#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#তানজিলা_খাতুন_তানু
#পর্ব_৫
– কে আপনি?
– আমি আরু মামনি অর্থাৎ আরাধ্যাদের বাড়িতে কাজ করি, দিদিমনি আমাকে আপনার কাছে পাঠালো।
– কিন্তু কেন?
– আরু মামনি খুব অসুস্থ। জ্বরের ঘোরে বারবার আন্টি আন্টি করছে। আপনি যদি যেতেন খুব ভালো হতো তাহলে।
অতসী চিন্তায় পড়ে গেলো কি করবে বুঝতে উঠতে পারছিল না। কিন্তু আরুর শরীর খারাপ শুনে বুকের ভেতরটা কিরকম একটা করছে, অজানা ভয় জমা হচ্ছে। অতসী সমস্ত উটকো ঝামেলাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলল…
– আমি যাব।
– চলুন ম্যাডাম আমি নিয়ে যাচ্ছি।
– না,আমাকে ঠিকানাটা দিন আমি নিজেই চলে যাব।
– কিন্তু ম্যাডাম!
– আমি যখন বলেছি যাব,তখন যাব এতটা চিন্তিত হবেন না। আপনি আপনার দিদিমনি কে আর আরু মামনিকে বলে দেবেন আমি আসছি খুব শীঘ্রই।
লোকটা আর কি বলবে খুঁজে না পেয়ে ওখান থেকে চলে যায়।
অন্যদিকে…
– মা প্লিজ আমি বলেছি না,আমাকে বিয়ের কথা বলবে না কেউ। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে ভালো আছি,, আর আমার মেয়ের খেয়াল আমি একাই রাখতে পারব। মা প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো, আমি নিজের স্বার্থে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারব না।
নিজের ছেলের কথাতে বিরক্ত হলেন মিসেস হাসান। ছেলেকে দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্য হাজার বার বলেও রাজি করাতে পারছেন না।
– বাবা আমার কথাটা একবার শোন।
– না মা,বিয়ে নিয়ে একটাও কথা শুনতে চাই না আমি।
আদৃত রাগ দেখিয়ে চলে যায়। মিসেস হাসান একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলের জীবনটাকে পুনরয়া গুছিয়ে দেবার জন্য চিন্তিত আছেন, নাহলে যে ম*রেও শান্তি পাবেন না।
——–
আদৃত হাসান। একজন ইঞ্জিনিয়ার,একটা প্রাইভেট কোম্পানি চাকরি করে।। মা,বোন আর আরাধ্যাকে নিয়েই সংসার। কয়েকবছর আগে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রী মা*রা গেছে। সেই থেকে আরাধ্যাই ওর পৃথিবী। মা বিয়ের জন্য জোরাজুরি করলেও আদৃত বিয়ে করতে নারাজ। আদৃত চাই না, নিজের স্বার্থে একজন মেয়ের জীবনটা ন*ষ্ট করতে। আর তার থেকেও বড়ো কথা, ওর মনের মাঝে এখন পর্যন্ত ওর প্রথম স্ত্রী আছে,তাকে ছাড়া আর কাউকে মেনে নিতে পারবে না।
——–
আদৃত আরাধ্যার কাছে যায়। সকাল থেকে মেয়েটার জ্বর হয়েছে,ডাক্তার দেখে গেছে কিন্তু জ্বর নামছে না। এটা নিয়ে বড্ড চিন্তিত আদৃত।
– মা মা।
– কি হয়েছে ডাকছিস কেন?
– আরু বারবার আন্টি আন্টি করছে, এই আন্টিটা কে!
– আমি তো জানি না। মিতু হয়ত জানতে পারে।
তখনি কলিং বেলের শব্দ হল। মিসেস হাসান বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিলেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারন সাজপোশাকে সজ্জিত অচেনা মেয়েটিকে চিনতে পারলেন না। তাই তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন…
-কাকে চাই?
– এটা কি আরু অর্থাৎ আরাধ্যার বাড়ি।
– হ্যা কিন্তু আপনি কে?
– আমি অতসী। আরাধ্যার সাথে আমার পার্কে আলাপ হয়েছিল। আপনাদের বাড়ির মেড বলল, আরাধ্যার খুব জ্বর হয়েছে আর জ্বরের ঘোরে বারবার আন্টি, আন্টি মানে আমাকে খুঁজছে তাই, আমাকে এইখানে আসতে বলেছেন আপনারা।
সবকিছু শুনে মিসেস হাসান অনেক অবাক হলেন, এইসবের কিছুই উনি জানতেন না। কথাটা তো সত্যি, আরু সত্যি সত্যিই আন্টি বলে কাউকে খুঁজছিল। কিন্তু একজন অচেনা অজানা মেয়েকে কি এইভাবে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারলেন না। তাই বাধ্য হয়েই আদৃতকে ডাকতে লাগলেন।
– কি হয়েছে মা,এইভাবে ডাকছ কেন?
কথা বলার মাঝে,দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে নজর পড়ল। নিজের মস্তিষ্কে চাপ দিয়েও বুঝল না,সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে।
– কে উনি। (মায়ের উদ্দেশ্য বলল)
আদৃতের মা সংক্ষেপে সবটা বললেন। আদৃত অতসীর দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল…
– আচ্ছা আপনি আসুন।
আদৃত অতসীকে নিয়ে আরুর ঘরে গেল। আরু বিছানায় শুয়ে আছে, একদিনেই কিরকম মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। অতসীর ইচ্ছা করছে,এখুনি আরুর কাছে যেতে।
– আপনি মিষ্টির কাছে যান।
আদৃতের অনুমতি পেয়ে অতসী আরুর কাছে গেল। মাথায় হাত দিয়ে দেখল, গায়ে অনেক জ্বর। অতসী আরুর মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
– আন্টি আন্টি।
– এই তো মামনি আমি এসেছি।
আরু চোখ পিটপিট করে তাকাল। অতসীকে সামনে দেখে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল।
– আন্টি তুমি সত্যি এসেছ।
আরু অতসীকে জড়িয়ে ধরল।
– মামনি তুমি অসুস্থ্ হলে কিভাবে?
– তুমি এসে গেছো, দেখো আমি ঠিক হয়ে গেছি।
– তাই সোনা।
– হুমম।
আরু অতসীর সাথে আড্ডায় মেতে উঠল। আদৃত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,ওদের দিকে। আরুকে আগে কখনো এতটা খুশি হতে দেখেনি,মা ম*রা মেয়েটাকে সব সুখ দিতে পারলেও মায়ের অভাবটা পূর্ন করতে পারেনি।
আদৃতের মা ও সবটা দেখে খুব অবাক হলেন। নিজের মনে মনেই বললেন…
– ভাগ্য কি তবে আমাদের সহায় হলো। আরুর মায়ের অভাব কি এইবার পূরন হবে।
জানা নেয়, ভাগ্য কি লিখে রেখেছে। অতসী আরুকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেই, আদৃত নিজের কাজে বেড়িয়ে গেল। আদৃতের মা বলল…
– মা তুমি কে? তোমার বাড়ি কোথায়?
– আমার নাম অতসী। বাড়ি নেয়,এই শহরে ভাড়াই থাকি।
– আর তোমার বাবা-মা।
অতসী কিছু বলল না। আদৃতের মা ধরে নিলেন, অতসীর বাবা মা জী*বিত নেয়। মেয়েটার প্রতি বড্ড মায়া হলো ওনার।
– আন্টি এইবার আমাকে যেতে হবে।
– আচ্ছা মা এসো।
– আন্টি কিছু না মনে করলে একটি কথা বলতে পারি।
– হ্যাঁ বলো।
– নম্বরটা পাওয়া যাবে? না মানে আরোহীর খোঁজ নিতাম একটু।
– আচ্ছা দিচ্ছি।
আদৃতের মা অতসীকে নম্বরটা দিতে,অতসী ওনাকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। টিউশনি পড়াতে যেতে হবে।
ছাত্রের বাড়িতে কলিংবেল বাজানোর পরে, একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। অতসীকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন..
– আরে অতসী তুমি চলে এসেছে।
– হ্যাঁ ভাবি।
– কিন্তু রিক তো বাড়িতে নেয়।
– কোথায় গেছে।
– ওর বাবার সাথে একটু বেড়িয়েছে,এখুনি চলে আসবে। তুমি ভেতরে আসো, আমার সাথে একটু গল্প করো ততক্ষন।
রিকের মায়ের কথা শুনে অতসী ভেতরে গিয়ে ওনার সাথে কথা বলতে লাগল। রিকের মা বড্ড মিশুকে, অতসী কে বোনের মতো স্মেহ করে সবসময়ে।
– তার বিয়ে করবে না নাকি।
– পড়াশোনা শেষ করতেই পারলাম না এখনো।
– কেন,বিয়ের পর কি পড়াশোনা করা যায় না।
– সংসার নিয়ে পড়লে কি আর পড়াশোনা হয়।
– সেটা অবশ্য ঠিক বলেছে। আমাকেই দেখ না, ১৮ না হতে হতেই বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দিল, তবুও তোমার দাদার সার্পোটে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলাম। রিক আসার পর আর পড়াশোনা হয়নি।
– হুম।
আড্ডার মাঝে রিক ওর বাবার সাথে ফিরে আসে। অতসী রিককে পড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসে। রিকের মা-বাবার সম্পর্কটা অতসীর কাছে বড্ড ভালো লাগে, দুজন দুজনের প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং। সুখের পরিবার,আচ্ছা অতসীর ও কোনোদিন ওইরকম সুখের সংসার হবে।
#চলবে….
#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#তানজিলা_খাতুন_তানু
#পর্ব_৬
অতসী কলেজ যাবার পরেই শাহানার মুখোমুখি হলো।
– কি ম্যাডাম,এতদিন পর কলেজে আসলেন কেন?
– সেটা কি আপনাকে বলতে হবে? শাহানা পথ ছাড়ো,আমার ক্লাস আছে।
– এত পড়াশোনা করে কি হবে? সেই তো খুন্তিই নাড়বি, তোর মতো ছোটলোক আর কি করবে ওটা ছাড়া। (শাহানা হেসে বলল)
– ছোটলোক কাকে বলে জানো! মানুষের ক্লাসে তার ছোটলোক,বড়োলোক প্রমান হয় না। হয় মানুষের ব্যবহারে, আর তুমি নিজের ব্যবহারে নিজেকে বারবার ছোটলোক বলে প্রমান করছ।
– অতসী!
– চেঁচিয়ে লাভ নেয়। চেঁচিয়ে বললেই সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যায় না।
– অতসী তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস।
– বাড়াবাড়ি এখনো করিনি,তবে করতে আমার একটুও সময় লাগবে না। তাই আগে থেকে সাবধানে থাকো।
অতসী শাহানাকে রাগ দেখিয়ে চলে যায়। শাহানা তেজ দেখিয়ে নিজের মনে বিরবির করে বলল…
– ওর এত সাহস কোথা থেকে আসছে,সেটাই বুঝতে পারছি না। এত তেজ, এত এ্যাটিটিউট কোথা থেকে আসছে এটাই আমি বুঝতে পারছি না।
অতসী ক্লাসে যাবার সময়ে চির শ*ত্রুর সাথে মুখোমুখি হলো। অতসী নিজে বিরবির করে বলল…
– শয়তানের মুখ দেখলাম। দিনটাই খারাপ যাবে।
– কি গো সুন্দরী। এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছো।
– কাউকে উত্তর দিতে বাধ্য নয় আমি।
– আমাকেও উত্তর দেবে না। আমি না তোমার জান(শয়তানি হেসে)
– পথ ছাড়ুন।
– তুমি না আমাকে ভালোবাসো? এইভাবে আমাকে ইগনোর করতে পারছ।(করুন কন্ঠে বলল)
– আপনার মুখে ভালোবাসার কথা মানায় না মিষ্টার মিহান। (তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে)
– আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি অতসী। জিনিয়ার সাথে আমার কোনো কিছুই নেয়, আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি…
কথাটা শেষ করার আগেই অতসী মিহানের গালে একটা থা*প্পর দিল।
– তুমি আমাকে থাপ্প*র মারলে?
– ল*জ্জা করে না, এতকিছুর পর আমার সামনে এসে দাঁড়াতে। তোর কি মনে হয় তোর মতো একটা কা”পুরুষকে এই অতসী ভালোবেসেছে। কখনো না, তোর মতো ছেলের দিকে অতসী ঘুরেও তাকায় না।
অতসীর বলা কথাগুলো শুনে মিহানের মেজাজ গরম হয়ে গেল। অতসীর হাত ধরে,পেছন দিকে মোচড় দিয়ে বলল…
– তোর বড্ড তে’জ বেড়েছে। আমাকে কা*পুরুষ বলছিস, এই কা*পুরুষ তোর কি অবস্থা করবে সেটা কল্পনাও করতে পারবি না। তোর সমস্ত অ*হংকার আমি ধুয়োই মিশিয়ে দেব। আমাকে তে*জ দেখাবি না, ফলাফল ভালো হবে না কিন্তু।
– হাতটা ছাড় মিহান। খুব খারাপ কিছু হয়ে যাবে।
– কি করবি তুই?
মিহানের কয়েকজন বন্ধু এসে মিহানকে ছাড়িয়ে নিলো। বন্ধুদের মধ্যে একজন অতসীর উদ্দেশ্য বলে উঠল…
– অতসী তুমি ঠিক আছিস।
– হুম।।
অতসী আর একমুহুর্ত দাঁড়াল না। দৌড়ে কলেজ থেকে বেড়িয়ে গেল।
– এই মিহান পাগল হয়ে গেছিস তুই। পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে কি করছিস,প্রিন্সিপাল স্যার জানলে কি হবে ভাবতে পারছিস।
বন্ধুরা মিহান কে বকাবকি করতে লাগল।
– ওই দুই টাকার মেয়েটার তে*জ দেখেছিস,আমাকে কা*পুরুষ বলছে। ওকে আমি ছাড়ব না।(রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল)
সকলে মিহানকে ঠান্ডা করতে লাগলেও,একজন একটু বেশিই অন্যমনস্ক হয়ে অতসীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল…
– নিজে থেকে কেন নিজের বি*পদ ডেকে আনছ অতসী। মিহানের কালো ছায়া থেকে কি তুমি আদোও র*ক্ষা পাবে কি?
অতসী কোনোরকমে বাড়ি ফিরে এসেই ওয়াশরুমে ঢুকল। মিহানের প্রতিটা স্পর্শই ওর গা ঘিনঘিন করছে, নিজেকে শে*ষ করে দিতে ইচ্ছা করছে।
– হ*ত্যা করা যদি জায়েজ থাকত,তাহলে আমি নিজের হাতে মিহান কে খু*ন করতাম। মিহান তোকে আমি প্রা*নে মা*রব না,ভাতে মা*রব। তোর মুখোশধারী রূপটা সকলের কাছে আমি আনবোই।
সমাজের আনাচে কানাচে মিহানের মতো হাজারো মুখোশধারী মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা ভালোবাসার নামে নিজের স্বার্থ*সিদ্ধি করে বেড়ায়, মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, অনুভূতি নিয়ে খেলা করে। একটার পর একটা মানুষকে ঠকিয়ে যায়। প্রতি*বাদ করতে গেলেই জীবনটাকে ছাড়’খা*ড় করে দেয়।
অতসী ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসল। মাথাটা বড্ড যন্ত্রনা করছ, এত এত প্রেশার এই ছোট মাথাটা নিতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে প্রানভরে শ্বাস দিতে পারছে না।
কিছুটা সময় চলে যাবার পর, অতসী নিজের টিউশনির উদ্দেশ্য রওনা দিলো। টিউশনি না করালে যে পেটের ভাতটাও জুটবে না, পড়াশোনাও করা হবে না।
রাস্তায় যাবার সময়ে, একটা আননোন নম্বরে ফোন আসলো।
– হ্যালো কে?
– আন্টি আমি আরু।
– হ্যাঁ বলো।
– আন্টি তুমি একবার আমার কাছে আসো না। আমার তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছা করছে।
– আচ্ছা মামনি, আমি যাবো তবে অনেকটা দেরি হবে, ঠিকাছে।
– থ্যাঙ্কু আন্টি।
অতসী টিউশনি পড়ানো শেষ করে ,আরোহীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এতদিনে একটা মনের মতো মানুষ পেয়েছে, আরোহীকে দেখলেই অতসীর কিরকম একটা আপন আপন মনে হয়, আদর করতে ইচ্ছা করে।
কলিং বেল বাজানোর পর একজন আদৃতের মা দরজা খুলে দিলো।
– আরে অতসী তুমি এখন।
– আসলে আন্টি আরু আমাকে কল করেছিল। আমার টিউশনি ছিল তাই আমার আসতে দেরি হলো।
– আচ্ছা ভেতরে আসো।
– আরু কোথায়?
– আরু নিজের ঘরে পড়াশোনা করছে,ওর মামনির কাছে।
– আচ্ছা। ওকে কি একবার ডেকে দেবেন।
– তুমি ওর ঘরে যাও,ওহ খুশি হবে।
– আচ্ছা।
আদৃতের মা আরোহীর ঘর দেখিয়ে দিলেন। অতসী ধীর পায়ে আরোহীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দেয়।
-আসবো।
আরোহী অতসী কে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল।
– আন্টি তুমি এসেছ সত্যি।
– হুম মামনি এসেছি।
আরোহী প্রচন্ড পরিমানে খুশি হয়।
– আন্টি চলো আমার মামনির সাথে তোমাকে আলাপ করিয়ে দিই।
– আচ্ছা।
আরোহী অতসীকে টেনে নিয়ে এসে, মামনির সামনে দাঁড় করালো। আরোহীর মামনিকে দেখে অতসী চমকে উঠল।
– তুমি?
– আরে অতসী তুমি এইখানে?
মিতুকে সামনে দেখে অতসী অবাক না হয়ে পারল না। এইভাবে এখন ওকে দেখবে সেটা আশাই করেনি।
– আন্টি তুমি মামনিকে চেন নাকি?
– হুমম।
– তাহলে তো খুব ভালো,আমরা তিনজনে ভালো বন্ধু হবো।
– তাই। (অতসী)
– আরু মামনি তুমি যাও তো,গিয়ে দিদুনকে বলো তোমার আন্টির জন্য কিছু খাবার আনতে।
– আরে এইসবের দরকার নেয় কোনো।
– আরু যাও।
মিতুর কথা শুনে আরু ওখান থেকে চলে যায়।
– অতসী, আমার সাথে এখনো কি বন্ধুত্ব করবে না।
– বন্ধুত্বের প্রতি আমার বিশ্বাসটাই চলে গেছে।
– পুরানো কথাগুলো বাদ দাও না। নতুন করে সবকিছু শুরু করো।
– সবকিছু নতুন করে শুরু করতে বললেই, শুরু করা যায় না। আর আমি মানুষটা বড্ড বেশি অগোছালো, তাই নিজের জীবনটা গুছিয়ে নেবার চেষ্টাও করিনি আমি। যেমন চলছে, সেইরকমই না হয় চলুক। নতুন করে আর কিছু শুরু করার নেয়।
– আর আরুর প্রতি?
– আরু একটা নিস্পাপ শিশু,ওকে আমি কখনোই স্বার্থ দিয়ে কিছু করব না।
– যদি আরুর দায়িত্ব দিতে বলি?
– এসব কি বলছ তুমি?
মিতুর কথা শুনে অতসী কিছুই বুঝতে পারল না। মিতু কিসের দায়িত্বের কথা বলছে।
#চলবে….
#প্রয়োজনে_প্রিয়জন
#পর্ব_৭
#তানজিলা_খাতুন_তানু
-কিসের দায়িত্বের কথা বলছ তুমি?
মিতু মুচকি হেসে বলল…
– এতটা সিরিয়াস হবার কিছু নেয়। আমি চাই,তুমি আরুকে টিউশনি পড়াও।
– কেন?
– আরু তোমাকে এই কয়েকদিনে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে, আর তুমি তো এমনিতেই টিউশনি পড়াও আরুকে টিউশনি পড়াবে?
– ভেবে জানবো। এখন আমাকে ফিরতে হবে,অনেক রাত হয়েছে।
– আমি গাড়ি বলে দিচ্ছি, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
– প্রয়োজন নেয়,আমার একা যাতায়াতের অভ্যাস আছে।
– কিন্তু।
– কোনো কিন্তু নয়। আমি আসলাম।
অতসী মিতুকে বলে সোজা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। মিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতসীর মাথাতে একটা কথাই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে, সবকিছুর পেছনে কি মিতুর কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে?
পরেরদিন স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু চলতে থাকল। অতসীর কলেজ যেতে ভালো লাগছে না,তাই বাড়িতেই থাকল। আজকে নিজেকে একটু সময় দেওয়া দরকার। নিজের পছন্দমতো রান্না করবে, নিজের সাথে সময় কাটাবে। রান্না তো করবে, কিন্তু তার আগে তো বাজার করতে হবে। অতসী বরাবরই বাজার করার বিষয়টা একটু এড়িয়ে চলে, এই বাড়ির পাশে একটা ছোট বাড়িতে একটা ছেলে থাকে,তাকে দিয়েই বাজার করাই।
– বিট্টু .. বিট্টু একবার এইখানে আসো না।
অতসীর ডাক শুনে বিট্টু চলে আসে।
– বলো দিদি।
– আমার জন্য একটু বাজার করে আনবে।
– আচ্ছা দাও। কি কি আনব বলো।
অতসী বিট্টুকে বাজারের লিস্টটা দিয়ে দিলো। বিট্টু পাশের বাড়িতেই একটা ছোট ঘরে ফ্যামিলির সাথে থাকে, বাবা একজন শ্রমিক, বিট্টুর মা অতসীদের বিল্ডিং এর অন্যান্য বাড়িতে কাজ করেন। বিট্টু ক্লাস ১০ এ পড়ে। পড়াশোনাতেও খুব ভালো। অতসীর খুব ভালো লাগে ছেলেটাকে, তাই তো ছোটোখাটো কাজ করিয়ে নিয়ে কিছু টাকা দেয়। সরাসরি টাকা দিলে নিতে চাই না, বড্ড আত্মসম্মান বোধ বিট্টুর।
বিট্টু বাজার করে এনে দেবার পর, অতসী নিজের মতো করে রান্না করলো। রান্না শেষ করে, গোসল করে করে রেডি হয়ে বিট্টুকে ডেকে পাঠাল।
-দিদি ডেকেছিলে।
-হুম ভেতরে আয়।
বিট্টু ভেতরে গিয়ে দেখল, নানা ধরনের খাবার দাবার সাজানো আছে।
– আজকে কি কোনো স্পেশাল দিন দিদি।
– কেন রে।
– না এত রান্না করেছ তাই।
– খুব ইচ্ছা করছিল তাই, তুই বস আমরা একসাথে খাবো আজকে।
– কিন্তু।
– কোন কিন্তু নয়। তুই বস।
অতসী জোর করে বিট্টুকে মেঝেতে বসিয়ে দিলো। বিট্টু না না করছে।
– আমি জানি তুই কেন না বলছিস, আমি খাবার থেকে কিছুটা সরিয়ে রেখেছি কাকু-কাকীমার জন্য। তুই এখন চুপচাপ আমার সাথে খেতে বস।
বিট্টুকে যত্ন করে খাওয়াতে লাগল অতসী।
– দিদি তুমিও খেতে বসো।
– হুমম।
দুজনে মিলে একসাথে খেতে লাগল। আশেপাশের কেউ দেখলে বিশ্বাস করবে না, ওদের দুজনের মাঝে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেয়। কিছু কিছু সম্পর্ক হয়, যেখানে রক্তের সম্পর্কেও হার মানায়।
বিট্টু খাওয়া শেষ করে,নিজের বাবা-মায়ের জন্য খাবার নিয়ে চলে গেল। বিট্টু ওর মায়ের হাতে খাবার গুলো দিতেই উনি বললেন…
– তুই এইগুলো কোথা থেকে আনলি।
– অতসী দিদি দিয়েছে।
– কিন্তু কেন?
– জানো মা, অতসী দিদি খুব খুব ভালো। আমাকে কাছে বসিয়ে কি সুন্দর খাওয়ালো, পুরো দিদির মতো । আমার অতসী দিদিকে না পুরো নিজের দিদিই লাগে। আমাকে খুব আদর করে জানো।
– মেয়েটা সত্যি খুব ভালো। ওর ব্যবহারও খুব সুন্দর আমি দেখেছি।
– হুমম। এখন তুমি খেয়ে নাও,ঠান্ডা হয়ে যাবে।
– হুম।
অতসী থালা বাসন গুলো গুছিয়ে দিয়ে বই নিয়ে বসলো। সামনেই সেমিস্টার। অথচ এখনো অনেক পড়া বাকি আছে। রেজাল্ট ভালো করতেই হবে,নাহলে যে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাবে।
বিকালে…
বিট্টু বক্সগুলো ফেরত দিতে আসে।
– দিদি বক্সগুলো।
– আচ্ছা দে।
অতসী বক্সগুলো নিয়ে বলল…
– তোর পড়াশোনা কেমন চলছে।
– চলছে ওইরকম।
– টিউশনি যাচ্ছিস তো।
– না।
– কিন্তু কেন?
– মাইনে দিতে পারিনি,তাই লজ্জায় আর যায়নি।
– কিন্তু তোর তো সামনে এক্সাম। টিউশনি না গেলে এক্সাম দিবি কিভাবে?
– জানি না।
– আচ্ছা, তুই রাতে আমার কাছে আসবি,আমি যতটা পারব তোকে দেখিয়ে দেব।
– সত্যি বলছো।
– হুমম সত্যি।
বিট্টু খুশিতে লাফিয়ে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
– কি হলো এখন আবার এত খুশি কেন?
– মা দিদি বলেছে,আমাকে টিউশনি পড়াবে।
– সত্যি।
-হুম।
বিট্টু ও ওর মা দুজনেই খুব খুশি হয়ে যায়। বিট্টুর মা খুশিতে কেঁদে দেয়, ছেলে পড়াশোনা করতে পারবে এর থেকে আর খুশির খবর আর কি হতে পারে।
আদৃত অফিস থেকে ফিরে,আরুর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখে,আরু মুখ গোমড়া করে বসে আছে।
– কি হয়েছে আমার মিষ্টিবুড়ির।
– মিষ্টিবুড়ি খুব রাগ করেছে।
– কিন্তু কেন?
– বাপি জানো আন্টি না কালকে আমাকে না বলেই চলে গিয়েছিল। তারপর আর কল করেনি আমাকে একবারো।
– তাই।
– হুমম আমার বড্ড মনে পড়ছে আন্টিকে।তুমি একবার কল করো না।
– কিন্তু আমার কাছে তো নম্বর নেয়।
– আমার কাছে আছে,আমি দিচ্ছি ওয়েট।
আরুর জেদের কাছে হার মেনে আদৃত শেষমেশ অতসীর নম্বরে কল লাগল। কলটা রিং হবার সাথে সাথেই রিসিভ হলো, ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম কন্ঠে অতসী বলে উঠল..
– কে?
ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনে, আদৃতের কিরকম একটা লাগল, গলাটা একটু পরিস্কার করে বলল…
– আমি আরুর বাবা বলছি।
অতসীর ঘুম উড়ে যাচ্ছে। সোজা হয়ে বসে বলল..
– হ্যাঁ বলুন। মিষ্টিবুড়ি ঠিক আছে তো।
– মিষ্টিবুড়ি? (ভ্রু কুঁচকে)
– আরু ঠিক আছে তো।
– হুম। ও বায়না করছিল, তাই আপনাকে বাধ্য হয়েই কল করলাম। কথা বলুন আপনি ওরসাথে।
অতসী আরুর সাথে কলে কথা বলতে থাকে। আদৃত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আরুর দিকে, মেয়েটাকে অতসীর সাথে থাকলে যতটা খুশি দেখা যায়,অন্য কোনো সময়ে সেটা দেখা যায় না। অতসীর মাঝে কি আছে, যেটা আরুকে এতটা খুশি করে দেয়?
আরু কথা বলা শেষ করে আদৃতের কানে ফোনটা ধরিয়ে দেয়। অতসী নিজের মতো বকবক করে যাচ্ছে, আদৃতের কলটা কাটতে ইচ্ছা করল না, চুপচাপ শুনতে থাকল। ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে অতসী আরু আরু বলে ডেকে উঠল…
– হ্যালো আরু আছো!
– হ্যাঁ বলুন।
– আপনি,আরু কোথায়?
– আরু ঘুমিয়ে পড়েছে।
– ওহ। তাহলে গুড নাইট।
– গুড নাইট।
অতসী কলটা কেটে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আদৃত একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে বসল।
– কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, কেন একা করে দিলে। কথা ছিল তো, দুজন দুজনের সাথে সারাজীবন থাকবে, আমাদের রাজকুমারীকে নিয়ে সুখে থাকব। কিন্তু তার কোনো কিছুই তো হলো না,মাঝপথে হাতটা ছেড়ে দিলে তুমি।
আকাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল আদৃত। পূর্নিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে অতীতের পাতাতে চোখ বোলালো…
অতীত….
#চলবে…