#প্রতিদিন_তুমি_আমার (০২)
“তোর মতো পড়াকু মেয়েও যে প্রেম করতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি। তা বাসায় জানে এ কথা?”
পেছন হতে এহেন কথা কানে ভেসে আসতেই আঁতকে উঠে পেছনে ঘুরে তাকায় অসিফা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে ভ’য়ে সারা শরীর তার কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। এবার যদি এই লোকটা তার বাবা-মাকে এসব কথা বলে দেয়! কাপা কন্ঠে অসিফা বলে ওঠে,
“শিখন ভাই আপনি এখানে!”
অসিফার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে শিখন বলে ওঠে,
“এইতো একটা মিটিং থেকে ফিরছিলাম। ভাবলাম সিএনজিতে না চড়ে শর্টকাট ধরে অলিগলি দিয়ে হেটেই বাসায় যাই।”
“শিখন ভাই প্লিজ আপনি কাউকে কিছু বলবেন না। আর আব্বু যদি জানতে পারে এসব তাহলে আমাকে একদম মে’রে’ই ফেলবে।”
“আচ্ছা তা না হয় না বললাম। তবে এই বয়সটা আবেগের জোয়ারে ভাসিয়ে রাখে মানুষকে। যে সাতরে কূলে পৌছাতে পারে সে জীবনে কিছু একটা করতে পারে। আমার আশা ছিল তুই অন্তত ডুববি না। কিন্তু আজ তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেল। ডুবলি তো ডুবলি তাও আবার ওই তামিমের জন্য? ওর সম্বন্ধে কিছু জানতিস না আগে থেকে? একেই কেন তোর বয়ফ্রেন্ড বানাতে হলো? এর চেয়ে ওইযে আমাদের পাশের গলির যে রিফাত তোকে পছন্দ করে ওর সাথে প্রেম করতি! ছেলে তোর চেয়ে খাটো তাতে কি? লয়্যাল তো হতো!”
শিখনের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নুয়ে নেয় অসিফা। নিজের ওপর তার বড্ড রা’গ হচ্ছে।
“তা কতদিনের রিলেশন তোদের?” (শিখন)
“আড়াই বছরের। তবে ওর সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই আমার। চি’ট করেছে আমার সাথে।” বলেই হু হু করে কেদে ফেলে অসিফা।
অসিফার কথা শুনে শিখন দুই কদম পেছনে সরে যায়। অবাক কন্ঠে বলে ওঠে,
“হোয়াট! আড়াই বছর! আড়াই বছর পর এসে চিনেছিস ওকে? অথচ একটু খোজ নিলেই ওর সম্বন্ধে সব জানতে পারতি। তোর মাথায় তো একদম ঘিলু নেই দেখছি। তাহলে রেজাল্ট এত ভালো করিস কিভাবে?”
অসিফা শিখনের দিকে এগিয়ে যায় কিছুটা। তার কিছুতেই শিখনকে ভরসা হচ্ছেনা। যদি সে তার বাসাতে সব বলে দেয়! অনুরোধের সুরে শিখনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“শিখন ভাই প্লিজ আব্বু-আম্মুকে কিছু বলবেন না। নাহলে তারা কষ্ট পাবে অনেক।”
“আচ্ছা বলব না যা। তবে এই কথাটা আরও আগে ভাবা উচিত ছিল তোর। এখন বাসায় চল সন্ধ্যা নেমে আসছে। আর যেতে যেতে বল আসলে কি হয়েছে ওর সাথে আর একটু আগে ওভাবে ওকে ইট নিয়ে ধাওয়াও বা করলি কেন?”
বাসার দিকে অগ্রসর হতে হতে অসিফা সবকিছু শিখনকে খুলে বলতে থাকে।
—–
বাসায় ফিরেই অসিফা দেখে গ্রাম হতে তার দাদী এসেছে। অসিফার খুশি আর দেখে কে! দৌড়ে গিয়ে দাদীর গলা জড়িয়ে ধরতেই জুলেখা বেগম ঝা’ড়ি দিয়ে তার গলা হতে অসিফার হাত সরিয়ে দেন।
“এই এই সর সর। আমাকে ধরবিনা একদম। আমার সাথে এত খাতির পাতাইতে আসার কোনো দরকার নাই। আর তুই আইছস বাইরে থাইকা। গতরের ধুলাবালি নিয়া কোন আক্কেলে আমারে জড়াইয়া ধরিস তুই?”
লজ্জায় কান্না চলে আসে অসিফার।
জুলেখা বেগম হাঁক ছেড়ে নিলুফা বেগমকে ডাকতেই রান্নাঘর হতে ছুটে আসেন তিনি।
মুখমন্ডলে রাগের আভা ফুটিয়ে তুলে জুলেখা বেগম বলে ওঠেন,
“মেঝো বউ তোমার কাজবাজ তো একদম ভালো না। মাইয়া সন্ধ্যা মাথায় কইরা বাড়ি আসলো আর তুমি কিছুই কইলানা?”
“আম্মা ও তো প্রাইভেট পড়তে যায়। তাই আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায় আরকি।”
জুলেখা বেগমের মুখমন্ডলে ফুটে ওঠে রাগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ছ্যাত করে উঠে বলেন,
“এহ! সন্ধ্যার সময় মাইয়া মাইনসের আবার কিসের প্রাইভেট? কাইল দিয়া কোনো প্রাইভেট নাই ওর।”
অসিফা অশ্রুসিক্ত নয়নে নিলুফা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি বলে ওঠেন,
“অসিফা দ্রুত তোর রুমে যা। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে তারপর পড়তে বস। দ্রুত যা।”
অসিফা রুম হতে বের হয়ে যেতেই নিলুফা বেগম তার শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“রা’গ করবেন না মা। অসিফা আমাদের মেয়ে। তার ভালো-মন্দ সম্বন্ধে বুঝি আমরা। আপনি অন্তত ওর বিষয়ে কিছু বলবেন না। আপনি ওর দাদী। তবে দাদী হিসেবে কখনো কোনো দায়িত্ব তো পালন করেননি। ওকে যখন প্রথম হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম তখন ওকে ছুয়েও দেখেছিলেন না আপনি। শুধুমাত্র ও মেয়ে বলে। চুলায় তরকারি দিয়ে এসেছি মা। আসছি।”
হনহন করে রুম হতে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে যান নিলুফা বেগম। জুলেখা বেগম অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। নিলুফা বেগমকে এর আগে কখনো এতো প্রতিবাদী হতে দেখেননি তিনি। অবশ্য মনে তার পাহাড়সম রা’গও বাসা বাধে নিলুফা বেগম ও অসিফার বিরুদ্ধে।
—–
রাতে সকলে একসাথে খেতে বসেছে। রুই মাছের মাথার একপাশ চিবোতে চিবোতে জুলেখা বেগম বলে তার মেঝো ছেলে আসিফ খন্দকারের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“দত্তক নেয়া মেয়ের প্রতি তোরা একটু বেশিই আদর-সোহাগ দেখিয়ে ফেলছিস না বাবু?”
ডাইংরুমে উপস্থিত সকলে বি’স্ফো’রি’ত নয়নে জুলেখা বেগমের দিকে চেয়ে পড়ে।
আসিফ খন্দকার কিছু বলে ওঠার আগে আবার তিনি ওঠেন,
“তোর বউ ব’ন্ধ্যা তা মাইনা নিছিলাম আমি। বাচ্চা দত্তক নিবি সে কথাও মাইনা নিছিলাম। কিন্তু দত্তক নিলি তাও নিলি একটা মাইয়া? এরে দিয়ে তোদের ভবিষ্যৎ কি ক আমারে একটু? তোর সব সম্পত্তি নিয়া তো সেই শশুরবাড়ি যাইয়াই ঠাঁই গা’ড়’বে। একখান ছেলেপেলে যদি দত্তক নিতি তাইলে জায়গার জিনিস জায়গায়ই থাকতো না? আর তোর বউ যে এই মাইয়ার খালি পালিত মা হয়েই যে তেজ দেখায় বাবা!”
হুংকার দিয়ে ওঠেন আসিফ খন্দকার।
“আম্মা!”
অসিফা অবাক দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“আমি তোমাদের দত্তক নেয়া মেয়ে? আসল মেয়ে নই তাই তো বাবা?
কথাটা শেষ হতেই চোখ হতে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে অসিফার। সে তার বাবা-মায়ের দিত্তক নেয়া মেয়ে শুনে ক’ষ্ট না পেলেও জুলেখা বেগমের বলা কথা গুলো তার বুকে তী’রের মতো এসে বি’ধে’ছে। এক মুহুর্ত আর ডাইনিং রুমে থাকেনা অসিফা। ছুটে নিজের বেড রুমে প্রবেশ করে ছিটকিনি তুলে দেয় দরজায়। পেছন হতে আসিফ খন্দকার ও নিলুফা বেগম বারবার ডাকলেও সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।
” আম্মা এটা বলা কি খুব দরকার ছিল। আজ পর্যন্ত ওকে আমরা বুঝতে দেইনি যে ও আমাদের দিত্তক নেয়া মেয়ে। কিন্তু আপনি করলেনটা কি? আর ছেলে-মেয়ে নিয়ে বৈষম্য করার অভ্যাস বোধ হয় আপনার কোনোদিনই যাবেনা। আপনার সম্পত্তি নিয়ে খুব মাথা ব্যথা আম্মা। কিন্তু নিজের ছেলে যে কতটা সুখে আছে তা আর চোখে পড়ল না আপনার!”
বলেই হনহন করে ডাইনিং টেবিল হতে উঠে চলে যায় আসিফ খন্দকার।
—–
হঠাৎ আসিফ খন্দকারের নাম্বার হতে কল আসতেই চমকে ওঠে শিখন। আসিফ খন্দকার লোকটা তাকে ব্যক্তিগতভাবে তেমন একটা পছন্দ করে না, শুধুমাত্র সে রাজনীতি করে বলে। তাই এই মুহুর্তে তার নাম্বার হতে কল আসাটা আসলেই শিখনকে খুবভাবে অবাক করেছে। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ হতে আসিফ খন্দকার অসহায় কন্ঠে বলে ওঠেন,
“হ্যালো শিখন? তুমি একটু দ্রুত ভাই-ভাবিকে নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে আসো বাবা। অসিফা সেন্সলেস হয়ে গেছে। কিছুতেই জ্ঞান ফিরছেনা। এ্যাম্বুলেন্স কল করেছি। তোমরা একটু দ্রুত আসো।”
“আমরা এক্ষুনি আসছি আংকেল” বলেই কল কেটে দেয় শিখন। এমন অপ্রত্যাশিত খবরে যেন তার শরীর শীতল হয়ে গেছে। ছুটে সে তার বাবা-মায়ের রুমে চলে যায়।
চলবে…
#আফিয়া_অন্ত্রীশা