#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২৮
আবির হতবাক।কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছে।অবিশ্বাস তার চোখেমুখে। রুদ্র হাসছে।বরাবরের সূক্ষ্ণ হাসিটা।আর সেই হাসি গোল চোখে দেখছে আবির।
মাত্রই শুনলো,রুদ্র সেঁজুতিকে ভালোবাসে।শুধু ভালোইবাসে না, ভালোবেসে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছেন।রুদ্র মজা পাচ্ছে আবিরের মুখ দেখে।ছেলেটা এবার ভালোয় ভালোয় সেঁজুতির পেছন ছাড়লে হয়।মশা মেরে হাত নষ্ট করতে কার-ই বা ভালো লাগে?আবিরের মুখ অর্ধখানেক ফাঁকা হয়ে আছে।রুদ্র টেবিলের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বলল,
“মি:আবির!আপনার সাথে আমার ভাই অভ্রর বেশ সাদৃশ্য আছে। জানেন কী?
আবির দুদিকে মাথা নাঁড়লো।সে জানেনা।রুদ্র কৌতুক কন্ঠে বলল,
“অভ্র আর আপনি দুজনেই আন-এক্সপেক্টেড কিছু শুনলে মুখ হা করে থাকেন।এই যে,এখন আপনি যেমন রয়েছেন।
আবির সম্বিৎ ফিরে পেলো।নঁড়েচড়ে গলা ঝাঁড়লো,
চেহারায় একটু সিরিয়াস ভাব নিয়ে এলো।নিশ্চিত হতে শুধালো,
” আপনি সত্যিই সেঁজুতিকে ভালোবাসেন?
“মিথ্যে মিথ্যে ভালোবাসা যায় নাকি??
“না ঠিক তা নয়। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি যে আপনার আর সেঁজুতির স্টাটাস তো এক নয়।কোথায় আপনি অার কোথায় সেঁজুতি!আপনি এত বড় একজন বিজনেসম্যান, আর সেঁজুতি সেখানে সামান্য মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে।তাহলে ব্যাপারটা কি করে? মানে ঠিক বুঝতে পারছিনা আমি।
“এটাই তো ভালোবাসা মি: আবির।কখন কার প্রতি কার অনুভূতি জন্মাবে সেটা আগে থেকে না বলা যায়, আর না নিয়ন্ত্রণ করা যায়।আমার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে।সেঁজুতি আর আমার মধ্যে অর্থের তফাৎ আমি কোনো দিনও আসতে দেবোনা।আমাদের মন এক হবে।বাকী সব আলাদা হোক।চূলোয় যাক আই ডোন্ট কেয়ার!
এনি ওয়ে,সব টাই আপনাকে বলেছি আমি।বলার প্রয়োজন যদিও ছিলোনা তাও বলেছি।
কেনো জানেন?
“কেনো?
” কারন,আপনার সাথে কথা বলে আজ মনে হলো আপনি একজন ভদ্র মানুষ।তারওপরে সেঁজুতির ছোট বেলার বন্ধু।আপনার সাথে দ্বিতীয় বার অশোভনীয় কিছু করতে আমার মন স্বায় দিচ্ছেনা।
আবির ভ্রু কুঁচকে বলল ‘ দ্বিতীয় বার মানে?
রুদ্র চেহারায় সেই গম্ভীর ভাবটা নিয়ে এলো আবার। স্পষ্ট ভাষায় বলল
‘ সিলেটে ছিনতাইকারীর বেশে যারা আপনার ওপর আক্রমন করে?ওরা আমার লোক,আমিই পাঠিয়েছিলাম ওদের।
আবিরের কাশি উঠে গেলো কথাটায়।রুদ্র পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ত্রস্ত হাতে নিলো।ভয়ে ভয়ে চেয়ে থেকে ঢকঢক করে খেলো পানিটুকু।অস্পষ্ট কন্ঠে বলল
” আপনি!
রুদ্রর নিরুদ্বেগ জবাব
‘ হ্যা আমি।আপনি সেঁজুতির আশেপাশে বেশি ঘেষাঘেষি করতেন,যেটা আমার পছন্দ হয়নি।তাই আপনাকে একটা ছোট্ট শিক্ষা দিতে চাইলাম।দিয়েও দিলাম।আপনিও বোঁকা।ছিনতাইকারী আপনার ওপর হামলা করবে অথচ ফোন,ওয়ালেট এসব কিছুই নেবেনা?শুধু আপনাকে কটা বারি দিয়ে রেখে যাবে?ফানি না?
আবির বড় বড় চোখে ঘনঘন পাতা ফেলল।কি ডেঞ্জারাস লোক!এরকম একটা ঘটনা ঘটিয়ে অকপটে স্বীকার করছে?এর কী প্রসাশনের ভয়ও নেই?
রুদ্র যেন শুনতে পেলো।দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ রুদ্র রওশন চৌধুরী কাউকে ভয় পায়না।একমাত্র সৃষ্টি কর্তা ছাড়া।
আবিরের চোখ পারলে লাফিয়ে আসে বাইরে।ইনি কী মনের কথাও শুনতে পায়?
রুদ্র শান্ত অথচ কঁড়া কন্ঠে বলল,
“আপনি ভদ্রলোক।আমিও ভদ্রলোক।তাই ভদ্রভাবেই ব্যাপারটা মেটাতে চাইছি।জেনেই নিলেন আমি সেঁজুতিকে ভালোবাসি।আর রুদ্র রওশনের ভালোবাসা তার রাগের থেকেও মারাত্মক। এবার আর আপনি আমাদের মাঝখানে আসবেন না আশা করি। আর সব শুনেও যদি আসতে চান, তো আমার অন্য রুপটাও দেখাতে বাধ্য হব আবির।আই সোয়্যার,এবার আর আপনার হাত পায়ের ওপর দিয়েই যাবেনা শুধু।
কি সুন্দর হুমকি!কি অবলীলায় দিলো রুদ্র।আবিরের ভয় পাওয়া উচিত।অথচ সে মুচকি হাসলো।রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো এতে।আবির লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
” আপনার কোথাও একটু ভুল হচ্ছে মিস্টার চৌধুরী।
রুদ্র ভ্রু বাঁকালো,
“ভুল?আপনি যাই বলুন না কেনো আবির,এটুকু বোঝার বুদ্ধি আমার রয়েছে।সেঁজুতির প্রতি আপনার দরদ,আপনার অনুভূতি কতটা তীব্র আমি জানি।
আবির এবার হেসেই ফেলল শব্দ করে।রুদ্রর চোয়াল শক্ত হলো।সে কী জোক্স বলল?এভাবে হেসে কী প্রমান করছে ছেলেটা? আবির হাসি থামিয়ে বলল
” একটা কথা আপনি ঠিক বললেন,সেঁজুতির প্রতি আমার দরদ, আমার অনুভূতি এসব অনেক প্রবল।এই প্রবল অনুভূতি দিয়ে যদি আপনি ভালোবাসা বোঝান, তবে বলবো আপনি অবশ্যই ভুল করছেন।কারন সেঁজুতি আমার বন্ধু,ইনফ্যাক্ট খুব ভালো বন্ধু। আমার বয়স যখন আট বছর,চার বছরের ফুটফুটে সেঁজুতি কে আমি কোলে নেই।প্রথম বারেই ও আমাকে খামঁচে দেয় জানেন?আমি তাতে রাগিনি।উলটে হেসে ফেলি।সেঁজুতির হয়ত তাতে আমাকে ভালো লাগে।ও-ও হাসলো।আর এরপর থেকে আমার পিছুই ছাড়লোনা।মাকে নকল করে আমাকে নাম ধরে ডাকতো।আবির টা উচ্চারন করতো “আবিল “বলে।আমার ভীষণ হাসি পেতো ওই ডাকে।সবাই বলতেন ভাইয়া ডাকো,ও তোমার বড়।কিন্তু ও কী কথা শুনবে?শোনেনি।নাম ধরেই ডাকে।যেটা এখন অব্দি ওর অভ্যেস।যেদিন আমি দেশ ছাড়ি?এয়ারপোর্টে আঙ্কেল নিয়ে যান ওকে,ও আমার গলা জড়িয়ে কাঁদে। কিছুতেই আমাকে ছাড়বেনা।সেদিন ওর প্রতি আরো বেশি মায়া অনুভব করি।সিঙ্গাপুর গিয়ে প্রথম প্রথম খাপ খাওয়াতে পারিনি।বাড়ির কথা,সেঁজুতির কথা ভীষণ মনে পড়তো। তাই বাবা যোগাযোগ কমিয়ে দেন।আমার শক্ত হওয়ার খাতিরে।আমিও আস্তে আস্তে পড়াশুনা,হৈ হুল্লোড়ে ব্যাস্ত হয়ে পরি।ভুলে যাই সব।সেঁজুতি কেও।তেমন সেঁজুতিও ভুলে যায় আমাকে।বারো বছর পর আবার দেখা হয় সিলেটে।আমি ওকে চিনে ফেললেও ও পারেনি।আমি ওর সাথে মজা করার জন্যেই ওমন কাছেকাছে ঘিষতাম।কৌশলে জানতেও চেয়েছিলাম,ও আমাকে আসলেই চিনলো কীনা! কিন্তু ওর কাছে যাওয়াটা আপনার চক্ষুশূল হবে তা কিন্তু আমার জানা ছিলোনা।সেঁজুতি কে আমি শুধুই বন্ধুর চোখে দেখি।সারাজীবন দেখব।আর একজন বন্ধু তার বন্ধুর ভালো চায় বলেই আমি আজ এখানে ওর হয়ে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম।এখানে দ্বিতীয় কোনো কারন নেই মিস্টার চৌধুরী।
আবির থামতেই রুদ্র সন্দেহী কন্ঠে বলল,
“আপনি যে সত্যি বলছেন তার কি মানে?কেনই বা আমি বিশ্বাস করব আপনাকে?
‘বিশ্বাস করা না করা আপনার ওপর। সেখানে আমার হস্তক্ষেপ কোনো কাজে আসবেনা।আপনি আপনার জায়গায় একদম সঠিক।কারন,আমরা যাকে ভালোবাসি তার আশেপাশে অন্য কারো সামান্য বিচরন আমরা মেনে নিতে পারিনা।হিংসে হয় সেই লোকের প্রতি। যেমন আপনার হয়েছিলো,আমার ওপর। তবে এটাই সত্যি,বন্ধুত্বের বাইরে আমি সেঁজুতিকে আলাদা ভাবে কখনও দেখিনি।আর এর থেকেও একটা বড় সত্যি হলো,
“আ’ম অলরেডি ম্যারিড।
রুদ্র চমকে বলল ”What!
” ইয়েস!এক বছর হতে চললো আমি বিয়ে করেছি।
রুদ্র অবাক কন্ঠে বলল,
“কিন্তু আমিতো ইনফরমেশন পেয়েছিলাম__
আবির মাঝপথে আটকে দিলো,
“এটা সবাই জানেনা।এর ভেতরের গল্প টা আমি আপনাকে বলছি…
আবির নিঃশ্বাস ফেলল,
“বাবা বরাবর ভালো ছাত্র ছিলেন।ওনার কাছে পড়াশোনার অনেক মূল্য।আমিও যৎসামান্য ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম।তাই বাবার ইচ্ছেতে সিঙ্গাপুর পড়তে যাওয়া ঠিক হলো।একটা সময় সেখান কার ভার্সিটি পড়াকালীন আলাপ হয় এরিকার সঙ্গে।আমার ওয়াইফ।ও অন্যান্য বিদেশিদের মতো নয়।একদম আলাদা।উগ্রতা ছিলোনা।উলটে মায়াবি,কেয়ারিং আর ভীষণ মার্জিত বলেই অজান্তেই ওকে মন দিয়ে ফেলি।ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে প্রোপোজ করলে ও বলল ভেবে দেখবে।দেড় মাস পর হ্যা জানালো।আমার খুশির অন্ত ছিলোনা সেদিন।কিন্তু ভয় পেতাম,দুজন আলাদা ধর্ম,বাবা কী মানবে?ওনাকে আমি জমের মতো ভয় পেয়ে আসছি সেই ছোট বেলা থেকে।ভাবলাম একবার বিয়ে হলে নিশ্চয়ই আর অমত করার সুযোগ থাকবেনা।বাধ্য হবে মানতে।সেই চিন্তা করেই আমি এরিকাকে বিয়ের কথা বলি।ওর তো কোনো ভয় ছিলোনা।ও এক কথায়ই স্বায় দিলো। কিন্তু এখনও বাড়িতে কিছুই জানাতে পারিনি আমি।
” কেন?
“আসলে বাবা মা দুজনকে নিয়েই ভয়। মা একজন ইমামের মেয়ে ছিলেন। উনি নিজেও পর্দা করেন।মন-মানসিকতা কেমন হবে বুঝতেই পারছেন?বিদেশী মেয়ে মানেই উগ্রো,বেয়াদব,ছোটো ছোট জামাকাপড়, পার্টি,নাইটক্লাব এ দেশের কালচারের সাথে মিলবেনা এসব ভাবনা তো রয়েইছে।আর তার সাথে ও দ্বি-জাতি। মানে খ্রিস্টান। মা শুনলে কি রিয়্যাক্ট করবে না করবে সেসব ভেবেই এখনও চুপ আছি।বিয়ে তো করে নিলাম কিন্তু নিজ গৃহে এরিকাকে দায়িত্বের সহিত নিয়ে আসতে পারছিনা।
রুদ্র বলল,
“কিন্তু জানাতে তো আপনাকে হবেই,।আজ না হোক কাল।আফটার অল সি ইজ ইওওর ওয়াইফ নাও।
আবিরের মুখে অন্ধকার,
“সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।ওদিকে এরিকাও দেশে আসার জন্যে প্রেশার ক্রিয়েট করছে।কোনও রকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে এসেছি যে আগে সবটা ম্যানেজ করে নেব, তারপর ওকে নিয়ে আসবো।কিন্ত এসে থেকে এক কদম ও আগাতে পারছিনা।আমি যে কেন এত ভীতু!
‘ ধৈর্য রাখুন।এভ্রিথিং উইল বি ফাইন!
আবির মাথা নাঁড়লো।ওর সমস্যার কথা শুনে খারাপ লেগেছে রুদ্রর।কিন্তু ভেতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ও বেরিয়েছে।বুকের ওপর থেকে নেমে গেছে একটা বড় পাথর।এতদিন যাকে গলার কাঁটা ভেবে এলো,সে আসলে কাঁটার ধারেকাছেও না।শুধু শুধু আবির কে নিয়ে তার এতো চিন্তা হচ্ছিলো।ধুর!
আবির চিন্তিত মুখে মাথা নীচু করে বসে আছে।রুদ্র ওর হাতের ওপর হাত রাখলো।নম্র কন্ঠে বলল,
” চিন্তা করবেন না।যে কোনো হেল্প লাগলে আমাকে জানাবেন।
_____
অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই রুদ্রর কেবিনে ডাক পরলো সেঁজুতির।অবাক হলো।অন্তত একটু বসে জিরোতে দে!এমনিতেই আজ প্রচন্ড গরম।সকাল বেলা এত্ত জ্যাম! গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার প্রায়।ঠিক দশটায় ঢুকতে পারেনি,দশটা পাঁচ বাজে এখন।এই জন্যেই কী ডাকছে?পাঁচ মিনিটের বিলম্বে ঝারি দেবেন বলে?কাঁধ ব্যাগ টা ডেস্কের টেবিলে রেখে পা বাড়ালো সেঁজুতি ।তীব্র অনিহা মনে।তাও কিছু করার নেই।কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই রুদ্র রিমোর্ট দিয়ে দরজা খুলে দেয়।অর্থ,সে নিরবে অনুমতি জানালো।সেঁজুতি ঢুকলো ভেতরে।
‘ডেকেছেন স্যার?
রুদ্র সরু চোখে তাকালো,
“মাত্রই এলেন?
“জ্বি।
রুদ্র পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো,
“খেয়ে নিন।
” লাগবেনা।
রুদ্র তপ্ত চোখে তাকালো।সাথে সাথে টেবিল থেকে গ্লাস ওঠালো সেঁজুতি। আসলে তেষ্টা পেয়েছিল।রুদ্র দিয়েছে বলেই খেতে চায়নি।কিন্তু এই লোকের চাউনি?মারাত্মক।তার ওপর এটা অফিস।সিনক্রিয়েট হোক চায়না সেঁজুতি। পানি খেয়ে ভেজা ঠোঁট হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে বলল,
“এবার বলুন।
পুরোটা সময় রুদ্র চেয়েছিলো।সেঁজুতির প্রশ্নে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,”কি বলবো?
” ডেকেছেন কেনো?
“ও হ্যা, আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো।
রুদ্র উঠে এলো।সেঁজুতির কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো ওমনি।এই লোক চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ানো মানে ভয়ানক কিছু ।কখন কি বলবে, কি করবে, কেউ জানেনা।রুদ্র সেঁজুতির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।সেঁজুতি এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে মেঝেতে। রুদ্র পা দুটো ফাঁক করে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালো।পরমুহূর্তে ঝুঁকে গিয়ে ফু দিলো সেঁজুতির মুখে।সেঁজুতি থমকে গেলো।কপালের চুল গুলো উড়ে উঠলো ক্ষনবায়ুতে।সেঁজুতি বাকরুদ্ধ তখন।ঢোক গিলে বলতে নিলো ‘ আপ…
রুদ্র থামিয়ে দিলো।ফিসফিস করে বলল ‘ কিছু বলার দরকার নেই।আমি জানি আমি চরিত্রহীন।অসভ্য।
সেঁজুতি চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ে থাকলো।রাগ করতে চাইছে খুব।কিন্তু কোনওভাবেই রাগ টা বের হচ্ছেনা।কেন?
রুদ্র সোজা হলো।আগের মতোই গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনার নামের মানে আমি বার করে ফেলেছি।সেঁজুতি। মানে, সন্ধ্যা প্রদীপ।আই মিন অন্ধকার দূর করতে যে আলো প্রথম জ্বালানো হয়।
এই জন্যেই তো বলি, এতো মেয়ে থাকতেও এই রুদ্র রওশন কেনো আপনার প্রতি হোচট খেলো?
একটা টান তো আছেই তাইনা?আপনি আসার আগে আমার জীবন টা তো ঠিক সন্ধ্যা বেলায় ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের মতই ছিলো।আর তার প্রদীপ হিসেবে আপনি এলেন।কি সুন্দর আলো জ্বেলে দিলেন আমার জীবনের।
রুদ্রর বৃত্তান্তে সেঁজুতি চোখ পিটপিট করলো,
” কোথা থেকে কি মানে বার করলো এই লোক?
মুখে বলল,
এই জন্যে ডাকলেন?
‘হ্যা।
সেঁজুতি বলল,
বলা শেষ? তাহলে আমি আসছি।আর আপনি আমাকে একটু কম কম কেবিনে ডাকবেন।অফিসের লোকজন আমাদের নিয়ে কানাঘুষা করে। সেটা আপনি না শুনলেও আমার কানে আসে।
রুদ্রর নিরুদ্বেগ জবাব
‘তো?
সেঁজুতি অবাক কন্ঠে বলল,
‘তো মানে?? আরে এভাবে লোকে কথা ছড়াক আমি চাইনা।
‘কথা ছড়াবে কেনো?ওদের মধ্যে আমাদের বিয়ে, আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ইন্টারেস্ট আছে তাই ওরা বলাবলি করে। দ্যাটস ইট।
সেঁজুতি হতভম্ব হয়ে বলল,
” বিয়ে?? কিসের বিয়ে? আর কিসেরই বা সম্পর্ক?
রুদ্র মিটিমিটি হাসলো।সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকায়।
‘ হাসছেন কেন?ইদানীং প্রায়ই দেখছি এরকম মিটমিট করে হাসেন।সমস্যা কী আপনার?
‘ আমার কী সমস্যা?কোনো সমস্যা নেই।আর হ্যা,শুনুন,আপনি অফিস আওয়ারের আট ঘন্টার মধ্যে পাঁচ ঘন্টাই আমার কেবিনে থাকেন।আসতে হয় আপনাকে।আমিই ডাকি।সবাই এটা নিয়ে কানাঘুষা করছেনা। অফিসের সবাইকে বলা হয়েছে যে খুব তাড়াতাড়িই আমাদের বিয়ে,সেই নিয়েই এদের মাতামাতি।
সেঁজুতি আশ্চর্কিত,
“কি বলছেন কি এসব?আমাকে না জানিয়ে, আমার থেকে অনুমতি না নিয়ে আপনি ওদের এসব বলতে পারেন না!
রুদ্রর নিরুৎসাহিত জবাব,
“কেনো পারবোনা? ভালোবাসার সময় তো পারমিশন লাগেনি।ভালো তো আপনাকে না জানিয়েই বেসেছি।
সেঁজুতি রাগে, শোকে কাঁদোকাঁদো হয়ে এলো,
“আপনার সাথে কথা বাড়ানোই ভুল।আপনি আগেই ভালো ছিলেন।কথা কম বলতেন,মুড নিয়ে থাকতেন,অন্তত এতো বাজে বাজে যুক্তি গুলো শোনা থেকে বেঁচে যেতাম আমি।
রুদ্র শান্ত কন্ঠে বলল
“এখনও পারবেন,যদি আপনি চান।
আমার ভালোবাসা গ্রহন করে।
সেঁজুতি দুকান চেপে ধরলো,
” উফফ! আবার শুরু।
______
সেঁজুতি পড়ছে।এই মাসের আঠাশ তারিখ সেমিস্টার ফাইনাল শুরু।তখন দরজার সামনে এলেন আমির।
‘আসবো রে মা??
সেঁজুতি ঘাড় ফেরালো,বাবাকে দেখে হেসে বলল,
‘বাবা? এসোনা।তোমার আবার অনুমতি নিতে হয় বাবা?
আমির হাসলেন।হুইলচেয়ার চালিয়ে মেয়ের রুমে ঢুকলেন।সেঁজুতি বইটা বন্ধ করে বলল,
‘এখনও ঘুমোয়নি যে!
“অনেকক্ষন এ পাশ ও পাশ করলাম।ঘুমই আসছেনা।ওষুধের ডোজ টা বোধহয় বাড়াতে হবে। ভাবলাম তোর সাথে একটু গল্প করে আসি।
পড়ছিলি নাকি রে?
“ওই একটু দেখছিলাম নেড়েচেড়ে।পরীক্ষার আর অল্প কদিন বাকী।
আমির চুপ করে গেলেন।মেঝেতে অগোছালো দৃষ্টি ফেলে ভাবছিলেন কিছু।সেঁজুতি লক্ষ্য করে বলল ‘ কিছু বলবে বাবা?
‘হ্যা?না।আসলে….
‘ কী ব্যাপার? আমার সাথে কথা বলতেও আজকাল এত ভাবছো তুমি?
আমির সময় নিয়ে বললেন ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো??
‘অবশ্যই।একটা কেন,দশটা করো।
আমির হেসে বললেন,
‘আবির কে ভালোই লাগে বল?বেশ ভদ্র একটা ছেলে।কথা বার্তাও খুব সুন্দর।এতো বছর বাইরে থেকেও ভদ্রতা ভোলেনি।এসেই একেবারে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছে জানিস?
‘বাহ! ভালো তো।ওতো এমনিতেও ছোট বেলা থেকে বেশ ঠান্ডা মেজাজের।এই জন্যেই না ওকে আমার এতো ভালো লাগে।
আমিরের হাসি প্রসস্থ হলো।নিশ্চিন্তের শ্বাস নিলেন।
যাক!উত্তর পেয়েছেন।আবির কে তাহলে সেঁজুতির ও পছন্দ। আজই হোসাইন প্রস্তাব রাখলেন সেঁজুতি কে ছেলের বউ করতে চান উনি।আমির এক কথাতেই রাজী হন।প্রান প্রিয় বন্ধু,তার এত ভালো, আদর্শবান ছেলে।সেঁজুতি কে হোসাইন কত ভালোবাসে তাতো আর অজানা নয়।অমত করবেনই বা কেন?মেয়েটা নিজেদের মধ্যেই থাকলো।
কিন্তু তার আগে ছেলেমেয়েদের মতামত তো জরুরি।হোসাইন বললেন সে আবিরের মত নেবে।আর আমিরকে দায়িত্ব দিলেন সেঁজুতির মতামত নিতে।আমির সেই থেকেই উশখুশ করছিলেন কথাটা কীভাবে তুলবেন?বাবা হয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারবেননা বিধায় এভাবে ঘুরিয়ে কথা গুলো তুললেন।আশানুরূপ ফল ও পেলেন।এবার আবিরের কথা জানার পালা।আমির যখন গভীর ভাবনায় সেঁজুতি জিজ্ঞেস করলো,
“হঠাৎ আবিরের কথা বলছো বাবা!
” হ্যা?না এমনিই।আমি বরং যাই এখন।বেশি রাত জাগিস না হ্যা? ঘুমিয়ে পড়িস।
সেঁজুতি ঘাড় কাঁত করলো,
“আচ্ছা।
___
পরেরদিন রুদ্র মাত্র অফিসে ঢুকেছে।সেঁজুতি তখনও আসেনি।রুদ্র কেবিনে বসতে না বসতেই বশির জানালেন আবির এসছে দেখা করতে।রুদ্রর একটু অবাক লাগলো। আজ আর অপেক্ষা করায়নি।সমস্যা যখন মিটে গেলো,তখন আর এসব করে কী লাভ?যত্র আবিরকে ডাকতে পাঠালো রুদ্র।আবির আসলো হন্তদন্ত পায়ে।বেচারার চেহারার অবস্থায়ও টলমলে।রাতে ঘুমোয় নি নাকী?রুদ্র আমুদে কন্ঠে বলল,
কি ব্যাপার আবির সাহেব? আজ আবার কাকে আটকালাম আমি?
আবির চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“আমি একটা বিপদে পরে এসেছি আপনার কাছে।একমাত্র আপনিই পারবেন আমাকে সাহায্য করতে।
রুদ্র সিরিয়াস হলো,
“কি হয়েছে?
চলবে।
#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব–২৯
হারফি রেস্টুরেন্ট। কোনার দিকের একটা টেবিলে একে একে বসে আছে রুদ্র, আবির আর অন্য পাশে এরিকা।এইতো কিছুক্ষন আগেই বাংলাদেশে পৌঁছোলো মেয়েটা।মেয়েটাকে দেখে আসলেই বিদেশিনী লাগছেনা।পড়নে ভদ্র পোশাক।ব্লু জিন্স সাথে হাটু অব্দি কূর্তি।পিঠে ছড়ানো সোনালী চুল।একটু আধটু বাংলা বলতে পারে।কিন্তু বুঝতে পারে পুরোটাই।রুদ্র ব্লাক কফির মগে চুমুক দিলো,শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
” এখন আপনি কি করতে চাইছেন আবির?
আবিরকে কেমন এলোমেলো দেখালো।চিন্তিত ছেলেটা!বলল,
“আমি জানিনা। আমার মাথায় কিছুই আসছেনা।,বিশ্বাস করুন, কাল রাতে বাবার মুখে বিয়ের কথা শুনলাম,মন চাইছিলো সত্যিটা বলে দেই।কিন্তু পারিনি।কেমন একটা সঙ্কোচ হচ্ছিলো।মডার্ন কান্ট্রিতে লাইফ স্পেন্ড করে এসেও মাইন্ড টাকে চেঞ্জ করতে পারছিনা।
রুদ্র হাসলো।এই হাসিতে স্পষ্ট ধিক্কার।বলল,
“কি অদ্ভূত তাইনা!এখন আপনার মাথায় পুরো পৃথিবীর চিন্তা ঘুরছে।এর একটা চিন্তাও যদি এরিকাকে ভালোবাসার আগে,বা বিয়ে করার আগে করতেন তাহলে হয়তো এইদিন দেখতে হতোনা।
আবিরের মুখ কালো হয়ে আসে।এরিকা মাথা নিঁচু করে কাটাকাটা ইংরেজিতে বলল,
“আমিই দ্বায়ী এসবের জন্যে।আমার জন্যে যত ভোগান্তি।
রুদ্র বলল,
“না। আমি আপনাকে বলিনি।এখানে আপনার কোনও দোষ নেই।
আবির নিজের চিন্তা ঝেড়ে এরিকাকে সান্ত্বনা দিলো,হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
“এরিকা প্লিজ।তুমি এভাবে ভাবছো কেন?এত ভেবোনা।আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।
এরিকা মাথা তুলল।অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘এটা তুমি গত এক বছর ধরে বলে আসছো আবির।,তুমিতো আমাকে ঠিক করে তোমার সমস্যা গুলোও বলছোনা।
রুদ্র মাথা নেঁড়ে বলল,
“ও আই সি!মিস্টার আবির, আপনি তাহলে এখনও ওনাকে আসল কথা গুলোই জানান নি?
আবির মাথা নামিয়ে ছোট করে বলল,
‘না।
” না জানালে সমস্যার সমাধান হবে আপনার?
আবির অসহায় চোখে তাকালো,
– কি করবো? আপনিই বলুন।
এরিকার দিকে একবার তাকালো রুদ্র।মেয়েটি কাঁদছে।ফর্সা গাল ভিজে একাকার।রুদ্র যেন বুঝে নিলো এরিকার মনের অবস্থান।মনে হচ্ছে এরিকার থেকে আশানুরূপ উত্তর পাওয়া যাবে।রুদ্র ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল,
” মিসেস এরিকা!আপনি তো আবিরকে ভালোবাসেন তাইনা?
এরিকা মাথা দোলায়।রুদ্র আবার বলল,
‘সারাজীবন আপনি আবিরের সাথেই থাকতে চান তো?
এরিকা ভ্রু কোঁচকায়, “ইউ হ্যাভ এনি ডাউট মিস্টার চাউডোরি?
রুদ্র হাসলো।তার পদবীটা হয়ত একটু বেশিই কঠিন।প্রায় সব বিদেশী ক্লায়েন্ট গুলোই এমন বিকৃত করে ডাকে।
-” না।আমার কোনো সন্দেহ নেই।তবে কিছু প্রশ্ন আছে।করতে পারি?
‘বলুন।
রুদ্র সোজাসাপটা বলল,
“আমি শুনেছি আপনি খ্রিস্টান। আপনি কি জানেন একজন মুসলিম হয়ে বিধর্মী কাউকে ঘরের বউ হিসেবে মেনে নেয়া ঠিক কতোটা কঠিন কাজ?
এরিকা প্রশ্ন নিয়ে তাকালো।রুদ্র নিজেই বলল,
‘ আমি বলতে চাইছি আপনি যদি আবিরকে পেতে চান তবে সবার আগে আপনাকে মুসলিম হতে হবে। অন্যথায় আবিরের পরিবার আপনাকে মেনে নেবেন না।
এরিকা স্তব্ধ হয়ে আবিরের দিকে তাকালো।অবিশ্বাসের কন্ঠে শুধালো,
“ইজ ইট ট্রু আবির?
অপরাধীর মত মাথা নাড়লো আবির।এরিকা কিছু সময়ের জন্যে থম মেরে যায়।সময় নিয়ে বলে,
” এটাই তাহলে তোমার মূল সমস্যা ছিলো? তাইতো?
আবির নিশ্চুপ।রুদ্র বলল,
” মিসেস এরিকা, এই মুহুর্তে আবির কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন।ওর হয় আপনাকে বেছে নিতে হবে না হয় ওর পরিবারকে।কিন্তু আমার ধারনা আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে কোনও বাবা মা আপনার কারণে তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ফেলুক?
এরিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আবির হাসফাস করলো ওর কান্নায়।কিছু বলতে নিলে রুদ্র থামিয়ে দিয়ে বলল ‘ ওনাকে বলতে দিন আবির।
এরিকার জবাবে এলো অনেকক্ষন পর।কাঁদতে কাঁদতে বলল ‘ আমি চাইনা।
রুদ্র বলল ‘এখন সবটাই আপনার মর্জি এরিকা।আপনি যা চাইবেন তাই হবে।
এরিকা ভেজা কন্ঠে বলল
“আমি একটি চার্চে বড় হয়েছি।আমার নিজের বলতে আবির ছাড়া কেউ নেই।পরিবার বলতে আমার কাছে ওই চার্চটাই। তাই একটা পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার দুঃখ আমি বুঝি।আমি আবিরকে পেতে সব করব।সব।
আবির,রুদ্র একিসাথে প্রশান্ত হাসলো।আবির এরিকাকে জড়িয়ে ধরলো একহাতে।এরিকা মুখ লোকালো আবিরের বুকে।প্রথমে দুটো কিল-ঘুষিও মেরেছে অভিমানে।কেন এই কথাগুলো আগে বলেনি ছেলেটা?আবির কৃতজ্ঞ চোখে রুদ্রর দিকে তাকালো।ইশারায় বোঝালো ‘ থ্যাংক্স।রুদ্র মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়।ওদের দুজনকে একা ছাড়া উচিত। হাটতে হাটতে মানস্পটে সেঁজুতির মুখটা ভেসে ওঠে। মেয়েটা যে কবে তাকে বুঝবে?বুঝলে এভাবেই ভালোবাসবে কী?সেও কী বলবে,’ রুদ্র,আমি আপনার জন্যে সব করতে পারব?
__
ধানমন্ডি লেক।পাড়েই সিমেন্ট বাঁধানো ছোট ছোট বেঞ্চ।রুদ্র এই প্রথম এখানে এলো।কাজ,ব্যাস্ততা,ইচ্ছে কোনটাই অনুকূলে ছিলোনা।ঘুরতে যাওয়ার সময় কই?রুদ্র পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে।হাতে সিগারেটের আধপোঁড়া অংশ।চোখ লেকের সবুজ পানিতে অবিচল।
চারপাশ জুড়ে কপোত কপোতির ভীর।রুদ্র একবার ব্রিজের ওপারের মেন রাস্তার দিকে তাকালো।সেঁজুতির আসার কথা।দশমিনিট পার হলো অথচ এলোনা।এই মেয়েটা কি কোনো দিন শুধরাবে না?মেয়ে মানুষ মানেই দেরি।রুদ্র মনে মনে হাসছে।সেঁজুতি কে বলেছে
আর্জেন্ট মিটিং। এসে যখন বুঝবে মিটিং আসলে অজুহাত,নির্ঘাত রুদ্রকে ঠেলে পানিতে ফেলে দেব।হ্যা দেবেই।যা রাগ!
সেতুর পারে রিক্সা থামালো সেঁজুতি। ভাড়া মিটিয়ে
এপাশ ওপাশ দেখলো।এতো লোকের ভীড়ে রুদ্র কে খুঁজে পাওয়া কী সম্ভব?ব্যার্থ হয়ে রুদ্রর নাম্বারে ডায়াল করতে যাবে এর আগেই রুদ্র কল দিলো।
“স্যার! কোথায় আপনি?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
‘সেতু পার হয়ে হাতের বাম দিকে এলেই পাবেন।
রুদ্র লাইন কেটে দিয়েছে।সেঁজুতি হাটা ধরলো।আজ রবিবার।অফিস বন্ধ।হঠাৎ এভাবে মিটিং পরার কারন সে জানেনা।তাও এরকম একটা লেকের পারে?অদ্ভূত না?
রুদ্র বসে বসে পা নাড়ছে।আশেপাশের যূগল দের প্রেম দেখে নিজেরও প্রেম প্রেম পাচ্ছে।গুনগুন করে গান গাইতে মন চাইছে।কিন্তু না! আজ প্রেমিক ভাব টা লুকোতে হবে।সেঁজুতি এসে পরবে এখনি।প্রেমিক ভাব আগেই দেখালে সিরিয়াস কথাগুলো বলা হবেনা।মেয়েটা এমনিতেই চেঁতে থাকে তার ওপর।তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,যেদিন সেঁজুতি তাকে ভালোবাসবে,তাদের প্রথম ডেট এই পার্কেই হবে।আহামরি কিছু নেই।অথচ মনোমুগ্ধকর জায়গা। সেঁজুতি কে এখানে ডাকার কারন,কিছু কথা সামনাসামনি বলা।অফিসে কী সব বলা যায় নাকী?
রুদ্র নিঁচের দিক চেয়ে ভাবছিলো।হঠাৎ সেখানে এক জোড়া স্লিপার পরা পা দেখে বুঝলো কাঙখিত মানুষটি এসেছে।রুদ্র চোখ তুলে দেখলো।
হলুদ সালোয়ার কামিজ পড়নে সেঁজুতির।কাঁধে ব্যাগ।চুল গুলো বেনি করে এক পাশে এনে রাখা।মুখে কোনো প্রসাধনী নেই।বিকেলের রোদ টা যেমন স্নিগ্ধ, নরম- লালচে,সেঁজুতিকে ঠিক তেমন মনে হলো রুদ্রর।মেয়েটার সবকটা রুপ তার বুকে ঢেউ তুলতে যথেস্ট।সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে রেখেছে।রুদ্র নিজের পাশ ইশারা করে বলল ” বসুন।সেঁজুতি বসলোনা।উলটে প্রশ্ন ছুড়লো,
“এখানে মিটিং?কার সাথে?কাউকেই তো দেখছিনা।
রুদ্রর নিরুদ্বেগ উত্তর,
” মিথ্যে বলেছি।লেকের পাড়ে আদৌ মিটিং হয় নাকি?
সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল,
‘ মানেটা কি এসবের?মিথ্যে বলে আমাকে এনেছেন?কেন?
রুদ্র উঠে দাঁড়ালো।পকেটে হাত গুঁজে বলল,
“মানে এটাই যে আপনি বড্ড বোঁকা! বললাম মিটিং আর চলে এলেন?এসব জায়গায় অফিসের মিটিং হয়? অবশ্য হয়,তবে কিসের মিটিং সেটা চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন….
রুদ্রর কথায় কৌতুক।সেঁজুতির মেজাজ খারাপ লাগছে।
” আপনি আমার সাথে মজা করছেন?
‘করছি।আপনার সাথে মজা করা বারন,এরকম লেখা কোথাও পড়িনি আমি।
সেঁজুতি মেকি শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ তা আমাকে ডাকার কারন?
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
সেঁজুতি ভ্রু নাঁচালো,
“কি এমন কথা? যার জন্যে এখানে ডাকতে হবে? অফিসে বলা যেতোনা?
রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘না। যেতোনা বলেই এখানে অাসা।আর অবশ্যই দরকার ছাড়া আমি আপনাকে ডাকবনা।
রুদ্রর গম্ভীর কন্ঠ শুনে সিরিয়াস কিছু হয়েছে মনে হলো সেঁজুতির। ভ্রুয়ের ভাঁজ টানটান করে বলল ‘বলুন।
রুদ্র জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,
“আবিরের সাথে আপনার বিয়ের কথা চলছে।আপনি জানেন?
সেঁজুতি চমকে উঠলো।কিছুক্ষন হা করে তাকিয়ে থাকলো।পরক্ষনে রুদ্রকে ধরা না দিতে স্বাভাবিক করলো চেহারা।
“হ্যা জানি।
রুদ্র নিশব্দে হাসলো।সেঁজুতি যে জানতোনা সে ওর মুখ দেখেই বুঝেছে।ডান ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
” তাই?আপনি জানেন?
সেঁজুতি কেন যেন রুদ্র চোখে চোখ মেলাতে পারলোনা।অন্যদিক ফিরে বলল,
“যেহেতু আমার বিয়ের কথা চলছে, আমি জানবো সেটাই তো স্বাভাবিক।
“এ নিয়ে আপনার কিছু বলার নেই?
” কি বলার থাকবে?
“আপনি কি এই বিয়েতে রাজি?
সেঁজুতি কাটকাট জবাব দিলো,
” রাজি না হওয়ার ও তো কিছু নেই। আবির সব দিক থেকেই ভালো ছেলে।আই মিন সব দিক থেকে..
শেষের কথাটা রুদ্রর দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল সেঁজুতি। মানে বুঝে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো রুদ্র।সব দিকের সাথে সাথে চরিত্রের দিক থেকেও আবির পার্ফেক্ট। এটাই বোঝালো মেয়েটা।
পরক্ষনে উদাস হলো রুদ্রর চেহারা।আবির রাজি হবেনা,কিন্তু সেঁজুতি? ওতো রাজি।ওতো জানেওনা আবির বিবাহিত।আজ আবির না হোক,কাল অন্য কোনো ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করলে?সেঁজুতি তখনও রাজি হবে?হবে নাই বা কেন!তার জীবনে কোনো পিছুটান আছে? নেই।রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো।সেঁজুতির ভেতরটা অজান্তেই মোচড় দিলো এমন চাউনিতে।রুদ্র আকুতি নিয়ে বলল
” আমাকে ভালোবাসা যায়না সেঁজুতি?
সেঁজুতি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।রুদ্রর চোখে তাকানো যায়না আজকাল।ঢোক গিলে মুখ শক্ত করে জবাব দেয়,
” না।
রুদ্রর বুক হুহু করে কেঁদে ওঠে।
“শুধু এই একটা অন্যায়ের জন্যে?
আমিতো ওসব কবেই__রুদ্রর কথা সম্পূর্ন করতে দিলোনা সেঁজুতি।বলল
” আপনি শুধু চরিত্রহীনই নন। তার পাশাপাশি আপনি একটা খুনিও।
রুদ্রর কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। কার কথা বলছে সেঁজুতি? ও এসব জানলোই বা কী করে!অস্পষ্ট আওয়াজে বলল, ” মানে?
সেঁজুতি তাচ্ছিল্য হাসলো ‘ অভিনয়ে আপনি অনেক কাঁচা রুদ্র।এই যে আপনার মুখের চিন্তার ছাপ টা? আমি এখান থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
বুঝেও না বোঝার ভান করছেন আপনি। নেহাল উদ্দীন এর মার্ডার কে করিয়েছে মি:রুদ্র রওশন চৌধুরী? অস্বীকার করতে পারবেন?আপনি মারেন নি ওনাকে?
রুদ্র অবিনত,
‘মেরেছি।
সেঁজুতি বিস্মিত না হয়ে পারলোনা।
“এটা বলতে আপনার একটুও বাঁধলো না?
রুদ্র মুখের ওপর বলল ‘ না।
সেঁজুতি ক্ষেপে গেলো।
‘বাঁধবে কি করে,আপনি তো একটা নির্লজ্জ্ব!
শব্দ করে হেসে উঠলো রুদ্র।হাসতে হাসতেই বলল,
” অনেস্টলি একটা কথা বলি?সেদিন যদি নেহালের হাতে আপনার রেপ হতো, আজ এই নির্লজ্জ কথাটা আপনি শুনতেন। সমাজের কাছে।
সেঁজুতি মাথা নামিয়ে নিলো।রুদ্র দৃঢ় কন্ঠে বলল
“নেহাল কে আমি মেরেছি।আর এটা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। কারণ ও আপনার দিকে হাত বাড়িয়েছে।আপনাকে অসন্মান করেতে চেয়েছে। আর তাই ওর প্রাপ্য শাস্তি একমাত্র মৃত্যু
। যা আমি নিজ হাতে দিয়েছি।
সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল,
” সে ও যাই করুক,মানুষ খুন করা পাপ।
রুদ্র দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল
“ও আচ্ছা?আর কাউকে ধর্ষন করতে চাওয়া বুঝি পূন্যের কাজ ? ধর্ষিতা হলে আজ এই কথা গুলো বলতে পারতেন?পারতেন না।তখন নিজেই ওর শাস্তির জন্যে থানার দোরগোড়ায় মাথা ঠুকে বেড়াতেন।
সেঁজুতি নিরুত্ত্যর।রুদ্রর একটা কথাও মিথ্যে নয়।নেহাল মরে যাওয়ায় ভেতর ভেতর একটা শান্তি পেয়েছে সেদিন।হত্যাকারীর প্রতি খুশিও ছিলো।তাহলে যখন জানলো সেই খুনি রুদ্র স্বয়ং,কেন এত খারাপ লাগছে?রুদ্রতো কেউ নয় তার!নাকী সেই বুঝতে পারছেনা,রুদ্র কতটা জুড়ে গেছে।সেঁজুতির ঘোর কাটলো রুদ্রর কথায়,
” আপনি কিভাবে জানলেন এসব?
“থানার ওসি মিঃ মাহবুল আলম,
যিনি আমার স্টেটমেন্ট নিয়েছিলেন,উনি বলেছেন।
রুদ্র অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল
” ও গড,তাই নাকী?কিন্তু তাহলে তো এতক্ষন আমার জেলে থাকার কথা ছিলো!আমি বাইরে কী করে?
রুদ্রর ইয়ার্কিতে সেঁজুতির মেজাজ আবার বিগড়ে আসে।চেঁতে বলল,
“বোকা সাজছেন? আমি জানি আপনি কত ধুরন্দর লোক!আপনার বিরুদ্ধে কোনো প্রমান আপনি রাখেননি। তাই এখনও বাইরের খোলা হাওয়া খেতে পারছেন।
রুদ্র অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” লাইক সিরিয়াসলি? আপনার এটা মনে হয়? ভেরী ফানি।
আমি এখনও বাইরের হাওয়া খাচ্ছি কারণ আমার পকেটে টাকা আছে।ওরা যদি সব ইনফরমেশন পেয়েও যায় তবুও আমাকে গ্রেফতার করতে আসবেনা।বর্তমান আঈন ব্যাবস্থা কতটুকু জানেন আপনি? টাকার কাছে আজকাল সব কিছুই নত। শুধু মাত্র ভালোবাসাটাই পাচ্ছিনা।
শেষ কথাটায় রুদ্রর গলা বুজে এলো।উত্তরে সেঁজুতি মুখের ওপর বলল,
“আর পাবেন ও না।
রুদ্র গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“একবার ভালোবেসেই দেখুন না আমাকে।কোনও দিন ঠকবেন না।কথা দিচ্ছি।
সেঁজুতির ইচ্ছে হলো রুদ্রকে বিশ্বাস করতে।পরমুহূর্তে সেই হোটেল,অত মেয়ে,আর রুদ্রর নারীসঙ্গের কথা মনে পড়তেই কঠিন কন্ঠে বলল,
“আপনার কথা দেয়ার প্রয়োজন নেই।বিয়েতে আসবেন।অবশ্য দাওয়াত করে যাব।
রুদ্র হতাশ হলো আরেকবার।ঠিক কী করলে সেঁজুতি মানবে?কেউ যদি বলে দিতো! তাই করতো ও।রুদ্র ভেজা কন্ঠে পিছু ডাকলো সেঁজুতির।সেঁজুতি দাঁড়িয়ে যায়,ফিরে চায়না।রুদ্র বলল ‘ ভালোবাসি।
সেঁজুতির পা কেঁপে ওঠে।এগোতে চায়না।টেনে,হিচড়ে শাসিয়ে নিয়ে চলল ওদের।
রুদ্র নিষ্পলক চোখে দেখলো যতক্ষন সেঁজুতি রিক্সা নিয়ে অদৃশ্য না হলো ততক্ষন।
রিক্সা চলছে।ব্যাস্ত রাস্তা।ফুরফুরে হাওয়াগুলো আজ মন ছুঁতে পারছেনা সেঁজুতির।ঘন মেঘ জমেছে মুখে।কেন যেন কান্না পাচ্ছে।পেছন ফিরে কারো মলিন মুখটা দেখার ইচ্ছে জাগলেও সাহসে কূলোলোনা।অজান্তেই সেঁজুতির চোখ ভিজে উঠলো। রুদ্রর কালো মুখ,অসহায় কন্ঠ কানে বাজছে যতবার বুক ফেঁটে কান্না আসছে। সেঁজুতি নিজেই অবাক হচ্ছে এতে।কেন এমন হচ্ছে? সে কী তবে রুদ্রকে ভালোবেসে ফেলল?সারাক্ষন রুদ্রর ভালোবাসি বলাটা তার হৃদয় ছুঁতে পারলো?সেঁজুতি বড্ড অভিমানি কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
“আবিরের সাথে আমার বিয়ে?এটা তুমি ঠিক করলেনা বাবা!ঠিক করলেনা।
রুদ্র বেঞ্চের ওপর বসে পরলো আবার।হঠাৎই বাঁকা হাসি ফুটলো ওষ্ঠে।
“কোথায় আর যাবেন সেঁজুতি? টার্ন ব্যাক তো আমার কাছেই নিতে হবে। আবিরের সাথে বিয়েটা যে আপনার হচ্ছেনা,তার ফুল সেট আপ আমি করেই এসেছি। এবার শুধু দেখার অপেক্ষা আপনি ঠিক কতদূর এগোতে পারেন!অভিনেত্রী আপনি বড্ড খারাপ।আমার মতোন।
চলবে,