন। অতসীর ভীষণ মায়া হলো।

– আন্টি আপনি বসুন। আমি কফি বানিয়ে দিচ্ছি।
– কিন্তু তুমি।
– আরে আন্টি আমি তো আপনার মেয়ের মতোই নাকি। এইটুকু করতে পারব না।

অতসীর কথার উপরে উনি আর কিছু বলতে পারলেন না। অতসী মিষ্টি করে হেসে ওনাকে সোফাতে বসিয়ে দিলেন।

– আর আপনি কি কিছু খাবেন।
– না মা। আদৃতের জন্য কিন্তু ব্ল্যাক কফি বানাবে।
– আচ্ছা।

অতসীকে উনি রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিলেন। অতসী রান্নাঘরে এসে দেখল, বাড়িটার মতোই রান্নাঘরটাও সুন্দর সাজানো,গোজানো। বোঝাই যাচ্ছে আদৃতের মা গোছানো প্রকৃতির মানুষ।

অতসীকে কফি করবার জন্য বেশি কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। সবটাই সামনেই ছিল, হয়তো আদৃতের মা ছেলের জন্য সবকিছু বের করেই রেখেছিলেন।

– একটা মানুষ ব্ল্যাক কফি কিভাবে খাই, তেঁতো।

ব্ল্যাক কফি খাবার কথা চিন্তা করে অতসীর মুখটা বি*কৃতি রুপ ধারণ করল। অতসী কফি বানিয়ে আদৃতের মায়ের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করল…

– আন্টি কফি।
– আর একটু কষ্ট করো মা। আদৃতের ঘর সোজা গিয়ে ডানদিকে। ওকে একটু দিয়ে আসো।
– আচ্ছা।

এতক্ষন সবটা হাসি মুখে করলেও এই কাজটাতে চরম বিরক্ত হলো অতসী। কারোর ঘরে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে, এই জিনিসটাতেই মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে অতসীর।

দরজার সামনে গিয়ে টোকা মারল। আদৃত সেইমাত্র ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। পরনে একটা ট্রাউজার, আর টি শার্ট, তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল…

– মা তুমি আবার কবে থেকে এত ফর্মাল মেনটেন করতে শুরু করলে।

অতসী হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বলল…
– আমি অতসী।

আদৃত একটু অবাক হলো। অতসীর হাতে কফির মগটা দেখে বলল..

– আপনি কফি নিয়ে আসলেন। মা কোথায়।
– আসলে আন্টির হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না।
– ওহ্। আপনি কফিটা ওইখানে রেখে দিন।

অতসী কফির মগটা রেখে দিয়ে বলল…

– একটা কথা বলবো।
– বলুন।
– আমি যতটা বুঝেছি, আপনাদের কোনো অভিব নেয়। যথেষ্ট সচ্ছল পরিবার। তাই বলছিলাম বাড়িতে যদি একটা সার্ভেন্ট রাখেন,তাহলে আন্টির একটু সুবিধা হয়।

অতসীর এইরকম কথা শুনে আদৃত ওর মুখের দিকে তাকাল। আদৃতের অদ্ভুত ভাবে তাকানোর কারনটা বুঝতে পেরে অতসী বলল…

– আসলে আন্টির হাঁটুর প্রবলেম। মিতুও বাড়িতে থাকে না সবসময়ে, সব কাজ আন্টিকেই করতে হয় তাই বলছিলাম। কিছু মনে করবেন না, আমি গেলাম।

অতসী কথাগুলো একদমে বলে দরজার দিকে চলে যায়। দরজার বাইরে বের হবার আগে একটু জোরেই বলল…

– আর একটা কথা, ওই কুখাদ্যটা কিভাবে খান আপনি?

কথাটা বলে উত্তরের আশা না করেই বেড়িয়ে গেল। আদৃত হা করে তাকিয়ে রইল ওর যাবার দিকে। শেষ কথাটার মানে বুঝতে পেরে আদৃতের ঠোঁটের কোনে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠল।

– অদ্ভুত মেয়ে তো।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে