প্রদীপের নিচে আমি পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
746

#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

নিরবের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বিষন্ন স্বরে প্রশ্ন করলো, ” আপনার র’ক্তের গ্রুপ কি? ”

” ও নেগেটিভ! ”

” কি বলছেন আপনি?”

” কি আবার বলবো! তুমিই তো জানতে চাইলে।”

” সবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে! দেরি করবেন না রেডি হয়ে নেন। সন্ধ্যার আগে আপনাকে পা”লা”তে হবে। ”

” কিসব বলছো তুমি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ”

” নিজের মস্তিষ্ককে কাজে লাগান, আপনি অবুঝ থাকতে চাইলে কেউ আপনাকে বোঝাতে পারবে না। বেশিকিছু বলার সময় নেই, যদি বাঁ’চ’তে চান তাহলে পালাতে হবে। ”

হতবাক হয়ে নিরবের দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলতে চাইছে ও? নিরবের বয়স যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের মতো কথা বলছে।

” এতো কিছু ভাবার সময় নেই। ওরা আপনার কিডনি বি”ক্রি করে দিতে চাইছে। বাবার যে পুলিশ বন্ধু আছে, উনার যমজ দুই ছেলে-মেয়ে। জন্মের পর দিয়ে ওদের কিডনিতে সমস্যা ছিল। নানা রকম চিকিৎসা করেছে, তবে ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। দিনে দিনে সমস্যা বেড়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন একমাত্র কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করলে ওদের বাঁচার আশা রয়েছে। এ বিষয়ে বাবার সাথে কথাও হয়েছে অনেকবার। পুলিশ কাকুর টাকা পয়সার অভাব নেই। তবে ও নেগেটিভ র”ক্তের কোন ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি, যারা কিডনি ডোনেশন দিবে। ব্লা”ক মার্কেটে কিডনির অনেক দাম। তাই আপনাকে…..”

নিরব কথা শেষ করার আগে শাশুড়ি মা’য়ের গলা শোনা গেল।

” বউ মা, নাস্তা বানানো শেষ হয়েছে? ট্রে-তে সাজিয়ে দাও, দিদির সাথে বসে খাবো। ”

ধরা গলায় বললাম, ” হুম প্রায় শেষ মা। আপনি বসেন, আমি নিয়ে আসছি। ”

নিরব শাশুড়ি মা’য়ের চোখে পড়ার আগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। বয়সে ছোট ছেলের সাথে বিয়ে থেকে এখন পর্যন্ত সবটা! বাবা-মা আমাকে টাকার বিনিময়ে এদের কাছে বি”ক্রি করে দিয়েছে। এরাও নিজেদের লাভের জন্য আমাকে ছেলের বউ করেছে, এখন আমার কিডনি বি’ক্রি করে লাখ লাখ টাকা পাবে। কি করবো এখন? পুলিশের কাছে সাহায্য চাইবো নাকি নিরবের কথামতো পালিয়ে যাব? সব থেকে উচিত কাজ এদের সবাইকে শা”স্তি দেওয়া কিন্তু ভীতু মনে সাহস জোগাড় করতে পারছি না।

” মা এই যে নাস্তা তৈরি। ”

” কি করছো বউমা? অমলেট! সত্যি বলছি অমলেট খেতে ইচ্ছে করছিল অনেক, তুমি তো মন পড়তে পারো। ”

শাশুড়ি মা’য়ের কথার জবাবে কিছুই বললাম না, শুধু মুচকি হাসলাম। উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শশুর আব্বুর ঘর খুঁজলে হয়তো কিছু পেতে পারি যা নিরবের কথার সত্যতা বোঝাবে। ছেলেটা মজা করতে পারে! শশুর আব্বুর ঘর খুঁজে বিশেষ কিছু পেলাম না, সবজায়গায় তালা লাগানো। শুধু খাটের কোণে একটা কাগজ পড়ে আছে, অযত্নে! কাগজটা তুলে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম।

কাগজটা পড়ে হতভম্ব হয়ে গেছি। কাগজে স্পষ্ট ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে,

“আমি সানজিদা আক্তার, নিজের জীবন নিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি অনেক, এ জীবন নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারছি না, মা-বাবা আমাকে বি’ক্রি করে দিয়েছে। এর থেকে বড় কষ্টের কি হতে পারে! ম’রার পর কিছু ভালো কাজ করে যেতে চাই। আমি দুটো কিডনি দান করছি, আশা করি, এ সামান্য দানে কারো জীবন রক্ষা পাবে। ”

অবাক করার বিষয় হচ্ছে কাগজের নিচে আমার সই রয়েছে। হ্যাঁ! মনে পড়ছে! বেশ কয়েকদিন আগে নিরবকে পড়ানোর সময় শাশুড়ি মা এসেছিল, হাতের লেখা, সই করি কিভাবে এসব দেখতে চেয়েছিল। তখন ব্যাপারটা স্বাভাবিক লেগেছিল। ইসসস! এতোটা বোকামি কিভাবে করতে পারলাম! একটু সর্তক থাকা উচিত ছিল। হাতের কাগজটা ফটোকপি, মানে এর আসল কপি আছে। লোকগুলো মারাত্মক দূরান্তর! এদের সাথে পেরে ওঠা খুব কঠিন, একা এদের সাথে পারবো না!

” আপনি যাবেন না আমার সাথে?”

” তুমি আমাকে বাঁচাতে চাইছো কেন? এতে তোমার কি লাভ? বরং মা বাবাকে সাহায্য করা উচিত। ”

” অতিরিক্ত টেনশনে আপনার মাথা খা’রা’প হয়ে গেছে! প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নেন। আমি পুকুরের ওদিকটায় অপেক্ষা করছি। ”

নিরব সাবধানী পায়ে পুকুরের ওদিকটায় হাঁটা দিল। নিরবকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও নেই। এ যুগে টাকার কাছে ন্যায় বিচার বি’ক্রি হয়। তাছাড়া আমার মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সাহায্য করারও কেউ নেই।
একটা ব্যাগে দুই-চারটা কাপড়, সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিলাম। বাবার বাড়ি থেকে আসার পথে এসব কাগজ নিয়ে এসেছি। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই, তাড়াতাড়ি করতে হবে।

কাঁদা ভরা পিচ্ছিল রাস্তায় হেঁটে চলেছি, নিরব আগে আমি পিছনে। কি জানি ছেলেটা আমায় কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে!

” আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”

” আপনাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। আপনার পরিচয় জায়গা আছে যেখানে যেতে পারবেন?”

“না নেই।”

হতাশ গলায় জবাব দিলাম। আসলেই যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, দাদির কাছে যেতে চাই না। কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নদীর পাড়ে পোঁছালাম বোরকায় মুখ ঢেকে আছি, নিরবের মুখে মাক্স পরা।

” কোথায় যাব এখন?”

” আপনাকে একটা লঞ্চে উঠিয়ে দেবো, বাসে যাওয়া ঠিক হবে না বোধহয়। ”

” কিন্তু যাব কোথায়? ”

” ঠিকানা আপনাকেই জোগাড় করতে হবে, আমি বলতে পারি না। তবে কোন গার্লস হোস্টেলে থাকতে পারেন। ”

ছেলেটা যতটুকু সাহায্য করেছে তাই অনেক বেশি, ও কি করে থাকার জায়গা ঠিক করে দিবে। ওর পরিচিত সবাই নিশ্চিত শশুর শাশুড়ির পরিচিত হবে। নিরব একটা লঞ্চে উঠিয়ে দিল, লঞ্চটা বরিশাল দিয়ে ভোলা যাবে। বিদায় নেওয়ার সময় নিরব আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ছেলেটা চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করছে। নিরবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লঞ্চে উঠে পড়লাম, দেরি করলে বিপদ বাড়বে। লঞ্চে প্রচুর ভীড়, জায়গা খুঁজে পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি নিরব নেই। হয়তো চলে গেছে। বুকের কোথাও ভীষণ ভারী লাগছে, খুব কষ্ট হচ্ছে!

লঞ্চ ছেড়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে, নানান শব্দে চারপাশে মুখরিত। নিরবের এমন ব্যবহারের কারণ বুঝতে পারিনি। কেন সাহায্য করলো জানা হয়নি। সবকথা জানতে নেই, কিছু কথা অজানা থাকাই ভালো। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া তরুণ কিশোরের মনে যুবতীর প্রতি প্রেম জাগ্রত হতে পারে, বন্ধুত্বের খাতিরেও সাহায্য করতে পারে। এ বিষয়ে অনুমান করা খুব কঠিন ব্যাপার। নিবরের দেওয়া প্যাকেটটা খুলে দেখলাম। বেশ কিছু টাকা আছে, সাথে একটা সোনার চেন। এই চেনটা সবসময় নিরবের গলায় থাকতো। কোন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার শক্তি আমার নেই। নিজের মনকে কোন প্রশ্ন প্রকার করতে চাই না। এখানে বিচলিত হলে সকলের নজর পড়তে পারে। কারো মনে সন্দেহ জাগাতে চাই না, ওরা নিশ্চয়ই আমার খোঁজ করবে!

” তুমি সানজিদা না?”

সবে চোখ লেগে এসেছিল এমন সময় কারো ডাকে উঠে গেলাম। ভয়ে শরীর কাঁপছে, পাছে ধ’রা পড়ে গেলাম নাকি! সামনে একজন বয়স্ক মহিলা, বোরকা হিজাবে নিজের ঢেকে রাখলেও হাতের পাতায় কুঁচকে যাওয়া চামড়া উনার বয়স বলে দিচ্ছে। যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। নরম গলায় বললাম, ” আপনি কে? আপনাকে তো চিনলাম না। ”

” তোমার কলেজে দপ্তরি কাকি। তুমি বাবার সাথে কলেজে আসতে না?”

ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম, এই মহিলার কি দরকার ছিল এগিয়ে এসে কথা বলার। এ ধরনের মানুষের চোখ খুব তীক্ষ্ণ হয়, কয়েকবার দেখা হলে কাউকে খুব তাড়াতাড়ি চিনে ফেলতে পারে।

” ভয় পাচ্ছো কেন?”

” বোধ হয় হারিয়ে গেছি। পরিচিত এক লোকের সাথে এসে ছিলাম তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ”

” আমি আছি তো, কলেজে পড়ার সময় তুমি খুব নরম ছিলে, কারো সাথে কথা বলতে না। এখনও তেমনই আছো। ”

” শরীরটা ভালো লাগছে না। ”

উনি আমাকে পানি খেতে দিলেন, স্বাভাবিক হওয়ার জন্য স্বান্তনা দিতে লাগলেন। ইচ্ছে করছিল উনাকে সবকিছু বলে দিতে কিন্তু সাহসে পারলাম না।


বছর দুই পার হয়ে গেছে, সেদিনের ওই বয়স্ক মহিলার জন্য নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছি। লঞ্চ থেকে নামার পর যখন যাওয়ার জায়গা খুঁজে ম’র’ছি তখন উনিও আমার সাথে ছিলেন। ভয়ে দুশ্চিন্তায় চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেছিলাম। উনি হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছিল, আমার কাছে সবকিছু জানতে চাইলো। কি মনে করে উনাকে সবকিছু খুলে বলেছিলাম।

আমার কষ্টে সে-ও কিছু সময় অশ্রু বিসর্জন দিলো। বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” তোর এই মা আছে না, চিন্তা কিসের? আমার সাথে থাকবি তুই। আমার মেয়েটা গতবছর মা”রা গেছে, ছেলের বউ ভাত দিতে চায় না। তাই কাজের জন্য এখানে এসেছি। একটা মাদ্রাসায় আয়ার কাজ করবো, থাকা-খাওয়া সেখানেই। তুইও আমার সাথে চল। ”

সেদিন নতুন মা’য়ের সাথে এই মাদ্রাসায় এসেছিলাম। নতুন মা’য়ের সুপারিস আর সার্টিফিকেটের জোরে এখানে শিক্ষকতা করছি। দিনগুলো বেশ ভালোই চলে যাচ্ছে। প্রায়ই নিরবের কথা মনে পড়ে, ছেলেটা না থাকলে এ জীবন পাওয়া হতো না। শশুর শাশুড়ির কি অবস্থা জানার চেষ্টা করিনি। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।

” মেডাম কাঁদছেন কেন?”

” কই না তো, লেখা শেষ হয়েছে তোমাদের? ”

চোখের পানি মুছে পড়ানোর মন দিলাম। নিরবের কথা মনে পড়লেই চোখটা ভিজে যায়। খুব দেখতে ইচ্ছে করে ছেলেটা।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে