প্রনয় পর্ব-১২+১৩

0
595

# প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব – ১২

কাঁচের দরজাটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সেঁজুতি।এমনিই নার্ভাস সে।সাথে এসির ঠান্ডার মাত্রায় গুটিয়ে আসছে আরো।সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা শরীর, আর চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলো।অভ্রও একিভাবে চেয়ে আছে।মুখ দেখে মনে হলো সেও অবাক হয়েছে।
সেঁজুতি উদ্বেগ নিয়ে বলল,
মিঃ অভ্র?? আপনি?
অভ্র বসা থেকে সটান উঠে দাঁড়ালো ‘ সেঁজুতি যে! আপনিই কী সেই ক্যান্ডিডেট?

সেঁজুতি এক পাশে মাথা নাঁড়লে অভ্র হাসলো। দম নিলো,
‘ এক মিনিট’
সময় টুকু চেয়ে টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো অভ্র।পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বসলো।সেঁজুতি কে বলল” বসুন।

সেঁজুতি এগিয়ে এলো বসার জন্যে।কৌতুহল তার মুখ চোখে।অভ্রকে এখানে আশা করেনি একদমই।অভ্রর অবস্থাও তাই।সেও সেঁজুতি কে আশা করেনি।গতকাল থেকে রুদ্রর হাবভাব ভালো লাগছিলোনা।যেখানে শত শত গ্রাজুয়েট লোক লাইনে থাকে ‘আর -আর -সিতে একটা চাকরী পেতে,সেখানে অফিসের বস নিজে যেচে একজন কে চাকরী দিচ্ছে।এমনকি এপ্যোয়েন্টমেন্ট লেটার অব্দি নিজে বানিয়েছে।অফিসের নেম প্লেট পাল্টেছে।ম্যানেজার কে পাঠিয়ে ভুঁড়ি ভুঁড়ি মিথ্যে বলিয়েছে।অভ্র তখনও জানতোনা যার জন্যে এসব, সে আদৌ ছেলে নাকী মেয়ে।রুদ্র তার সামনেই ম্যানেজার কে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছিলো।তখনও সে বোঝেনি মেয়েটি আসলে সেঁজুতি হবে।কিন্তু সেঁজুতির জন্যে ভাইয়ের এত কর্মকাণ্ডের মানে কি? শুধুই কী ঋন শোধ? অভ্র যখন গভীর ভাবনায়, সেঁজুতি বলল,
— তার মানে এটা আপনাদের অফিস?আমি কিন্তু জানতাম না আপনি এখানে থাকবেন।
‘ আমিওনা।
সেঁজুতি এতক্ষনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো,
‘যাক! ব্যাপার টা তাহলে আপনার ইচ্ছাকৃত নয়।

“একদম ই নয়,,
সেঁজুতি মৃদূ হাসলো ‘ তাহলে ঠিক আছে। ইচ্ছেকৃত হলে হয়তো কাজটা করা হতোনা আমার।
অভ্র পালটা হেসে বলল ‘ জ্বি জানি। একদিনে আপনাকে এত টুকু বুঝেছি।কারো দানপত্র নেয়াতে আপনার খুবই এলার্জি।বলেছিলেন আপনি!
অভ্র মনে মনে ভাবলো,’ হয়ত এইজন্যেই ভাই এত কাহিনী করলো আপনাকে চাকরী টা পাইয়ে দিতে।ভাইয়ের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছিনা।মেয়েটা টাকা নেয়নি দেখে এইভাবে তার ঋন শোধ করার উপায়টা কিন্তু দারুন!

সেঁজুতি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,
‘তো এখন কি আমি সিলেক্টেড?
অভ্র দৃঢ় কন্ঠে বলল
‘অবশ্যই…
‘ ইন্টারভিউ?
‘ আমাদের ম্যানেজার আপনাকে বলেনি কিছু?
‘ বলেছিলো।মার্কের ওপর ডিপেন্ড করে চাকরীটা পাচ্ছি কিন্তু এখানে এসে ভার্সিটির কাউকে দেখলাম না যে! আর মার্ক ভালো হলেই গ্রাফিক্স বা ডিজাইনিং ভালো পারব তাও কিন্তু নয়।

অভ্র প্রসন্ন হেসে বলল ‘ সেঁজুতি! আপনি নিঃসন্দেহে একজন বুদ্ধিমতি মেয়ে।আপনার যাচাই করার ধরন টা কিন্তু ভালো।আসলে ব্যাপারটা হলো আমরা এক ডিপার্টমেন্ট থেকে যে কোনো একজন কে বাছাই করি।আপনাদের ডিপার্টমেন্টে মোট চারজন করে করা হয়।এরপর তন্মধ্যে লটারি করা হলো।আর লাকিলি আপনার নাম উঠলো।বুঝতে পারলেন?
ভেতরে ভেতরে হাফ ছাড়লো অভ্র।এত গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারায় বাহবা দিলো নিজেকে।
‘ ওহ! তাই ভাবি কাউকেই এখানে পেলাম না।
অভ্র চট করে বলল
‘ আপনি একটু পরেই আরো একটা প্রশ্ন করে বসবেন আমি জানি।তাই আগেভাগে উত্তর দিচ্ছি শুনুন, আপনাদের লটারি করার দায়িত্ব কিন্তু আমার ছিলোনা,তাই আমি জানতে পারিনি যে সিলেক্ট হলেন তার পরিচয় কী! বা তিনিই আপনি।
সেঁজুতি হেসে ফেলল।হাতের ফাইল ঠেলে দিয়ে বলল ‘ এখানে আমার সব ডকুমেন্টস আছে।ওখানে যা যা লেখা ছিলো এনেছি সব।

অভ্র নাটকীয় ভাবে সেগুলো নিলো বিনাবাক্য ব্যায়ে।সেঁজুতি একটু ইতস্তত করে বলল
‘ আমার কী কাজ এখানে? মানে কী পদ?
অভ্রর সহজ উত্তর,
‘ পি এ… আই মিন পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট।
‘ আপনার?
‘আমার ভাইয়ের…
সেঁজুতি চোখ বড় করে বলল,
‘ ওই যে উনি? যিনি চেহারা ঢেকে রাখেন সব সময়?
‘ জ্বি।অত্র অফিসের মালিক উনিই।আমিতো সামান্য ভার বহন করছি।
সেঁজুতি অন্যমনস্ক হয়ে বলল ‘ কী কাকতালীয় ব্যাপার। গত পরশুই উনি আমার চাকরীর কথা জানতে চাইলেন।আর আজ ওনার কোম্পানি তেই চাকরী পেয়ে গেলাম আমি?
,
একেই বলে ভাগ্য!
অভ্র দাঁত বের করে হেসে নীল রংয়ের একটি ফাইল এগিয়ে দিলো।
‘ আপনার জয়েনিং কিন্তু কাল থেকে।আপাতত এটাতে একটা সই করে দিন।

সেঁজুতি ফাইল খুলে পড়তে গেলে অভ্র তটস্থ হয়ে বলল’ তেমন কিছুই না।আসলে এতে লেখা আছে যে আগামী তিন মাসে আপনি যদি একদিন ও অফিসে অনুপস্থিত থাকেন তবে আর এই চাকরী টা আপনার থাকবেনা।এখনও তিন মাস সময় লাগবে আপনার স্থায়ী হতে।অন্যান্য অফিসেও যে রুলস হয় আরকী।আর দ্বিতীয় শর্তটা হলো আপনি যে এখানে এসে জয়েন করেছেন সেই ব্যাপারে একটা ছোট্ট দস্তখত।আপনার তো আবার শিরায় শিরায় সন্দেহ।চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

সেঁজুতি একটু লজ্জ্বা পেয়ে বলল
‘কোথায় সাইন করতে হবে বলে দিন আমি করে দিচ্ছি।
‘একদম নীচে।
না পড়েই পেপার্স গুলোতে একে একে সাইন করে দিলো সেজুথি।কাজ শেষে যথারীতি ফাইল টা আবার এগিয়ে দিলো অভ্রর দিকে।হ্যান্ড ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে বলল’ এবার তাহলে আসি।
‘এক সেকেন্ড!

সেঁজুতি থামলো।অভ্র একটা মোটা টাকার বান্ডিল টেবিলের ওপর রেখে বলল, এটা আপনার এডভান্স।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
— এডভান্স??
অভ্র স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ এই চাকরীটার ক্ষেত্রে এই নিয়ম টা চলে এসছে।যেহেতু প্রত্যেকে স্টুডেন্ট হয় ভাই -ই সেজন্যে নিয়ম টা বানিয়েছিলো।
সেঁজুতি আর ভাবলোনা।এত বড় কোম্পানিকে সন্দেহ করার কী আছে?প্রসন্ন হেসে টাকা গুলো ব্যাগে ভরলো।কিন্তু মন বড় নাছোড়বান্দা। হাটতে হাটতে ভাবছিলো,
‘ জয়েন হওয়ার আগেই স্যালারি দিয়ে দেয়া? এটা ঠিক কেমন অফিস? তবে টাকা পেয়ে মন্দ হয়নি।এটা এই মুহুর্তে ভীষণ দরকার ছিলো।অন্তত বাসা ভাঁড়ার ব্যাপার টা তো চুঁকে যাবে।
___
আমি ও এটা বুঝতে পারছিনা যে সব কিছু এতটা কাকতালীয় কিভাবে হয়?চাকরীর বাজারে সামান্য একটা চাকরীর জন্যে যেখানে মারামারি লেগে যায় সেখানে পায়ে হেটে এত ভালো একটা অফার এসে গেলো তোর কাছে?তাও আবার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট এর পোস্টে? মানে এত বড় পদ? তাও ওই সেই চেনা লোকের।কি হচ্ছে কিছুইতো বুঝতে পারছিনা।
সেঁজুতি বাবার পায়ের কাছে বাবু হয়ে বসেছিলো।গালে হাত দিয়ে বলল ‘আমিও নাহ.

আমির কিছুক্ষন ভেবে বললেন, ‘তোর ওখানে কাজ করার দরকার নেই,যেতে হবেনা তোকে।
সেঁজুতি তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে ওঠে,
— এটা আবার কি কথা? টাকা নিয়ে এলাম।মার্ক শীট থেকে শুরু করে সব ডকুমেন্টস জমা দিয়ে এলাম।আর এখন বলছো যাবোনা? পরমুহূর্তে বসে পরলো আবার। নরম স্বরে বলল’ এত ভেবোনা তো।যা হবে ভালোই হবে।এখন একটা জব এমনিতেই দরকার ছিলো।তাতে তো ভালোই হলো যে ওনারা আমার পরিচিত ছিলেন।তাছাড়া আমি নিজে গেলাম অফিসে, কত্ত বড় অফিস না দেখলে বুঝবেনা।শয়ে শয়ে লোক কাজ করছিলো।এত কিছুতো আর মিথ্যে হবেনা বলো!
,,
দ্যাখ যেটা ভালো মনে করিস৷

সেঁজুতি আবার উঠে দাঁড়ায়।
” খন্দকারের টাকা টা দিয়ে আসি।ব্যাটার মুখে টাকা গুলো ছুড়ে মারব আজ।

আমির চোখ পাঁকালেন ‘ এই না,কোনও বেয়াদবী করবেনা তুমি।
,,
আচ্ছা বাবা আচ্ছা।
______
রুদ্রর মুখে বিস্তর হাসি।চিকিমিক রোদ খেলছে মুখ জুড়ে।নিঁচের ঠোঁট চেপে রেখে ফাইল থেকে পেপার্স গুলো বের করে উল্টে পালটে দেখছিলো এতক্ষন।সব শেষে বাঁকা হেসে ভাবলো, মেয়েটা নিজেকে যতটা চালাক ভাবে অতটা নয়।বরং অনেক বেশি বোঁকা।আর কতটা বোকা হলে একটা এডুকেটেড মেয়ে না পড়েই পেপার্স এ সাইন করে দেয়?এভাবেতো জমিজমাও লিখে নেবে কেউ।অবশ্য এটাকী মেয়েটির বোঁকামী নাকী তার চতুরতা? সে এমন কোনো ক্লুই ছাড়েনি যাতে সেঁজুতির সন্দেহ হতো।

রুদ্র হাত মেলে দিলো কাউচের ওপর। ওপর দিক তাকিয়ে ভাবলো
‘মিস সেজুথি! আপনি জানেন ও না আপনি ঠিক কোন জালে আটকে পরেছেন।স্বয়ং রুদ্র রওশনের বোনা জাল। এখান থেকে বের হওয়া আপনার সাধ্যের বাইরে।আসল খেলা তো কাল জমবে।যখন আপনি আর আমি মুখোমুখি হবো।
,
রুদ্রর সামনেই বিছানার ওপর বসে আছে অভ্র।
পেপার্স গুলো দেখে দেখে রুদ্রর এমন হাসির কোনও মানেই খুজে পাচ্ছেনা সে।
,,
এই ভাইয়ের যে কি হলো কে জানে।প্রথমেত হোটেলে মেয়ে আসাই বন্ধ করে দিয়েছে।মেয়েদের ধারেকাছে আর ঘিষবেনা ভাবলাম।অথচ এখন কিনা আরেকটা মেয়েকে নিয়েই এত কান্ড করছে?একেবারে নিজের পি এর পোস্টে চাকরী দিয়ে দিলো? ভাইতো নিজেই মেয়ে এসিস্ট্যান্ট রাখতে চাইতোনা।সব সময় ছেলেদের রাখতো।হঠাৎ কি এমন চৈতন্য হলো ভাইয়ের? যে একেবারে এতদিনের নিয়ম জারি জুরি সব ভেঙে দিলো?অভ্রর ভাবতেই অবাক লাগছে যে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া একটা মেয়ে কিনা এতো বড় অফিসের বসের পি এ হবে?ভাইয়ের আগের এসিস্ট্যান্ট ছেলেটাই তো ঠিক ছিলো।স্মার্ট, ভদ্র,গুছিয়ে কথা বলতো।যদিও ভাই তাকে অন্য কোম্পানি তে চাকরীর ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।তারপরেও একটা কিন্তুতে এসে সব থেমে যাচ্ছে অভ্রর।সেঁজুতি ভাইয়ের পি এ কী করে হবে? হাউ ক্যান ইট বি!কিভাবে হ্যান্ডেল করবে সব? কোনো অভিজ্ঞতা নেই কিচ্ছুনা।কম্পিউটার ঠিকঠাক চালাতে পারে কীনা কে জানে!এমন চাকরী পাওয়ার জন্যে কত শিক্ষিত লোক ও কপাল চাপড়াচ্ছে।আর সেখানে মিস সেজুথির কোনও রিয়্যাকশন ই ছিলোনা।উনি হয়তো বুঝতেই পারেন নি উনি ঠিক কি পাচ্ছেন?তবে তার থেকেও এখন তার ভাইয়ের ব্যাপার টা জানা জরুরি।ভাইয়ের জায়গায় অন্য কেউ হলে তো এতক্ষনে এটা ধরে নিতাম যে মেয়েটার প্রেমে পড়েই এসব করছে।,কিন্তু ভাই আর প্রেম?ব্যাপারটা উত্তর -দক্ষিন।
তবে এর মধ্যে ঠিক কি কারন থাকতে পারে?
— আমাকে নিয়ে এত না ভেবে নিজের কাজে যা অভ্র।
অভ্র ভূত দেখার মতোন তাকালো।এতক্ষন আকাশ পাতাল ভাবনায় ছেদ পরায় পিলে চমকালো তার।সেতো মনে মনে ভাবছিলো,রুদ্র বুঝলো কি করে? কি অদ্ভূত! রুদ্র তার মুখ দেখে মনের কথা বুঝে যায়।এরকম গুন যদি তার ও থাকতো তবে এখন এত হাসফাস করতে হতোনা।সব উত্তর জেনে নিত।তারপর নাকে সরষে তেল দিয়ে ঘুমাতো।
অনেকটা চুরি করতে এসে ধরা পরে যাওয়ার মত মুখ করে নিশব্দে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো অভ্র।
ওহ গড! ( ওপর এর দিকে তাকিয়ে) কেনো এতটা গাঁধা বানালে আমাকে তুমি?ভাইয়ের মত একটু বুদ্ধি দিলেও তো পারতে!সব থেকে বেশি কষ্ট তো তখন হয় যখন ভাইয়ের আশেপাশে এতো এতো মেয়ে দেখেও নিজের বেলায় একটা গার্লফ্রেন্ড পাচ্ছিনা…..ভাবা যায়!
_______
দরজা খুলে সেঁজুতি কে দেখতেই আঁতকে উঠলো খন্দকার।ধড়ফড় করে ফাঁটা নাক, কাটা ঠোঁটে হাত বোলালো।ব্যাথা এখনও আছে।বরং বেশিই আছে।বড় বড় চোখ করে বলল ‘ ততুমি?
সেঁজুতি কোনো কথা না বলে টাকা এগিয়ে দিলো।
খন্দকার একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল ‘ কী এটা?
সেঁজুতি মুখ কুঁচকে বলল ‘ আপনার ভাঁড়া।নিন ধরুন।পুরো দুমাসের আছে কীনা দেখে নিন।

খন্দকার আর্তনাদ করে বলল ‘ না।আমি নেবনা।
সেঁজুতি ভঁড়কালো।কপাল গুছিয়ে বলল ‘ নেবেন না? কেন?
খন্দকার তোঁতলালো ‘ এমমনি এএওমনি! তুমি যাও যাও।আজ থেকে বাসা ভাঁড়া দিতে হবনা তোমাদের।

সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল ‘ আপনার মাথা ঠিক আছে? সেদিন এতো অপমান করে এলেন। আর আজ বলছেন বাড়ি ভাড়া নেবেন না?
খন্দকার অত্যধিক নরম কন্ঠে বললেন,
‘না মা বললাম তো।তোমাদের ভাড়া দিতে হবেনা,তুমি টাকা টা নিয়ে যাও।আজ থেকে বাসা টা তোমাদের জন্যে ফ্রি।

‘ ফ্রি কেন? আপনি ফ্রি দিলেও কী আমরা ফ্রিতে থাকব নাকী?
খন্দকার থতমত খেয়ে বললেন ‘ আসলে ফ্রি বলতে বোঝালাম,নিয়ম ফ্রি।মানে এক তারিখ টাকা দিতে হবে এরকম কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম মানতে হবেনা।যখন তোমাদের সুবিধে তখন টাকা দেবে।

সেঁজুতি চেঁতে গেল এবার।
,
আজব লোক তো আপনি!,সেকেন্ডে সেকেন্ডে রং বদলাচ্ছেন।না সেকেন্ডে নয়, একদিন পর পর রং বদলাচ্ছেন।কিন্তু এমন করলে তো হবেনা কাকা।টাকা আপনাকে নিতেই হবে,বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিচ্ছি এমনি এমনি নাকি? সেদিনের কথা ভুলে যাইনি আমি।কি কুৎসিত কথা শুনিয়েছিলেন আপনি আমাকে।

খন্দকার হা- হুতাশ করে উঠলেন।
,
দোহাই তোমার!,টাকা টা নিয়ে যাও,দরকার হলে এসো তোমার পায়ে ধরি আমি।
সেঁজুতি ছিটকে দুহাত পিছিয়ে গেলো। হতভম্ব হয়ে বলল
‘ এ কী! কি করছেন?

খন্দকার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“সেদিনের সব কথা আমি ফিরিয়ে নিলাম।আজ থেকে ওই ফ্ল্যাট শুধুই তোমাদের।আমি কেউনা৷, কেউনা,,তাও আমাকে টাকা দিতে এসোনা।হাত জোর করছি।

সেঁজুতির চোয়াল ঝুলে এলো খন্দকারের অদ্ভূত আচরনে।
‘এ আবার কেমন বাড়িওয়ালা রে বাবা?ভাঁড়া নেবেনা বলে পায়ে অব্দি ধরতে এলো?
— এত ভাবতে হবেনা মা,,টাকা নিয়ে যাও,,আমাকে বাঁচাও.. তোমার পায়ে ধরি আমি। পায়ে হাত দিতে দিতে)

— আরে আরে কি করছেন ছি! ছি। আপনি গুরুজন।বারবার পায়ে হাত কেনো দিচ্ছেন?
,,
তাহলে বলো টাকা তুমি দিচ্ছোনা??
,,
ঠিক আছে দিচ্ছিনা।তবে হ্যা আবার যদি অপমান করতে যান, তখন কিন্তু….
খন্দকার তড়িঘড়ি সোজা হলেন,
‘না না আমার ঘাঁড়ে কটা মাথা যে আমি তোমাদের অপমান করবো?
নাক মুখ কুঁচকে চলে এলো সেজুথি,,
‘এই লোক নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে,।সুস্থ হলে আবার টাকা চাইতে আসবে।টাকা টা বরং রেখে দেবে।এলেই বের করে দেয়া যাবে।
,,
সেজুথি যাওয়া মাত্রই ঘরের দরজা ধঁড়াম করে বন্ধ করলেন খন্দকার।ভাগ্যিশ বাড়ি ফাঁকা।নাহলে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হিমসিম খেতো।খন্দকার দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিলো দুবার।
বাপরে! প্রানের মায়া বড় মায়া।আগে তো বাঁচি।এই টাকা নিলে তার ঘাঁড় টা থাকতো তবে ঘাঁড়ের ওপর এর মাথা টা আর থাকতো নাহ।সেদিনের সেই ঘুষি, থাপ্পড় এখনও জীবন্ত মনে হয়।আর তারপর? তারপর যখন ছাদে চোখ মেলে রক্তচক্ষু দুটো দেখলো,আত্মা শুকিয়ে এসছিলো তার।লোকটা কি ভয়ানক ভাবে শাসিয়েছিলো।লাইটার দিয়ে চুলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখালো।আর শেষে?ছুড়ি দিয়ে ঠোঁটের পাশে টান মারলো।কথাগুলো ভেবেই ঠান্ডা হয়ে এলো খন্দকারের হাত পা।চোখ খিচে ঠোঁটে হাত রাখলো ‘ কি ব্যাথা! উফ!

চলবে….

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব-১৩
অফিসের আজ প্রথম দিন।দিনটি সেঁজুতির পরীক্ষার দিনের মতোই লাগছে।মানসিক প্রস্তুতি,মাথা ভর্তি টেনশন সবটা ঠিক একইরকম।দশটায় অফিস।সেঁজুতি সকাল সকাল উঠে বাড়ির সব কাজ সেড়েছে।বাবাকে সাথে নিয়ে নাস্তাও খেয়েছে।বাবাকে ওষুধ খাইয়ে তৈরী হয়ে এসে বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো সেঁজুতি। দোয়া দুরুদ পাঠ করে দুরুদুরু বুক নিয়ে পা বাড়ালো গন্তব্যে।আজ তার জীবনের একটি স্বপ্ন পূরন হতে যাচ্ছে।ছোট থেকেই নিজেকে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দেখার ইচ্ছে সেঁজুতির।পড়ছিলোও সেই লাইনে।এত দ্রুত যে একটা ভালো চাকরি পাবে সে ভাবতেই পারেনি।শুধুমাত্র তোহাকে জানিয়েছে চাকরীর বিষয়ে।তবে কিভাবে সিলেক্ট হয়েছে সেটুকু বলতে চেয়েও বলেনি।ম্যানেজার লোকটি মানা করেছিলেন তাই।রিক্সায় বসে সেঁজুতি লম্বা করে শ্বাস নিলো।উচ্ছ্বল,মুগ্ধ শ্বাস।মন ভীষণ ভালো আজ।
চুল গুলো বেনি করে এক পাশে রাখা।সামনের চুল গুলো কালো ক্লিপ দিয়ে আটকানো।কানে এক জোড়া পাথরের দুল। পড়নে সবুজ থ্রি পিস, কাঁধে ব্যাগ।এই তার সাজগোজ।
অফিসের সামনে নেমে,ভাঁড়া চুকিয়ে ভেতরে ঢুকলো সেঁজুতি। যত এগোচ্ছে বুক তত কাঁপছে চিন্তায়।সে পারবেতো তার দায়িত্ব ঠিকঠাক সামলাতে?ঢুকতেই ম্যানেজারকে দেখতে পেলো।ওকে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি।আজ ও একইরকম সাজপোশাক।আশরাফুল হেসে জিজ্ঞেস করলেন ” ভালো আছেন ম্যাডাম?
মধ্যবয়সী লোক।ম্যাডাম ডাকাতে অস্বস্তি লাগলো সেঁজুতির।কাজের দিক থেকে হয়ত সে ওপরের পদে তাই লোকটা ডেকেছে।কিন্তু তারতো অভ্যেসের খাতা শূন্য।ইতস্তত করে বলল ‘ জ্বি।আপনি?
‘ বেশ ভালো আছি।আসুন আপনাকে আপনার ডেস্ক দেখিয়ে দেই।
সেঁজুতির ভালোই হলো।একা একা কোন দিকে যেত সে নিয়েই চিন্তা করছিলো এতক্ষন।উনি আসাতে বেঁচে গেলো অল্পস্বল্প। লোকটি কিছু সময় কুশল বিনিময় করে চলে গেলেন।সেঁজুতি চোখ বুজে দুবার ঘন শ্বাস ফেলল।এভাবে ভয়,কাঁপা-কাঁপি এসবের সময় নেই তার।অনেক দায়িত্ব এখন। অনেক।কনফিডেন্স বাড়াতে হবে ।একটা ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও যেন বস ভুল ধরতে না পারেন সে ব্যাপারে তটস্থ থাকতে হবে সবসময়। সেঁজুতি এদিক ওদিক তাকালো।অভ্রকে খুঁজলো হয়ত।একমাত্র ওই পরিচিত বলতে গেলে।এভাবে বসে থাকবে নাকী কোনো কাজ করবে সে জানেনা।বলাও হয়নি।যেঁচে কী একবার যাবে অভ্রর কেবিনে? ভালো দেখাবে সেটা?
____
রোলিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে রুদ্র।আয়েশী ভঙ্গি তার।একটু পরপর চেয়ার সমেত দুপাশে দোল খাচ্ছে।চোখ দুটো তীক্ষ্ণতা নিয়ে সামনে নিবদ্ধ।তার কেবিনের পুরোটাই কাঁচ দিয়ে তৈরী।বাইরের সব কিছু স্বচ্ছ ভাবে দেখা যায়।অথচ বাইরের কেউ তার টিকিটাও দেখেনা এই কাঁচ গলিয়ে।এমন ভাবেই সে নিজের স্পেস টা তৈরি করেছিলো।কেবিনে বসেই পুরো ডেস্ক দেখা যায়।এই কথা সবাই জানে।তাই রুদ্র অফিসে থাকাকালীন কেউ গল্প করার সাহস করেনা।যন্ত্রের মতো কাজ করে।ঈগলের মতো চোখ দিয়ে রুদ্র সব খবর তার নখদর্পনে রাখে সে ব্যাপারে সবাই জ্ঞাত।জানেনা শুধু সেঁজুতি। জানলে কী বুঝতো,ঠিক এই সময় রুদ্র মন দিয়ে দেখছে তাকে।নিঁখুত ভাবে তার প্রত্যেকটা মুখভঙ্গি পরোখ করছে।মূলত, রুদ্রর এসিস্ট্যান্টের জন্যে অফিসে আলাদা কেবিন থাকে।কিন্তু রুদ্র ইচ্ছে করেই সেঁজুতির ডেস্ক টা তার কেবিনের একদম সামনে দিয়েছে।কেন দিয়েছে? সেটা শুধুমাত্র রহস্য ময় এই লোকটাই জানে।
রুদ্র অনেকক্ষন পর সোজা হয়ে বসলো।চোখ দুটো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নীচের দিক তাকালো।একটু পর আবার সেঁজুতির দিকে।সেঁজুতি আঙুলের ফাঁকে কলম নাড়াচ্ছে।

রুদ্র বাঁকা হাসলো একটু,
“এবার তাহলে এই লুকোচুরি খেলার অবসান ঘটানো যাক?আর ইউ রেডি মিস সে….জু…..তি?”
______
সেঁজুতি বোর হচ্ছিলো ভীষণ। কাউকে চেনেনা, পরিচয় নেই।কী করবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো যখন,তখনি পিওন পদের লোকটি ফিনফিনে কন্ঠে বলে ওঠে,
“ম্যাডাম! আপনাকে বস ডাকছে…
সেঁজুতি লোকটিকে চেনে।কাল একে দেখেছিলো ফাইল এদিক থেকে ওদিক আনা নেয়া করতে।আবার যখন সে অভ্রর কেবিনে ছিলো তখন ইনিই চা, আর দুটো স্যান্ডউইচ দিয়ে গেছিলেন।
হাল্কা ঘাঁড় নেড়ে বলল ‘ যাচ্ছি।
রুদ্রর কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো সেঁজুতি। গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করতে দেখে রুদ্রর হাসি পেলো।মেয়েটি যদি জানতো সে আসা থেকেই রুদ্র তাকে দেখছিলো তখন কী করবে? সেঁজুতি যেই হাত উঁচিয়ে নক করবে দরজায়, তখনি দরজা রিমোর্টের বাটন টিপে খুলে দিলো রুদ্র। সেঁজুতি প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। খানিকটা ভঁড়কায়ও।সেকেন্ড খানিক গবেষণা করে আঁওড়ালো ‘ এটা মনে হয় রিমোর্ট কন্ট্রোল দরজা।
তখনি রুদ্র ভেতর থেকে কঠিন কন্ঠে বলে ওঠে,
‘ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হলে বাইরে যান।সেঁজুতি নঁড়বড়ে খুঁটির মতোন কেঁপে উঠলো।মৃদূ মৃদূ কন্ঠে বলল
-আসব স্যার?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো ‘ ইয়েস!
সেঁজুতি দরজা টানবে কি টানবে না ভাবলো।এমনি এমনি খুলেছে যেভাবে সেভাবেই কী লেগে যাবে আবার? দরজা হা করে খুলে রেখে গেলে যদি বস রেগে যান?দু সেকেন্ড ভেবে দরজা টানলো।নরম পায়ে এসে রুদ্রর টেবিলের কোনায় দাঁড়ালো।কেবিন থেকে একাবার বাইরের দিকে তাকাতেই ঠোঁট দুটো আলাদা হয়ে এলো।এখান থেকে সব দেখা যাচ্ছে? তার মানে তারা যা করবে লোকটা সব দেখবে? কী এক ঝামেলা! সেঁজুতি চোখ সরিয়ে এনে মেঝের দিক রাখলো।বস নামক
লোকটিকে সে চেনে।দুবার দেখা হলো।কথাও হয়েছে।তাও কেমন স্বস্তিবোধ হচ্ছেনা। অজানা আশঙ্কায় বুক ধড়ফড় করছে।উনি কি জানেন আমার কথা? নাকী অভ্রর মতোন অবাক হবেন আমায় দেখে।সেঁজুতি চোখ তুলে তাকায়।রুদ্র চেয়ার নিয়ে উল্টো হয়ে ঘুরে আছে।লোকটাকে চিনলেও মুখ দেখেনি।নাম অব্দি জানেনা।সেঁজুতির মনে পড়লো লোকটির সেদিন তাকে কোলে তোলার মুহুর্তটা।সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি কয়েকশ গুন বাড়লো।ওইদিন গাড়িতে সে লোকটির সাথে একদফা ঝগড়া ও করেছিলো। আজ সেই কীনা এখন তার বস।বারবার উঠতে বসতে স্যার সম্বোধন করতে হবে।সত্যিই পৃথিবী গোল!
সেঁজুতি যখন ভাবনায় মশগুল।রুদ্র তখন ভরাট কন্ঠে বলে,
“তো মিস সেঁজুতি, অফিস কেমন লাগছে আপনার?
সেঁজুতি বুঝলো রুদ্র তার কথা জানে।নাহলে নাম কীভাবে বললেন? ছোট করে উত্তর দিলো,
— গুড স্যার।
— অফিসের সবাইকে?
— গুড স্যার।
— আর আপনার বস কে?
তাৎক্ষণিক চেয়ার ঘুরিয়ে সামনে ফিরলো রুদ্র।
‘গুড স্যা…….. সেঁজুতি এতক্ষন নিচের দিক চেয়ে ছিলো।রুদ্র ঘুরেছে বুঝতে পেরে চোখ ওঠাতেই কথাটুকু গলায় আটকে পরলো।
সেজুথির মুখের অবস্থা দেখার মতোন মনে হলো রুদ্রর।সূচালো হাসিটা আরও দ্বিগুন বাড়লো যেন।মেয়েটার এই এক্সপ্রেশন টা দেখার জন্যেই তো কাল রাত থেকে তর সইছিলোনা তার।ভাবছিলো কখন সকাল হবে আর সেঁজুতির এই মিশ্র চাউনীটা দেখবে।যেখানে থাকবে, ভয়, বিস্ময় , অস্বস্তি,কৌতুহল, আর লাভার মত ক্রোধ।আর এত কিছু একসাথে মন ভরে উপভোগ করবে রুদ্র।এই যে দেখো..কি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।,এতো টা সারপ্রাইজড হয়তো ও এ জীবনে হয়নি…
সেজুতির মুখ থেকে কোনও কথা বেরোচ্ছেনা।জ্বিভ যেন অসাড় হয়ে পরলো।গোটা শরীরটা পরিনত হয়েছে ফ্রিজে।নড়তেও পারছেনা যেন।এই লোকটা! এই লোকটা তো রুদ্র রওশন চৌধুরী। সে এখানে কেন? কী করে এলো?অনেকক্ষন পরেও যখন সেঁজুতির কোনো শব্দ নেই রুদ্র তখন নিজেই ধৈর্য হারালো। কৌতুক কন্ঠে বলল
“বললেন না তো,বস কে কেমন লাগল?
সেঁজুতি যেন নিজেতে ফিরলো।থেমে থেমে বেগ নিয়ে বলল,
” আপনি! আপনি তো রুদ্র রওশন চৌধুরী? আপনি এখানে কেন?
রুদ্র নিরেট কন্ঠে বলে,
— ইয়েস,আমিই রুদ্র রওশন চৌধুরী। আজ থেকে আপনি যার P. A আই মিন ব্যাক্তিগত সহকারী!
সেঁজুতি মাথা চেপে ধরে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল মেঝেতে।পরমুহূর্তে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
— এটা….এটা কি করে স..সম্ভব?আমার বস তো মিঃঅভ্র চৌধুরীর ভাই ছিলেন তাইনা?
রুদ্র একিরকম বাঁকা হাসলো
“আমিইতো অভ্র চৌধুরীর একমাত্র ভাই।
সেঁজুতির গাঢ় বিস্ময় এবার মাত্রা ছাড়ালো।আঙুল উঁচিয়ে মনে করার ভঙ্গি করে বলল
‘তার মানে ওই লোকটা…ওই মাস্ক পরা লোকটা… আপনি ছিলেন?
‘ yeah!
সেঁজুতি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো।
“এই সব কিছু আপনি জেনেবুঝে করেছেন?
এইজন্যেই আপনি ওভাবে মুখ ঢেকে গিয়েছিলেন আমার সামনে?
রুদ্র মাথা নেঁড়ে বলল
-ঠিক ধরেছেন।
” এইসব আপনার প্রিপ্ল্যান্ড?? চাকরী দেয়ার ব্যাপারটা? সেটা মিথ্যে?
রুদ্রর দৃঢ় জবাব, ” অভিয়েস্লি..

সেঁজুতি কতক্ষন শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে চেয়ে থাকলো।পরক্ষনেই তীব্র ক্রোধ এসে বাসা বাঁধলো শরীরে।টেবিলের ওপর দুহাত থাঁপড়ে ঝুঁকে বলল,
“এটা কিছুতেই হতে পারেনা।আপনারা আমাকে এভাবে ঠকাতে পারেন না।আমি এই চাকরী করবোনা।এই মুহুর্তে আমি রিজাইন দেবো।যাস্ট নাও।
রুদ্র জানতো এমন হবে।অবাক হলোনা।কিন্তু সেঁজুতি কে উষ্কাতে ভীষণ ইচ্ছে জাগলো মনে। সহজ কন্ঠে বলল,
কেনো? চাকরির প্রথম দিনেই রিজাইন কেন দেবেন?
সেঁজুতি দাঁত চেপে বলল ‘ দ্যাটস মাই চয়েস।
রুদ্রর ভারি মজা লাগছে।কাউকে ক্ষিপ্ত হতে দেখতে এত আনন্দ? এত?অবুঝের ভান করে বলল
‘ আশ্চর্য! এতো বড় কোম্পানি তে জব পেতে কত মানুষ আহাজারি করছে আপনি জানেন?আর সেখানে আপনি পেয়েও ছেড়ে দিতে চাইছেন??হোয়াই?
সেঁজুতি রুষ্ট চোখে চাইলো।
‘হ্যা চাইছি।আর তার একমাত্র কারন আপনি নিজে।
আপনাকে দেখলেই আমার সেই রাতের…

রুদ্র বুঝেও চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
‘সেই রাতের কী?
সেঁজুতি শান্ত করলো নিজেকে।কাকে রাগ দেখাবে সে? রুদ্র তার কেউ নয়।বিপদে পরে একবার শরীর মিশেছিলো লোকটির সাথে ব্যাস ওইটুকুই।গত একটা সপ্তাহ ধরে যে রাতের জঘন্য স্মৃতি থেকে পালাতে চেয়েছে,ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছে,ঘন্টার পর ঘন্টা শাওয়ারের নিঁচে দাঁড়িয়ে গা ভিজিয়েছে শুধুমাত্র অযাচিত স্পর্শ গুলো ধুঁয়ে ফেলতে। স্বয়ং সেই লোকের অফিসের কাজ করা কী আদৌ সম্ভব? তাও তারই সহকারী হয়ে? কোনো মেয়ে পারবে সেটা?
সেঁজুতি ঢোক গিলে ঠান্ডা ভাবে বলল,
‘ কিছুনা।এতো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।আমি আসছি।

‘এক সেকেন্ড!
রুদ্রর কথায় সেঁজুতি দাঁড়ালো।ঘুরে তাকালোনা।স্তম্ভের মতো শক্ত করে মাটিতে লাগিয়ে রাখলো পা দুটো।ভীষণ ভাবে টলছে এগুলো।দাঁড়ানোর শক্তি যেন নেই।ভাগ্য কী নির্মম প্রতারণা করলো শেষে।

এতক্ষনে চেয়ার ছেড়ে উঠলো রুদ্র।সেঁজুতির সামনে এসে পা দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁকা রেখে পকেটে দু হাত গুজে দাঁড়ালো।ঘাঁড় কাঁত করে বলল
— আপনি ঠিক ই বলেছেন। সব টাই আমার তৈরী পরিকল্পনা।সব টা।এই যে আপনাকে এখানে চাকরী দেয়া,তার জন্যে ম্যানেজার কে দিয়ে আপনাকে মিথ্যা বলানো, এসব কিছু আগে থেকে সাজানো ছিলো।আর এতটাই নীট এন্ড ক্লিন ভাবে রুদ্র সাজিয়েছে যে তার ফাঁকফোকড় খুঁজে পাওয়া আপনার মতো মেয়ের জন্যে দুঃসাধ্যই নয়,অসম্ভব ও বটে!
সেঁজুতি স্তব্ধ।কী অকপটে নিজের অন্যায় স্বীকার করছে এই লোক!
রুদ্র দুই ভ্রু উঁচালো,
— অবাক হচ্ছেন?এখনি অবাক হবেন না মিস সেঁজুতি। আপনার জন্যে যে এখনও অনেক চমক বাকী।
(একটু থেমে)
আমাকে চেনেন তো?? ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রুদ্র রওশন চৌধুরী।দেশে বিদেশে যাকে নাম্বার ওয়ান বিজনেসম্যান দের মধ্যে একজন হিসেবে এক ডাকে চিনে যায় সবাই।আমার থেকে সব সময় সবাই হাত পেতে নিয়েছে। আর আমিও দুহাত ভরে দিয়েছি।
সেই রুদ্র রওশন কিনা আপনার মত সামান্য একটা মেয়ের দান নিয়ে বেঁচে থাকবে?? ইটস কোয়াইট ইম্পসিবল মিস সেজুতি।আপনাকে টাকা দিতে চেয়েছিলাম আমি।এবং সেটা দুবার,কিন্তু না। আপনি রাখেন নি।নিজের তথাকথিত আত্মসন্মান দেখিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন।যেটা আমার ইগো তে লেগেছে(দাঁত চিবিয়ে)
আপনি চাইছিলেন আপনি আমাকে বাঁচিয়ে আমার কাছে সারাটাজীবন ম..হা..ন হয়ে থাকবেন।কিন্তু সেটা তো আমি হতে দিতে পারিনা।আমি বুঝে গিয়েছিলাম টাকা আপনি নেবেন না।অন্য কিছু ভাবতে হবে।আপনি অনেকটা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না টাইপের।তাই এত্তকিছু করতে হলো।আর এই ভাবেই আপনাকে আমি আমার কাছে নত করে রাখলাম।প্রতিনিয়ত এখন আমার অর্ডারে চলতে হবে আপনাকে,আপনার যে কিচ্ছু করার নেই মিস নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি…..

সেঁজুতি থম মেরে শুনছিলো।কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছে।কি মারাত্মক জঘন্য চিন্তাভাবনা লোকটির।বিস্মিত না হয়ে পারলোনা সে।মানুষকে সাহায্য করার সংগা টা এত বিশ্রী ভাবে ভাবেন উনি? ছি!সেঁজুতি হাসলো,সবাই আসলে সব কিছুর মূল্য দিতে জানেনা।এই লোকের ও হয়েছে তাই।রুদ্রর দিকে তাকালো।রুদ্র ছোট চোখের গভীর দৃষ্টিতে তারই দিক চেয়ে।সেঁজুতি এক পাশে ঠোঁট বাঁকালো,
-কে বললো কিছু করার নেই?আপনি হয়তো আমার কথা শুনতে পাননি। আমি এক্ষুনি রিজাইন দেবো বলেছি।এবার শুনেছেন?আপনার আন্ডারে চাকরী আমি করছিনা।
রুদ্র চোখ সরু করলো
— আমার আন্ডারে কাজ করতে কত মেয়ে লাইন ধরে আছে ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?

‘মেয়েঘটিত ব্যাপার টাতে আপনি অনেক অভিজ্ঞ যে।হয়তো তাই!তাছাড়া আপনার মত লোকের জন্যে লাইন কি আর কোনও ভদ্র ঘরের মেয়েরা ধরবে??
কিংবা কোনও সভ্য মেয়ে আসবে আপনার কাছে?আপনি ও যেমন ওরাও ঠিক তেমন।
সেঁজুতির কথায় স্পষ্ট বিদ্রুপ।রুদ্রর ভয়ে যেখানে অফিসের সকলে তটস্থ,সেখানে সটান দাঁড়িয়ে এই মেয়ে পাল্লা দিয়ে তর্কে লিপ্ত।রুদ্র ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,

আপনি ভুলে যাচ্ছেন মিস সেঁজুতি, এটা আমার অফিস।আপনার বাড়ি নয়।আর আপনি আমার অফিসের সামান্য একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাই
এখানে আপনার গলার জোর টা ছোট থাকাই শ্রেয়
(ছোট শ্বাস ফেলে)
এনি ওয়ে!কি যেনো বলছিলেন? আমার জন্যে কোনও ভদ্র ঘরের মেয়েরা লাইন ধরবেনা,কিংবা কোনও সভ্য মেয়ে আমার কাছে আসবেনা ব্লা ব্লা ব্লা?হু?
রুদ্র ঝুঁকে এসে ডান ভ্রু নাঁচালো।পরমুহূর্তে ফেঁটে পরলো অট্টহাসি তে।যে হাসিতে তাচ্ছিল্য পরিষ্কার।সেঁজুতির যেন গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে রুদ্রর অযৌক্তিক হাসি দেখে।
রুদ্র হাসি থামিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“তবে তো সেই সব অসভ্য মেয়েদের কাতারে আপনিও পরলেন। আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন সেই রাতে…. আমার হোটেল রুমে….আপনি আর আমি..
মনে পড়ছে? কতটা কাছাকাছি ছিলাম আমরা?

সেঁজুতি তাৎক্ষণিক চেঁচিয়ে বলল, ‘ চুপ করুন।চুপ করুন আপনি!
আমি ভুলে যেতে চাই,,মনে করতে চাইনা,,চাইনা মনে করতে…..
সেঁজুতি হাসফাস করলো কতক্ষন।যেন শ্বাস কষ্টে ভুগছে।রুদ্র শান্ত নজরে পরোখ করছে ওর অভিব্যাক্তি।সেঁজুতি সময় নিয়ে ঠান্ডা হলো। ভেজা চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কেনো করছেন আপনি এরকম?আমি তো বললাম আমি আপনার আন্ডারে কাজ করবোনা।তাও কেন এত কথা শোনাচ্ছেন?মানে কি এসবের?আমি যেতে চাচ্ছি আমাকে যেতে দিন!

রুদ্র ভ্রুক্ষেপ হীন।বলল, ” সব সময় যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায়? এটা রুদ্রর জায়গা।তার রাজত্ব।এখানে নিজ ইচ্ছায় প্রবেশ হয়তো করা যায়।কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া বের হওয়া যে অসম্ভব।

সেঁজুতি কিছুই বুঝে ওঠেনি।চোখেমুখে তীব্র জিজ্ঞাসা দেখে রুদ্র বলল ‘ আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে।ওয়েট…
রুদ্র টেবিলের ড্রয়ার টেনে খুলে সেই নীল রংয়ের ফাইলটা সেঁজুতির দিক ইশারা করে টেবিলের ওপর একরকম ছুড়ে মারলো।মোটা কন্ঠে বলল
‘ পড়ুন এটা।
আগে থেকে দেখে রাখায় চিনতে অসুবিধে হয়নি সেজুতির।এই ফাইলেই সে দস্তখত দিয়েছে কাল।
সেঁজুতি কে ভ্রু কুঁচকে ফাইলের দিক চেয়ে থাকতে দেখে রুদ্র বলল,
— কাল তো না পড়েই সাইন করেছিলেন,আজই কে বরং পড়ে দেখুন।আ বিগ সারপ্রাইজ এ্যাওয়েটস ফর ইউ।
রুদ্রর প্রতিটি কথা রহস্যময়।সব রহস্যের সমাধান কী এই ফাইলে? তাড়াহুড়ো করে ফাইল হাতে নিলো সেঁজুতি। পড়তে পড়তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো।রক্তশূন্য যাকে বলে।হাত দুটো কেঁপে উঠলো যেন।ফাইলটা ঝুপ করে পরলো পায়ের কাছে।সেঁজুতির চোখের কোটর ভরে উঠেছে।ঠান্ডা অশ্রুতে গাল দুটো ভিজে চুপচুপে হয়েছে।তবুও এক চুল নড়লোনা সে।
এতটা প্রতারনা?এতটা!
রুদ্র সেঁজুতির হয়ে মিথ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ভেতরে ভেতরে ভারী মজা পাচ্ছে হয়তো।সেঁজুতি যে সহজে পোষ মানবেনা সে জানত।তাইতো এত জল ঘোলা করতে হয়েছে।একটু না হয় কষ্টই পাক!
রুদ্র গ্লাস ভর্তি পানি সেঁজুতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-খেয়ে নিন।আই থিংক ধাক্কা টা সামলে উঠতে পারবেন।
রাগ, ক্রোধ ছুটছে সেঁজুতির সমগ্র শিরায়।তার ওপর রুদ্রর এমন উপহাস করে বলা কথা আগুনে ঘি ঢালার মতোন।সেঁজুতি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
‘ আপনি অত্যন্ত নোংরা, বিদঘুটে মস্তিষ্কের একটা লোক।এত দিন জানতাম,আপনার চরিত্র টাই জঘন্য। এখন দেখছি মন টা তার থেকেও কুচকুচে কালো আপনার। কি সুন্দর ভাবে আমাকে ঠকালেন?আপনি একা কেন, আপনার ভাই অভ্রই বা কম কিসে? উনি নিজেই আমাকে মিথ্যে বলে এখানে সাইন করিয়েছিলো,আর আমিও বোকার….

রুদ্র আটকে দিয়ে বলল,
“আপনিও বোকার মত সাইন করে দিলেন।সত্যিই পড়ে দেখা উচিত ছিলো আপনার।এত মেধাবী স্টুডেন্ট আপনি আর এই ভুল টা আপনার দ্বারা মেনে নেয়া যায়না।আফসোস লাগছে আমার।সত্যি বলছি।এখন যা হবার বা যা করার করা হয়ে গিয়েছে।দেখে নিলেন তো সবটা?আশা করি বুঝতেও পেরেছেন।
আগামী তিন বছরের আগে আপনি এই চাকরী ছাড়তে পারছেন না।এর আগে যদি আপনি রিজাইন দিতেই চান,তবে আমার কোনও অসুবিধে নেই,ডিল অনুযায়ী জরিমানার পাঁচ কোটি টাকা জমা করলেই আপনিও খুশি আমিও খুশি।

সেজুতি নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রাখলো।লোকটা তাকে বিপদে ফেলে কি আনন্দটাই না পাচ্ছে।টেবিলের ওপর দুহাত রেখে
সেজুথির দিকে ঝুকে এলো রুদ্র,বরফ কন্ঠে বলল,
—তো মিস,বেশ ভালোভাবেই ফেসে গিয়েছেন আপনি।বেরোনোর কোনো পথ ই যে খোলা নেই আর।আমি খোলা রাখিওনি।তাই রিজাইন দেয়ার চিন্তা ঝেরে ফেলে কাজে মন দিন.…
নাউ…গেট ব্যাক টু ইওর ওয়ার্ক।
রুদ্র সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সেঁজুতি। পারলে এই দৃষ্টি দিয়েই ঝলসে দিতো লোকটাকে।
ডেস্কে এসে ধপ করে বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো চিন্তায়।
,
মিঃঅভ্র আমার বিশ্বাসের এই দাম দিলেন ? বাবা ঠিকই বলেন দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা!
এখন এই লোকটার সাথে কি করে কাজ করবো আমি?যতবারই একে দেখবো আমার চোখের সামনে সেই অভিশপ্ত রাত টাই তো ভেসে উঠবে।এত বড় একটা শাস্তি আমাকে কেন দিলে আল্লাহ?

বাম হাতে পেপারওয়েট টেবিলের ওপর রেখে ঘোরাচ্ছে রুদ্র।ঘুরে ঘুরে থেমে যায়, রুদ্র একিভাবে ঘুরিয়ে দেয় আবার।শান্ত চাউনী তখনও কেবিনের মুখোমুখি সেজুথির ডেস্কের ওপর।সেজুতির অসহায় মুখটাও বেশ সুন্দর মনে হলো!

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে