#প্রনয়
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্বঃএক
নিশুতি রাত।গোটা গোটা অক্ষরে ‘আর আর সি ‘লেখা।যার পুরো অর্থ রুদ্র রওশন চৌধুরী।ঝা চকচকে একটা আবাসিক হোটেল এটি।ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল গুলির মধ্যে অন্যতম।মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি কালো রংয়ের বিলাসবহুল গাড়ি এসে দাঁড়ালো সেখানে।মুহুর্তেই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন গার্ড হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে।একজন গাড়ির দরজা খুলে দেয় নতজানুভাবে।সেকেন্ডের কম সময়ে গাড়ি থেকে এক জোড়া বুট পরিহিত পা এসে মাটিতে ঠেকে।ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয় লোকটির পুরো শরীর। চোখে কালো সানগ্লাস,ছাই রঙা শার্টের সাথে কালো রঙের কোর্ট,চকচকে ঘড়ি বাঁধা বা হাতের কব্জিতে।গৌড় বর্নের সুদর্শন এ পুরুষটি ডানে বামে না তাকিয়েই হনহনিয়ে হেটে যায় হোটেলের ভেতরে।
চোখের কালো চশমা খানা খনিক বাদে তর্জনী দিয়ে ঠেলছেন তিনি।রাত্রিবেলা বুঝি কেউ কালো চশমা পরে? এ প্রশ্ন অনেকেরই।তবু করার সাহস নেই।কাকেই বা করবেন?ইনি কি পাত্তা দেবেন তাদের? হাটার এ্যাটিটিউড টাই যে বলে দিচ্ছে উত্তর। যেতে যেতে প্রত্যেক কর্মচারীর প্রদত্ত সন্মান তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি তার মধ্যে।এ যে এখন রোজকার ডাল ভাতের মতোন।টাকা যার,দুনিয়ায় সন্মান তার হতে বাধ্য বলেই মানে সে।
অত্র হোটেলের মালিক সে।এরকম আরো গুটিকয়েক হোটেল,রেস্টুরেন্ট,গার্মেন্টস তার অধীনস্থ বলে টাকার উঁচু পাহাড়ে বসবাস তার।ভদ্রতা আর চরিত্রের ঘাটতি সেখানে থাকলেও তিল পরিমান অহংকারের ঘাটতি মিলবেনা।
বয়স ২৯ এর কোঠায় ছুঁইছুঁই এখন।ব্যাক্তিত্বে অকল্পনীয় কঠোরতার প্রভাব।মায়া মমতাও নেই বোধ হয়।ঠোঁটের হাসি টাও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের মতো।অত্যাধিক মেজাজের দরুন ধারেকাছে খুব কম লোকের আনাগোনা ।তাতে কী? সেতো দিব্যি আছে,তার মতোন।
রুদ্র সোজা গিয়ে ঢুকলো ৪০৪ নম্বর রুমে।ধানমন্ডির এই হোটেলটি তার অধিক প্রিয় বলে নিজের সব থেকে পার্সোনাল কাজটি এখানেই সাড়া হয়।রুদ্র ভেতরে ঢুকে দরজার লক লাগালো। পুরো রুম অন্ধকারে ডুবে আছে।থাই কাঁচ ভেদ করে আলো এলেও অতি সমিহ করে উঠছেনা।রুদ্র সুইচ টিপে লাইট জ্বালালো প্রথমে।চোখ রাখলো বিছানার ওপর।মাঝ বরাবর গুটিসুটি মেরে বসে আছে একটি মেয়ে।পড়নে পাতলা ফিনফিনে জর্জেটের শাড়ি।স্লিভ লেস ব্লাউজ।কানে ভারী দুটো ঝুমকো।মুখ ভর্তি মেক-আপ আর রং চটা লিপস্টিক।লাইট জ্বলতে সে যেন গুটিয়ে গেলো আরো।রুদ্রর চোখ এড়িয়ে শরীরের উন্মুক্ত অংশ একটু ঢাকতে চাইলো কী?কি জানি! রুদ্রর দেখার অতো সময় নেই।গায়ের কোর্ট,হাতের ঘড়ি আর সানগ্লাশ খুলে টেবিলের ওপর রাখলো।তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষন দেখলো মেয়েটিকে।এক রাতের জন্যে এতটা স্বাজার কি আছে?সেতো ওই স্বাজ ফিরেও দেখবেনা।
মেয়েটির দৃষ্টি মেঝে বরাবর। ভুলেও সে তাকাচ্ছেনা।মেলাচ্ছেনা চোখ।রুদ্র এগিয়ে আসে।মেয়েটা নিজেকে গুটিয়ে নিলো কিঞ্চিৎ। রুদ্র বিছানার ওপর বসলো।বাদামী রংয়ের চোখ দুটো দিয়ে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষন করলো সামান্য।মেক আপের দৌলতে গায়ের আসল রং বোঝা মুশকিল।তবে আজকের রাতের জন্যে চলনসই।
মেয়েটির হাতের ওপর হাত রাখতেই শক খাওয়ার মতো ঝাঁকুনি দিলো মেয়েটার শরীর।যেন এ স্পর্শ বড্ড অনাকাঙ্ক্ষিত।
রুদ্র মাথা ঘামালোনা।ঠোঁট দুটো এগোতেই মেয়েটি পিছিয়ে নিলো মাথাটা।রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো,মোটা কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো…
‘ হোয়্যাট হ্যাপেন্ড?
মেয়েটি ঢোক গিললো।কৃত্রিম আলোতে রুদ্র স্পষ্ট দেখলো মেয়েটির চোখের পানি।মেয়েটা কী কাঁদছে?কেন? তাকে তো জোর করে আনা হয়নি এখানে।এসেছে স্বেচ্ছায়।তবে?রুদ্র তাকিয়ে থাকলো।মেজাজ তার খারাপ হচ্ছে বৈকি।মেয়েটি জবাব দেয়ার নামই নিচ্ছেনা।এবার সে ধমকে একী প্রশ্ন আওড়ালো।তাৎক্ষণিক ওপাশ থেকে কাপাকাপা গলায় উত্তর এলো
‘দদুঃখিত!আ..পপনি কন্টিনিঊ করুন।
রুদ্র আর মাথা ঘামায়না।নিঃশব্দে বেড সুইচ টিপে লাইট নেভায়।লিপ্ত হয় তার দৈনন্দিন কর্মে।
রুদ্রের কাছে যাওয়ার পরিমান বেড়ে যায়।ঘনিষ্ঠতার মাত্রা যতটা অতিক্রম হয় মেয়েটির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির পরিমান বেড়ে যায় তত।
কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেটা আর চোখে পরেনা কারো।রাত গভীর হয় আরো।মেয়েটির মনে হতে থাকে সামনের লোকটি মানুষ কীনা! এতটা হিংস্রতা কোনো পুরুষের স্পর্শে থাকে বুঝি?অতি কষ্টে চাপানো কান্না বের হয় তাৎক্ষণিক।ফোঁপানোর শব্দে বিরক্ত হয় রুদ্র।ক্ষনিকের জন্যে থেমে রুঢ় শব্দে বলে,
‘ ব্যাথা পেলেও আই হ্যাভ নাথিং টু ডু।এখানে আসার আগে ভেবে নিতে হয়।
তখন সকাল দশটা।কড়া রোদ যেন একটু তাড়াতাড়িই হাত পা মেলেছে আজ।ফোনের রিংটোন এর শব্দে ঘুম ভাঙে রুদ্রর।
হাতড়ে টেবিল থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করতে ভেসে আসে উদ্বীগ্ন স্বর।রুদ্র কানে তোলেনা।উল্টে থমথমে গলায় বলে,
‘অভ্র, ডোন্ট ইউ নো দ্যাট, আই ডোন্ট লাইক ডিস্টার্বেন্স ইন টাইম অফ স্লিপিং..?
রুদ্রর ছোট ভাই অভ্র।কাজ সূত্রে তার সহকারীও বলা যায়।যতটা ভালোবাসে তার থেকে অধিক ভয় পায় সে রুদ্রকে।রুদ্রর আওয়াজে অভ্র মিনমিনে কন্ঠে বলল
“স্যরি ভাই! আমি একদম বিরক্ত করতে চাইনি। আসলে একটা আর্জেন্ট নিউজ তোমাকে দেয়ার ছিলো।
– কি নিউজ?
মুহুর্তেই ধৈর্য হীন হয়ে আসে অভ্র।
– ভাই মিঃ আলতাফ কে পাওয়া গেছে।বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছিলো।আমাদের লোক ওকে পেট্রোল পাম্পে আটকে রেখেছে…
রুদ্রর ঘুম ছুটে যায়।উঠে বসে জলদি।তুষ্ট কন্ঠে বলে,
– গুড।আমি আসছি
ফোনের লাইন কেটে পুরো রুমে চোখ বোলালো রুদ্র.রুম ফাকা।টেবিলের ওপরে রাখা চেক টাও নেই,
তার মানে মেয়েটি চলে গেছে।
রুদ্র আর দেরী করেনা।নগ্ন দেহ টেনে ঢুকলো ওয়াশরুমে। দেয়ালে এক হাত ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রুদ্র।মাথার ওপরে ঝরঝরিয়ে ছেড়ে রাখা শাওয়ার।গা ভেজাচ্ছে রুদ্র। বুজে আছে চোখ।ফর্সা পেট,পিঠ, বুক নখের আচড়ে হিজিবিজি।পানি পরতেই জ্বলছে।রুদ্র ভ্রুক্ষেপ।এটাও তার কাছে রোজকার ব্যাপার
তবে নখের আচড় গুলো ভিন্ন ভিন্ন মেয়েদের হয়,তফাৎ এইটুকুই।
এদিকে,,
হোটেল গেইটের সামনে থেকে রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো সেজুতি। চোখ জ্বলছে।বুকটা পুড়ছে বেশ।হাহাকার লাগছে সব কিছু।অস্থিরতা যেন গলা টিপে মারছে তাকে।রিক্সাওয়ালাকে কোন মতে হূড টেনে দিতে বলল।হুড ওঠাতেই মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলো সেঁজুতি।
এতক্ষন কান্না গুলো গলার ভেতর দলা পাকাচ্ছিলো।দিচ্ছিলো মৃত্যু সমান যন্ত্রনা।
‘শেষ! আজ তার সব শেষ! নিজ হাতে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে এলো সে।একটা মেয়ের সবথেকে দামী জিনিস স্ব-ইচ্ছায় এভাবে হারালো।সেঁজুতির গা ঘিনঘিন করছে।ওড়না দিয়ে গাল থেকে শুরু করে যতটুকু পারছে ডলছে সে।এই স্পর্শ চাইনা তার।মনে পড়লেই বারবার মরতে ইচ্ছে হচ্ছে।ঘৃনায় নিজেকেই তিরষ্কার করতে মন চাইছে।
কান্নায় হেচকি উঠে গেলো একেবার।
শব্দ পেয়ে রিক্সাচালক এবার রিক্সা থামালো।ঘাড় ঘুরিয়ে বলে উঠলো..
‘আপা কোনও সমস্যা?
নিজেকে কোনও ভাবে সামলে নিলো সেজুতি। ক্রন্দনরত কন্ঠ লুকিয়ে বললো…
‘নাহ আপনি চলুন,,
রিক্সাচালক বুঝে নিলেন তাও।ফোলা চেহারাটা কি লোকানো যায়?বললেন,
– কোথায় যাবেন কইলেন না তো?
সেঁজুতি একটু সময় নিলো।বলল,
– আর একটু সামনে গিয়ে বামের মোড়ে যে হাসপাতাল টা আছে ওখানে।
– আইচ্ছা
রিক্সা আবার চলতে শুরু করলো।সেই সাথে নিজ গতিতে চলতে থাকলো দু প্রান্তের দুটো মানুষের জীবন।
চলবে।