#প্রণয়
#৯ম পর্ব
#Abir Hasan Niloy
…
অর্ন ভিতরে আসে। অবনির খুব কাছেই সিফাত দাঁড়িয়ে আছে। অর্ন আসছে, সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। অর্ন ফ্রিজের কাছে গেলো। দরজা খুৃলে পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে বোতলটা আবারো ফ্রিজে রেখে, জোরে দরজা আটকে দেয়। দরজা আটকানোর শব্দে দুজন চমকে ওঠে। পাশে ঘুরে তাকিয়ে দেখে অর্ন এসে দাঁড়িয়েছে। অবনি তাড়াতাড়ি সিফাতের থেকে কিছুটা সরে এসে অর্নের দিকে তাকিয়ে বললো..
– তুই.. কখন এসেছিস? (অবনি)
– মাত্র। সিফাত কথা বলিস না কেনো? কেমন আছিস? (অর্ন)
– তুই কেমন আছিস? আর শুকিয়ে গিয়েছিস কেনো? চল বাহিরে চল। (সিফাত)
– হুম।
সিফাত অর্নের হাত ধরে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। অর্ন পিছনে ঘুরে তাকায়। অবনির দিকে তাকাতেই অবনি মাথা নিচু করে নিল। সিফাত আর অর্ন সোফাতে যেয়ে বসে। অর্ন সারাদিন না খেয়ে আছে। বারবার রান্না ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। অন্যদিন হলে তো খাবার টেবিলেই অবনিকে বসে থাকতে দেখতো অর্ন। কিন্তু তার আজ কিসের ব্যস্ততা, অর্ন বুঝতে পারছে না কি হয়েছে অবনির। সিফাত অর্নের দিকে তাকিয়ে বললো..
– তোর কি মন খারাপ? (সিফাত)
– কই না তো? কেনো? (অর্ন)
– একটা কথা বলবো ভাবছি। (সিফাত)
– হুম বলে ফেল। (অর্ন)
– কিচেনে থাকা ঐ…. (সিফাত)
– অর্ন.. তোর খাবার রেডি করেছি। গোসল করে খেয়ে নাও। রুমে তোর জন্য ঔষধও রেখেছি। (অবনি)
– হুমমম। ঠিক আছে। (অর্ন)
– কিরে তোরা দুজন বন্ধু নাকি? (সিফাত)
– ছিলাম… এখন আমরা… (অর্ন)
– হ্যা.. ছোট থেকেই বন্ধু আমরা। যাষ্ট ফ্রেন্ড। এখনো আছি (অবনি)
– ওও। তাহলে আমাকেও তোরা এড করে নে। আমি যতদিন আছি, মানে ইচ্ছে আছে এখন সারাজীবন দেশেই থেকে যাবো। তোদের বন্ধুর লিষ্টে এড করে নে আমাকে। (সিফাত)
– কালো মানুষ আমি। কালোদের বন্ধু থাকতে নেই। আর যে বন্ধু থাকে, সে কেবল সিমপ্যাথি ছাড়া কিছুই দেখাবে না। (অবনি)
– কালো? তুমি কালো? এটা হাস্যকর। শোনো তোমাদের বলি… পশ্চিমা দেশগুলোতে মঙ্গোলীয় আর নিগ্রোজাতি আছে। কালো বর্নের তারা। কিন্তু তাতে কি? পশ্চিমা দেশে কালো, সাদা কোনো ফ্যাক্ট না। এখানে কে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত সেটাই আসল। মিস ওয়ার্ল্ড সুন্দরীও হয়ে থাকে একজন গায়ের রঙ কালো মেয়েরা। তাই এটা কোনো ফ্যাক্ট না। খালি আমরা বাঙালীরা অলমোস্ট ৮০% মানুষ সৌন্দর্য বিবেচনা করি গায়ের রঙ দেখে। গায়ের রঙ কালো ছেলেটাকে অনেকে দেখে বলে বেয়াদব হবে। গায়ের রঙ কালো মেয়েটাকে দেখে অনেকেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু কেনো? যেখানে সবাই আমরা মানুষ। আর মানুষকে চিনতে হয় গুনে.. রুপে নয়। মানুষকে ভালোবাসতে হয় মায়ার টানে। এখন কারো মায়া থাকে হাসিতে, চোখের পাতায়, কথায়, স্টাইলে। অবনি, কেউ তোমার পাশে থাকুক বা না থাকুক, তোমার গায়ের রঙ নিয়ে কেউ এড়িয়ে চলুক বা না চলুক, আমি তোমার পাশে আছি, থাকবো। (সিফাত)
সিফাতের কথা শুনে অবনি নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। অর্ন মাথা নিচু করেই বসে রইল। অর্নের মা আরিনা বেগম সিফাতে কাছে এসে দাঁড়ালো। তিনি বললেন..
– ঠিক বলেছিস তুই। আমিও অবনিকে এটা বোঝাতে পারিনা। (আরিনা বেগম)
– কোনো সমস্যা নেই বড়মা। আমি আছি তো। (সিফাত)
শেষের কথাটা অবনির দিকে তাকিয়ে বললো সিফাত। তারপর সেখান থেকে উঠে চলে যায়। সিফাতের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে অবনি। অবনি সিফাতের কথাগুলো মনে মনে ভাবতে থাকে। অবনির পাশে এই প্রথম কোনো ছেলে এভাবে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটা মানুষই তো চায়, যেন তার পাশে এমন একজন আসুক। যে তাকে সাপোর্ট করবে, তাকে করুণা নয়, ভালোবাসা দেবে। আরিনা বেগম চলে যায়। অবনি দুরের সোফাতে যেয়ে বসলো। অর্ন অবনির দিকে তাকায়। অবনি বলে..
– আমি তোর কথা রাখছি। তোর থেকে দুরে থাকছি। তোর সাথে আমার আলাদা যে পরিচয় তা ওরা দুজন জানেনা। ভয় নেই, তারা আমার থেকে জানবে না। অন্য কেউ জানবে না। আমাকে নিয়ে পার্টি, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় কথা বলা লাগবে না। আমি এখন অনুভব করতে পারছি, কালোরাও মানুষ। তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তারা অন্যদের অপমান নিয়ে বাঁচার অধিকার রাখে না। তোকে ভালোবাসি আমি। তবে সেটা আর প্রকাশ হবেনা। হয়ত ভালোবাসাটাও পরিবর্তন হতে পারে। অসুস্থ আছিস, খাবার রেডি করা আছে। ঔষধও আছে রুমে। ইচ্ছে হলে খেতে পারিস। জোর করার জন্য নিজে থেকেই জোর করে অধিকার আদায় করার জোর করেছি। কিন্তু সেটাতে আরো বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলি। এখন বাকিটা তোর ইচ্ছে। আর ছ’ মাস কেনো? চাইলে তার আগেও আমাকে ডিভোর্স দিতে পারিস।
অবনি এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অর্ন অবনির মুখের দিকে তাকিয়েই ছিল। হঠাৎ করে অর্ন অবনির এমন পরিবর্তনের কারণ খুজতে থাকে। আর কারণ খুজতে যেয়েই সে আবিষ্কার করে অবনির কথা তার নিজ থেকেই মনে পড়ছে বেশি। অবনি অর্নের সামনে থেকে চলে আসে। কিছুদুর এসে থেমে যায়। অর্নের দিকে তাকিয়ে বলে..
– আমি চাই, তুই ইরাকে নিয়ে হ্যাপি থাকিস। আমার জন্য ইরা তোর হয়নি। এটার জন্য যেকোনো শাস্তি দিতে পারিস। আমি কিছু মনে করবো না। কিন্তু ইরা যেন তোর হয়। তোদের ভালোবাসায় কোনো ভূল ছিল না। ভূল টা আমার কপালে লেখা ছিল। তোদের জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। আনাফ মানে তোর ভাই, আমার সাথে অন্যায় করতে যাচ্ছিল। সেটার প্রতিবাদে বিয়ে। আর বিয়েটা হল তারই ছোট ভাইয়ের সাথে। যাকে আমি ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতাম। ভালোবাসতাম। একটা দিক দেখে তোর প্রতি ভালোবাসাটা বৃদ্ধি পেতো। সেটা হল, তুই আমাকে সাপোর্ট করতি। বিষয়টা ভালো লাগতো। জোর করে বন্ধুত্ব রেখেছিলাম, এই সাপোর্টের জন্য। কিন্তু বিয়ের পর বুঝলাম, এটা আসলে করুণা ছিল। আর তুই আমাকে ব্যবহার করেছিস। ভালোবাসিস নি কোনোদিন। আমি বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই, এটা বারবার বুঝিয়েছিস। ধন্যবাদ।
অবনি কথাগুলো বলে সোজা রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। অর্ন চুপচাপ বসেই আছে। এতকিছু অবনি বলতে পারে কখনো ধারনা করেনি অর্ন। সবকিছু ওর ভাবনার বাহিরে চলে গেছে। ইরা কখনো তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না, এটা বিশ্বাস ছিল। ইরা তাকে বুঝবে এটাও বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু ইরা শেষ পর্যন্ত অর্নকে বোঝেনি। অর্ন তার ভালোবাসাটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অর্নের কি দোষ? এখানে না আছে অবনির দোষ, না আছে অর্নের দোষ, আর না ইরার দোষ। তবুও তিনটে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। অর্ন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমের দিকে এগিয়ে চলে যায়।
ওয়াশ রুমে চলে গেলো। হাত থেকে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে অর্ন। ডাক্তার বলেছিল ক্ষত স্থানে যেন পানি না লাগাতে। কিন্তু অর্ন এখন কারো বারণ, শাষণ শোনার মধ্যে নেই। অর্ন পানির ঝরণা ছেঁড়ে দিয়ে তার নিচে হাত রাখে। পানি প্রথমে আস্তে আস্তে পড়ছিল। কিন্তৃ অর্ন আরো জোর দেয়। পানির ফোঁটার গতিবেগ আরো জোরে বের হতে থাকে। অর্নের ক্ষত স্থান এখনো কিছুই শুকায়নি। জোরে পানির ফোটা পড়ার কারনে আবারো রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে। অর্ন যন্ত্রনায় কেঁদে ওঠে। তবে মনের মধ্যে যে যন্ত্রনা তা প্রতিনিয়ত অর্নকে কাঁদিয়ে চলেছে। অর্ন আর কোনো যন্ত্রনায় সহ্য করতে পারছে না। ইরাকে একদমই হারিয়ে ফেলেছে অর্ন। ইরা তাকে ভূল বুঝেছে। আর বুঝবেই বা না কেন? বিবাহিত ছেলের সাথে কে বা সম্পর্ক রাখবে? কোনো নিশ্চয়তা নেই। চেয়েছিল অবনিকে বুঝতে। হয়ত অবনিই তার জন্য সৃষ্টিকর্তা ঠিক করেছে। কিন্তু এই বোধটুকু আসার পরই অবনিও যেন অর্নের থেকে দূরে সরে যাওয়ার ইচ্ছে করে ফেলেছে।
এভাবে প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে পানির নিচে হাত দিয়ে রাখে অর্ন। ক্ষত স্থান ফেঁটে আবারো রক্ত পড়ছে। অর্ন তোয়ালে নিয়ে গা মুছে নিল। দরজা খুলে বের হতেই দেখে অবনি খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করছে। সাথে সাথেই অর্ন হাতটা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে নিল। অবনি তাকালো না সেদিকে। অর্নের দিকে না তাকিয়েই বললো..
– খাবার রুমে রেখে যাচ্ছি। টেবিলে ঔষধও আছে। খেয়ে নে। সারাদিন কোথায় ছিলি? ইরার সাথে নাকি? ইরাকে বোঝা। তাকে বোঝাবি, যে ছেলে পছন্দ তো দূরে থাক, আমাকে টাচ অবদি করেনি, সে শুধু ইরার। (অবনি)
অবনি অর্নের থেকে বকা শোনার প্রস্তুতি নিয়ে তাকালো। কিন্তু অর্ন চুপচাপ হাতে তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অবনি বোঝার চেষ্টা করে “কি হল অর্নের? এত চুপচাপ সে থাকে না। হয় আমাকে বকা দেবে, না হয় বাড়িতে কারো সাথে গল্প করে। আজ কি হল ওর? কথায় বলছে না কেনো?” অর্ন টিশার্ট পরার জন্য একটা টিশার্ট হাতে নিল। অবনি দাঁড়িয়েই আছে। অর্ন ভেবেছিল সে কথা বলে চলে যাবে। অর্ন এখন কারো থেকে হেল্প নিতে চাচ্ছে না। কার থেকে নেবে? মায়ের থেকে নিতে গেলে বলবে এটা তোর বৌয়ের কাজ। আর অবনি এখন নিজে থেকেই দায়িত্ব পালন করা ছেঁড়ে দিচ্ছে। হাতে তোয়ালে পেঁচিয়ে নিল। অবনি বলে..
– কি ব্যাপার? তোয়ালে রেখে টিশার্ট পর। এত ঢং করছিস কেনো? দেখ আমি তোর বউ কাগজে কলমে। মন থেকে না। তাই এসব ভনিতা আমিও আর চাইনা। (অবনি)
– আমি কিছু বলেছি? (অর্ন)
– নাহ বলিস নি। তবুও বলার আগেই তোকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। (অবনি)
– আচ্ছা। ধন্যবাদ
কথাটা বলে অর্ন তোয়ালে সরায়। ডান হাতে ব্যান্ডেজ নেই। সাদা তোয়ালেটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। এখনো রক্ত পড়ছে। অর্ন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টিশার্ট পরে নিল। তারপর আবার তোয়ালে রক্ত মুছে নিয়ে, অবনির দিকে ঘুরে বলে..
– খাবার নিয়ে যা। সিফাত, শেফা ওরা হয়ত খাইনি। ওদেরকে খাবার দে। ঔষধেরও প্রয়োজন নেই। আর ধন্যবাদ, আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে তুই আমার বউ না। মানে মন থেকে মেনে না নেওয়া বউ না।
অর্ন কথাটা বলেই বাইরের দিকে পা বাড়ায়। অবনি খপ করে অর্নের হাত ধরে ফেলে। অর্ন ছাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু অবনি শক্ত করেই অর্নের হাত চেপে ধরে রাখে। অর্ন অবনির দিকে ঘুরলো না। অবনি জোরে টেনে এনে বিছানায় বসালো অর্নকে। অর্ন মাথা নিচু করে নিল। অবনিও কোনো কথা বলে না। স্যাভলন, তুলো আর ব্যান্ডেজ এনে দাঁড়ালো অর্নের সামনে। হাতটা টেবিলের উপর নিয়ে, তুলোর সাথে স্যাভলন নিয়ে অর্নের কাঁটা স্থানে লাগাতে থাকে। অবনি বলে..
– কি হয়েছে? জিদ আমার উপর কর। নিজের উপরে কেনো দেখাচ্ছিস? আমাকে বকা দে। নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস? (অবনি)
– কোনো সমস্যা নেই। (অর্ন)
– আছে সমস্যা। তোর মা তোর জন্য চিন্তা করে। (অবনি)
– হুম। তিনি আছেই বলেই এখানে আছি। তিনি ছিলেন বলেই তোকে বিয়ে করেছিলাম। তিনি… (অর্ন)
– তিনি ছিলেন বলেই আমাকে না চাওয়া সত্তেও বিয়ে করতে হয়েছে। বউ হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে। যে মেয়ে কারো বন্ধু হওয়ার যোগ্যতাই রাখে না। সেখানে বউ তো বিশাল ব্যাপার। (অবনি)
– হুম। (অর্ন)
– ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। এরপর নিজের খেয়াল নিজে রাখবি।
অবনি কথাটা বলে স্যাভলনগুলো আগের জায়গাতে রেখে আসে। তারপর খাবার মাখিয়ে অর্নের দিকে বাড়িয়ে দেয়। অর্ন অবনির দিকে তাকালো। অবনি অর্নের দিকে তাকায়। একটা মানুষ যতটা না অন্যের জন্য কাঁদে। নিজের জন্য কখনো কোনোদিন তার একগুনও কাঁদে না। ইরা অর্নের জন্য কেঁদেছে। অর্ন ইরার জন্য কেঁদেছে। আর অবনি অর্নের জন্যই কেঁদেছে। নিজের জন্য কান্নার সময় কই? মানুষ নিজের জন্য কাঁদে কেঁটে গেলে, প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলে, খুজে না পেলে, বা নষ্ট হয়ে গেলে কাঁদে। কিন্তু ভালোবাসলে মানুষটা অন্যের জন্য কাঁদবেই।
অর্ন খাবার খেতে থাকে। অবনিও কিছু বলছে না। খাবার শেষ হয়। অবনি ঔষধ দেয় অর্নকে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কেমন যেন ঘুম পেতে থাকে অর্নের। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে অর্ন টের পায়নি।
.
রাত এগারোটা বাজে। অবনি ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা সময় হল সে কাঁদছে। একা একাই কাঁদছে। অর্নের জন্যই কাঁদছে। এতটা ভালোবাসার পরও কেনো অর্ন তাকে বোঝেনি। সে ইরার। মাথার মধ্যে ডিভোর্সের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেলো অবনি। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সে পিছনে তাকায়। সিফাত এসে দাঁড়িয়েছে। সিফাতকে দেখে সে মুচকি হাসলো। সিফাতকে অবনির কাছে অন্যরকম মানুষ লাগে। সিফাতের প্রতি রেসপেক্টনেস ব্যাপারটা কাজ করে। মুহুর্তের মধ্যেই অবনির মনে থাকা ভাবনাগুলো চলে যেয়ে সিফাতের ভাবনা এসে দাঁড়িয়েছে। সিফাত বললো…
– আজকে চাঁদ দেখেছো? দেখো কত বড় একটি চাঁদ। কি সুন্দর জ্যোৎস্না। এই চাঁদের আলোয় একটা মায়াবতী দাঁড়িয়ে আছে। যার মুখে চাঁদের আলো পড়াতে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। তোমার চোখে চাঁদ এসে উঁকি দিচ্ছে। তুমি কাঁদছিলে তাইনা? দেখো আমি কিন্তু তোমাকে কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু তোমার চোখে ভেসে থাকা চাঁদের প্রতিভিম্ব বলে দিচ্ছে তুমি কাঁদছিলে? মানুষ কখন কাঁদে জানো? যখন সে কষ্ট জমা রেখে, কাউকে বলতে পারেনা। একা থাকবে কেনো? আমাকে বলো। মায়াবতীর চোখে কেনো বিষন্নতার ছাপ?
অবনি সিফাতের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পিছনে ঘুরলো।মুহুর্তেই অবনির মন ভালো হয়ে গেছে। সিফাতের কথায় জাদু আছে যেন। অবনির মনে থাকা সব কষ্টগুলো সিফাতের কথা শুনে এই মুহুর্তে চলে গিয়েছে। অবনির পাশে এসে দাঁড়ালো সিফাত। ছাঁদের বেরিকেডে হাত রাখলো অবনি। সিফাতও অবনির হাতের উপর হাত রাখলো। দুজন চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলোয় দুজন যেন গোসল করতে ব্যস্ত। দুজনে কথা বলা শুরু করে। ঘনিষ্টতা বাঁড়তে থাকে। একে অপরের কাছে গা ঘেসে দাঁড়ায়। অবনি যেন অনেক হ্যাপি। অর্নের থেকে পাওয়া কষ্টগুলো সে সিফাতের মাধ্যমে ভূলে যেতে থাকে। কেনোই বা সে সিফাতের বন্ধু হবেনা? প্রথমবার কোনো কারণ ছাড়াই সিফাত তার কাছে বন্ধুত্বের দাবি জানিয়েছে। বন্ধু হয়েছে তার। যা কখনো কোনো মানুষ এভাবে হয়নি। ছোট থেকেই অবহেলিত হয়েছে অবনি।
যেদিন অবনি পৃথিবীতে আসে। সেদিন ওর বাবা এক্সিডেন্ট করে একটা পা হারায়। এ জন্য অবনির মা অবনিকে সহ্য করতে পারেনা। তিনি মনে করেন অবনি কালো বলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। কালো রঙ দেখতে মেয়েটা তখন থেকেই অবহেলা সহ্য করছে। নিজের মা ঠিকমত কেয়ারই করেনি। আরিনা বেগম অবনিকে নিজের মত করে, ভালোবেসে কাছে আগলে রেখেছে। আরিনা বেগমের পর অবনি ভেবেছিল অর্ন তাকে ভালোবাসছে। কিন্তু সে ভূল। নিজ থেকে অর্নের সাথে বন্ধুত্ব তৈরী করেছে। আবার নিজ থেকে ভালোবাসা দেখিয়েছে। অর্ন কখনো বোঝেনি। প্রয়োজনে অবনি পেয়েছে অবহেলা। আরিনার বেগমের পর সিফাতই একমাত্র ব্যক্তি, যে কিনা ভালোবাসা দেখাচ্ছে। করুনা না, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। যার সাথে অবনি কথা বলে আনন্দ অনুভব করে। যার সাথে মিশে অবনি কষ্টগুলো ভুলতে পারছে। এরকমই কাউকে সে সবসময় চেয়েছে। অর্নকে এমন করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু অর্ন তো ইরাকে ভালোবাসে। অবনির পাশে আর কেউ নেই।
.
অর্ন ঘুমিয়ে আছে। সে স্বপ্ন দেখছে ‘একটি রজনীগন্ধা ফুলের মাঠ। হলুদ গাদা ফুৃলও আছে। একটি সাদা খরগোশ ফুলের বাগানে খেলা করছে। অর্ন শুনতে পায় ‘আমাকে খরগোশটা এনে দাও।’ অর্ন মুৃখের দিকে তাকায়। অবনি দাঁড়িয়ে আছে দুরে। অবনির আবদার শুনে অর্নের মধ্যে বিশাল আনন্দ কাজ করছে। এই আনন্দটা যেন বহু প্রতিক্ষিত আনন্দ। বহু বছর পর যেন অবনিকে খুশি রাখার একটা সুযোগ যেন অর্ন পেয়েছে। যা কিছু হয়ে যাক, অবনির জন্য সে খরগোশ আর সাদা রজনীগন্ধা ফুল এনে দেবেই। সে এক পা এগিয়ে গেলো। খরগোশের কাছে এসে হাত বাড়িয়ে নিতে যাবে, কে যেন পিছন থেকে ওর হাত টেনে ধরে। অর্ন ছাঁড়াতেই পারেনা। পিছনে তাকিয়ে দেখে ইরার প্রতিচ্ছবি। অর্ন হাত ছাঁড়িয়ে সামনে ঘুরে দেখে সেখানে খরগোশ নেই। একটা ছেলে খরগোশটি কোলে তুলে নিয়ে অবনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবনির মুখে হাসির রেখা প্রসারিত। ছেলেটাকে সে চেনেনা। অবনির হাতে খরগোশ দিয়ে দুজনে হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সাদা ধোয়াশায় মিলে যেতে থাকে। পিছন থেকে ইরার অসহ্যকর হাসি শুনতে পায় অর্ন। বুঝে যায় ইরা অর্নের সুখ চায়নি। আর অবনিও অর্নকে এখন চাচ্ছে না। সে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। তখনি ওর ঘুম ভেঙে গেলো।’
সে ঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটা বাজতে গেছে। কেমন যেন অস্বস্থি লাগছে। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। সে নামলো বিছানা থেকে। অবনিকে খুজছে। সে ছাঁড়ের সিঁড়ির দিকে তাকালো। মন খারাপ লাগছে অনেক। ছাঁদের দিকে পা বাড়ায় অর্ন। তারপর..
চলবে,,