প্রনয় পর্ব-১৬

0
589

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১৬
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভোরের সূচনা।সাথে সব মন খারাপের অবসান।সেঁজুতি সারারাত ছটফট করেছে উত্তেজনায়।এক ফোঁটা যদি ঘুম আসে।নেহালের মরদেহ দেখে রাতে খেতেও পারেনি।বমি করেছে কয়েকবার।এত নৃসংশ ভাবে একটা মানুষকে আরেকটা মানুষ কীভাবে মারে কে জানে? অজ্ঞাত খুনিকে পুলিশ খুঁজছে।কঠোর সাজা হবে তার।কিন্তু সেঁজুতি খুনির ওপর প্রসন্ন।জঘন্য লোকটির জঘন্য মৃত্যুতে মনে মনে ও শান্তিই পেয়েছে।প্রথম কয়েক দফায় তো বিশ্বাসই হয়নি এটা উনিই কীনা।চেহারার যাচ্ছে তাই অবস্থা।পুলিশ আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে বলেই নাম ধাম তুলে দিয়েছিলো শিরোনামে।দেখেই ভয়ে থরথর করে কেঁপে ওঠে সেঁজুতি। পছন্দের সেমাই আর খাওয়া হয়নি।মাথায় তখন নেহাল ঘুরছিলো।দুপুরের ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা মনে করে শরীর অবশ হয়ে আসছিলো।অথচ বাবাকে কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি।নিজেকে সামলানোর দারুন ক্ষমতা তার।চুপচাপ উঠে নিজের রুমের দিক যায়।বাথরুমে গিয়েই বমি করে ভাসায়।তারপর টানটান হয়ে লেপ্টে থাকে বিছানায়।আমির কতবার খেতে ডাকলেন তাও উঠে যায়নি।রুম থেকেই আওয়াজ পাঠালো ‘খাবনা ‘বলে।চোখের সামনে একটা লোককে সুস্থ দেখে এসে, রাতেই তার বিভৎস মরদেহ দেখাটা সেঁজুতির স্নায়ু তৎক্ষনাৎ নিতে পারেনি।ফলে শরীর আরো নেতিয়ে গেছিলো।তবুও প্রশান্তি লাগছিলো খুব।সারাটা দিন চিন্তায় তার মাথা ঠিক ছিলোনা।কাজে অনেক ভুল করেছে।রুদ্র বলেছে এক, সে করেছে আরেক।জোর পূর্বক মাথা ঠান্ডা আর মুখ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় হয়ত ত্রুটি ছিলোনা,কিন্তু মন তখনও অশান্ত,অবিচল।কিছুতেই ঘটনা গুলো মেনে উঠতে পারেনি। নেহাল প্রতাপশালী ব্যাবসায়ী।নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতা।সে যা করে এলো নেহাল তো এমনি এমনি ছেড়ে দেবেনা।রাস্তাঘাট থেকে তুলে নিয়ে যাবে কী? নাহয় এসিড মেরে মুখ ঝলসে দেবে।অথবা গাড়ি চাপা দিয়ে মারবে।এসব ভেবেই ভয়ে আঁটশাট হয়েছিলো সেঁজুতি। ফলে কাজেও মন ছিলোনা।ভুল হয়েছে অনেক।কিন্তু, যে রুদ্র তাকে কথা শোনানোর সুযোগ খোঁজে সে কাল ছিলো নির্লিপ্ত।যেন বকাঝকা কাকে বলে জানেই না।সেঁজুতির একটা ভুলেও তাকে কিচ্ছু বলেনি।শুধু ঠান্ডা নজরে দেখে গেছে,শান্ত ভাবে ঠিক কর‍তে বলেছে।সেঁজুতির মনে তখন কালবৈশাখি। তাই রুদ্রর অদ্ভূত আচরন গুলো খেয়াল করেনি।রুদ্র প্রায় এক ঘন্টা অফিসে থেকেই বেরিয়ে গেছিলো। সারাদিনে আর আসেনি।আজতো আসবে, আজ আবার লোকটার মুখোমুখি হবে।কাল কে রুদ্রর বলা কথাগুলো মনে পড়লেও সেঁজুতির রাগ তরতর করে বাড়ছে।সেঁজুতি চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ডুবে ছিলো ভাবনায়।ফোনের টোন বাজতেই ঘোর কাটলো তার।বিছানা থেকে ফোন তুলে দেখলো তোহার মেসেজ।সামনের মাসের শুরুতে সেমিস্টার ফাইনাল।তারই ছোট্ট বার্তা।সেঁজুতি মৃদূ হাসলো।মেয়েটা না চাইতেই সব তাকে টাইমলি মনে করিয়ে দেয়।সেঁজুতির রেজাল্ট যাতে কোনো ভাবেই খারাপ না আসে তোহা তাতে ভীষণ তৎপর। সেঁজুতি দম ফেলল। তার ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা বড় নগন্য।অথচ সেই নগন্য সংখ্যাটাই তাকে প্রান উজাড় করে ভালোবাসে।যেমন বাবা,তেমন হোসাইন আঙ্কেল,তার স্ত্রী,আর তোহাও।এদের ভালবাসায় তার সব মন খারাপ কর্পূরের মতো উবে যায়।সেঁজুতি কাঁধ ব্যাগ গুছিয়ে বের হলো।আজ সে আরো একটা কাজ করেছে।স্প্রে বোতলের মধ্যে মরিচের গুড়ো গুলে নিয়েছে।কালকের মতো যদি কিছু হয়? মেয়ে মানুষ! বিপদ আপদের বালাই নেই।বুদ্ধি করে না চললে কেউ বাঁচাতে আসবেনা।কেউনা।সেঁজুতি বাড়ির সামিনের রাস্তা ধরে হাঁটছে।মাথায় তখন ও নেহালের কথা ঘুরছে।লাশের চেহারা ভেসে উঠছে চোখে।
কিন্তু লোকটাকে মারলো কে?মেরে আবার মুখ থেতলে দিয়েছে।বলাই যায় বেশ কষ্ট দিয়ে মেরেছে।হাত কেটে দিয়েছে একটা।সারা শরীরে ক্ষত।সেঁজুতির আবার গা গুলোলো।ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেলো।মোড়ের মাথায় এসে রিক্সা ডেকে উঠলো।অফিসের কাজের চাপে থাকলেই হয়ত মাথা থেকে বের হবে এসব।

রিক্সার মিনমিনে গতিতে সেঁজুতির ঘুম পাচ্ছিলো খুব।বাইরে ফুরফুরে হাওয়া যেন ষোল কলা পূর্ন করলো তার।একেতো রাতে ঘুম হয়নি।সকাল বেলা উঠে রান্নাবান্না,সব মিলিয়ে এখন দুচোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেছে।চোখের পাতা খুলে রাখাই দ্বায়।অফিসের ক্যান্টিন থেকে এক কাপ স্ট্রং কফি খেতে হবে।কিন্তু সে অব্দি যেতে পারলে হয়।ঘুমে ঢুলে বোধ হয় এখানেই পরবে।চোখে দেখছেও অন্ধকার।সেঁজুতি কোনও মতে রিক্সা থেকে নেমে অফিসের দিক হাঁটা ধরলো। আর ওমনি ধাক্কা।অকষাৎ ধাক্কা খেয়ে পরতে পরতে বাঁচলো।সামনের শক্ত জিনিস টাকে দেখতে তাকালো।চোখের সামনে স্পষ্ট তখন রুদ্রর গম্ভীর মুখটা।সেঁজুতির আর কফির প্রয়োজন পরেনি।রুদ্রকে দেখতেই ঘুম শেষ। ভর করলো এক ঝাঁক রাগ।পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ভাবলো।এর আগেই রুদ্র গমগমে কন্ঠে বলে ওঠে,
‘ চোখ কী আকাশে রেখে হাটেন?নাকি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিলেন।বস কে তো বস মনেই করেন না।তার কেবিনে নক না করে ঢোকেন,মুখে ফাইল ছুড়ে মারেন।এবার কী ধাক্কা দিয়ে ফেলার ইচ্ছে হলো?
মুখ টা কালো হয়ে এলো সেজুতির।সেতো দেখতেই পায়নি।দেখলে কী ধাক্কা খেতো? কখনওই না।উলটে রুদ্রর থেকে একশ হাত দূরে দূরে থাকতো।
সেঁজুতির চুপ থাকা রুদ্রর হজম হয়নি।
” কিছু বলছি…
‘ শুনতে পেয়েছি।
কথাটা বলে সেঁজুতি রুদ্রর দিকে তাকালো।ঘুমুঘুমু চোখ দুটো তীরের বেগে রুদ্রর বুকে বিঁধলো বোধ হয়।তৎক্ষনাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।শুকনো ঢোক গিলল।রুদ্রর মুখ ঘোরানোটা অদ্ভূত লাগলো সেঁজুতির।ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরী হয়েছিলো।মুখে কিছু লেগে আছে ভেবে হাত বোলালো একবার।রুদ্র অন্যদিক চেয়ে থেকেই বলল
” আপনি শুনতে পেলে উত্তর দিলেন না কেন?আমার কথার পিঠে চুপ থাকার মত সাহস কোথায় পেলেন?

সেঁজুতি যেন আকাশ থেকে পরলো।এমন কথা বাপের জন্মে শোনেনি ।কারো কথার পিঠে চুপ থাকা একটি অপরাধ? রুদ্র না বললে তো জানতেই পারতোনা।জবাবে বলল,
‘ আমি আপনার সাথে সকাল সকাল কথা বলে মুড খারাপ করতে চাইছিনা।
রুদ্র তড়িৎ বেগে তাকালো,
‘হোয়াট?? হোয়াট ডিড ইউ সে….?
সেঁজুতি থতমত খেয়ে বলল ‘ ককিছুনা।কিছুনা।
সেঁজুতি আবার চুপ করে যায়।রুদ্র সামনে দাড়িয়ে থাকায় সে যেতেও পারছেনা।আবার রুদ্রকে সরতে বলতেও পারছেনা।রুদ্র চাইছে সেঁজুতি কথা বলুক।কাল মেয়েটার ওমন চুপসে যাওয়া তার একদম ভালো লাগেনি।অথচ সেজুতি যেন তালা এঁটেছে মুখে।কিছুক্ষন পর সেঁজুতি বলল ‘ আমি কী যেতে পারি স্যার?
রুদ্র সানগ্লাস ভেদ করে সেঁজুতির অধৈর্য মুখভঙ্গি দেখছে।কথাটা কতটা রয়েসয়ে বলেছে মেয়েটা, সে জানে।মন থেকে মেয়েটি তাকে আদৌ এত সন্মান করে নাকী! রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলে,
— আপনাকে ভেতরে যেতে হবেনা।
সেঁজুতি ঘাঁবড়ে গেলো।ভেতরে যেতে মানা করছেন কেন? চাকরি টা কী নেই?।রুদ্র কী কালকের জন্যে তাকে বার করে দিলো?বার করে দিলে সে অত গুলো টাকা কোথা থেকে দেবে? তার চৌদ্দ গোষ্ঠী হাটে বেঁচলেও পাঁচ কোটি পাওয়া যাবেনা।
কাঁপা কন্ঠে শুধালো ‘ ককেনো?
রুদ্র হঠাৎই ক্ষ্যাপাটে ষাড়ের মতো আচরন করলো,মেজাজ নিয়ে বলল,
— আপনি এতো প্রশ্ন কেনো করেন?বলেছিনা বসের মুখের ওপরে প্রশ্ন করবেন না? আপনি আসলেই অভদ্র।
সেঁজুতির মুখটা থমথমে হয়ে এলো অপমানে।জীবনে প্রথম কেউ তাকে অভদ্র বলল।
রুদ্র আবার বলল,
‘রুদ্র রওশন চৌধুরী জবাব নিতেই পছন্দ করে, দিতে নয়।এনি ওয়ে, গাড়িতে উঠুন।যান।

সেঁজুতি ঠোঁট কাঁমড়ালো।গাড়িতে উঠবে কেন? রুদ্র ধমকে বলল ‘ Go!
সেঁজুতি কেঁপে উঠে ধড়ফড় করে গাড়ি তে গিয়ে বসলো।কিন্তু পেছনে।রুদ্র ড্রাইভিং সিটে বসলো এসে।গাড়ির লুকিং গ্লাসের দিকে চেয়ে বলল
“পেছনে বসেছেন কেনো?? আমি ড্রাইভ করবো আর আপনি গাড়ির পেছনে বসবেন?কেনো? আমি কি আপনার ড্রাইভার?
সেঁজুতি মুখ কোঁচকালো।মনে মনে আওড়ালো,
— আজব তো!ভাবলাম পি- এ বসের পাশে বসলে ওনার সন্মানে লাগবে তাই তো পেছনে বসেছি।এই লোকটা এতোটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিভাবে ভাবতে পারে,, আল্লাহই জানে।
‘ সামনে আসুন।
সেঁজুতি সামনে এসে বসলো চুপচাপ।
রুদ্র সিট বেল্ট বেঁধে দেয়ার জন্যে এগোলে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমি পারবো,,সেদিন দেখে নিয়েছি।
‘ ওকে।
রুদ্র সোজা হয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।ততক্ষনেও সেঁজুতির বেল্ট বাঁধা হয়নি বলে পেছনে হেলে পরলো একদম।নঁড়বড়ে হাতে অনেক সময় নিয়ে বাঁধলো শেষে। রুদ্র পুরোটাই খেয়াল করলো।বললনা কিছু।গাড়ির কাঁচ তুলতে গেলে সেঁজুতি মিনমিনিয়ে বলল ‘ একটু খোলা থাকুক না! আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
রুদ্র উত্তরে নিশ্চুপ।নিরবতা সম্মতির লক্ষন হিসেবে ধরে নিলো সেঁজুতি।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো হাইওয়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চলার সময়। খোলা জায়গা পেতেই বাতাসের ঝাপটায় সেঁজুতির চুল উড়াউড়ির পাল্লা দিলো।আর সব পরছে তো পরছে,রুদ্রর মুখের ওপর। রুদ্র কয়েকবার সরিয়ে দিলো। কাজই হচ্ছেনা।ওদিকে সেঁজুতি ও বারবার হাত দিয়ে চেপে ধরছে।রুদ্র শেষ মেষ বিরক্ত হয়ে বলল ‘ চুল সামলাতে না পারলে কেটে ফেলুন।এভাবে মুখের ওপর এসে পরছে কেন?ডিসকাস্টিং!
সেঁজুতি উপায় না পেয়ে গাড়ির জানলা আটকে দিলো। রুদ্রও এসি অন করলো।পুরো রাস্তা মুখ অন্ধকার করে রাখলো সেঁজুতি।একটু না হয় মুখের ওপর পরেইছে তাতে এমন করার কী হলো? এই চুল বড় করতে তার কত সময় লেগেছে লোকটা জানে? নির্দ্বিধায় বলল কেটে ফেলতে।নিজের টা কাটলেই পারে!এরপর গাড়ি এসে একটি বিশাল বাড়ির আঙিনায় থামলো।সেঁজুতি কে নামতে বলে রুদ্র নিজে নেমে গেলো আগে আগে।সেঁজুতি নেমে সামনে তাকাতেই মুখ হা হয়ে এলো।এতো লোকজন বাড়ির সামনে?বিড়বিড় কিরে বলল ‘ কার বাড়ি এটা?
রুদ্র তখন সেঁজুতির পাশে এসে দাঁড়ানোয় শুনতে পেলা।নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল ‘ নেহাল উদ্দিনের বাড়ি।
সেঁজুতি হতবাক।ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ এই লোকের বাসায় আমাকে কেনো এনেছেন?
‘ কাজ আছে।
‘ আপনার আছে তো আপনি আসতেন। আমি কেনো আসবো..?
রুদ্র রেগে গেলো,
‘ মুখে মুখে তর্ক করবেন না।মিস্টার নেহাল আমার অনেক কাজের একজন লোক ছিলেন।ওনার আকষ্মিক এমন মৃত্যু তে আমাদের সবার ই খারাপ লেগেছে।তাই আমাকে আসতে হতো, আর আপনি যেহেতু আমার পি -এ তাই অবশ্যই আপনিও আসবেন তাইনয় কি?
সেঁজুতি চুপ মেরে যায়।বলার কিছু নেইও।রুদ্রর যুক্তিতো একদম ঠিক।রুদ্র লম্বা পা ফেলে সামনে এগোতেই সেঁজুতি ও পিছু নিলো ওর।বাড়ির ভেতর যৎসামান্য ফাঁকা নেই।লোকজনে গিজগিজ করছে।মৃত লোকের বাড়ি বলেই এমন, সেঁজুতি এতক্ষনে বুঝেছে সেটা।কিন্তু অবাক না হয়ে পারছেনা।একটা লোকের চোখেও যদি পানির দেখা মেলে।পেটের মধ্যে কৌতুহল রাখতে না পেরে রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,

” আচ্ছা কেউ কাঁদছেনা কেনো?? মৃত লোকের বাড়িতে তো কান্নার রোল পরে যায় আর এখানে সবাই কী স্বাভাবিক!
জবাবে রুদ্র উদ্বেগহীন কন্ঠে বলল,
” কে কাঁদবে?? কেউ থাকলে তো!নেহালের সাতকূলে কেউ নেই।
‘ তাহলে এরা কারা?ওনার স্ত্রী সন্তান ও নেই? এত বয়সের একটা লোক বিয়ে করেন নি?
সেঁজুতির আগ্রহে রুদ্র চোখ ছোট করে তাকায়।পরমুহূর্তে সামনে তাকিয়ে বলে ,
” এরা ওনার ব্যাবসায়ীক লোকজন।ওনার বাবা মা নেই।স্ত্রী আর এক মেয়ে ছিলো। নেহালের চারিত্রিক দোষের জন্যে ওনার স্ত্রী ওনাকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বিদেশ চলে গিয়েছেন।
” উনি আর বিয়ে করেননি?
” না।
‘ কেন?
রুদ্র কপাল কুঁচকে বলল ‘ আমি কী করে জানব?

সেঁজুতি নিজের মতো ভেবে নিলো ‘ লোকটার চরিত্র ভালোনা।মেয়ে নিয়ে পরে থাকলে কী আর বিয়ের দরকার হয়? তবে ওনার স্ত্রী একটা ভালো কাজ করেছেন ওনাকে ডিভোর্স করে। দুশ্চরিত্র লোকের সাথে সারাজীবন কাটানোর থেকে একা থাকাও ভালো। শেষ কথাটা বিড়বিড় করলো সেঁজুতি। কিন্তু রুদ্রর কানে ঠিক পৌঁছোলো।শীতল চোখে সেঁজুতি কে দেখলো সে। ভেতর থেকে কোথাও প্রশ্ন উঠলো ‘ আমিও কী দুশ্চরিত্র?

সেঁজুতি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়িটা পর্যবেক্ষন করছে।পুলিশ এসেছে বাড়িতে।এছাড়া বাকিরা ফরমাল পোশাক আশাকের লোকজন।রুদ্র দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ফোনে।হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ভরাট কন্ঠে ডাকলো,
” এক্সকিউজ মি ম্যাম!

সেঁজুতি ফিরে তাকালো।পুলিশের এক লোক দাঁড়িয়ে। আস্তে করে বলল,
‘ জ্বি? আমাকে বলছেন?
‘ জ্বি।আমি উত্তরা থানার ও-সি মাহবুল আলম।নেহালের ব্যাপারে আপনার একটা স্টেটমেন্ট দরকার আমাদের।
সেঁজুতি বুঝলোনা,
” আমার স্টেটমেন্ট? কিসের জন্যে?
‘ নেহালের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করার জন্যে ম্যাডাম।গতকাল ওনার অফিসে উনি আপনার সন্মান হানি করতে চেয়েছিলেন শুনলাম।

সেঁজুতি উদ্বেগ নিয়ে বলল ‘ সেটা আপনি কি করে জানলেন?
লোকটি জবাব দেয়, ‘ আপনার বস মিস্টার রুদ্র রওশন চৌধুরী আমাদের জানিয়েছেন।
বিস্ময় নিয়ে একবার দূরে ফোনালাপে ব্যাস্ত রুদ্রকে দেখে নেয় সেঁজুতি। আবার লোকটির দিকে ফিরে বলে,
“কিন্তু একজন মৃত লোকের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করে কি লাভ?? ওনাকে তো আর জীবিত করে শাস্তি দিতে পারবেন না তাইনা?

এ পর্যায়ে লোকটি মুচকি হাসলেন। বললেন,
‘ তা হয়তো পারবোনা ম্যাডাম,কিন্তু ওনার সমস্ত বাজে কাজ গুলোর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এবং তা সরকারের কাছে প্রমান করে ওনার সমস্ত প্রপার্টি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ এসেছে ওপর মহল থেকে।

সেঁজুতি চোখ গোলগোল করে বলল,
‘উনি কি আরও কোনও খারাপ কাজে যুক্ত ছিলেন ?
এই মুহুর্তে যেন সেঁজুতির প্রশ্নের উত্তর করাই লোকটির গুরুত্বপূর্ণ কাজ।রুদ্রর এসিস্ট্যান্ট বলেই এত সমীহ করছেন উনি।আর সেঁজুতিও পাল্লা দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ছে।
“জ্বি, ফ্যাশন ডিজাইনিং এর বিজনেস ছাড়াও ওনার অন্যান্য অনেক কালো টাকার বিজনেস ছিলো।অবৈধ ভাবে হীরে আনা নেয়া করা বিদেশ থেকে,নারীপাচার এসবেও যুক্ত ছিলেন। আর সেসবের হদিস আমরা রুদ্র স্যারের থেকেই পেয়েছি।
আর এখানে যেহেতু ইনকাম ট্যাক্সের লোকজন ও এসেছেন তো ওনার সব কাজ কর্মের হিসাব নিকাশ পাওয়া যাবে খুব তাড়াতাড়ি।
রুদ্রর কথা শুনে মাথা ঘুরছে সেঁজুতির।চোখের সামনে লাল নীল আলো দেখছে।কি হলো ব্যাপার টা?এই লোকটা কাল নেহাল উদ্দিনের সাপোর্ট টেনে কথা বললেন।কাল কি একটু আগেও তো বললেন নেহালের মৃত্যু তে শোক পেয়েছেন।একেবারে শোকে নাকী শোকাহত উনি! তাহলে এত সৎ বুদ্ধির উদয় কি করে হলো? কোন দিকে উঠলো সূর্য? নাকী, ওনাকে যতটা খারাপ ভেবেছি উনি ততটা খারাপ নন।হোক ভালো তাতে আমার কী? হুহ!

‘ ম্যাম?
সেঁজুতির সম্বিৎ ফিরলো।একটু হেসে বেলল ‘ আমি স্টেটমেন্ট দিতে রাজি।কি করতে হবে বলুন।
____
সেঁজুতি রুদ্রকে খুঁজছে তখন থেকে।একটু আগেই না এখানে ছিলেন উনি? গেলেন কোথায় এর মধ্যে? ওনার এমন রহস্যময় চালচলনের মানে আমার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা।নিজেই নেহাল উদ্দিনকে কাজের লোক বলে নিজেই তার গোপন তথ্য পুলিশকে দিয়ে দিলো?সেঁজুতির একবার মনে হলো রুদ্রও কী এসবে যুক্ত? পরমুহূর্তে নিজের মাথায় চাটি মারলো নিজেই।রুদ্র যুক্ত থাকলে কী যেচে পুলিশকে এসব জানাতেন? উনিও তো ফাঁসবেন তাহলে। নেহাল লোকটা কাল বলেছিলেন রুদ্রকে ৭ বছর ধরে চেনে।রুদ্রর খুটিনাটি সব জানেন। তাহলে রুদ্রও ওনার সব জানবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
” কিছু খুজছেন??
হঠাৎ কথায় চমকালো সেঁজুতি। রুদ্রকে দেখেই ধড়ফড়িয়ে বলল,
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো!
রুদ্র উৎকন্ঠাহীন
“আমি জানি আপনি কি বলবেন(একটু থেমে) আপনি এটাই ভাবছেন, যে আমি এসব কেনো করছি?যেখানে নেহাল উদ্দিন কে আমার এতো কাজে লাগতো?
সেঁজুতি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো।যার অর্থ হ্যা।রদ্র ঝুঁকে এলো কিঞ্চিৎ। হাল্কা গলায় বলল ‘ শুনবেন?
সেঁজুতির অদ্ভূত অনুভূতি হলো। ঢোক গিলে মাথা নাড়লো আবারও। রুদ্র সেঁজুতির চোখের দিক সেকেন্ড খানিক চেয়ে থেকে সোজা হলো।মুখ ঘুরিয়ে বলল’ আপনাকে কোনও উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই,সো আপনি কিছু জানতেও পারছেন না।
(ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) লেট হয়ে যাচ্ছে। চলুন, এখানের কাজ শেষ।

বলেই রুদ্র হাটা ধরলো।সেঁজুতি কিছু সময়ের জন্যে বোঁকা বনে গেলো।হুশ ফিরতেই ছুট লাগালো রুদ্রর পেছনে।
“আরে এসব এর কি মানে আরে শুনুন তো..
গাড়িতে বসে গিয়েছে রুদ্র।সেজুতিও হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো।হাঁপিয়ে গিয়েছে এটুকু দৌড়ে। হাত নাড়িয়ে বলল ,
“আচ্ছা বেশ! আপনাকে সব টা বলতে হবেনা।যাস্ট এইটুকু বলুন যে স্টেটমেন্ট নেয়ার জন্যে ওনার বাড়িতে কেনো?? থানায় গেলেই তো হতো…

রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল’ তাহলে তো পুরোটাই বলতে হবে।
সেঁজুতি অনুরোধ করলো এবার,
— প্লিজ বলুন না, আর কক্ষনও কোনও প্রশ্ন করবোনা আপনাকে।
রুদ্র ভ্রু নাঁচালো,
” শিওরিটি দিচ্ছেন?
“হ্যা
” বেশ,
রুদ্র ড্রাইভ করতে করতে বলল,
“আপনাকে এখানে নিয়ে আসার দুটো কারণ ছিলো।no 1-আমি চাইনি আমার অফিসের পিএ থানায় যাক।থানা ব্যাপারটা আমি ইগনোর করে চলি।আপনি যেহেতু আমার সাথে যুক্ত(সেঁজুতি তাকাতেই)আই মিন আমার অফিসের সাথে তাই আপনাকে এটা থেকে দূরে রাখা আমার উচিত।কারন এখানে আমার কোম্পানির রেপ্যুটেশন জড়িয়ে।And no 2-কাল আপনি যেভাবে কাঁদছিলেন,তাই আমার মনে হলো মরার পরেও বেচারার এমন অবস্থা দেখলে কিছুটা হয়তো শান্তি পাবেন।দ্যাটস ইট….

রুদ্রর মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সেজুতি।এই কি সেই লোকটা যে কাল তাকে ওসব কথা শোনোলো।সেঁজুতি নিজেকেই শুধালো,
“আমার মনের শান্তি নিয়ে ভাবছেন উনি?পরমুহূর্তে চিন্তা ঝেড়ে রুদ্রর দিক তাকালো,
” আচ্ছা,,আপনার কি মনে হয় , ওনাকে কে মারতে পারে??আর তাও এভাবে?
রুদ্রর সেই নিরুদ্বেগ উত্তর, ‘সেটা কী আমার জানার কথা?আমার জানার কোনও দরকার আছে বলেও মনে হয়না।আর না প্র‍য়োজন আছে আপনার।
হতে পারে নেহাল কারো কোনও দামী জিনিসের দিকে হাত বাড়িয়েছিলো তাই এভাবে মরলো।বেচারা!
সেঁজুতি ফোসফোস করে বলল’কাল আমার কাছে যদি একটা ছুরি থাকতো না?আমি নিজেই ওর পেটে ঢুকিয়ে দিতাম।
হাসলো রুদ্র।সেজুথির আঁড়ালেই।বলল
‘ কাল আপনার কিছু কথার উত্তর দেয়া বাকি রয়ে গিয়েছে।
সেঁজুতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলো।রুদ্র ওর দিক দেখলোনা।সে সামনে তাকিয়ে। ওভাবেই নিরেট কন্ঠে বলল,

“আমি জানি আপনি আমাকে খারাপ ভাবেন।সত্যিই আমি খারাপ।সাথে এটাও সত্যি আমি মেয়েদের সহ্য করতে না পারলেও অসন্মান করিনি কখনও।অন্য কেউ অসন্মান করুক সেটাও মেনে নেইনি।নেহাল উদ্দিন কাজ টা যখন করেইছেন তখন একটা পানিশমেন্ট ওনার পাওনা ছিলো। কিন্তু তার আগেই বেচারার মার্ডার হয়ে গেলো।তাই ভাবলাম অন্তত পুলিশ ফোর্স কে একটু সাহায্য করি!আর এজন্যেই সব ইনফরমেশন কালেক্ট করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।এবার বাকিটা ওরাই বুঝে নিক।রুদ্র একটু থামলো।দম নিলো বোধ হয়,পরের টুকু
শক্ত কন্ঠে বলল,
“আর হ্যা! আপনি নেহাল উদ্দিনের সাথে আমাকে মেলাতে আসবেন না।কারণ আমি কাউকে জোর করে নয় বরং নিজ ইচ্ছায় যারা এসেছে তাদের সাথেই ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডে যাই।যেমন একদিন আপনি এসেছিলেন হোটেলে।

এতক্ষন উৎসুক হয়ে রুদ্রর সব কথা শুনছিলো সেঁজুতি।শেষের কথাটা কানে যেতেই মুখে আমাবস্যা নামলো।পুরোনো ক্ষত-তেই কেন বারবার খোঁচা মারে এই লোকটা?তাৎক্ষণিক জানলার দিক মুখ ঘোরালো সেঁজুতি।দৃষ্টি জোড়া উদাস হলো।বুকের ভেতর শুরু হলো অসহ্য ব্যাথা।
ব্যাপারটা ঠিকই আঁচ করতে পারলো রুদ্র।তবুও সে নিশ্চুপ।মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলো ‘ আমি তো জেনেই ছাড়বো মিস সেজুতি।কেনো আপনার মত একটা মেয়ে আমার হোটেলে এসেছিলো সেদিন?
জেনেই ছাড়বো আমি।যেটা আমি ভাবছি সেটাই যদি সত্যি হয় তবে সামনে আপনার সাথে যে অনেক কিছু ঘটবে।যা আপনি কল্পনাও করেননা।

চলবে

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১৬( বাকী অংশ)
কিছুদিন পার হলো।নেহালের হত্যাকারীকে খুঁজে পেতে পুলিশের তৎপরতা তেমন একটা দেখা যায়নি।এত বড় ব্যাবসায়ী হলেও কেস চালানোর মতো কেউ ছিলোনা।অন্যদিকে পুলিশও তদন্ত করে কোনো ক্লু পায়নি।তাই আপাতত ফাইল বন্ধ না করলেও মুখে মুখে ওঠা গুঞ্জন থেমেছে।ধামাচাপা পরেছে এক কথায়।
সেঁজুতিও কাজের চাপে নেহালের বিষয় টা ভাবেনা।ভাবার ফুরসত কই? সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে পুরো বাসার কাজ একা হাতে সামলায়।আবার অফিস গিয়ে এক গাঁদা কাজ রুদ্রর।মেয়েটাকে ছুটিয়ে প্রান নেবে হয়তো।অনেক সময় বাড়ি সামলে অফিস পৌঁছোতে দেরীও হয় সেঁজুতির।বৃষ্টি হলেতো কথাই নেই।একটা রিক্সা যদি পায় তখন।দেরী করা নিয়ে রুদ্র অনেকবার ওয়ার্নিং দিয়েছে। তবে হালকা পাতলা।রুদ্র অফিসে আসার পর মহারানী আসেন। এটাই তার অপরাধ।রুদ্রর প্রবল ইচ্ছে,যখন সে অফিসে ঢুকবে বাকীদের সঙ্গে সঙ্গে সেঁজুতিও দাঁড়াবে।মিষ্টি করে মিহি কন্ঠে বলবে ‘ গুড মর্নিং স্যার! কিন্তু সেই ইচ্ছে ইচ্ছেই রয়ে যাচ্ছে।সেঁজুতির দেখা মেলে সাড়ে দশটার দিকে।কিন্তু এতে ওরতো দোষ নেই।এত ধকল সামলে কেই বা পারবে টাইম মেইনটেইন করতে? কিন্তু এ কথা রুদ্রকে বোঝাবে কে? সে ফুলে অাছে রীতিমতো। সেঁজুতি কে কঁড়া কিছু শোনানোর জন্যে ওকে কেবিনে ডেকে পাঠিয়েছে অাজ।সেঁজুতি মাত্রই এসেছে।চেয়ারে বসবে তার আগেই পিওন এসে হাক পারলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেঁজুতি। বিড়বিড় করলো ‘ জীবন বড় বেদনার।

সেঁজুতি মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অন্ধকার।এই মুহুর্তে সে রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে। রুদ্রর কেবিনে।অন্যদিকে পকেটে হাত গুজে সেঁজুতির দিকে চেয়ে আছে রুদ্র।চোখে মুখে সহস্র বিরক্তি।কার ওপর সেটা অনিশ্চিত রুদ্র।সেঁজুতি কে কঠিন কিছু শোনাতে গেলে তার জ্বিভ আজকাল স্বায় দেয়না।কেমন বেঈমানি করে।রুদ্র তিতিবিরক্ত এতে।তাও, যৎসম্ভব গম্ভীর স্বরে বলল,

“মিস সেজুতি অফিস টাইম কখন শুরু হয়?
সেঁজুতি জানে তাকে এসব প্রশ্ন কেন করছে রুদ্র।আজও দেরি করেছে সে।আস্তে করে বলল ‘ দশটায় স্যার।
‘ আপনি এসেছেন কখন?
সেঁজুতি চোরের মত মুখ করে বলল ‘ ইয়ে..সাড়ে দশটায় মেইবি।
রুদ্র দাঁত চেপে মৃদূ স্বরে বলল ‘ নট মেইবি।সাড়ে দশটায়ই এসেছেন আপনি। গত চারদিন যাবত ঠিক আধঘন্টা দেরী করছেন।হুয়াই?

সেঁজুতি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলো।তার যে বাড়িতে এক গাঁদা কাজ সেড়ে আসতে হয় এসব কী আর বলা যায় কাউকে?রুদ্র নিজেই বলল,
‘ আচ্ছা বলুন,বস আগে এসে পি- এর জন্যে অপেক্ষা করে নাকি পি- এ বসের জন্যে অপেক্ষা করে?
সেঁজুতি একইরকম নিঁচু স্বরে বলল,
— পি-এ বসের জন্যে অপেক্ষা করে।

‘ তাহলে কার আগে আসা উচিত?পি -এর নাকী বসের??
সেঁজুতি মুখ ফস্কে বলল
— বসের।ইয়ে না পি-এর,,
রুদ্র ভ্রু নাঁচালো,
— কিন্তু দেরী কে করছে?
সেঁজুতি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল
‘পি-এ…

“এই পি-এ টা কে??
” আমি..
” তাহলে দেরী কার হচ্ছে?
এ পর্যায়ে নিঁচের ঠোঁট ওপরের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরলো সেঁজুতি। তার যে দেরী হয়েছে এটা তাকে দিয়েই স্বীকার করাচ্ছে লোকটা! কি ধুরন্ধর!আগের থেকেও আস্তে করে বলল,

‘ আমার,,
রুদ্র তুষ্ট হওয়ার ভান করে বলল ‘ বাহ! একদম ঠিক বললেন।
সেঁজুতি চোখ ওঠালো।অল্প হেসে বলল ‘ ধন্যবাদ”
রুদ্র তাকাতেই হাসি থামিয়ে চট করে মাথা নিচু করে রইলো আবার।রুদ্রর বিরক্তি বোধ হয় বাড়লো।শক্ত কন্ঠে বলল,
” রোজ রোজ আপনি যদি এভাবে দেরী করে আসতে থাকেন তবে আপনাকে আমি ছাটাই করতে বাধ্য হব।আর তখন তিন বছর আগে চাকরী ছাড়ার জন্যে জরিমানার টাকা জমা করতে হবে আপনাকে।সব টাই জানেন তো?
সেঁজুতি মাথা নাঁড়লো।সে জানে।
‘ কাল থেকে দেরী করবেন আর?
সেঁজুতি এবারেও মাথা নাঁড়লো।সে দেরী করবেনা।
রুদ্র টেবিল থেকে কফির মগ নিতে নিতে বলল ‘ নাও লিভ!কফির মগে চুমুক দিয়েই থু দিয়ে সেটা ফেলে দিলো রুদ্র।মুখ কুঁচকে বিস্বাদ নিয়ে বলল,

” ইয়াক! কি বানিয়েছে এটা?ডিজগাস্টিং,
হাজার বার বলেছি এতো টা মিষ্টি না দিতে!এক্ষুনি এই পিওনটাকে বার করে দেব অফিস থেকে।
সেঁজুতি চলেই যাচ্ছিলো।রুদ্রর কথায় দাঁড়িয়ে পরলো।পিওনের প্রতি তার নরম মনে মায়া হলো বেশ।মনে মনে ভাবলো,
“বশীরভাই কফি ভালো বানাতে পারেননা,নিশ্চয়ই।একটু পরেই হয়তো ওনাকে ডেকে আচ্ছা মতো ঝাড়বেন এই লোক।কাজ থেকে ছাড়িয়েও দেবেন।বেচারার কি হবে তখন?অবশ্য সারাদিনই তো লোকটা কে এই কফিটুকুই খেতে দেখি।বেশ কয়েকবার খান। সেটাও যদি ভালো না হয় তবে মাথা গরম তো হবেই।ওনারও দোষ নেই।সেঁজুতি কে ঠাঁয় দাঁড়ানো দেখে রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো,
” কি ব্যাপার?? আপনি এখনও যান নি যে?কাজ করার ইচ্ছে নেই?
সেঁজুতি রুদ্রর দিকে দু-কদম এগিয়ে এলো।হাঁত কঁচলাতে কঁচলাতে বলল,
‘বলছিলাম কি…..
রুদ্রর ভ্রু কুঞ্চন আরো গাঢ় হয়।সেঁজুতি অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে বলল ‘
” স..স্যার! আপনার কফি বানানোর ভার টা যদি আমি নেই?মমানে আমি অনেক ভালো কফি বানাতে পারি তো, তাই।
সেঁজুতি হাসার চেষ্টা করলো একটু।কিন্তু হাসিটা ভালো করে ফোঁটার আগেই মিলিয়ে গেলো রুদ্রর কথায়।
রুদ্র সন্দেহী কন্ঠে বলল ‘ আপনি বানাবেন? স্ট্রেঞ্জ!কাজের কথা শুনলেই তো আপনার মুখ আমাবস্যার মতো কালো হয়ে যায়।
সেঁজুতি চোখ ছোট করে ফেলল।মনে মনে বলল,
‘ব্যাস শুরু হয়ে গেলো এই লোকের খোঁচা মেরে কথা বলা।মেকি হেসে বলল,
“আমি পারবো…
রুদ্র চেয়ারে গিয়ে বসলো,শ্বাস ফেলে বলল,
‘ বেশ!যেচে কাজ নিতে চাইছেন নিন।তবে কাল থেকে নয়।এক্ষুনি এক মগ কফি বানিয়ে দিন আমাকে।

সেঁজুতি অনুরোধ করে বলল,
‘ বশীর ভাইকে কাজ থেকে বরখাস্ত করবেন না। প্লিজ স্যার!
রুদ্রর সোজাসাপ্টা জবাব,
‘ দ্যাটস ডিপেন্ড টু ইওর পার্ফমেন্স।আপনি যদি কফিটা ভালো বানাতে পারেন তবে আর করবনা।

সেঁজুতির মুখে বিস্তর হাসি ফুঁটলো ‘ আমি এক্ষুনি আসছি স্যার।পাঁচ মিনিট সময় দিন।
সেঁজুতি কেবিন থেকে বের হয়।সেদিক তাকিয়ে হাসলো রুদ্র।কফির খালি মগটা টেবিলের ওপর রাখলো।
‘ বারবার আপনাকে বোঁকা বানাতে এত কেন মজা লাগছে বলুনতো সেজুতি?শুধু কফি বানানো কেনো আস্তে আস্তে রুদ্র রওশনের প্রত্যেক টা কাজই আপনাকে করতে হবে।আপনি চান বা না চান।ও হ্যা টাইমলি আপনাকে অফিসে কিভাবে টেনে আনতে হয় সেটা এই রুদ্র রওশন খুব ভালোভাবে বুঝে ফেলেছে।
____
সেঁজুতি বাসায় ফিরেছে দশ মিনিটের মতো।এই কম সময়ে একশর বেশি ঝটকা খেলো সে।
ঘরের সব কাজ শেষ,নতুন করে রান্নাও করে রাখা।সেঁজুতি কাপড় ভিজিয়ে রেখে গেছিলো,ভেবেছিলো এসে ধুঁয়ে দেবে।অথচ সেগুলোও সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ। সেঁজুতি তখন অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ এসব কে করলো বাবা?
আমির টিভি দেখতে দেখতে জবাব দিলেন ‘ শেফালী।
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বলল
‘ শেফালী?শেফালী টা আবার কে
‘ আমি আফা…
আওয়াজ শুনে ঘাঁড় ঘোরালো সেঁজুতি। ২৪-২৫ বয়সী একটি মেয়ে।পড়নে সুতির পুরোনো শাড়ি।মুখে পান।পায়ের কাছেই রাখা এক বালতি ময়লা পানি আর ন্যাকড়া।সে মাত্রই আমিরের ঘরের বারান্দা মুছে এলো।সেঁজুতি এতক্ষন দেখতে পায়নি এজন্যে।মেয়েটির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো সেজুথি।
আপনি কে?মেয়েটির উত্তর,
‘ ওইতো শেফালী।
‘ হ্যা বুঝেছি।কিন্তু আপনি কে?
মেয়েটি বিরক্ত হলো যেন,
‘কি কন আফা?কইলামত আমি শেফালী!
সেঁজুতিও পালটা বিরক্ত,
— উফফ!
আচ্ছা বুঝেছি, এখানে কেনো এসেছেন?
শেফালীর উদ্বেগহীন জবাব,
“কাম করতে আইছি।আর কিল্লাই আইতে যামু?
“কিন্তু আমিতো আপনাকে কাজে রাখিনি। আপনাকে কখনও দেখেছি বলেও মনে পড়ছেনা।
শেফালী পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো,
‘রাহেন নাই তো কি অইছে।না রাখলে কি কাম করোন যায়না?এহন থেইক্কা আমনেগো সব কাম আমি কইরা দিমু।আফনারে আর কষ্ট কইরা ঘর বাইর সামলান লাগতো না।তয় মাসে মাসে কিন্তু আমারে দেড়ডা হাজার ট্যাকা দেওন লাগবো।একদাম আফা।

সেঁজুতি হতবুদ্ধি ভাবে শেফালীর সব কথা শুনলো।মাথায় এখনও কিছুই ঢুকছেনা।বলল
‘কিন্তু আপনি কি করে আমাদের বাড়ির খোঁজ পেলেন?
শেফালী এবারেও হাসলো।
‘কি যে কন আফা!আমরা হইলাম গরীব মানুষ, সারাদিন কাম খুইজতে থাহি।ওই এক ভাবেই পাইছি আপনাগো বাসা।তারপর খালুজানের কাছে আইসা জিগাইতেই হেয় কইলো সত্যিই আমনেগো কামের লোক দরকার একজন।
সেঁজুতি দ্বিধায় পরলো।এমন অচেনা একজন মানুষকে কাজে রাখা ঠিক হবে? তাও এমন হুটহাট! বাবার যা অবস্থা!যদি খারাপ হয়?সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে বলল,
‘কিন্তু…..

আমির এতক্ষন টিভিতে ডুবে থাকলেও সব কথা শুনেছেন।সেঁজুতির কিন্তু শুনতেই কপট ধমকে বললেন,
‘ এত কী ভাবিস তুই?কোনো কিন্তু নয়।ওকে কাজে রাখবি তুই।সারাদিন এতো খাঁটুনি খাটছিস,এগুলো আমি দেখতে পারছিনা,তাই আজ থেকে ওই তোর সব কাজ এগিয়ে দিয়ে যাবে।

‘ কিন্তু বাবা তুমিতো বুয়ার হাতের রান্না খেতে পারোনা।

আমির দৃঢ় কন্ঠে বললেন ‘পারিনা,কিন্তু পারবো।আমার মেয়ের জন্যে এইটুকু অভ্যেস করতে পারবোনা আমি?
সেঁজুতি অসহায় চোখে তাকালো,
‘তবুও…
পাশ থেকে শেফালী কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
‘ আর ভাইবা লাভ নাই আফা।খালুজান যহন কইছে তহন আমার চাকরী পাক্কা।এই আমি এইহানে বইলাম।
শেফালী হাত পা গুছিয়ে ফ্লোরে বসে পরলো।সেঁজুতি হেসে ফেলল তাতে। ‘ আচ্ছা ঠিক আছে রাখলাম।উঠুন এখন।
” হাছা কইলেন?? ঠিক আছে,তয় উটতাছি।
‘ কোথায় বাসা আপনার ?
‘বলখেলার মাঠ টার পিছন দিক দিয়া যে বস্তিখান, ওইহানে।
‘ ওহ! কাল থেকে প্রতিদিন সকাল ৮ টায় চলে আসবেন।
শেফালী ঘাঁড় কাত করলো ‘আইচ্ছা।
অনেক রাইত হইছে ওহন আমি যাই। কাইল সক্কাল বেলা আমুনে।দেড়ি করলে জামাই টা আবার মন খারাপ করবো! হেতি আমারে অনেক ভালোবাসে তো।বাবার সামনে শেফালীর বেঁফাস কথায় লজ্জ্বা পেলো সেজুতি।
” মাথার তার তো দেখি ছেড়া।তবুও ভালো,
অন্তত কাউকে তো পাওয়া গেলো।অন্য কেউ কাজ গুলো সেড়ে রাখলে আর অফিস যেতে দেরী হবেনা আমার। ওই বদমাশ লোকের ঝাড়ি ও খেতে হবেনা।এবার আপনিও দেখবেন মিঃ বস,আমি কতটা পাংকচুয়াল!হুহ!
_____
ওটি সেড়ে মাত্রই চেম্বারে বসেছে হোসাইন।গরমে অবস্থা যাচ্ছেতাই।অসময়ের বৃষ্টিতে আদৌ কোনো লাভ হচ্ছেনা। একটু যদি ঠান্ডা লাগে! হোসাইন এসির পাওয়ার বাড়ালো।সাদা এপ্রোন চেয়ারের হাতলে রেখে বোতল খুলে পানি খেল।তখনি একজন এসে জানালেন ‘ স্যার রুদ্র রওশন চৌধুরী আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন।
হোসাইন অবাক হলেন।রুদ্র এই সময়ে তার চেম্বারে ঠিক কী কারনে আসবে বুঝে উঠলেন না।সেদিনের পর লোকটাকে আর দেখেন ও নি।খবর দিতে আসা লোকটিকে বললেন ‘ পাঠিয়ে দাও।
দু মিনিটের মাথায় রুদ্র নক করলো দরজায়।দরজা খোলাই ছিলো।রুদ্র শুধু টোকা দিয়ে হোসাইনের মনোযোগ নিলো। রুদ্রকে দেখতেই হোসাইন বিরাট হাসি ঝোলালেন মুখে।লোকটা ভীষণ হাসিখুশি হিসেবেই পরিচিত।’ মিস্টার চৌধুরী যে! আসুন আসুন।,প্লিজ বসুন…
রুদ্র বসলো।
‘থ্যাংক ইউ!
‘ কি খাবেন বলুন? চা? কফি? নাকি ঠান্ডা।
‘ নাথিং!
রুদ্র সোজাসুজি মূল বিষয় তুলল ‘ আমি এখানে আপনার থেকে কিছু জানতে এসেছি।বলতে পারেন ইনফরমেশন চাইতে এসছি।
হোসাইন বুঝলেন না,
‘ আমার কাছে ইনফরমেশন ? কি ব্যাপারে?

রুদ্রর অকপট জবাব, ‘ সেঁজুতির ব্যাপারে।
হোসাইন যেন হোচট খেলেন, ‘ সেঁজুতির ব্যাপারে?
‘ হু।
হোসাইন নড়েচড়ে বসলেন।শান্ত অথচ কঠিন স্বরে বললেন ‘ স্যরি! এভাবে আমি সেজুতির অপরিচিত কাউকে ওর ব্যাপারে তথ্য দিতে পারবনা।

রুদ্র ভ্রু বাঁকালো,
অপরিচিত?? আমি যে সেজুতির অপরিচিত সেটা আপনাকে কে বললো?আপনি হয়তো জানেন না আমি ওর কে?
হোসাইনের হাসি পেলো।সেঁজুতির ব্যাপারে এমন কোনো কথা আছে নাকী সে জানেনা? দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল
“তাই? তা কে আপনি ??
রুদ্র স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘আমি ওর বয়ফ্রেন্ড।বাংলায় যাকে বলে প্রেমিক। আর কিছুদিন বাদেই যেটা দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে হাজবেন্ড হয়ে যাবে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে