প্রদীপের নিচে আমি পর্ব-০৭

0
634

#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৭

অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম, আজ জীবনের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছি। মৃদুল দেখতে পেলে সমস্যা হতে পারে, নানান প্রশ্ন করবে। মনে ভয় ঢুকবে, সবকিছু জেনে গেছি কিনা। এতে আমারও সমস্যা হতে পারে, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য জোরজবরদস্তির করলেই বা কে দেখতে আসবে। কি দরকার এসবের! এর থেকে আড়ালে ফিরে যাওয়া ভালো।

রুমে ফিরে গোসল সেরে নিলাম, শরীরের স্বস্তি প্রয়োজন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছি, খুব বেশি কুৎসিত দেখতে নই। রূপ কি কখনো ভালোবাসা আনতে পারে? জানা নেই।

” সারাক্ষণ আয়নার সামনে কি দেখিস? কথা বললে হু হা জবাব দিচ্ছিস।”

” নিজেকে দেখছি, শরীরে মনের কষ্টের ছাপ পড়ে কিনা বোঝার চেষ্টা করছি। ”

” বড্ড কঠিন কথা বললে দিদিভাই।”

” তুমি আবার শুরু করেছ, এর থেকে ভালো হয় আপনি করে কথা বললে, তুই তুমি বাদ দিয়ে দাও। ”

” তাও মন্দ হয় না, কি বলেন মেডাম?”

শেষবারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম। দুপুরের জন্য রান্না করতে হবে।
কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে, কেটে রাখা বেগুনগুলোতে লবণ হলুদ মাখিয়ে নিচ্ছি। দুপুরের মেনুতে বেগুন ভাজা, মাছের ঝোল, ডাল। মা’য়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি, নিজে মাতব্বরি করলে হয়তো কথা শুনতে হতো।

” সানজিদা নে নে ধর। ”

মোবাইল হাতে মা দৌড়ে আসলো, এখনও হাঁপাচ্ছে।

” কার সাথে কথা বলবো?”

” তোর বর কল দিয়েছে। কি তেজ বাবা রে, নে কথা বল। ”

মায়ের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে কানের কাছে ধরলাম। নিরব কল দিবে ভাবতে পারিনি, কিছু হয়নি তো আবার।

” হ্যালো।”

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?”

” আপনি বাবার সাথে এলেন না কেন? নাকি ওখানে থেকে যাবেন?”

” থেকে যাব মনে হয়। ”

” ওহ আচ্ছা। ”

কল কেটে দিল। এতো রাগ উনার! জানতামই না। কিছু তুচ্ছ ঘটনা অনেক বড় মন খারাপ দূর করে দিতে পারে, নিরবের সাথে কথা বলার পর বেশ ভালো লাগছে। সে-ও আমার উপর রেগে আছে, কেন বাবার সাথে বাড়ি ফিরে যাইনি। ছোট মরিচের ঝাল বেশি, হা হা হা।

” একা একা হাসছিস কেন? রান্না করবি না?”

” হুম। ”

” তাড়াতাড়ি কর। মৃদুলের জন্য পায়েস রান্না করিস তো। ”

মৃদুলের নাম শুনে গা রিরি করে উঠলো, ইচ্ছে করছে পায়েসে বি”ষ মিশিয়ে দিতে। ওদের মতো ছেলের জন্য ভালোবাসা এতো কলুষিত। রান্নার কাজকর্ম শেষ, সকলে খেতে বসেছে। প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল বলে রান্নার সময় খেয়ে নিয়েছি, আপাতত কোন কাজ নেই। দাদির খাওয়া শেষ, বিছানায় ঝিমাচ্ছে।

” দাদি, মা’য়ের ব্যাপারে কিছু বলবে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে। ”

” রাতে বলবো, এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ”

দাদি সেভাবেই শুয়ে রইলো। এ বাড়িতে ভালো লাগছে না, চিরপরিচিত ঘরটাকে কেমন অসহ্য লাগছে। এতো সময়ে সকলের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, থালাবাসন ধূয়ে রাখলে মন্দ হয় না। এ বাড়িতে যতক্ষণ আছি সকল কাজ আমাকেই করতে হবে। অলস সময়টা পার করা দরকার। বাবার খাওয়া শেষে চা খাওয়ার অভ্যাস আছে, এক কাপ চা বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। শত হলেও এই মানুষটা আমার বাবা। উনি তো মা’কে ছেড়ে দেননি, বরং মা চলে যাওয়ার পর আমাকে নতুন মা এনে দিয়েছেন। সব বাবারাই শাসন করে, তবে তাতে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।

” খালুজান সানজিদা মারাত্মক সুন্দরী। চাইলে এর থেকেও বেশি দামে বি”ক্রি করতে পারতেন। ”

” পাঁচ লাখ টাকাই বা কম কিসে! তার উপর পঁচিশ হাজার উপরি পাওনা, এই ভালো। ”

” কম হলেও লাখ দশেক টাকা পেতেন। ”

” শত হলেও নিজের ঔরসজাত মেয়ে, এতো নিষ্ঠুরতা উচিত নয়। তুমি যেখানে বি”ক্রি করতে বলছ সেখানে কি হয় ভালোই বুঝতে পারছি। ”

” তাহলে এখানে বিয়ে দিয়ে কি লাভ হলো? ওরা সানজিদাকে নিয়ে কি করবে?”

” উনাদের বিনা পয়সার চাকর দরকার। শিক্ষিত হলে ছেলেদেরও পড়াতে পারবে, সেভাবে বিয়ে। টাকা না দিলে তো কেউ এতো কম বয়সী ছেলের কাছে মেয়ে দিবে না। তাছাড়া ওভাবে বিক্রি করলে অনেক লস হতো। তুমি এসব হিসেব বুঝবে না। ”

” হবে হয়তো, খালাই সবটা বললো। ”

” হ্যাঁ বুঝতে পারছি। তোমার খালার জন্যই সব। ওদের সাথে কথা হয়েছে সানজিদাকে এ বাড়িতে আসতে দিবে না। ”

” কেন এ বাড়ি আসলে কি সমস্যা? ”

” সে সানজিদার মুখ দেখতে চায় না, অথচ এতো বছরে আমাকে একটা ছেলের মুখ দেখাতে পারলো না। ”

হাত কাঁপছে, কয়েক ফোঁটা চা পড়ে চামড়া পু”ড়ে গেছে। নিজের কানকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। এসব মিথ্যে হোক, আমি কোন সত্যি জানতে চাই না। সব সত্যি জানতে নেই, অজানা থাকাই ভালো। যদিও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম, তবুও কষ্ট হচ্ছে। চা দেওয়ার ইচ্ছে বহু আগে ম”রে গেছে। বাবার প্রতি অবশিষ্ট সম্মানটুকু আজ শেষ হয়ে গেল।
সারা বিকেল ছাঁদে বসে ছিলাম। মৃদুল এসেছিল গল্প করতে, কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বললো। মিছরির ছুরি একটা! সবার উদ্দেশ্য বোঝা হয়ে গেছে, নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম। কালকেই নিরবদের বাড়িতে ফিরে যাব। এখানে আর থাকতে চাই না।

সকাল নয়টা, পিচঢালা রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছে। চারদিকের পরিবেশ উপভোগ করছি, গাড়ির জানালা খোলা। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র চা বসিয়ে ছিলাম, শশুর আব্বু গিয়ে হাজির। আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন। অথচ উনিই কাল সকালে দুদিন থাকার জন্য বলে গেছিলেন। হয়তো শাশুড়ি মা’য়ের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাতে দাদি মা’য়ের কাহিনী বললেন, খুবই করুণ! ম”রে গিয়ে বেঁচে গেছেন, না হলে আরো কষ্ট পেতে হতো।
মা ছিলেন অসম্ভব রূপবতী, অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছেন। ভাগ্যক্রমে দাদার সাথে দেখা হয়, প্রথম দেখায় উনি মা’কে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন মা’য়ের বয়স ছিল ১৫ বছর। বছর দুই দাদার বাড়িতে ছিল, তারপর বাবার সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের পর মা’কে নিয়ে বাবা শহরে চলে আসেন। গড়ে ওঠে টোনাটুনির সংসার! তবে সুখ বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, বছর খানেকের মাথায় বাবা রেণু দেবীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যখন ওদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হয় তখন মা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মানসিক অশান্তি, কষ্ট নিয়ে সময় পার করতে থাকেন। অবশেষে আমায় জন্ম দিতে গিয়ে পরপারে চলে গেলেন। বাবা নামক মানুষটার উপর প্রচন্ড ঘৃণা জমেছে।

শশুর বাড়ি আসতে আসতে দুপুর একটা বেজে গেল। দুপুরে রান্না আয়োজন করার প্রয়োজন নেই, শাশুড়ি মা সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে, বিছানায় শুয়ে আছি। নিবর এখন স্কুলে, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

এ বাড়িতে আসার পর সাতদিন পার হয়ে গেছে, সময় কত দ্রুত চলে যায়। সারাদিন বাড়ির কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় নিরবকে নিয়ে পড়তে বসা, বেশ ভালো সময় কাটছে। রোজকার মতো সন্ধ্যাবেলা নিরবকে নিয়ে পড়তে বসবো, কিন্তু সে স্কুল থেকে ফিরেই চাচির ঘরে গেছে। আসার নাম গন্ধ নেই, হয়তো রিতুর সাথে গল্প করছে। ছেলেটা ঘরের কি বিশ্রী অবস্থা করে রেখেছে, নিজের ঘরটা পর্যন্ত গোছাতে পারে না। আবার বাবুর জিনিসে কেউ হাত দিলে তাঁর বেজায় রাগ হয়। বিছানায় বালি কিচকিচ করছে, স্কুল ব্যাগে বালি লেগে রয়েছে। হয়তো মাঠের উপর ফেলে রেখে ফুটবল খেলছিল। ব্যাগ খুলতেই চমকে গেলাম। এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল, সাথে দুইটা বেলি ফুলের মালা। ফুলগুলো বড্ড সুন্দর, কোমল পাপড়ি।

” কি করছেন?”

” ফুলগুলো দেখছিলাম, খুব সুন্দর। ”

” ফুল পছন্দ? ”

” ফুল কে না পছন্দ করে! তোমার ভালো লাগে না?”

” হুম লাগে, আসলে এগুলো রিতুর জন্য এনেছিলাম। ওকে দিয়েই পড়তে আসছি। মা’কে কিছু বলে দিও না যেন। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। ”

নিরব ফুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। শাশুড়ি মা সমানে চিৎকার করছে, পড়তে না বসে এতো ঘোরাঘুরি কেন! নিরব আসছি বলে বেরিয়ে গেল। মা ছেলের কথায় কান দিলাম না, নিরবের বিছানা ছেড়ে ঘরটা পরিষ্কার করলাম। নিরব বেশ রাত করে ঘরে ফিরলো।

” আজ পড়তে হবে না? ”

” সবসময় কি পড়তে ইচ্ছে করে নাকি? আজ ভালো লাগছে না। ”

” মা রাগ করছে তো। ”

” পড়া নিয়ে সারাবছর রাগারাগি করে, ওইটা ব্যাপার না। ”

” তুমি পরীক্ষা ভালো করতে পারবে?”

” উফফ, সারাক্ষণ পড়া পড়া, চোখ বন্ধ করেন তো। ”

” কি হবে চোখ বন্ধ করলে?”

” বাঁচাল মহিলা!”

” ওই মহিলা কাকে বললে হ্যাঁ?”

” আপনাকে! একটু চোখ বন্ধ করলে কি এমন হয়!”

নিরব শুকনো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে নিরবের দিকে হাত বাড়ালাম। হাতে নরম ফুলের স্পর্শ অনুভব করছি, নাকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। চোখ খুলে দেখলাম হাতের উপর বেলিফুলের মালা দু’টো রাখা।

” এগুলো আপনার জন্য এনেছিলাম, খোঁপায় পরলে দারুণ দেখাবে। কিছু মনে করেননি তো আবার?”

“না কিছু মনে করিনি, ফুল আমার খুব পছন্দের। সবচেয়ে বেশি পছন্দ কামিনী ফুল। ”

” একটা কথা বলবো? আপনি মালা দু’টো খোঁপায় পরবেন? কয়েকটা ছবি তুলবো। ”

খোঁপায় বেলীফুল জড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। বেশ ভালো লাগছে দেখতে। আজ আর পড়াশোনা হলো না, খেয়ে শুয়ে পড়ালাম। লম্বা ঘুম দিতে ইচ্ছে করছে। সকালে আবার কত্ত কাজ!

সকাল সাতটা হবে, থালাবাসন ধূয়ে রান্না চাপিয়েছি। পুকুরে পানি আনতে যেতে হবে। দ্রুত পায়ে পুকুরের দিকে হাঁটা ধরলাম, দেরি হলে তরকারি পুড়ে যেতে পারে। সিঁড়ি দিয়েই কয়েক পা নামতেই পা পিছলে পানিতে পড়ে গেলাম। খুব ব্যাথা পেয়েছি! সাঁতার জানি, তবুও পানি ডুবে যাচ্ছি মনে হয়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে