#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২৫
ভালোবাসা একটি মানবীয় অনূভুতি।একটি আত্মকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা। হাজার রকম ভালোবাসার মধ্যে পুরুষ আর নারীর মধ্যকার ভালোবাসা….. জগত সংসারে #প্রনয় বলে সন্মোধিত। যার আক্ষরিক অর্থ প্রেম। ধীরে হোক বা দ্রুত, প্রেম কারো জীবনে বলে কয়ে আসেনা।
প্রেম হয় দেখা ও চোখের ভালো লাগা থেকে,রাগ থেকে প্রেম হয়, প্রেম হয় অপমান থেকে। এমনকি লজ্জ্বা থেকেও বর্ষিত হয় প্রেমের বারিধারা। প্রেম লুকিয়ে আছে মানব সম্প্রদায়ের প্রতিটি ক্রোমোসমে,প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
সুযোগ পেলেই সে জেগে ওঠে।উঠবেই।
( হুমায়ুন আহমেদ)
ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষ টার জন্যে নিজের সমস্ত ইগো কে বিসর্জন দিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পন করা। জয়ের কাছে স্বীকার করা পরাজয়।
ঠিক তেমনভাবে আজ পরাজিত রুদ্র।ভালোবেসে হার মেনেছে সেঁজুতির কাছে। অবশেষে নিজেকে সংযত করতে না পেরে মনের কথা মুখ অব্ধি এনেছে। সেজুতির চোখের দিক চেয়ে জানান দিয়েছে নিজের অভিব্যক্তি।
দুজনার মধ্যে এক ইঞ্চির দুরুত্ব।কারো মুখে কথা নেই।সেজুতি বিষ্মিত চোখে রুদ্র কে দেখছে।,তার বাহুদ্বয় এখনও রুদ্রর হাতে বন্দী।রুদ্র ধূসর দৃষ্টিতে একভাবে তাকিয়ে অাছে সেজুতির দিকে।তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে সেঁজুতির কপালে, সেঁজুতির চোখের পাতায়।এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছেনা কয়েক সেকেন্ড আগে রুদ্রর উচ্চারিত তিনটে শব্দ। অনিশ্চিত কাঁপা কন্ঠে শুধালো ‘কি বললেন??
সেঁজুতির বাহু চেপে আর একটু শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো রুদ্র। ঠান্ডাস্বরে থেমে থেমে বলল ‘ আই… লাভ… ইউ। এত সাবলীল তার আওয়াজ, যেন পৃথিবীতে এই মুহুর্তে এর থেকে সহজ সুন্দর বানী আর দ্বিতীয় টি নেই।
‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি সেঁজুতি। জানিনা কবে থেকে।তবে বাসি,ভীষণ ভালোবাসি।
রুদ্রর হাত ঢিলে হলো।ধ্যান সরে যাওয়ায় হয়ত।সুযোগটা লুফে নিলো সেঁজুতি। ধাক্কা মেরে রুদ্রকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিলো।আচমকা এতো প্রবল ধাক্কায় রুদ্র কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।অবাক চোখে তাকালো সেঁজুতির দিকে।হঠাৎই হু -হা করে হেসে উঠলো সেঁজুতি। যে হাসিতে স্পষ্ট, বিদ্রুপ,তাচ্ছিল্য, ধিক্কার।রুদ্র চমকালো সেঁজুতির ব্যাবহারে।
সেঁজুতি হাসছে।অথচ কোটর ভর্তি টলমলে অশ্রু।
“নিজেকে কি ভাবেন মি: রুদ্র রওশন চৌধুরী?? হোয়াট ডু ইউ থিংক টু ইওরসেল্ফ?টাকা আছে বলে যখন যার সাথে যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যাবহার করবেন আপনি?আমার সাথে এমন নিম্ন মানের মজা করার সাহস কোথ থেকে এলো আপনার?বেতন ভুক্ত কর্মচারী বলে আপনার সব অসন্মান সহ্য করে যাবো এমন টা কিন্তু নয়।
রুদ্র এগিয়ে আসতে নিলে সেঁজুতি হাত উঁচু করে বলল ‘ দূর থেকে কথা বলুন।আমি কানে শুনতে পাই।
সেঁজুতির কঠিন স্বর।কঠিন মুখ।রুদ্র দাঁড়িয়ে যায়।মোলায়েম কন্ঠে বলে,
‘সেজুতি আমি আপনার সাথে মজা করছিনা।আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি।
সেঁজুতি আবার হাসলো।ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ভালোবাসেন?? ইয়া আল্লাহ! মি: রুদ্র রওশন কিনা ভালোবাসে আমার মত মেয়েকে? আদৌ এটা বিশ্বাস যোগ্য?আর তাছাড়া ভালোবাসি তো বললেন, ভালোবাসার মর্ম বোঝেন আপনি? বোঝেন এর গভীরতা?ইচ্ছে হলেই ভালোবাসি বলে দেয়া যায়না।
ভালোবাসা কে শুধু বয়ফ্রেন্ড- গার্লফ্রেন্ড এর মধ্যকার সম্পর্ক মনে করবেন না।খুব তুচ্ছ কারনে কাউকে ভালো লাগলেও ভালোবাসা এতো সহজ নয়। ভালোবাসা এমন এক বস্তু যাকে ভালোবাসলে পুরো পৃথিবীর বিপক্ষে গিয়ে হলেও শক্ত করে তার হাত ধরে রাখা যায়।যাকে ভালোবাসলে সব ছেড়েছুড়ে তাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাওয়া যায়। যার কাছে থাকা মানে আমি সব চেয়ে নিরাপদ।,যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়,যার প্রতি নির্ভর হয়ে পথ চলা যায়।আচ্ছা আপনিই বলুন না, আদৌ কি আপনি এসবের যোগ্য?যে ছেলে জামাকাপড় এর মতো বেড পার্টনার চেঞ্জ করে তাকে আর যাই হোক বিশ্বাস করা যায়না।
যার মধ্যে চরিত্রের ছিটেফোঁটাও নেই তাকে নির্ভর করে পথ চলা তো দূর,কয়েক সেকেন্ড তার সামনে দাড়িয়ে থাকতেও ভয় লাগবে। আর সেখানে ভালোবাসার তো কোনও প্রশ্নই আসেনা।
(একটু থেমে)
আপনি চাইলেই টাকা দিয়ে অনেক কিছু পেতে পারবেন।সে ক্ষমতা আপনার আছে।কিন্তু ভালোবাসা পাওয়ার মতো গুন বা যোগ্যতা আপনার মধ্যে নেই। তাই অহেতুক নিজেকে প্রহসন এর স্বীকার নাই বা বানালেন।আপনার মতো মানুষ এমন পবিত্র শব্দ উচ্চারন করলে এর অপমান বৈ কিছুই হবেনা।পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আপনার সাথে রাত কাটিয়েছিলাম বলে কোনও সস্তা পন্যের সাথে আমার তুলনা করাটা ভুল হবে আপনার।প্রয়োজন হলে কুমারী থেকে যাবো তাও কোনও দুশ্চরিত্রবান লোককে নিজের জীবনে জায়গা দেবোনা।
রুদ্র স্তব্ধ।সেঁজুতির মনের মধ্যে তাহলে এত্ত নোংরা ধারনা তাকে নিয়ে?এতদিনের ভালো ব্যাবহার নিছক অভিনয়? সেঁজুতি তাকে ঘৃনা করে?হ্যা করেইতো।নাহলে এভাবে বলতোনা নিশ্চয়ই। সেঁজুতি রুদ্রর পাথর বনে যাওয়া মুখের দিকে তাকালোনা।একবারওনা।সোজা বেরিয়ে গেলো পার্টি হাউস ছেড়ে।
স্থির হয়ে সেখানে দাড়িয়ে থাকলো রুদ্র।এতোটা অপমান আজ অব্ধি তাকে কেউ করেনি । এই মুহুর্তে পুরো পৃথিবী জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ভালোবেসে কি অন্যায় করে ফেলল তাহলে? নিজেকে অনেক বার অনেক রকমভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলো।যাতে আর যাইহোক নিজের মনের কথা গুলো মুখ অব্ধি চলে না আসে।অথচ রাগের বশে আজ সত্যিটা বলে ফেলল।কিন্তু তার পরিবর্তে কি পেলো? উপহাস!ধিক্কার!এখন তো নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃনা হচ্ছে।কিন্তু,
একটা কথা এই মেয়ে সত্যি বলেছে, এখন না হোক, কয়েক মাস আগে অব্ধি রোজ রাতে নিত্যনতুন শয্যাসঙ্গি পাল্টেছে সে। তাই বলে কি নিজেকে শুধরে কাউকে ভালোবাসা যায়না?? যায় তো। এই যে রুদ্র বাসলো।তবে কেনো মেয়েটি ফিরিয়ে দিলো তাকে?রুদ্র পুলের সবুজ পানিতে চোখ রাখলো।দুপা এগিয়ে এসে পুলের কিনারায় দাঁড়ালে পানিতে ভেসে ওঠে তার স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। রুদ্র নিজের প্রতিবিম্বকেই প্রশ্ন করলো,
— আমি কি সত্যিই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই?
রুদ্রর চোখ জ্বলছে।
চোখের কোনে চিকচিক করছে অশ্রুকনা। কত বছর পর সে কাঁদছে?ঠিক মনে করতে পারলোনা।পানিটুকু আঙুলের ডগায় এনে চোখের সামনে ধরলো ।
একটা মেয়ের জন্যে আজ তার চোখে পানি?? তাও তার থেকে প্রত্যাখান হওয়ার কারণে? সত্যিই নিজেকে বড্ড বেশীই প্রহসনের স্বীকার বানালো।
____
বিছানার ওপর মাথা চেপে ধরে বসে আছে সেজুতি। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।,রাগে দুঃখে পুরোটা পথ কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। যার ফল এই ব্যাথা। রুদ্রর আচরন গুলো যতবারই মনে পড়ছে, ততবারই রাগে শরীর গিজগিজ করছে।
শেষ মেষ এরকম একটা বিষয় নিয়ে মজা?আদৌ কি এই লোক ভালোবাসার কিছু বোঝে? বোঝেনা। এরা শুধু জানে মেয়েদের বিছানায় নিতে। ভালোবাসাতো তাদের কাছে এরই একটা অংশ।কিন্তু তার সাথেই কেনো? সে নিজেও তো রুদ্রর শয্যাসঙ্গী ছিলো একরাতের।তারপর নাকী রুদ্র আর কোনও মেয়ের দিকে ফিরে তাকায়না? তাহলে কেনো ভালোবাসার কথা বললো তাকে? কে জানে!হয়তো চাকরী দেবার মতো এটাও নতুন কোনও ফাঁদ।
রুমের মধ্যে কারো পায়ের শব্দ পেলো সেঁজুতি।চোখ তুলে দেখলোআবির এসেছে।সেঁজুতির খারাপ লাগলো।
ইশ! এই ছেলেটা তার সাথে পার্টিতে গিয়েছিলো, আর সে কিনা ওকে রেখেই চলে এলো?আসার আগে বলে পর্যন্ত আসলোনা?আবিরের মুখে চিন্তার ছাপ।উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“সেজুতি!কি হয়েছে? পার্টি ছেড়ে ওভাবে চলে এলে??
“এমনি শরীর টা ভালো লাগছেনা। মাথা ব্যাথা হচ্ছিলো।
” কমেছে এখন?
‘একটু।
আবির সেঁজুতির পাশে এসে বসলো।প্রশ্ন করলো,
“কিন্তু তোমার বস তোমাকে ওভাবে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কেনো?জানো আমি যখন ওদিক টায় যেতে নিচ্ছিলাম মি:রুদ্রর ভাই আব কি যেনো নাম?,ওহ হ্যা মিঃ অভ্র, উনি আমাকে আটকে দেন।
তাই বাধ্য হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হলো আমাকে।
সেঁজুতি নীঁচু কন্ঠে বলল
‘স্যরি আবির!আসলে আমি তোমাকে রেখেই চলে এলাম।
” এটা এমন কোনও ব্যাপার নয়।শরীর খারাপ লেগেছে সো এসে ভালো করেছো।আমি তোমাকে খুঁজেছি অবশ্য,পরে আংকেল কে ফোন করেই জানতে পারলাম তুমি বাসায় চলে এসেছো।
কিন্তু কি জানো? তোমার বসের রাগ দেখে আজ আমি সত্যিই আশ্চর্যকিত হয়ে গেছি।বাবারে। কি তেজ লোকটার!
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো । উৎসুক কন্ঠে বলল,
— কেনো?? কি হয়েছে? কি করেছেন উনি?
সেঁজুতির প্রশ্নে আবির আগ্রহ পেলো, বলল,
‘কি করেননি তাই বলো??প্রথমে তো তোমাকে ওভাবে টেনে নিয়ে গেলেন।তার কিছুক্ষন পর এসেই সবার সামনে পার্টির সমস্ত জিনিস পত্র ভাংচুর করতে শুরু করলেন।ওনার ভাই অভ্র আরও কজন মিলেও ধরে রাখতে পারছিলেন না কিছুতেই। আর কি চেঁচাচ্ছিলেন! ওমন ক্ষিপ্ত লোকের আন্ডারে কিভাবে কাজ করো তুমি?
সেঁজুতি মনে মনে বলল,
— আমার ওপরের রাগ তাহলে এভাবে মিটিয়েছে?
মুখে বলল ‘ কি আর করার?সবই ভাগ্য।
আবির দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘ না। এটা বললে চলবেনা।তোমার ওখানে চাকরি করার দরকার নেই।তুমি বরং ছেড়ে দাও ওটা।আরে বাবা আমি আর ড্যাড তো রয়েছি। তোমাদের দুজন এর খেয়াল রাখতে আমরাই যথেস্ট সেজুতি।
সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল,
আবির সেটা আমি জানি।কিন্তু আমি আত্মনির্ভরশীল হতে চাই।নিজে কিছু করতে চাই,অনেক তো সাহায্য নিয়েছি তোমাদের। এবার না হয় আমার মতো করে বাবাকে দেখি?
আবির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— বেশ! তা করো, কিন্তু ওই রুদ্র রওশনের আন্ডারে নয়।,যদি একান্ত চাকরী করতেই হয় তবে আমার অফিসে করো না হয়।
— কিন্তু….
“আর কোনও কিন্ত শুনবো না আমি সেঁজুতি। আমার এই কথাটা অন্তত শুনতে হবে তোমাকে।
কালই জব ছাড়ছো তুমি,ওকে?
সেঁজুতি মনে মনে বলল,
‘কাল ওই জব টা আমি এমনিতেও ছাড়বো। আর যাই হোক এতো কিছুর পরে ওই লোকের আন্ডারে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
চলবে…..