#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব-১০
বিছানা ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো সেজুথী।ঘুম ভাঙলো দেরী করে।ফজরের নামাজ ও পড়া হয়নি।হবেইতো, রাতে গায়ের ব্যাথায় ঘুমই হয়নি।এক কাত ফিরলেও টনটনিয়ে উঠেছে শরীরটা।রেললাইনের মতো সোজা হয়ে কী আর ঘুমানো যায়?অন্যদিন ছাদে হাটাহাটি করে সকালে।আজই এমন হলো।রাতে পেইন কিলার নিয়েছিলো।ব্যাথা অনেকটা কমেছে আগের থেকে।রাতে খাওয়ার সময় আমির চেপে ধরলেন ওষুধ খাওয়ার জন্যে।প্রেসক্রিপশন যে অভ্রর কাছে রয়ে গিয়েছে সেটা তখন মনে পড়লো সেঁজুতির।মিনমিনিয়ে বাবাকে বলতেই আমির ধমকে ধামকে রাখলেন না।শরীরের ব্যাপার। সেখানে এত কেয়ারলেস হলে চলে? সেঁজুতি আশ্চর্য হলো,বাবা নিজেই ওষুধ খেতে চাননা।অনেক বলে কয়ে খাওয়াতে হয়।অথচ তার বেলা? সেঁজুতি বিছানা ছেড়ে উঠলো।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঢুকলো বাথরুমে।সকালের নাস্তাটা যদি বানাতে পারে তবেতো ভালোই।এইটুকু ব্যাথায় হাটতে না পেরে তার এক আকাশ সমান মন খারাপ ছিলো।
তাহলে বাবার না জানি কত মন খারাপ হয়।সেতো আর কোনও দিন…
ভাবতেই বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।ভাগ্য ভালো কাল রান্না টা পাশের ফ্ল্যাটের পরিচিতা ভাড়াটিয়া করে দিয়েছিলেন। নাহলে দুই বাপ বেটিকে না খেয়েই থাকতে হত।ব্রাশের মাথায় পেস্ট লাগাতে লাগাতে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে গেলো সেজুতি।
“সামনে কত খরচ,বাবার ওষুধ,নিজের পড়াশুনা,খাবার।টুকিটাকি খরচা। সামান্য দুটো টিউশনীর বেতন থেকে কিভাবে সম্ভব?এমনিতেও কাল এক্সিডেন্ট এ তার হাতের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ওখানেই পরে গিয়েছে হয়ত।আবার নতুন করে ওগুলো কেনা।
দুশ্চিন্তায় সে মরেই যাবে।এই প্রথম সংসারের ভার পরলো কাঁধে।এতদিন তো বাবাই সামলেছেন।সেতো মাথাও ঘামায়নি।এখন তো বাবা আর ওই অবস্থায় নেই।সব তাকেই করতে হবে।সে-ই বাবার ভরসা।কিন্তু কীভাবে কি করবে? ভাগ্যিস সময় কাটাতে টিউশন দুটো করাচ্ছিলো।একটু হলেও লাভ হচ্ছে।হোসাইন আংকেল এর থেকেই বা কত নেবে?এ অব্ধি বাবার সব ওষুধ এর খরচা সেই দিয়েছে।নিতে না চাইলেও দিলেন।হাসপাতালের বিরাট অঙ্কের বিল টাও মিটিয়েছেন।লজ্জ্বায় সেঁজুতির অবস্থা তখন করুন হয়েছিলো।যদিও হোসাইন কে সে নিজের বাবার মত ভাবে।কিন্তু কোথাও একটা দ্বিধা কাজ করে যে! এই দ্বিধার নামই বোধ হয় আত্মসন্মান।
রুদ্রর মাথা ব্যাথা কমেছে।তার একটা হাকেই দুজন সার্ভেন্টস এসে তন্নতন্ন করে বাম খুঁজেছে রুমে।কিন্তু এরাও পায়নি।তারাতো হাত ও দেয়না ওখানে।আর রুদ্রর রুম থেকে জিনিস নেয়ার সাহস ও নেই কারো।তাও আবার একটা মাথা ব্যাথার মলম? অনেক খুঁজে শেষে বাম পাওয়া গেলো অভ্রর বিছানার ওপর। কাল সেও রাত করে ঘুমিয়েছে।মাথা ব্যাথা করছিলো বলে রুদ্রর রুম থেকে বাম নিয়ে গেছিলো।রুদ্র তখন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।ভাবছিলো বসে বসে, তার এত টাকা পয়সা! অথচ পুরো বাসায় কীনা একটা বামের এত সংকট?যে এভাবে টানাটানি পরে গেল!
প্রেস্ক্রিপশন হাতে নিয়ে থম ধরে বসে আছে রুদ্র।কাল আগ বাড়িয়ে অভ্রকে প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে রাখতে সেই বলেছিলো।মেয়েটির ওষুধ পত্র যা লাগবে নিজেই বুঝেশুনে কিনে দেবে ভেবে।কিন্তু দিতেই ভুলে গেলো একদম।রাতে নিশ্চয়ই মেয়েটি ওষুধ খেতে পারেনি।রুদ্রর খারাপ লাগলো এতে।
ভেবেছিলো মেয়েটির ত্রিসীমানায় আর যাবেনা।কেমন হিপনোটাইজ করে রাখে তাকে।হ্যালুসিনেশনে তার গলা অব্দি ডুবেছিলো। কিন্তু এখন এটা পাঠাবে কাকে দিয়ে? ড্রাইভার কে দিয়ে পাঠানো যাবেনা।অভ্রকেও দেয়া যাবেনা।একটা মেয়ে নিয়ে তার এত বাড়াবাড়ি সবার চোখে বিঁধবে।কাল কের ব্যাপার নিয়ে এমনিতেই অভ্র কী কী ভাবছে কে জানে! তখন অত ভেবে দেখেনি, অথচ এখন কেমন অদ্ভূত লাগছে।আচ্ছা অদ্ভূত লাগারই বা কী আছে? রাতে মেয়ে নিয়ে হোটেলে থেকে দিনের বেলায় যে বুক ফুলিয়ে হাটে সে একটা মেয়েকে কোলে নেয়ায় এত সংকোচ করছে কেন?
পরমুহূর্তেই ভাবলো,না। কীসের সাথে কী মেলাচ্ছি?দুটো এক নাকি! সম্পূর্ন আলাদা।মেয়েরা আমার হোটেলে আসে।আর ওখানেতো আমি নিজে আগ বাড়িয়ে গেলাম।রুদ্র অনেকক্ষন ভাবলো।পরে নিজেই অবাক হলো।এত ভাবাভাবি বিজনেসের ব্যাপারেও করতে হয়না।এই সামান্য ইস্যু টাকে সেকী একটু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছেনা?দিচ্ছেইতো।
শেষে এসে ঠিক করলো সে নিজেই যাবে।প্রেস্ক্রিপশন টা দিয়েই চলে আসবে।একবার তাকাবেও না সেঁজুতির দিকে। নাহলে সারা টা দিন ওই মেয়ে পরোক্ষভাবে ঘুরঘুর করবে তার পেছনে।
______
সেঁজুতি বেশ কষ্ট করে নাস্তা বানিয়েছে।আমির তখনও ঘুমে।মধ্য রাত অব্দি মেয়ের মাথার কাছে বসেছিলেন তিনি।চুলে বিলি কেটেছেন।সেঁজুতি কতবার যেতে বললেও শোনেননি।মেয়েটার সারা গায়ে ব্যাথা।যদি কিছু দরকার হয়! বাবার এত ভালোবাসা দেখে সেঁজুতির সব কষ্ট,ব্যাথা দুশ্চিন্তা উবে যায় কর্পূরের মতোন।যা করেছে তার জন্যেও হীনমন্যতা আসেনা।আসবে কেন? সেতো বাবার জন্যে করেছে সব।এতে যদি নিজের সব শেষ হয়, হবে।তাও বাবাতো পাশে রইলো।
সেঁজুতি নাস্তা বেড়ে ভাবলো বাবাকে ডাকবে।এর মধ্যেই ডোরবেল বাজার শব্দ।দরজা খুলে বাড়িওয়ালাকে দেখতেই মুখ অন্ধকার হয়ে এলো সেঁজুতির।সকাল সকাল বাড়িওয়ালা হাজির। যেখানে ভাড়া দিতে হয় ১ তারিখ সেখানে আজ মাসের ২১ তারিখ।আবার গত মাসের টাও বাকী।এত কিছুর মধ্যে ভাঁড়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছিলো।টিউশনির চার হাজার টাকা দিয়ে বাজার করেছিলো কাল,সাথে টুকিটাকি কিছু জিনিস।সেগুলোতো রাস্তায়ই পরে রইলো।বাবার জমানো এক টাকাও নেই ঘরে।এখন কী করবে? কি দিয়ে দেবে ভাড়া!
— কেমন আছো সেঁজুতি?
— জ্বি ভালো,ভেতরে আসুন। দু পা বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলেন খন্দকার।মুখে আমাবস্যা নেমেছে যেন।ভাঁড়া দেরি করে কেউ দেয়না তাকে।এ ব্যাপারে খুব স্ট্রিক্ট তিনি।মাসের ভাঁড়া মাসে নেয়াই তার কাজ।কোনো ছাড় নেই। তাতে তুমি মরো, বাঁচো যাই করো ভাঁড়া টাইম টু টাইম চাই খন্দকারের।ই এম আই নিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন।ভাগে পেয়েছেন মাত্র চারটি ফ্লোর।কাজ বাজ ও করেননা।এই টাকায় সংসার চলে।তার ওপর এ বাড়ির সব চেয়ে সুন্দর ফ্ল্যাটটি নিয়েই এই বাবা মেয়ে থাকে।ভাড়াও বেশি এটির।ঠিকমতো ভাঁড়া না দিয়ে উপায় আছে? ভাঁড়া দেয়ার কথা সেই এক তারিখ।কতবার এসে ঘুরে গেছেন।মস্ত বড় তালা ঝুলছিলো দরজায়।শুনেছেন আমির হাসপাতালে। তাই আর কিছু বলেননি।কিন্তু উনিশ দিন সময় তো দিয়েছেন।তার জন্যে এটা এক বছরের সমান।আজ এসেছেন হয় ভাঁড়া নেবেন।না হয় যা মুখে আসবে বলবেন।
রুদ্র সিড়ি বেয়ে উঠছিলো।সেঁজুতি দের দরজা অব্দি আসতেই হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলো ওখানেই।দরজা ভেজানো।ভেতরে চিল্লিয়ে কথা বলছে কেউ।কোনো পুরুষালী স্বর।রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকলো। লোকটি বলছে,
‘ দেখো, এই ব্যাপারে আমি কোনো ছাড় দিতে পারবনা জানোইতো।তাও তোমার বাবা অসুস্থ বলে গত মাসে আমি কিছুই বলিনি।কিন্তু এর বেশী সময় দিতে পারবনা।আমার যে মাসের ভাঁড়া মাসে চাই সেটা কী নতুন জানো তুমি? আর তোমার সাথে এত কথাই বা আমি বলছি কেন? বাড়ি ভাড়া তো তুমি নাওনি নিয়েছেন তোমার বাবা।কই উনি? ডাকোতো।
সেঁজুতি বারবার রুমের দিক তাকাচ্ছে।খন্দকার এত চেঁচাচ্ছেন বাবার ঘুম না ভাঙলে হয়।এসব শুনলে বাবা খুব কষ্ট পাবে।নিজেকে দোষ দেবে।
-আমিতো বললাম শুধু এ মাস টা সময় দিন।আগামী মাসের টাকা সহ একসাথে দিয়ে দেব।
– না না না,ওটি হচ্ছেনা।আমি বাবা এই টাকা দিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকি।ভাড়ার ব্যাপারে আমার কাছে কোনও আহ্লাদ নেই।
– আচ্ছা আপনার ভাড়া আমরা দেইনি বা দিতে পারিনি এরকম কোনও দিন হয়েছে?শুধু তো দু মাসের ভাড়াই।
‘ দু মাস গড়িয়ে চার মাস করা ভাড়াটিয়াদের কাজ, সেকী আর আমি জানিনা।অত কথা বলে লাভ নেই।আমার ভাঁড়া চাই।এক্ষুনি।দিতে না পারলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেয় হও।
‘ আশ্চর্য লোক তো আপনি। বললাম তো দিয়ে দেব তাও এরকম করছেন কেন?বাবা অসুস্থ আপনি জানেন না? লজ্জ্বাও করেনা একটা অসুস্থ মানুষের বাসায় এসে এভাবে চেঁচামেচি করতে! আপনার মতো এমন ছোটলোক আমি জন্মে দেখিনি।টাকা থাকলেই কী সবাই মানুষ হয়?
খন্দকার ফুঁসে উঠে বললেন
‘ এই মেয়ে এই, মুখ সামলে কথা বলো বলে দিচ্ছি।আমি ছোটলোক? ছোটলোকি কাকে বলে দেখাইনি এখনও। যখন পুলিশ ডেকে এনে ঘাড় ধরে বার করব তখন বুঝবে আসল ছোটলোকি কেমন হয়।তোমার বাবা অসুস্থ বলেই আগের মাসে আমি কিছু বলিনি।কিন্তু আরতো ছাড় দেবনা।ভাঁড়া আমার চাই।এই আমি বসলাম,ভাঁড়া না নিয়ে কোথাও যাবনা।
সেঁজুতি হতাশ শ্বাস ফেলল।এখন এত গুলো টাকা কোথায় পাবে সে।বাবা গত মাসের ভাড়া রেখেছিলেন।কিন্তু সেসব টাকা তার হাসপাতালের ভর্তিতে লেগে গিয়েছে।এখন সারা বাড়ি খুঁজলেও টাকা পাওয়া যাবেনা।
সেঁজুতির মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা খন্দকারের পছন্দ হয়নি।
‘ কী ব্যাপার? স্ট্যাচু হয়ে আছো কেন? আমি তোমাকে দেখতে আসিনি।এসেছি ভাড়া নিতে।বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যাও টাকা নিয়ে এসো।
সেঁজুতি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।নরম কন্ঠে বলল
‘ আঙ্কেল এত গুলো টাকা এখন আমি কোথায় পাব বলুন? একটু বোঝার চেষ্ট….
‘ কোথায় পাবে আমি কি জানি? দরকার হলে নিজেকে বেঁচে টাকা এনে দাও।মেয়ে মানুষ খোদ্দেরের অভাব হবে নাকী!
দরজার বাইরে রুদ্রর হাত মুঠো হয়ে এলো তাৎক্ষণিক। খন্দকারের মুখে চরম এক ঘুষি বসিয়ে রক্ত বের করতে ইচ্ছে জাগলো।এক পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো,সেঁজুতি ক্ষিপ্ত বাঘীনির মত চেঁচিয়ে ওঠাতে
‘ মুখ সামলে কথা বলবেন। টাকা পান বলে যা আসছে তাই বলছেন? এক্ষুনি বের হন এখান থেকে।আর আপনার টাকাতো?পরশুদিন,আগামী পরশুর মধ্যে আপনার টাকা গিয়ে আপনার মুখে ছুড়ে মেরে আসব।
খন্দকার তীব্র অপমানে ফেঁটে পরলেন,
‘ আমার বাড়ি থেকে আমাকেই বের করে দিচ্ছো? ঠিক আছে! এই অপমান খন্দকার ভুলবেনা।পরশুদিন তো? দেখা যাক।পরশুদিন টাকা না পেলে দুই বাপ বেটিকে ল্যাংটো করে ঝুলিয়ে পেটাব।
সেঁজুতি চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো।খন্ধকার হিঁসহিঁস করতে করতে বেরিয়ে গেলেন।দরজা টা ধড়াম করে ফেলে গেলেন যাওয়ার সময়। সেঁজুতির টনক নড়লো যেন ।বাবা শোনেনি তো কিছু?
দরজার বাইরে আসতেই কেউ একজন খপ করে পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো খন্দকারের।আচমকা আক্রমনে খন্দকারের রুহ কেঁপে উঠলো।ভালো করে তাকানোর আগেই শক্ত হাতের ঘুষি পরলো নাকে।গলগলিয়ে রক্ত বের হলো সাথে সাথে।খন্দকার ভঁড়কে গেলেন।নাকের ব্যাথায় চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসতে না আসতেই কানের পাশে টের পেলেন আরেক শক্ত থাবা।মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো।কানে যেন খসে পরলো মেঝেতে।চিৎকার করার ও সুযোগ পেলেন না।লুটিয়ে পরলেন মাটিতে। রুদ্র তার ছিপছিপে দেহ টাকে কাঁধে তুলে ছাদের দিকে রওনা দিলো।একবার চোখ বোলালো চারদিকে।কেউ কী দেখেছে?
আমিরের বুকে ব্যাথা করছে ভীষণ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।হাত পা অবশ হয়ে আসছে।মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে।কলিংবেলের শব্দেই ঘুম ভেঙেছিলো।বিছানা থেকে একা একা উঠে হুইল চেয়ারের নাগাল পায়নি বলে বের হতে পারেনি।তবে উঠে বসেছিলো।বসার ঘরের সব কথা কানে এসেছে এতক্ষন।লজ্ব্বায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে। তার জন্যে,শুধুমাত্র তার জন্যে আজ মেয়েটাকে এত এত নোংরা কথা শুনতে হল? ছি! বাবা হয়ে কিচ্ছু করতে পারলেন না। এত গুলো বছর সে সন্মানের সহিত মাথা উঁচু করে বেঁচে ছিলেন তা এক নিমিষেই গুড়িয়ে গেলো।আমির বুক চেপে ধরলেন।মরে যাবেন মনে হলো।ভয়ে আটশাট হয়ে এলো শরীরটা।মরে গেলে মেয়েটার কী হবে?
সেঁজুতি রুমে ঢুকতেই বাবাকে বুকে হাত চেপে বসে থাকতে দেখলো।ধড়ফড় করে এগিয়ে এলো,
— কি হয়েছে বাবা? বুকে ব্যাথা করছে?
আমির জোরে জোরে শ্বাস নিলেন কবার।ঢুলে পরলেন মেয়ের হাতে।
রুদ্র সিড়ি বেয়ে নামছিলো।ভাগ্যিশ আজ কালো শার্ট পরেছে।নাহলে রক্তের দাগ গুলো স্পষ্ট বোঝা যেত।সেঁজুতির প্রকান্ড চিৎকারে পা দুটো থেমে গেলো তার।কী হলো?তড়িৎ গতিতে ঘরের দিকে দৌড় মারলো সে।এই মেয়ের ঘাড় থেকে দেখছি বিপদ নামছেইনা।
দরজা লক করা ছিলোনা।খন্দকার বেরিয়ে গেলেও দরজা লাগানো হয়নি সেঁজুতির।সে তড়িঘড়ি করে বাবার রুমে এসেছিলো।রুদ্রর এতে সুবিধেই হয়েছে।একদম ঘরে ঢুকে পরেছে সে।সেঁজুতি কাঁদছে। আমিরকে ঝাঁকাচ্ছে।ও বাবা ও বাবা বলে হাউমাউ করছে।রুদ্র যখন পুরো ব্যাপারটা বুঝলো তখন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সেখানে।
‘ কি হয়েছে ওনার?
সেঁজুতি রুদ্রর দিকে তাকালোনা।তাকানোর সময় কই? কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো,
দে.. দেখুন না বাবা ক…কথা বলছেনা,,দেখুন না…
রুদ্র ব্যাস্ত কন্ঠে বলল
‘কাদবেন না আমি দেখছি।
বাবার অসুস্থতায় রুদ্রকে খেয়াল করেনি সেঁজুতি। লোকটা আজকে আবার কেন এলো সে জানেওনা।কিংবা খেয়াল করলেও কোনো প্রশ্ন করার মন মানসিকতা হয়নি।আমির লম্বালম্বি শুয়ে আছে বিছানায়।মাথার কাছে বসে সমানে ফোঁপাচ্ছে সেজুতি।হোসাইন ও এসেছেন। একটু আগেই তারা হাসপাতাল থেকে ফিরলেন আমির কে সাথে নিয়ে।নতুন নতুন অপারেশন। ওপরে এরকম একটা ধাক্কা।তাই ব্যাথা হচ্ছিলো বুকে।আবার চিন্তায় প্রেশার ও ফল করেছিলো বলে জ্ঞান হারায়।খুব সিরিয়াস কোনও ইস্যু নয় বলে ডাক্তার মেহরাব শুধু চেক- আপ আর টেস্ট করে ছেড়ে দিলেন।সাথে ঘুমের ইঞ্জেকশন। বাসায় আনা নেওয়া সব রুদ্র করেছে।আমিরের ভারী শরীরটা নিয়ে সেইতো সিড়ি বেয়ে নেমেছে উঠেছে।সেঁজুতি তো শুধু পিছু পিছু ছুটেছে তার।কেঁদেছে ফ্যাচফ্যাচ করে।গায়ের ব্যাথা তখন তাকে কাবু করতে পারেনি।বাবার কাছে তার যন্ত্রনা কিছুইনা।তবে রুদ্রর আজ প্রথম মনে হলো তার এত বছরের জিমে যাওয়া স্বার্থক।
সেঁজুতি সেই তখন থেকে কাঁদছে।শব্দ না হলেও নাক টানছে।রুদ্রর ভালো লাগছেনা এত কান্না।ডাক্তার তো বলেছেন ভয়ের কিছু নেই।তাও এত কাঁদছে কেন মেয়েটা।
রুদ্রর মনের কথা বলে দিলেন হোসাইন,
—সেজুতি! শুনলে তো সিরিয়াস কিছু নয়।তাহলে কেনো কাদছো তুমি?
সেঁজুতি বোধ হয় একটু থামলো।চোখ মুছে পাশ ফিরতেই নজরে এলো রুদ্রকে।আজ ও সেই সাজ তার।সেঁজুতি মুখ না দেখলেও সাজ দেখেই বুঝলো এটা অভ্রর ভাই।অবাক হয়ে বলল,
— আপনি কখন এলেন??
রুদ্র ছোট করে বলল,
— অনেকক্ষন।
— কিন্তু আমিতো এতক্ষন আপনাকে দেখিনি।
—আপনি বেহুশ ছিলেন তাই খেয়াল করেননি।।
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বলল
— আমি বেহুশ ছিলাম?
— আপনার বাবার এই অবস্থায় হুশে ছিলেন না সেটাই বোঝালাম।
পাশ থেকে হোসাইন বললেন,
‘তুই দেখিস নি?কি বলছিস? ওই না তোর বাবাকে হাসপাতালে নিলো।আবার নিয়েও এলো? সাথে সাথেই তো ছিলিস এতক্ষন।
সেঁজুতি ছোট করে বলল,
‘ খেয়াল করিনি।দেখেছিলাম।ভেবেছি পাশের ফ্ল্যাটের কেউ।উনি হবেন মাথায় আসেনি।
হোসাইন আবার বললেন,
‘ তা হঠাৎ এত অসুস্থ হলো কেন আমির? এত চিন্তা করছিলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি রে?
জবাবে দুদিকে মাথা নাড়লো সেজুথি।কিছু হয়নি।সব টা জানাতে গেলে আংকেল বাড়ি ভাড়া দিতে চাইবেন।বাবার জন্যে যেটা আরও অপমানের।এর আগের সাহায্য নিতেও বাবার অনেক আপত্তি ছিলো।তাও অনেক জোড়াজুড়ি তে নেওয়া।সেতো তার বাবার মতোই হয়েছে।এই ব্যাপার টা জানানো যাবেনা কিছুতেই।টাকা তাকেই ম্যানেজ করতে হবে।
উত্তর পেয়ে হোসাইন কিছু বললেন না।তবে রুদ্র বিস্মিত। মিথ্যে কেন বলল? হয়েছেতো অনেক কিছুই।এবার আর মুখ ফুঁটে সত্যি বলা সমিচীন মনে করলোনা সে।হোসাইন হাত ঘড়ি দেখে বললেন
–; ঠিক আছে,ওষুধ গুলো ঠিকঠাক ভাবে খাওয়াস।আমার ওটি আছে।যেতে হবে।
— আচ্ছা।
হোসাইন ঘর ছেড়ে বের হতেই রুদ্র আর টিকতে পারলোনা।ধৈর্য হীন কন্ঠে বলল
‘আপনি এতো মিথ্যে কেনো বলেন??
সেঁজুতি অবাক চোখে তাকালো
‘কি মিথ্যে বললাম?
— কাল আপনার এক্সিডেন্ট এর ব্যাপার টা তো আপনার বাবাকে বলেন নি।আর আজ ওনাকে আপনাদের বাড়ি ভাড়ার ব্যাপার টাও লুকিয়ে গেছেন।ইফ আ’ম নট রং, বাড়িওয়ালার এমন অপমানের জন্যেই আপনার বাবা এত টা অসুস্থ হয়ে পরেছেন।তাহলে সেটা ওনাকে জানালেন না কেনো?
সেঁজুতি ভ্রু উঁচালো,
— বাড়ি ভাড়ার ব্যাপার টা আপনি কি করে জানেন?
রুদ্র বলল ” শুনেছি।
এরপর পকেট হাতড়ে প্রেস্ক্রিপশন বের করলো,’ ভুল করে রয়ে গেছিলো।দিতে এসেছিলাম।
সেঁজুতি ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে আমিরের মাথায় হাত বোলালো।বিছানা ছেড়ে উঠে বলল ‘ চলুন।
রুদ্র কে নিয়ে বসার ঘরে এলো। ‘ আপনি বসুন।আমি আসছি।রুদ্র বসলোনা,
সেঁজুতি যেতে নিলে বলে ওঠে,
— উত্তর টা পেলাম নাহ।
সেঁজুতি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে জবাব দিলো
– ওসব আপনি বুঝবেন না।
এক কাপ চা আর পিরিচে পাউরুটি ডিম দিয়ে ভাজা,আর এক গ্লাশ পানি । ট্রেতে গুছিয়ে রুদ্রর সামনে এনে রাখলো সেঁজুতি। এসব সকালে নিজেদের জন্যে বানিয়েছিল কিন্তু খাওয়া আর হয়নি।ফ্লাস্কে চা আর হটপটে রুটি রাখায় এখনও বেশ গরম আছে বলে সুবিধে হলো।সেঁজুতি সোজা হতেই রুদ্র চট করে বলল ‘ আমি চা খাইনা।
সেঁজুতি মাথা নুইয়ে বলল ‘ কফি করে দিচ্ছি।
রুদ্র বাঁধা দিলো’ দরকার নেই।সময় কম।আমি খেয়েই বেরিয়েছি।
সেঁজুতি চুপ করে রইলো।ঘরে আগে কফি আনা ছিলো বলে দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু লোকটা যখন খাবেনা তখন আর কী করার।রুদ্র থেমে থেমে বলল
‘ আপনি না কাল বললেন, ডক্টর হোসাইন আপনার ভরসার জায়গা? তাহলে তার কাছ থেকে লুকোনোর কি আছে?
সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো।লোকটার কৌতুহল একটু বেশিই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বেঁচে থেকে বাবার অসহায় চাউনী সহ্য করা অনেক কঠিন। মরে গেলে তো আর সেটা দেখবনা তখন।
আর হোসাইন আংকেল আমাদের জন্যে অনেক করেছেন , কত আর হাত পাতবো বলুন তো?বাবার সন্মানের কথা ভেবেই বলিনি।
রুদ্র চোখা চোখে চেয়ে বলল
— আপনি কি করেন?
—অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।
‘ চাকরী?
সেঁজুতি মলিন হাসলো
‘ গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেও কত মানুষ চাকরী পাচ্ছেনা। সেখানে আমিতো! তবে কয়েকটা জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি অভিজ্ঞতা নেই! হয়নি।
রুদ্র ব্যাস্ততা দেখাল, ” আমি আসি এখন।আপনার বাবার খেয়াল রাখবেন।
‘ হু।
‘ আপনারও
সেঁজুতি তাকাতেই রুদ্রর রন্ধ্রে রন্ধে অস্বস্তি ছুটে গেলো।কথাটা তার মুখ ফসকে বেরিয়েছে। বলতে চায়নি একদম।মেয়েটি কি ভাবলো? হ্যাংলা?
তার অস্বস্তি কাটলো সেঁজুতির কথায়।
‘ সাবধানে যাবেন।রাস্তা পার হতে এত তাড়াহুড়ো করবেন না যেন।
রুদ্রর প্রচন্ড ভালো লাগলো কথাগুলো।একটু হাসলো কি গম্ভীর লোকটা? কি জানি,মাস্কের কারনে বোঝা গেলোনা তো!
চলবে….
#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১১
আর-আর-সি ইন্ডাস্ট্রিজ।বিশাল জায়গা নিয়ে অফিসটি।দশতলা ভবনের।ভেতরে ঢুকলে এসির হিমহিম ঠান্ডা,কাঁচ বেস্টিত দেয়াল, চকচকে ঝকঝকে সব কিছু চোখে লাগতে বাধ্য।রুদ্রর মেইন অফিস এটি।এখানেই সব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং,কনফারেন্স, ইম্পোর্ট -এক্সপোর্টের যাবতীয় কাজ সাড়ে সে।অন্যান্য গার্মেন্টস, রেস্টুরেন্ট গুলোতে ঢু মারলেও দিনের সব থেকে বেশি সময় কাটায় এখানেই। অফিসের সব থেকে আকর্ষনীয় জায়গাটি হচ্ছে রুদ্রর কেবিন।এত বড় জায়গা নিয়ে বানানো, দেখে বসার ঘর ভেবে বসবে যে কেউ।তার সাথে কেবিনে বিশাল বড় এক জানলা।যদিও সব সময় বন্ধই থাকে।তাও থাই গ্লাস ভেদ করে দূরের গাছগুলো দেখতে ভালো লাগে রুদ্রর।আশেপাশে আর উচু বিল্ডিং না থাকায় খুব সহজেই দেখা যায় সেসব।অভ্র মাত্রই রুদ্রর কেবিনের দরজায় নক করলো।রুদ্রর কেবিনের সব থেকে বিশেষ একটি দিক হচ্ছে তার দরজাটি রিমোর্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।ইচ্ছে করলে বসে বসেই লক করে দেয়,যখন মনে হয় একা থাকা প্রয়োজন। আবার ইচ্ছে হলে বসে বসেই খুলে দেয়।রুদ্রর ও বেশ লাগে বিষয় টা।অভ্র মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিলো,
—ভাই ডেকেছিলে?
‘ভেতরে আয়।
অভ্র আসতেই রুদ্র বসতে ইশারা করলো।অভ্র বরাবরই বাধ্য ভাই।বসতে সময় নিলোনা।তবে চিন্তিত সে।রুদ্র তাকে গল্প করতে ডাকেনা।খাবার খেতেও না।একমাত্র কাজ ছাড়া কেবিনে সবার ঢোকা নিষেধ।তাতে সে ভাই হলেও বা কী!
‘ কিছু হয়েছে ভাই?
রুদ্রর জবাব এলো সময় নিয়ে।অভ্রর দিকে একটা কাগজ মতো কিছু এগিয়ে দিয়ে বলল, ” পড় এটা।
অভ্র হাতে নিয়ে রুদ্রর দিক চেয়ে থাকলো বোঁকার মতন।রুদ্র ছোট্ট শ্বাস ফেলল
,আমাকে পরে দেখিস।আগে পড়।
অভ্র মনে মনে জিভ কেটে কাগজে চোখ দিলো।পুরোটা পড়লো এক নিঃশ্বাসে।
‘এটাতো…
‘ এপ্যোয়্যেন্টমেন্ট লেটার।
অভ্র জিজ্ঞাসু মুখচোখ নিয়ে বলল,
— হ্যা।কিন্তু কার ভাই?আর দেখো,এখানে আমাদের অফিসের নাম টাও ভুল এসছে। RRC ইন্ডাস্ট্রিজ এর জায়গায় শুধু চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ লেখা এসছে।
রুদ্র চেয়ারে হেলান দিলো।আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল
ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
— কার জন্যে সেটা না হয় পরে জানবি।এখানে যা আছে সব আমি দিয়েছি। কোনও ভুল নেই।তোকে বলছি কারন তোর কিছু কাজ আছে।
অভ্র প্রশ্ন করলনা।তাকিয়ে রইলো।রুদ্র বলল,
‘ আজকেই অফিসের নেম প্লেট চেঞ্জ করবি।
অভ্র এবারেও নিশ্চুপ।সে প্রশ্ন করতে চেয়েও করছেনা।ভাই নিজে থেকেই বলুক।একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুক উত্তরের।ভাইতো প্রশ্ন করা পছন্দই করেনা।
রুদ্র অভ্রকে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার ইশারা করে বলল
‘ ওখানে অফিসের মালিকের নাম নেই।লক্ষ্য করেছিস?
অভ্র তড়িৎ বেগে চোখ বোলালো।’ আসলেই তো।
রুদ্র কপট রাগ নিয়ে বলল
,
তোকে পড়তে দিয়েছি কেন? এত কেয়ারলেস হলে চলবে অভ্র? একটা কাগজের কিছু পড়া মানে দাঁড়ি,কমা সব কিছুতে চোখ বোলানো।
অভ্র চোরের মত নামিয়ে নিলো মাথাটাকে।রুদ্র এবার শান্ত কন্ঠে বলল,
,
যা যা বলছি মন দিয়ে শোন।কান দিয়ে নয় শুধু,মন দিয়ে… ওকে?
অভ্র মাথা কাত করলো,
‘আমি একটা ঠিকানা দেব। ম্যানেজার কে দিয়ে এটা পাঠাবি সেখানে।আমি যা যা বলতে বলবো ঠিক তাই তাই যেনো বলা হয়।একটা ওয়ার্ড না বেশি আর না একটা ওয়ার্ড কম।
‘ ওকে ভাই।
,
যা এখন।এটা নিয়ে যা।
অভ্র বেরিয়ে যেতেই রুদ্র ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল।পরমুহূর্তে রহস্য হাসলো।চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইলো অদূরে।
,
আমি কারো ঋন রাখিনা মিস সেঁজুতি ……
___________
বাবা আর একটা কথাও নয়।তুমি যাবেনা ব্যাস!
সেঁজুতি কঁড়াভাবে বলে, সোফার ওপর ধুপ করে বসলো।পেছন পেছন হাজির হলেন আমির।মেয়েকে মানাতে বললেন,
‘আরে বাবা এতে কি এমন হয়েছে?এখন আমাদের যা অবস্থা তাতে তো বাসা টা ছাড়াতেই হবে তাইনা! দু মাসের ভাড়া আমাদের ঘাঁড়ে রে মা।একটু তো বোঝ!
সেঁজুতি বিস্ময় নিয়ে বলল,
— বাসা ছাড়বো মানে?ছোট্টবেলা থেকে এ বাসায় বড় হয়েছি আমি। এ বাসায় আমাদের কত স্মৃতি,বাসা কেনো ছাড়বো?
আমির মোলায়েম কন্ঠে বললেন
‘ এটাকী আমাদের বাড়ি রে মা? এটাতো ভাড়া বাড়ি।একদিন না একদিন ছাড়তে হবেনা?
‘ সে তখন দেখা যাবে বাবা।বাসা ছাড়লেও মাথা উঁচু করে ছাড়ব।এভাবে টাকা দিতে পারছিনা বলে অপমানের ভয়ে নয়।
আমির হতাশ শ্বাস ফেললেন,
সেঁজুতি এ বাসায় থাকতে হলে টাকা লাগবে।মাসে এত গুলো টাকা ভাঁড়া।কীভাবে সামলি সেটা তো ভাব।
সেঁজুতি অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
একটা না একটা ব্যাবস্থা ঠিক হবে।
আমির অধৈর্য হয়ে পরলেন।মেয়েটা ঠিক তার মায়ের মতোন জেদি।একটা কথা যদি সহজে বোঝে।
‘ কি করে করবি তুই ব্যবস্থা?অপারেশনের জন্যে লোনের টাকাগুলোই তো এখনও শোধ হয়নি। এতো এতো টাকার ভার একা কিভাবে সামলাবি তুই?
সেঁজুতি ও বাবার সমান রাগ দেখিয়ে বলল
— তাই বলে তুমি জামাকাপড় ফেরি করবে??
আমির ক্ষীন হাসলেন মেয়ের রাগে।আদুরে কন্ঠে বললেন,
তাতে কি হয়েছে আম্মা?পৃথিবীতে কোনও কাজ ই ছোট নয়।
সেঁজুতি মুখ ঘুরিয়ে বলল
হোক।তাও তুমি কোত্থাও যাবেনা
।না মানে না।আমি ছেলে হলে কী আমার ওপর ভরসা করতেনা? তাহলে এখন কেনো করতে পারছোনা।আমি মেয়ে বলে??
আমির বিরক্ত হলেন ” আমি কখন বললাম?
,
বলোনিতো?তাহলে অামার কথা শুনবে।আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাইছিনা।তুমি কোত্থাও যাবেনা।তোমাকে কোনও কাজ করতে হবেনা ব্যস।
সেঁজুতির অবিচল জেদ।অবশেষে হার মানলেন আমির।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।সেঁজুতি আঁড়চোখে একবার বাবাকে দেখে রান্নাঘরে গেলো।এই সময় চা খাওয়ার অভ্যেস তাদের।খেয়ে পড়তে বসবে।শরীর খারাপ থাকায় ভার্সিটি যাওয়া হলোনা।হাতে এক হাজার টাকা আছে। আপাতত দু একদিনের বাজার হয়ে যাবে এতে।কিন্তু খন্দকারকে যে বলল বাড়ি ভাঁড়া পরশুর মধ্যে দেবে কী করবে তার?
এদিকে সকালে তাদের বাড়িতে বিরাট এক কান্ড ঘটেছে।খন্দকার কোথা থেকে নাক মুখ ফাঁটিয়েছেন।কানেও কম কম শুনছেন নাকী।সেঁজুতিদের পাশের ফ্ল্যাটে এক জোড়া দম্পতি থাকেন।তারা অবশ্য এক রুমে থেকে, বাকী রুম ব্যাচেলর ছেলেদের ভাঁড়া দিয়েছেন।স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরীজীবি।আটটা বাজলেই অফিসে চলে যায়।ফেরেও একসাথে।প্রেমের বিয়ে। দুজনেই একই অফিসে।ব্যাচেলর ছেলে গুলোতো সারাদিন থাকেনা বাসায়। গতকাল উনিই রান্না করে দিয়েছিলেন।আজকেও দেখতে এসেছিলেন বাবা মেয়েকে।ওনার মুখেই খন্দকারের কথা কানে যায় সেঁজুতির।লোকটা নাকি সিড়ি থেকে পরে গেছিলেন।সবাই দেখতে গেলেও সেঁজুতি যাইনি।উলটে মনে মনে খুশিই হলো,
” সকালে তাকে আজেবাজে কথা শোনানোর ফল এগুলো।এতদিন ভাঁড়া ঠিকঠাক দিয়েছে। লোকটার গলায় তখন মধু ঝড়তো।যেই দুটো মাস দিতে পারলোনা ওমনি প্রত্যেকটা কথায় যেন বিষ পরে।
______
আমির চুপ করে বসে আছেন।মেঝের টাইলস গুলোর সুন্দর নকশা দেখছেন মনোযোগ দিয়ে।
ভাগ্য তাকে কি দিন দেখালো!এত বড় ঘরের সন্তান হয়েও ভালোবেসে বিয়ে করার অপরাধে ঘর ছেড়েছিলো একদিন।প্রিয় মানুষ টির নাম ছিলো মুনারা।তিনি ভালোবেসে ডাকতেন মুনা বলে।ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায় নিজেদের সংসার সাজিয়েছিলো দুজনে।তখন তার মাস্টার্স শেষ।প্রথম প্রথম দুজনেই বেশ কষ্ট করেছেন।পরে যখন তার ব্যাংকের কাজ টা হলো,তখন আর পেছনে তাকাতে হয়নি।স্বচ্ছলতার ছোয়ায় এত বড় বাসায় এসে উঠলো।ভালোই যাচ্ছিলো দিন।তারপর ঘর আলো করে এলো সেজুথি।কি ফুটফুটে সুন্দর পুতুলের মতোন হয়েছিলো মেয়েটা।মুনা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরেন তারপরপরই।
আর এক মাস পরেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন।এরপর মেয়েকে নিজের মত মানুষ করেছেন আমির।একা হাতে ছোট্ট শিশুটাকে মায়ের মত আগলেছেন,আবার অফিসের কাজও করেছেন।আয়া রেখেছিলেন যদিও।কিন্তু সেঁজুতি ছোট থেকেই বড্ড ন্যাওটা ছিলো তার। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়েও দু বাড়ির কেউই আসেনি মুনারা বা তাদের দেখতে।তাই রাগ আর অভিমানে তিনিও সেজুথিকে জানাননি ওর দাদু বাড়ি বা নানু বাড়ি সম্পর্কে।ভেবেছিলেন মেয়েটার বিয়ে দিলে তার একার জীবন কোনো মতে চলে যাবে।দ্বিতীয় বিয়ের কথা মাথায়ও আনেননি।কোনও দিন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলো, তার পুতুলের মতো মেয়েটিকে সংসারের জোয়াল টানতে হবে? গত কদিনেই মেয়েটার শরীর ভেঙে গিয়েছে।রাতেতো ঠিকঠাক ঘুমায়ওনা। নিজের এমন করুন অবস্থা হবে আর বসে বসে মেয়ের কষ্টের টাকায় তাকে খেতে হবে ভাবেনি আমির।এতো ছোট বয়সে মেয়ে টা মা হারালো,আর এখন এই বয়সে পুরো সংসার খরচের দায়িত্ব কাঁধে।কি করবে কে জানে!এখন তো আল্লাহই তাদের একমাত্র ভরসা।
____
সেঁজুতি মাত্রই চা বানিয়ে বাবার হাতে দিয়েছে। তখন কলিংবেল বাজলো।
‘এখন আবার কে এলো?
‘ বাড়িওয়ালা নাকী? বলেছিলাম তো টাকা কাল দেব।এখন এলো কেন?
‘ দরজা খুলে দে।খবরদার খারাপ ব্যাবহার করবিনা।
সেঁজুতি বাবার আঁড়ালে মুখ বাঁকালো।খারাপ ব্যাবহার উনি করবেন,আমি ছেড়ে দেব নাকী?
চায়ের কাপ টা শব্দ করে রাখলো টি-টেবিলে। দরজা খুলতেই দেখল একজন অপরিচিত ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। সেঁজুতি লোকটির পা থেকে মাথা অব্দি দেখলো।একেবারে স্যুটেড বুট্যেড যাকে বলে।
ভেতরের রুম থেকে জিজ্ঞেস করলো আমির ‘ কে এলো?
‘ দেখছি বাবা।
সেঁজুতি লোকটির দিকে তাকালো।মিষ্টি করে বলল,
-জ্বি, বলুন! কাকে চান?
‘ এটাকী মিস্টার আমির উদ্দিন এর বাসা?
‘ হ্যা।
‘ ওনার মেয়ে মিস নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি আছেন?
‘ জ্বি আমিই সেঁজুতি। আপনি কে?
, আমি চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম। আপনার জন্যে একটি চাকরির অফার এনেছি।এই যে আপনার এপ্যোয়েন্টমেন্ট লেটার।
সেঁজুতি অবাক হলো।লোকটি ফাইল থেকে দুপাতার কাগজটি বের করে এগিয়ে দিলেন। সেঁজুতি পড়ার আগেই বলল
‘কিন্তু আমিতো আপনাদের অফিসে চাকরীর জন্যে এপ্লাই করিনি।
লোকটি সামান্য হেসে বললেন,
— জ্বি ম্যাডাম।আপনি এপ্লাই করেননি।তবে এটা আমাদের পক্ষ থেকে সেইসব ব্রাইট স্টুডেন্ট দের জন্যে একটি গোল্ডেন চান্স,নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার।একেক বছর একেক ভার্সিটির স্টুডেন্ট দের চান্স দেয়া হয় যাদের পাশিং মার্ক্স ভালো।এ বছর আপনাদের ভার্সিটি থেকে আপনাকে সহ আরও কয়েকজন কে দেয়া হচ্ছে।আমরা আপনাদের ভার্সিটিতে খোজ নিয়ে তবেই এসেছি।নাহলে এড্রেস কোথায় পেলাম বলুন! লাস্ট ইয়ার এক্সামে আপনার রেজাল্ট ভালো ছিলো তাই জন্যেই আপনি এই চান্স টা পাচ্ছেন,,,…
খুশিতে ঝলমল করে উঠলো সেঁজুতির চেহারা।অপ্রত্যাশিত চাকরি পেয়ে বিশ্বাসই হচ্ছেনা যেন।
দুচোখে সুখ আর কৃতজ্ঞবোধ উপচে আসছে।
‘ ভেতরে আসুন আপনি।
আশরাফুল বললেন,
‘ নো ম্যাম। আমার তাড়া আছে।তবে একটা কথা।এই নিউজটি আপাতত লিক করবেন না।
সেঁজুতি সন্দেহী চোখে তাকালো
‘কেনো? এই যে আপনারা বললেন আপানারা খোজ নিয়েই এসছেন আমার ভার্সিটি থেকে।
,
হ্যা কিন্তু সেটা টেকনিক্যালি জেনে নিয়েছি।এইরকম কোনও ব্যাপার জানাজানি হওয়া টা আমাদের অফিসের আউট অফ রুলস।তাছাড়া এটা,,আমাদের ইকোনোমিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে
তাই আপনাকে বলছিলাম যে…
সেঁজুতি ছোট করে বলল ‘ বুঝেছি।
,
ধন্যবাদ,,,তবে আপনি কালই অফিসে আসুন।আর এখানে সমস্ত ডিটেইলস আর এড্রেস দেয়াই আছে।
‘আচ্ছা।
লোকটি চলে যেতেই সেঁজুতি দরজা আটকালো।
“কে ছিলো?
“একটা চাকরীর এপোয়েন্টমেন্ট লেটার এসছে বাবা।তাও আবার এপ্লাই ছাড়াই।
‘এপ্লাই ছাড়া আবার চাকরী?
সেঁজুতি খুশি খুশি কন্ঠে বলল
‘তাইতো। এটা নাকি ভার্সিটির ভালো ছাত্রছাত্রিদের চান্স দেয়া হয়ে থাকে ওনাদের অফিস থেকে। আর সেটা প্রতি বছর,এ বছর আমি আর কজন পাচ্ছি।
আমির শ্বাস ফেলে বললেন,
ওহহ!” যাক ভালোই হলো,,,আল্লাহ একটা উপায় করে দিয়েছেন।
সেঁজুতি কে এবার চিন্তিত দেখালো।
‘কিন্তু কাল ই যেতে বলেছে,বাড়িওয়ালা তো কাল ই আসবে।কীভাবে কি করব?
‘ ওনা কে নাহয় বুঝিয়ে বলবো।তুই ভাবিস না।চাকরী হয়েছে শুনলে নিশ্চয়ই ছাড় দেবেন।সামনের মাসে তো দিয়েই দিচ্ছি তাইনা।
,
হু
সেঁজুতি হাতের কাগজটি উলটে পালটে দেখলো।খটকা নিয়ে ভাবলো,
চাকরীর লেটার অথচ বসের নাম নেই?
____
অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলো সেজুতি।ঠিকানা অনুযায়ী রিক্সা থেকে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লো চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির সামনে।সামনে তাকাতেই মুখটা হা হয়ে এলো
‘বাপরে কত্ত বড় অফিস,,এতো বড় অফিসে আমি কাজ করব? এত ভাগ্য আমার?
সেঁজুতি চারপাশ দেখলো।কত্ত গাড়ি এখানে।বিভিন্ন রংয়ের।আরেকটু খেয়াল করলে হয়ত সেই লোকটির কালো গাড়িটাও দেখতে পেতো।বেশ নার্ভাস হয়ে ভেতরে নরম পায়ে প্রবেশ করলো।
অফিসের ভেতর ঢুকে তার অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়।এটাত ফুটখেলার মাঠ! এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সেজুতি। সব কিছু কতটা গোছানো, পরিপাটি।এক চুল পরিমান যেখানে কোনও অসৌজন্যতা নেই।কেন যেন এখানে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে তার।কিন্তু তাকে ঠিক কোথায় যেতে হবে কিছুই তো জানেনা।চোখে পরলো রিসেপশন।কিছু না ভেবে সেখানে গেলো।
‘এক্সিকিউজ মি!
পাতলা গড়নের একটি মেয়ে।চুল গুলো ওপরে ঝুটি করে বাঁধা।পড়নে লেডিস কোর্ট। মন দিয়ে কাজ করছিলো কম্পিউটারে। সেঁজুতি ডাকতেই চোখ না তুলেই বলল,
ইয়েস ??
‘আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে।ওই..
পুরো কথা বলার আগেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটার টেলিফোন বাজলো।মেয়েটি ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন,,
টেলিফোনের রিসিভারটি কানে তুললো মেয়েটি।ওপাশ থেকে কী বলল শোনা গেলোনা।মেয়েটি তৎপর কন্ঠে বলছে,
‘ইয়েস স্যার,,
‘ ওকে স্যার ওকে ,আমি পাঠাচ্ছি…
এতক্ষনে মেয়েটি হাসলো।মোলায়েম সুরে বলল,
,
ম্যাম আপনাকে এখানে জবের জন্যে ডাকা হয়েছে রাইট??
সেঁজুতি মাথা নাড়তেই বলল,
,
ওকে আপনাকে তাহলে অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের রুমে যেতে হবে।
,
রুম টা কোথায় একটু বলবেন?
মেয়েটি হাতের ইশারায় একটা দিক দেখাতেই সেঁজুতি হাটা ধরলো।প্রত্যেকটা কদমে বুক ধুকপুক করছে সাথে ভীরছে আকাশ কুসুম ভাবনা।
এই ম্যানেজিং ডিরেক্টর ই কি তার বস? বস কি অনেক রাগী হবে?বয়ষ্ক হবে? কিংবা তামিল ভিলেন দের মত মোটা বড় বড় গোফ থাকবে?
অনেক কৌতুহল নিয়ে দরজার সামনে এসে দাড়ালো সেজুথি।একবার নক করতেই ভেতর থেকে উত্তর এলো..
কাম ইন….
চলবে…