#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব–৩২
“”””তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহুর্তের মধ্যে ফিরে এসে,
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়।
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে
যেখানেই রাখি এ হৃদয়।
(জীবনান্দ দাশ…….)
পৃথিবীতে দুটো জিনিস সব থেকে কষ্টের।
এক, ” যখন তোমার ভালোবাসার মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে কিন্তু বলেনা।
দ্বিতীয়, যখন তোমার ভালোবাসার মানুষ তোমাকে ভালোবাসেনা,আর সেটা মুখের ওপরে সরাসরি বলে দেয়।
রুদ্রর ক্ষেত্রে হয়তো দুটিই ঘটলো।কিংবা একটি?রুদ্র বিভ্রান্ত। সেঁজুতি মুখের ওপর বহুবার বলেছে ভালোনাবাসার কথা।প্রতিটি শব্দে তার ঘৃনা ঝরেছে।অথচ চোখ?ওই চোখ দুটো দেখে আদৌ মনে হয়নি সেঁজুতি ঘৃনা করে।উলটে ওই দৃষ্টিতে ভালোবাসা অনুভব করেছে ।অপার ভালোবাসা।
রুদ্র জানলার কাঁচ গলিয়ে আকাশ দেখছে।তারা বিহীন মেঘলা আকাশ।সন্ধ্যায় এক দফা বৃষ্টি হয়েছে।মেঘ এখনও ডাকছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।ওরাও বুঝি বুঝে ফেলল,রুদ্রর মনের অবস্থান?ওরা কী বিদ্র্যুপ করছে?হাসছে আমায় নিয়ে?ধিক্কার করে বলছে,
হাহ!রুদ্র রওশন চৌধুরী কিনা অবশেষে একটা মেয়ের ভালোবাসা না পেয়ে দেবদাস হতে চললো? সেঁজুতি কে পেলিনা?এত ভালোবেসেও না?আজকের রাত ফুরালে কাল তোর প্রেয়সীর গায়ে হলুদ।যদি কাল ও সেঁজুতি না ফেরে?তাহলে কী করবি তুই?দেবদাসের মতো কৃষ্ণচূড়া তলায় আহুতি দিবি?
রুদ্র ঢোক গিলল।উত্তর দিলো, চলে যাব আমি।পালিয়ে যাব। এত দূরে পালাব, যেখানে সেজুতির স্মৃতি তাড়া করে বেড়াবেনা।একদম না।কিন্তু মন মানছেনা।ইদানীং ও এতো বেহায়া হচ্ছে কেন?এই যে, সেঁজুতি যখন বারান্দায় এসে দাঁড়াতো,রুদ্র লুকিয়ে দেখতো।একটা দিন তার এদিক-ওদিক হয়নি।আবির যখনই সেঁজুতির সাথে কথা বলতো,রুদ্রকে গোপনে ভিডিও কলে রেখে দিত।সেঁজুতি বুঝতোনা।মন মরা হয়ে কথা বলাটা রুদ্রর চোখ এড়াতোনা।খুব করে চাইতো,সেঁজুতি একবার বলুক,”আবির!আমি রুদ্রকে ভালোবাসি।কিন্তু প্রত্যেকবার রুদ্র হতাশ হয়।সেঁজুতি বলেনি।চুপ মেরে যেত।
কি করনীয় এখন?ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেবে সব? নাকি জোর করে তুলে আনবে?কিন্তু কি লাভ এতে? আদৌ কোনও দিন সেজুতি ভালোবাসবে তাকে?বাসবে না।বরং ঘৃনার পাহাড় আরো উঁচু হবে।একটুখানি সুখের আশায় আজীবন অবহেলা আর ঘৃনা কে বরন করে নিতে পারবেনা রুদ্র।সেঁজুতির সুন্দর দুটি চোখে শুধু ভালোবাসা দেখতে চায় সে।শুধু ভালোবাসা।
কিন্তু সেই দিন, সেই ক্ষন কী আদৌ আসবে?ধরা দেবে এত সুখ?দেবেনা।সেঁজুতি যদি অন্যকারোর সঙ্গে সুখী হতে চায়।হোক না হয়।ভালোবাসলেই তাকে পেতে হবে,এমন তো কোনো কথা নেই।
রুদ্র চোখ বুজলো।সঙ্গে সঙ্গে দু ফোঁটা অশ্রু গড়ালো কার্নিশ বেয়ে।গাল অব্দি চলল তাদের বিচরন।রুদ্র থাই গ্লাস টেনে জানলা আটকে দেয়।এসে কাউচের ওপর বসে।ছিপি খুলে মদের বোতলে মুখ ডোবায়।বুকের জ্বালা কমছেনা। একটুও না।রুদ্র শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছলো।ভাঙা গলায় বিড়বিড় করলো,
— হয়তো আমার কপালে আপনি লেখা নেই সেঁজুতি।প্রথম বার ভালোবেসেই আমি ব্যার্থ।ঠিকই করেছেন আপনি,আমার মতো একগুঁয়ে জেদি,রাগী, চরিত্রহীন লোককে ভালোবাসা যায়না। একদম না।কিন্তু বিশ্বাস করুন,এই দেহে অসংখ্য নারীর নখের দাগ পরলেও মনে দাগ কেটেছেন শুধুমাত্র আপনি। আপনার পর এই শরীর টা কেউ স্পর্শ করেনি।কাউকে করতেও দেবনা আমি।এখনও আপনার স্পর্শ আমার কাছে জীবন্ত।আপনিই হতেন আমার জীবনের শেষ নারী সেঁজুতি। অাপনিই হতেন।
রুদ্রর কান্নায় শব্দ নেই।অথচ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি গাল ভিজে চুপচুপে।
নিঃশব্দে কাঁদছে।বুক ফেঁটে চিৎকার গুলো বের হতে চাইলেও পারছেনা।রুদ্র প্রশ্রয় দিচ্ছেনা।অন্য কেউ কেন শুনবে তার হাহাকার?কেন বুঝবে,রুদ্র রওশন চৌধুরী ও কাঁদে।তার ও কষ্ট হয়!কাউকে বুঝতে দেবেনা। এ কষ্ট যে একার, শুধুমাত্র তার একারই।
অভ্রর চোখে পানি।চিকচিক করছে কোটর।বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে প্রিয় ভাইয়ের যন্ত্রনায়।দরজার আড়ালে থেকে এতক্ষন সব দেখেছে,শুনেছে।
তার ভাই কাঁদছে? সেঁজুতি কে না পেলে সারাজীবন কাঁদবে।কষ্ট পাবে।কাউকে বলবেনা।গুমরে গুমরে মরবে।না না এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবেনা।
হাতে আর সময় নেই,যা করার এখনই করতে হবে। এক্ষুনি।
___
সেঁজুতি ফ্লোরে বসে আছে।পিঠ দেয়ালে ঠ্যাকানো।হাটুতে মুখ গুঁজে খানিক পরপর কেঁপে উঠছে শরীর।মেয়েটা কাঁদছে।আজ অর্ধমাস,কেঁদেই পার হচ্ছে প্রতিটি ঘন্টা।দুঃখ,শোক যেন পিছন ছাড়ছেনা।আমির আর হোসাইন এক রকম জোর করে সেঁজুতি কে রাফসানের সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছে।ছেলেটির ব্যাপারে হোসাইনের বলা প্রত্যেকটা বিশেষন- ই সঠিক।একে বিয়ে করলে নিঃসন্দেহে সুখী হবে।অথচ,এই সুখ সে চায়না।চায়না অন্য কারো সাথে সুখি দাম্পত্য। যাকে চায়,কেন তাকে পেলোনা?কেন তার মধ্যেই পৃথিবীর সব থেকে খারাপ গুনটি দিলেন সৃষ্টি কর্তা!কেন দিলেন?
রুদ্রর প্রথম ভালোবাসি বলার মুহুর্ত, রুদ্রর নেশালো চোখ দুটি যতবার চোখে ভাসছে দুভাগ হচ্ছে হৃদপিণ্ড। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রুদ্রকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরতে।চিৎকার করে বলতে ‘আমিও আপনাকে ভালোবাসি।
কিন্তু না।সব ইচ্ছে পূরন হবার নয়।রুদ্র তার অধরা ভালোবাসা।চাইলেও ছুঁতে পারবেনা,সারাটাজীবন পস্তানোর ভয়ে।
হঠাৎ মুঠোফোন বাজলো।সেঁজুতির আগের ফোন ভেঙে গেছে।হোসাইন নিজে থেকেই দুদিন আগে এনে দিলো এটা।সিমটা আগেরই।ফোনের শব্দেও সেঁজুতি মুখ তুললনা।কয়েকবার বেজে বেজে কেটে গেলো।সেঁজুতি না ধরলেও ওপাশের ব্যাক্তির কোনো বিশ্রাম নেই।লাগাতার ফোন করছে সে।অবশেষে বিরক্ত হয়ে ভেজা, ফোলা মুখ তুলল সেঁজুতি। উঠে এসে বিছানার ওপর থেকে ফোন তুলে দেখলো অচেনা নম্বর।কে ফোন করেছে?কেন করছে এসব ভাবলোনা সেঁজুতি। রিসিভ করলো।মুহুর্তেই ভেসে এলো একটা পুরুষালি উদ্বীগ্ন স্বর,
” হ্যালো।মিস সেজুতি?
সেঁজুতি গলা ঝেড়ে বলল
” জ্বি।কে বলছেন?
“আমি অভ্র চৌধুরী।
সেঁজুতি অবাক হলো
“আপনি হঠাৎ?
” বলবো।বলতেই তো ফোন করলাম।তা আপনার মূল্যবান সময়ের কিছুটা পাওয়া যাবে কি?
অভ্রর কন্ঠে ঝাঁঝ, বিদ্রুপ,বিরক্তি। সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল
“এভাবে কেনো বলছেন?
” তাও ঠিক।আপনার প্রতি এর থেকেও রুড হওয়া দরকার আমার।
সেঁজুতি অভ্রর এমন আচরনের আগামাথা খুঁজে পেলোনা,
” কি করেছি আমি?
অভ্র তেঁজ নিয়ে বলল,
“আপনি কি করেছেন সেটা আমার থেকে আপনিই ভালো জানেন।একবার এসে দেখুন, কি হারে ড্রিংক করছে ভাই।পাগলের মতো কাঁদছে। খুশি হচ্ছেন তো?
সেঁজুতি চুপ মেরে যায়।বুকের ভেতর উত্থাল-পাথাল শুরু হয়।লোকটা কাঁদছে?আমার জন্যে?কেন কাঁদবে?কই ছিলেন এতদিন?একটা বার তো আমার খোঁজ নিলেন না!বোজা কন্ঠে বলল,
“নিষেধ করুন ওনাকে।
অভ্র যেন আরো চেঁতে গেল,
” বাহ!আমি নিষেধ করলেই শুনবে বলে মনে হয় আপনার?
সেঁজুতি নিশ্চুপ।অভ্রর কন্ঠ হঠাৎই নরম হয়ে আসে,
” একটা কথা রাখবেন আমার?
“বলুন।
” কাল সকালে একবার দেখা করবেন আমার সাথে? প্লিজ!
” কেনো?
অভ্র বলল,
” আসবেন কিনা সেটাই শুনতে চাইছি।শুধু কিছু কথা বলব।
সেঁজুতি উদাস কন্ঠে বলল,
” কিন্তু কাল যে আমার….
অভ্র হাসলো।ফোনের ওপাশে হাসির আড়ালের তাচ্ছিল্য টা দেখলোনা সেঁজুতি।
” গায়ে হলুদ তাইতো? সেতো বিকেলে। অনেক সময়। আমি আপনার বেশি সময় নেবোনা,
কাল একবার আসুন প্লিজ।
“কোথায় আসতে হবে আমাকে?
“জানিয়ে দেবো।
____
জিগাতলা।সকাল সকাল কম ভিড়।এখনও লোক সমাগম জমেনি।রাস্তার এক পাড়ে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে অভ্র।অনেকক্ষন হলো এসেছে।কিন্তু যার জন্যে অপেক্ষা,তার দেখা নেই।অভ্র চিন্তিত।সেজুতি আসবে তো? আজ কিছু কথা বলা যে খুব দরকার।অভ্র হাত ঘড়ি দেখলো।এখানের কাজ শেষ করে অফিস যেতে হবে।ভাই দুদিন অফিসের ধারকাছে ঘিষছেনা।বলতে গেলে মনের জোরটা নেই।অভ্রই সামলাচ্ছে সব।
অভ্র আশেপাশে তাকালো। হঠাৎ দূর থেকে সেঁজুতিকে আসতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটলো।সেঁজুতির রিক্সা এসে থামলো ঠিক অভ্রর সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ফিরতেই অভ্র বলল,
“এলেন তাহলে? কিন্তু একটু দেরী।
সেঁজুতি বলল,
” বাবাকে ম্যানেজ করতে সময় লাগলো।গায়ে হলুদের দিন মেয়ে বাইরে যাচ্ছে বোঝেনিই তো।
সেঁজুতির গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা শোনালো।মেয়েটা কী কেঁদেছে?অভ্র বলল,
“চলুন বসে কথা বলি।
দুজন মিলে কাছাকাছি একটা কফিশপে ঢুকলো।সেঁজুতি কে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে নিজেও বসলো ওর মুখোমুখি।
” বলুন। কেনো ডেকেছেন?
“বলছি।তার আগে আপনি বলুন যে আমার পুরো কথাই শুনবেন আপনি?
সেঁজুতি মাথা দোলায়।এসে থেকে একবার ও অভ্রর চোখের দিক চায়নি।চাইলে হয়ত চাপা ক্ষোভ খুঁজে পেতো।যে দৃষ্টি আরো অপরাধি বানাতো ওকে।
অভ্র ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“মিস সেজুতি!রুদ্র রওশন চৌধুরী আপনার বস,যাকে রাগী, বদমেজাজী,ইগোয়িস্টিক, আর চরিত্রহীন বলেই জানেন আপনি। তাইনা?
সেঁজুতি তাকিয়েছিল।তাইনা কথাটায় আবার নামিয়ে ফেলল চোখ।অভ্র বলল,
“কিন্তু আদৌ কি মানুষ টা এরকম?? আচ্ছা, কোনও মানুষ কি পৃথিবীতে খারাপ হয়ে জন্ম নেয়?নাকী
পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে এভাবে তৈরী করে?
আপনি জানেন, ভাই তার মাকে সহ্য করতে পারেনা! এক কথায় যাকে বলে ঘৃনা করে। অনেক বেশিই ঘৃনা।
সেঁজুতি অবাক কন্ঠে বলল,
“কেনো?
অভ্র নিঁচের দিক তাকালো।ঠান্ডা গলায় ওল্টাতে শুরু করলো রুদ্রর একেকটি অতীতের পাতা,
“ভাই তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার।কোটি কোটি টাকার মালিক তারা।কিন্তু আংকেল,মানে ভাইয়ের বাবা উনি ছিলেন পরিশ্রমে বিশ্বাসী। বাপের টাকায় আরাম আয়েশ করায় ওনার বাধতো।নিজে কিছু করতে চাইতেন।সম্পূর্ন নিজ চেষ্টায়।যেটা ওনার স্ত্রীর ছিলো সব চেয়ে অপছন্দের।যার বাবার এত টাকা পয়সা তার কেন চাকরি করতে হবে?আঙ্কেলের এরকম সিদ্ধান্তে দাদু-দিদুন কখনও আপত্তি করেননি।ছেলে যাতে ভালো থাকবে থাকুক। আঙ্কেল সরকারি চাকরি পেলেন।ফ্যামিলি বিজনেসের প্রতি ওনার ছিলো তীব্র বিতৃষ্ণা। এ নিয়েই আন্টির চাপা ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে।ভাইয়ের বয়স তখন পাঁচ কি ছয়?তখনও দিন ভালো কাটছে।একটা সময় আঙ্কেলের বদলি হলো ঢাকায়।উনি স্ত্রী সন্তান সহ ঢাকায় চলে এলেন।তারপর থেকে শুরু হলো আলাদা সংসার।এর আগে দাদুর ছত্রছায়ায় আন্টির সমস্ত বিলাসিতা পূর্ন হওয়ায় উনি অত প্রতিক্রিয়া করেননি।কিন্তু নতুন সংসারে আসার পর যেটা কালবৈশাখির রুপ নেয়। ভাই নাকী ভীষণ দুরন্ত ছিলেন।আগেতো দিদাই সামলাতো,এবার পুরোপুরি মায়ের কাঁধে পরলো ওকে সামলানোর দায়ভার।রুপচর্চা,নিত্য শপিং, স্বামী সন্তানের প্রতি উদাস চলাফেরা তখন ফুরিয়ে আসতে ধরলো।আঙ্কেল চাকরির টাকায় সংসার ভালোই চালাতেন।কিন্তু আন্টির মনঃপুত হতোনা।ওনার চাহিদা সম্পন্ন করায় আঙ্কেল ত্রুটি না রাখলেও সফল হতে পারেননি।ধীরে ধীরে তাদের মনমালিন্য শুরু হলো।আন্টির চাহিদা কমার বদলে দিন দিন যেন বাড়ছে। এ নিয়ে সংসারে সব সময় অ/শা/ন্তি,ঝ/গ/ড়া ,ক/ল/হ লেগেই থাকতো।আংকেল এর ওপর রাগ, আন্টি মেটাতেন ভাইয়ের ওপর। পাঁচ বছরের ছেলেটাকে মার/ধর করতেন একটুতেই।কখনও বা না খাইয়েও রাখতেন।কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মা তার সন্তানের সাথে এরকম করতে পারে, আমার জানা নেই।ঢাকায় আঙ্কেলের এক ধনী বন্ধু ছিলেন।আশরাফ।আঙ্কেলের সাথে বাসায় আসা যাওয়া ছিল ওনার।আঙ্কেলের সরলতা,বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আন্টি আর ওনার মধ্যে একটা সম্পর্কের শুরু হয়।আই মিন প/র/কীয়া। সংসারে যেটুকু শান্তি বেচে ছিলো তাও নিঃশেষ।ভাইয়ের জন্যে তাদের অবাধ বিচরনে বাঁধা পরতো।কারন ভাই আঙ্কেল কে বলে দিতো।আধো বুলিতে যতটুকু পারতো আর কী!এতে আন্টির ধরা পরার ভয়,রাগ দুটোই বাড়ে। ভদ্রলোক এলেই ভাইকে আগে সরাতেন উনি।অন্য ঘরে আটকে রাখতেন। তারপর মজে যেতেন পাপের দুনিয়ায়। এসব আঙ্কেল তখনও জানতেন কীনা আমি জানিনা।ভাইয়ের বলা কথা উনি কখনও সিরিয়াসলি নেননি হয়ত।দিন এভাবেই যাচ্ছিলো।কিন্তু একদিন,আঙ্কেলের শরীর খারাপ করলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরেন।আন্টিতো আর জানতেননা।তাই সতর্ক হননি।ঐদিন আঙ্কেলের কাছে হাতে নাতে ধরা পরেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী।নিজের বন্ধুর সাথে স্ত্রীকে একই বিছানায় দেখে আঙ্কেল যেন উন্মাদে পরিনত হলেন।কাউকে সাফাই গাওয়ার কোনো সুযোগই দিলেন না।প্রথমেই ছু/ড়ি চালালেন বিবাহিত স্ত্রীর গ/লা/য়।আশরাফ তখন পালাতে চান,ভয়ে মাফ ও চান কিন্তু আঙ্কেল শোনেননি।রাগে,দুঃখে, শোকে পাথর সে কয়েকবার ওনার মাথা দেয়ালের সাথে ঠুকে দেন।ওনার প্রানবায়ু শেষ হয় সেখানে।আঙ্কেল নিজ হাতে তার স্ত্রীর কুকর্মের শাস্তি দেন।
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সেঁজুতি স্তব্ধ,বিমুঢ়। এই কথাগুলো তো রুদ্র গল্পের ছলে বলেছিলো সিলেটে।ওই যেদিন মদ খেলো!অথচ এটা রুদ্রর নিজেরই জীবনের গল্প?এত কষ্ট মানুষ টার?সেঁজুতি কেঁদে ফেলল।কাঁদতে কাঁদতেই শুধালো ‘ তারপর?
অভ্র শান্ত চোখে সেঁজুতির কান্নামাখা মুখটা দেখলো কিয়ৎক্ষন।বলল,
“তারপর আংকেল নিজেই পুলিশ কে খবর দিলেন।দাদু দিদাকেও আসতে বললেন।ভাইয়েরতো একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার।পুলিশ এলো বাসায়।দাদু দিদাও।সব শুনে মাথায় আকশ ভেঙে পরলো তাদের।ভাই মায়ের লা/শ দেখে থরথর করে কাঁপছিলো।পুলিশ যখন আঙ্কেল কে নিয়ে যাবেন,ভাই চিৎকার করে কেঁদেছে।একটা সময় জ্ঞান হারালো।
এদিকে
আংকেল কে কাস্টাডিতে নেয়া হলো।আঙ্কেল সবটা স্বীকার করলেন।জানালেন, তিনিই খু/ন করেছেন ওই দুজন কে।তার জামিন চাইনা।দাদু খুব চেষ্টা করলেন আঙ্কেল কে ছাড়ানোর।কিন্তু প্রকৃতির মতো আঙ্কেল ও বিরোধিতা করলেন।তার বাঁচার ইচ্ছে শেষ। একেতো খু/নের আসামি।তাও আবার দু দুটো।আশরাফ নামিদামি ব্যাবসায়ী। তার স্ত্রী স্বজন সবাই একজোট হয়ে নামলেন হত্যাকারীর বিচারের জন্যে। সব প্রমান আংকেলের বিপক্ষে।
জামিন আর পাওয়া হয়নি।আঙ্কেল ও চাননি।আদালত ফাসির ঘোষণা দিলো।তারপর থেকেই ভাই চুপ হয়ে যায়।কারো সাথে মেশেনা,কথা বলেনা।ওর ঘরই হয় ওর দুনিয়া।মনে মনে মায়ের প্রতি আকাশ সম ঘৃনার জন্ম নেয়।ভালোবাসা,বিশ্বাস এসবের ওপর থেকে আস্থা নড়ে যায়।মেয়ে মানুষ মানেই অর্থলোভী।টাকা পেলে এরা যা কিছু করবে এমন ভাবনা পোষন করে বড় হতে থাকে।দাদুর হঠাৎ মৃত্যুতে ব্যাবসা কাঁধে নিলো।নিজের পরিশ্রম বুদ্ধিদীপ্ততা দিয়ে ক্ষনিকের ঝুলে পরা ব্যাবসা তঁড়াক করে দাঁড় করালো।ভাইয়ের লঞ্জ করা কাপড় দেশ বিদেশে সুনাম কুঁড়ালো।কিন্তু ভাইয়ের ধারনা বদলালো না।যে মায়ের জন্যে তার বাবা,তাদের সংসার টা ভেঙে গেলো সেই মেয়ে জাতীর প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা কমলোনা।হোটেলে একের পর এক মেয়ের সাথে রাত্রীযাপন হলো। প্রমান করলো মেয়ে মানেই অর্থসন্ধানী।স্বার্থপর।কথাটা পুরো সত্যি নয়।কারন হাতের পাঁচ আঙুল পাঁচ রকম।কিন্তু ফেলেও দেয়া যায়না।কারন হোটেলে আসা মেয়ে গুলো তার জ্বলন্ত প্রমান।ওরা স্বেচ্ছায় আসে।টাকা পাওয়ার লোভে।
মায়ের প্রতি ঘৃনা আর বাবার করুন পরিনতিই ভাইকে আজ এমন করেছে।বিশ বছর বয়স থেকেই শুরু এই নারী সঙ্গ।কিন্তু কখনও কোনও মেয়েকে অসন্মান বা জবরদস্তি করে নয়। লোভের বশবর্তী আর ভাইয়ের নৈকট্য পাওয়ার আশায় কিছু মেয়ে এমনিই আসতো।তবে রাত ছাড়া মেয়েদেরকে কখনওই নিজের ধারে কাছেও ঘিষতে দেয়নি ভাই।
সেঁজুতি হা করে শুনছে।অভ্র বিরতি নিলো একটু।তারপর ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
কিন্তু বিশ্বাস করুন,ভাইয়ের জীবনে যেদিন আপনি এসেছেন? সেদিন থেকে হোটেলে আর একটি মেয়েও আসেনি।ইনফ্যাক্ট ভাই তো হোটেলের সামনে বড় করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে নারী প্রবেশ নিষেধ।
অভ্র মৃদূ হাসলো কথাটা বলে।
ভাইয়ের মনে শুধু আপনিই আছেন সেজুতি। শুধু আপনি। আপনি জানেন? ভাইকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি।কিন্তু কাল দেখেছি।প্রথম বার।কাঁদছিলো ভাই, শুধুমাত্র আপনার জন্য। ভাইয়ের মন স্পর্শ করেছেন আপনি।যার গভীরতা এতোই বেশি যে ভাই এখন পুরো পৃথিবীর বিনিময়ে হলেও আপনাকে চায়। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই কিছু খারাপ গুন থাকে সেজুতি।কারোর টা হয়তো খুব বেশিই খারাপ হয়!কিন্তু তাই বলে তাকে শুধরানোর সুযোগ টুকু দেবেন না? ভাইতো যথাসম্ভব নিজেকে পাল্টেছে। তাও আপনার জন্যে।আপনি বললে নিজেকে পুরোপুরি পাল্টাতে দুবার ভাববেনা।আর কি চাই আপনার?
আপনি জানেন?ভাইকে বলা হয়েছিলো আপনাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে।অথচ ভাই তা চায়না।চায়না জোর করে আপনাকে পেতে। আপনি ভালোবেসে ধরা দেবেন এটাই ভাইয়ের ইচ্ছে।
সেঁজুতি ডুকরে কেঁদে উঠলো। টেবিলের ওপর হাত রেখে মুখ গুঁজে হুহু করে কাঁদলো কিছু সময়। অভ্র সময় দিলো সেঁজুতি কে।হাল্কা হোক মেয়েটা।অনেকক্ষন পার হলে অভ্র নিজেই বলল,
“আপনি কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করেননি।
সেঁজুতি মাথা তুলল।ভেজা কন্ঠে শুধালো ‘ কী?
অভ্র মুচকি হাসলো,
” আমি ভাইকে ভাই বললেও ওর বাবা মাকে আঙ্কেল- আন্টি বলেছি।
সেঁজুতির ভ্রু কুঁচকে আসে।সত্যিইতো!এটা খেয়াল করেনি এতক্ষন।সেঁজুতির জিজ্ঞাসু চেহারায় অভ্র ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
” এর কারন,আমি ভাইয়ের নিজের কেউ নই।ভাই আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলেন।
সেঁজুতি চমকে তাকায়।অভ্র বলল,
‘আমি আমার বাবা মাকে কখনও দেখিনি।জানিওনা তারা কারা।রাস্তায় ভিক্ষা করতাম।পড়নে ছেড়া কাপড়, গায়ে পায়ে ময়লা( উদাস হেসে)।ভাই নিজেও তখন ছোট।আমার থেকে পাঁচ বছরের বড় ভাই।
একদিন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুটি খাচ্ছি।দূর থেকে দেখলাম একটা ছেলে স্কুলে ঢুকতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরলো।পিচের রাস্তা,হাত পা ছিলেও গেছিলো।আমি ছুটে গিয়ে হাত বাড়াই।ছেলেটি কতক্ষন আমাকে দেখে আমার ময়লা হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়।আমি তার হাতে পায়ের ময়লা ঝেড়ে দেই।পড়নের জামা টা খুলে ছিড়তে থাকি।ছেড়া টুকরো গুলো দিয়ে কে/টে যাওয়া জায়গা বেধে দিই।ছেলেটি ছিলো ভাই।ভাই সেদিন অবাক চোখে আমাকে দেখছিলো।মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো আমার নাম কী?কোথায় থাকি?
যখন জানলো আমি এতিম, ভাই বিনা সঙ্কোচে আমাকে সাথে নিয়ে চলল।বলল, “আজ থেকে তুই আমার ছোট ভাই।সেই থেকে আমার পরিচয় বদলালো।এতিম ছেলেটাকে ভাই নিজের পরিচয় দিলো।সাথে আমার নামে আলাদা ব্যাবসা,গার্মেন্টস এসব তো রয়েইছে।এতক্ষন আপনাকে যা যা বললাম ভাইয়ের পরিবার নিয়ে? এগুলো ভাইয়ের দিদার থেকে শোনা আমার।
সেঁজুতি ফিঁচেল কন্ঠে বলল ‘ উনি এত উদার?
অভ্র হাসলো,বলল,
আবির বিবাহিত হওয়া স্বত্তেও বিয়েতে রাজি হয়,সেটা কিন্তু ভাইয়ের কথায়।
সেঁজুতি বিস্মিত।অভ্র আবার বলল,
‘ ভাই আসলে দেখতে চাচ্ছিলো আপনি সত্যিই বিয়ে করেন কীনা!ও এখনও বুক বেঁধে আছে এই আশায়,আপনি ফিরবেন।ওহ হ্যা আরেকটা কথা, আবির আপনাকে বলেছিলেন,এগ্রিমেন্টের টাকা দিয়েছেন উনি।এটাও কিন্তু মিথ্যে।
সেঁজুতির দুচোখ ভার হয়ে আসছে,
‘ কিন্তু এসব করে কী পেলেন?
‘ ওই যে বললাম,ভাই তার ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছিলো।আপনাকে যেদিন আংটি পরাতে যায় আবিরের পরিবার।আংটি হারিয়ে যায়।মনে আছে নিশ্চয়ই?
সেঁজুতি মাথা দোলায়।অভ্র হেসে বলল ‘ আবির সরিয়েছিলো।তাও ভাইয়ের পরিকল্পনা মাফিক।ভাই চায়নি অন্য কেউ আপনার আঙুলে আংটি পরাক।আপনি অন্যকারো বউ হবেন তাতো আরোই না।অথচ দেখুন, আবিরের সাথে আপনার বিয়ে না হলেও অন্য কারো সাথে কিন্তু ঠিকই হচ্ছে।
সেঁজুতি মাথা নিচু করে ফেলল।অভ্র বলল,
ভাই আপনাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে সেঁজুতি। দিন তারিখ আমার ঠিক জানা নেই।সেই ভালোবাসা অনুভব করতেই ও চাকরির অজুহাতে আপনাকে নিজের আশপাশে রেখে দেয়।এগ্রিমেন্ট ও একটা ছুঁতো ছিলো।যাতে আপনি চাইলেও দূরে যেতে না পারেন।ভাই কিন্তু জানতো আপনি ওকে দেখতে পারেন না।কেন পারেন না সেটা আমি জানিনা।তারপরেও ভাই আপনাকে ভালোবেসেছে নিঃস্বার্থ ভাবে।যেভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে আপনার অগোচরে।
আপনাদের কাজের মেয়েটি?উম,শেফালী?ও কিন্তু ভাইয়ের কথাতেই আপনাদের বাসায় কাজ নিতে যায়।আপনার থেকে বেতন নেয়া একটি অভিনয়ের অংশ।পাছে আপনি বুঝে ফেলেন!আপনি প্রতিদিন অফিসে দেরি করতেন।ভাইয়ের এতটুকু দেরিও সহ্য হতোনা।আপনাকে ছাড়া প্রত্যেকটা সেকেন্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগতো।একদিন খোঁজ নিয়ে জানলো আপনি পুরো বাসার দায়িত্ব পালন করে তারপর অফিসে আসেন।তাই ভাই শেফালীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।এতে অবশ্য এক ঢিলে ওর দুই পাখি বধ হলো।এক আপনি ঠিক সময় অফিসে এলেন,আপনার কষ্ট কমলো আর দ্বিতীয় টা না হয় না বলাই থাকুক।
সেঁজুতি মূর্তির মত বসে আছে।চোখে পলক অব্দি পরছেনা।রুদ্র এতভাবে সাহায্য করেছে?এত ঋন তার রুদ্রর প্রতি?কী দিয়ে শোধ করবে এই ঋন?ভালোবাসা কী যথেষ্ট হবে?
অভ্র সেঁজুতির হাতের ওপর হাত রাখলো।আকুতি নিয়ে বলল,
“সেঁজুতি! আপনাকে ছাড়া আমার ভাই বাঁচবে কিন্তু ভালো থাকবেনা। ম/রার মত বাঁচার কি স্বার্থকতা?
আচ্ছা, আপনিই বলুন,” যে আপনার জন্যে তার খারাপ অভ্যাস গুলো কে পরিত্যাগ করতে পারে,যার প্রত্যেকটা ভাবনাই শুরু হয় আপনার ভালো থাকা না থাকা দিয়ে তার ভালোবাসায় সন্দেহ থাকে কখনও?
এই ভাবে আমার ভাইকে শেষ করে দেবেন না।প্লিজ!,আমি অনুরোধ করছি।ভাইকে ভালোবাসলে কোনও দিনও ঠকবেন না আপনি।একবার বিশ্বাস করেই দেখুন।প্লিজ!
সেঁজুতি নিঃশব্দে কাঁদছে।অভ্র হাত সরিয়ে বলল ‘ আমার ধারনা মিথ্যে হবেনা।আপনার চোখ,আপনার এই কান্না বলে দিচ্ছে আপনিও ভাইকে ভালোবাসেন।তাহলে কেন করছেন বিয়েটা?এখনও সময় আছে ভেঙে দিন।ফিরে যান ভাইয়ের কাছে।আপ__
অভ্র পুরোটা শেষ করতে পারলোনা।এর আগেই সেঁজুতি মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল।কফিশপের অনেকে এতক্ষন দেখছিলো তাদের।সেঁজুতির বেরিয়ে যাওয়ায় অভ্রর নিরস মুখ দেখেই শুরু হলো তাদের কানাঘুষা। অভ্রর তাতে মন নেই।সে ভাবছে সেঁজুতির যেতে যেতে বলা কথাগুলো ‘ আমি পারবনা,আমি পারবনা।
অভ্র বরাবরই নরম মনের মানুষ। চোখ জ্বলে উঠলো তার।এক দু ফোঁটা অশ্রু গড়ালোও।সেকী তবে পারলোনা,ভাইয়ের ভালোবাসা পাইয়ে দিতে?
চলবে?