#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্টের বর্ধিত অংশ
‘মা রে, আমার কথাগুলো একটু বোঝার চেষ্টা কর। বয়স তো কম হয়নি, এবার নিজেকে নিয়ে একটু চিন্তা কর। ‘
‘ নিজেকে নিয়ে কিছু চিন্তা করতে চাই না নতুন মা। এইতো বেশ ভালো আছি। ”
‘ এসব বললে কি হয় মা? আমাদের নতুন হুজুর তোরে পছন্দ করছে, আমাকে বললো…”
সানজিদা রেহানা বানুর কথার মাঝে উঠে চলে গেল। রেহানা বানু হতাশ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোন এক রাতে লঞ্চে দেখা হওয়া মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসেন তিনি। সেদিনের পর থেকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছে, মেয়েটাও খুব মান্য করে তাঁকে। সে রাতের পর এক যুগ পার হয়ে গেছে। রেহানা বানুর চুলে পাক ধরছে, আধা কাঁচা চুলগুলো সময়ের সাথে সাথে সাদা হয়ে গেছে। বারো বছরে মা-মেয়ের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। মেয়েটা রেহানা বানুর সব কথা মেনে চলে শুধু একটা ব্যাপার বাদে। বিয়ে করতে চায় না। এখানে আসার পর অনেকেই সানজিদার রূপে-গুনে মুগ্ধ হয়েছে। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু মেয়ে কিছুতেই রাজি হয় না। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে সোনার চেন হাতে নিয়ে বসে থাকে। কখনো কখনো গলায় পরে থাকে।
রাত এগারোটা। রেহানা বানু বিছানায় শুয়ে আছে, সানজিদা বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা দেখছে।
” খাতা দেখতে কত সময় লাগবে রে মা? রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে। ”
” এইতো হয়ে এসেছে। আসছি। ”
।
।
খাতা দেখা শেষ হতে ঢের বাকি, তবে এখন আর খাতা দেখতে ইচ্ছে করছে না। পুরনো কথায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বারো বছর হয়ে গেছে নিরবের সাথে দেখা হয়নি। এই নতুন জীবনে বেশিরভাগ কৃতিত্ব নিরবের, বাকিটা নতুন মা’য়ের। নিরব সেদিন সাহায্য না করলে আজ হয়তো আমার অস্তিত্ব থাকতো না। ছেলেটা সবার বিপক্ষে গিয়ে আমায় বাঁচিয়ে ছিল। পরবর্তী জীবনে কি হয়েছে ওর সাথে? হয়তো ভালোই আছে, এতোদিনে রিতুকে বিয়ে করে নিয়েছে। এ জীবনে একবার হলেও নিরবের সাথে দেখা করা প্রয়োজন, ধন্যবাদ দেওয়া মানাবে না। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেও কম হবে।
” কিসব ভাবছিস? বিয়ের ব্যাপারে?”
” তুমি তো জানো আমার বিয়ে হয়েছিল। তবে নিরবের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক। ”
” এসব কথা কেন বলছিস মা?”
” আমি নিরবকে ভালোবাসি। নিরবের সাথে কখনো সংসার হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না হয়তো। তবুও আমি ওকে ভালোবাসি। এই নতুন জীবনের বেশিরভাগ কৃতিত্ব ওর। নিজের বাবা আমায় বি’ক্রি করে দিয়েছে, জীবনের বেশিরভাগ সময় বন্দীর মতো কাটিয়েছি। এই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিরব। হয়তো বন্ধু, হয়তো ভালোবাসা, হয়তো স্বামী নয়তো নামহীন সম্পর্ক। ”
” কিসব বলিস বুঝতে পারি না।”
” নিজেও বুঝতে পারি না মা। তাঁদেরকে কখনো ভোলা যায় না যারা আমাদের নতুন করে বাঁচতে শেখায়। আমি আজীবন এক প্রাণবন্ত কিশোরের হাসি দেখার অপেক্ষায় রইবো। এমন উদ্ভট সিদ্ধান্তের পরিনতি জানা নেই। সংসার সাজানো ইচ্ছেও নেই। ”
” এভাবে জীবন চলে না। স্বামী সন্তানের দরকার আছে। ”
” ভালো লাগছে না, ঘুমাতে চাই। ”
মা’য়ের চিন্তা বুঝতে পারি, কিন্তু সত্যিই নতুন করে কিছু সাজাতে ইচ্ছে করে না। ভয় হয় যদি প্রতারিত হই।
।
সেদিন রাতের পর মা কখনো বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে না। বিয়ের সময় বয়স ছিল ২৪ বছর , নিরবের ১৬। এক যুগ পার হয়ে বয়স হয়েছে ৩৬। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে এতোটা বয়স্ক মনে হয় না। নিয়মিত শরীরের যত্ন নেওয়ার ফলে বয়সের ছাপ পড়েনি, কার জন্য নিজেকে আকর্ষণীয় রাখতে চাই আমি? শুধুমাত্র নিজের জন্য?
মা’য়ের কাছে যে লোকটা প্রস্তাব দিয়েছে উনার বউ মারা গেছে, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে পরিবারে লোক বলতে সে আর তার ছোট ছেলে। সুখ থাকলে এখানেও সুখী হতে পারব। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই না। সামনের মাসে মাদ্রাসা বন্ধ, কয়েকদিনের জন্য বরিশাল বেড়াতে যাব মা’য়ের সাথে। মা’য়ের থেকে নিজের যাওয়ার ইচ্ছে অনেকগুণ বেশী। মনের কোণে কিঞ্চিৎ আশা, যদি নিরবের সাথে দেখা হয়।
।
সবার মনে ইচ্ছে পূরণ হয় না, আমিও সে-ই না পাওয়া দলের লোক। সাতদিনের জন্য বরিশাল এসেছিলাম, নিরবের খোঁজ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু পাইনি। এক যুগে শহরের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম যখন নিরবদের বাড়িতে এসেছিলাম তখন ঘরবাড়ি ছিল না তেমন, শুনশান জায়গা। এখন শহর বললেও ভুল হবে না।
নতুন মা’য়ের সাথে লঞ্চে বসে আছি, আজ ফিরে যাচ্ছি। সব জায়গা পরিবর্তন হলেও এইখানে তেমন পরিবর্তন হয়নি। নিরবের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। পুরনো কথা মনে পড়লে কান্না আসে না, গলা শুকিয়ে যায়। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেতে শুরু করলাম।
” আপনার নাম সানজিদা? ”
” হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”
” আমি নিরব। চিনতে পেরেছেন?”
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আমার সাথে এমন মিরাকেল হবে। নিরবকে চেনাই যাচ্ছে না। কৈশোর বয়সের চেহানার সাথে কোন মিল নেই। মায়া ভরা চোখ দু’টো কঠিন হয়ে আছে। চেহারার লাবণ্য হারিয়ে গেছে। তবুও বড্ড সুদর্শন লাগছে দেখতে।
” আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেননি। বা আমি আপনাকে চিনতে ভুল করেছি। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ”
” সব মানুষকে ভোলা যায় না। চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে তাই চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল। কেমন আছো?”
” ওই আছি। ”
” ওই আছি কেন? বাকিরা কেমন আছে?”
” বাবা জে”লে, মা মা”রা গেছে। ছোট ভাই একটা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। আপনার কি খরব?”
” আছি আলহামদুলিল্লাহ। রিতু কেমন আছে? বিয়ে হয়েছে তোমাদের?”
নিরব কথার উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল। লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। একটা ছেলে চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে, লঞ্চ ছেড়ে দিবে, তাড়াতাড়ি আসেন। অতিরিক্ত চিল্লানোর ফলে গলার স্বর কিছুটা ভেঙে গেছে।
জানালা দিয়ে বাইয়ে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ নিরব কিছু খাবার হাত হন্তদন্ত হয়ে লঞ্চে ঢুকলো। আমার কাছে এসে ব্যস্ত গলায় বললো,
” সময় মতো চলে এসেছি। আর একটু হলে দেরি হয়ে যেত। ”
” কোথায় গেছিলে?”
” দূরের পথে খিদে পায় অনেক। তাই খাবার কিনতে গেছিলাম। ”
” তাড়াহুড়ো না করে আগে থেকেই কিনতে পারতে। ”
” কিনতেই যাচ্ছিলাম। আপনাকে দেখে কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। ”
” আচ্ছা। সকালে খেয়েছ?”
” না সকালে খাওয়া হয়নি। আপনার পাশে বসলে কি কোন অসুবিধা হবে ?”
” না বসতে পারো। যদিও নতুন মা’য়ের বসার কথা, তবে সমস্যা নেই। ”
” ঠিক আছে। নতুন মা কে?”
” সে অনেক কাহিনী যেতে যেতে বলবো। ”
” রিতুর সাথে আমার বিয়ে হয়নি। রিতু অন্য ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছে। আপনি চলে আসার পর সবকিছু অনেক পাল্টে গেছে।”
” কি হয়েছে? ”
“সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। বাড়িতে গিয়ে দেখি পুলিশ কাকা, মা, চাচি, রিতু সবাই বসে আছে। বাবা আপনাকে খোঁজার জন্য ছোটাছুটি করছে। আমাকে দেখে মা বললো, ” সানজিদাকে দেখেছিস?”
” আসেপাশে কোথাও আছে। বাড়ির বাইরে তো যায় না। ”
” ওহ তুই ঘরে যা। ”
মা’য়ের কথায় ঘরে চলে গেলাম। সবাই বাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। হয়তো বাবা আপনাকে সাথে নিয়ে ফিরবে। ভয়ে আমার অবস্থা দেখার মতো, উপায় না পেয়ে দরজা বন্ধ করে নামাজে দাঁড়ালাম। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া বাবা যেন আপনাকে খুঁজে না পায়। রাত এগারোটার দিকে বাবা ফিরে এলেন কিন্তু আপনি নেই। পুলিশ কাকু বেজায় ক্ষেপে গেলেন বাবার উপর। কর্কশ গলায় বাবার উপর চিল্লাতে লাগলেন।
” কি করেন আপনি? এতো সময় বসে একটা মেয়েকে খুঁজে আনতে পারলেন না। আমি গেলে এতো সময় মেয়েটা হাতের নাগালে চলে আসতো। আমার বাচ্চা দু’টোর অবস্থা মারাত্মক খারাপ, ডাক্তার বলেছে দু’দিনের মধ্যে অন্য কিডনির লাগাতে। আপনার আর কি আপনার তো টাকা পেলেই হলো। ”
” আপনি এমন অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলতে পারেন না। কত খুঁজে সানজিদাকে পেয়েছি একমাত্র আমিই জানি। তারপর ওর বাবাকে ম্যানেজ করে ছেলের বউ করেছি। আপনার ছেলেমেয়েকে ওর কিডনি নিতে পারবে কিনা পরীক্ষা করেছি। এতোকিছু পরেও আপনি এমনটা বলতে পারেন না। ”
” লাভ কি হলো? এতকিছু করে লাভটা কি? মেয়েটা পালিয়েছে। আমার অবস্থা আপনি বুঝতে পারছেন না। ”
কথার মাঝে হাসপাতাল থেকে পুলিশ কাকুর কাছে কল আসে। উনি তড়িঘড়ি বেরিয়ে যান। আপনার মনে আছে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেছিলেন? ”
মাথা নাড়ালাম। সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে।
” ওইদিন পা পিছলে পড়ে যাননি। রিতু তেল ছড়িয়ে রেখেছিল, তাতে পিছলেই পানিতে পড়ে গেছিলেন। মা জানতো আপনার সকালে ঘুম দিয়ে উঠে পানি খাওয়ার অভ্যাস আছে, তাই শেষ রাতে পানিতে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল। যাতে করে পা পিছলে পড়ে না গেলেও অজ্ঞান হয়ে যান। এরপর হাসপাতালে নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে আপনার উপরে। শুধু র”ক্তের গ্রুপ মিললেই তো আর কিডনি দেওয়া যায় না। টিস্যুসহ নানান পরীক্ষা থাকে। দূর্ভাগ্য ক্রমে পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসে। কথা ছিল কয়েকদিন পর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হবে। শেষ মুহূর্তে আপনি পালিয়ে আসতে সফল হন।
পুলিশ কাকা উনার ফোর্স লাগিয়ে খুব সহজে আপনাকে খুঁজে বের করতে পারতো কিন্তু তারপরদিন সকালে উনার ছেলে মা”রা যায়। ছেলে মা”রা যাওয়ার ১৮ ঘন্টা পরে মেয়েও মা”রা যায়। পুলিশ কাকা অনেক ভেঙে পড়েন। উনার আপনাকে খোঁজার প্রয়োজনীয়তা শেষ হলেও বাবার উপর ভিষণ রেগে যায়। সে-ই রাগ থেকে পরবর্তীতে কয়েকটা কে”সে বাবাকে ফাঁসিয়ে দেয়। তবে বেশিরভাগ অভিযোগ সত্যি ছিল। দোষ প্রমানিত হয়ে বাবার আজীবন কা’রা’দ’ণ্ডের শা’স্তি হয়। বাবা জে”লে যাওয়ার কয়েকদিন পরে চাচি উনার সম্পত্তির অংশ বুঝে নেয়। তখনও রিতুর সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বছর দুয়েক পরে মায়ের ক্যা’ন্সা’র ধরা পড়ে, চিকিৎসা করতে গিয়ে বেশিরভাগ সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়। আমাদের দেউলিয়া হতে দেখে চাচিকে রিতুকে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। আফসোসের ব্যাপার হলো রিতুর আগে থেকেই ওই ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল।
ম”রার আগে মা সবকিছু বলে গেছিলেন। সেই সাথে বলেছেন যদি কখনো আপনার সাথে দেখা হয় তাহলে যেন মা’য়ের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিই। আপনার বিয়ের পিছনে বেশিরভাগ অবদান ছিল মা’য়ের। উনিই বিভিন্ন কলেজে স্কুলে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের র”ক্ত পরীক্ষা করতেন। ও নেগেটিভ র”ক্তের কাউকে খুঁজে পেতে। মা মা”রা যাওয়ার পর ভাইকে মানুষ করেছি, ঘরের কাজ, টাকা রোজগার সবকিছু আমাকেই করতে হয়েছে। এইতো এভাবে জীবন চলছে।”
চোখের কোণে পানি জমেছে। খারাপ লাগছে, ভীষণ খারপ! নিরবের মা-বাবা হয়তো ওদের কাজের শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু নিরব আর ওর ভাইয়ের তো কোন দোষ ছিল না। কারো একার দোষে গোটা একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমরা অন্যায় কাজ করার সময় কেন একথা মনে রাখি না! নিরব স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে, যেন ওর কোন কষ্ট হচ্ছে না। হয়তো সয়ে গেছে।
” আপনি বিয়ে করেছেন? কয় ছেলে মেয়ে আপনার?”
” আমার এখনও বিয়ে হয়নি। ”
নিরবের চোখ চকচক করে উঠলো। কিছু বলতে গিয়ে, থেমে গেল।
নিরব বিস্কিটের প্যাকেট ছিঁড়ে বিস্কিটে খাওয়া শুরু করছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
” আপনি কোথায় থাকেন?”
সেদিন পর যা-কিছু হয়েছে, সবটা সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম। ছেলেটা খুব আগ্রহ নিয়ে প্রতিটা কথা শুনছে। কথা শেষে নিরব বলে উঠলো,
” নতুন মা’কে এখানে বসতে বলেন, উনার বোধহয় ওদিকে কষ্ট হচ্ছে। আমি গিয়ে বসছি, বেশি পথ নেই। ”
নিবর উত্তরে অপেক্ষা না করে চলে গেল। ব্যস্ত যেতে গিয়ে মোবাইলটা বেঞ্চের উপর ফেলে রেখে গেল। স্বযত্নে মোবাইলটা হাতে নিলাম। ফোন লক করা, তবে ওয়ালপেপার অবাক করার মতো। সেদিন বেলীফুলের মালা খোঁপায় জড়িয়ে যে ছবিগুলো তুলেছিলাম তার একটা ওয়ালপেপারে। পাশে নিরবও আছে। সেই দূরন্ত কিশোর!
কয়েকবার উঁকি দিলাম, নিরব মনোযোগ সহকারে কিছু লিখছে। কাজের কিছু হবে হয়তো।
যথাসময়ে লঞ্চ খাটে ভিড়ল। সকলে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেছে, ভিড়ের মধ্যে নিরবকে খুঁজে পেলাম না। ওর ফোনটা আমার কাছে। তাড়াহুড়ো করে নামতে পানির বোতল লঞ্চেই রয়ে গেল।
।
নিরব পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে, এগিয়ে গিয়ে মোবাইল হাতে দিলাম। হাত থেকে মোবাইল না নিয়েই নিজের পকেটে হাতড়াতে শুরু করলো। নিরবকে বেড়াতে আসার জন্য বললাম। উত্তর বললো, ” আপনি আসবেন, এখানে ঠিকানা লেখা আছে। আমার যাওয়ার সময় হবে না। ”
যাওয়ার আগে হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। তারপর চোখের পলকে কোথাও হারিয়ে গেল। মা’য়ের সাথে মাদ্রাসায় ফেরত চলে এলাম।
আজকে দিনটা খুব স্পেশাল। নিরবের সাথে দেখা হয়েছে, কিছু না জানা সত্য জানা হলো। হঠাৎই নিরবের দেওয়া কাগজের কথা মনে পড়লো। গোটাগোটা অক্ষরে বেশ অনেকটা লেখা, জায়গার অভাবে ঠাসাঠাসি করে লিখেছে।
‘কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। সোজা ভাবেই বলি, ১৬ বছরের এক তরুণ কিশোরের ২৪ বছরের যুবতীর প্রেমে পড়া খুব বেশি অস্বাভাবিক। সেজন্য হয়তো আপনার প্রেমে পড়া হয়ে ওঠেনি, প্রথম দেখায় মায়া জন্মায়নি। আপনি হারিয়ে যাওয়ার পর প্রতিটা মুহূর্তে আপনাকে মনে পড়ছে। প্রথম কয়েকদিন দম ব”ন্ধ লাগতো যেন খুব দামী কিছু হারিয়ে গেছে। সময়ের সাথে বয়স বেড়েছে, উপলব্ধি করেছে আপনাকে ভালোবাসি। ভিষণ ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই সেদিন ওভাবে পালিয়ে যেতে বলেছিলাম। জানি সমাজ এ সম্পর্ক মেনে নিবে না, নানান কথা শোনাবে, পাছে লোকে অনেক কথাই বলবে। হয়তো সামনেও বলবে। কিন্তু এ সমাজ শুধু লোকের দোষ খুঁজতে পারে। জানেন ভাইকে যখন ওয়ানে ভর্তি করাই, স্কুলের মেডামরাও বাবার ব্যাপারে প্রশ্ন করতো। বন্ধুরা বাবার কথা জিজ্ঞেস করতো, ভাইটা প্রতিদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতো। সে যাইহোক। ভাগ্য হয়তো আমায় আপনাকে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। জানি না আপনি রাজি হবেন কিনা, তবে আমি আপনির পরিবর্তে তুমি বলতে চাই। সত্যি চাই।
আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো। পরশুদিন বরিশাল ফিরে যাব। লঞ্চঘাটে অপেক্ষা করবেন আমার জন্য? সব বাঁধা ভুলে গিয়ে আপন করে নিবেন? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে পরশুদিনের অপেক্ষায় থাকবো, আর না হলে যেন পরশুদিনের দেখা না পাই।
ইতি
নিরব
চোখের কোণে পানি জমেছে, কষ্টের নয় খুশির অশ্রু! পরশুদিন এতো দূরে কেন!
সমাপ্ত