#প্রণয়
#৮ম পর্ব
#আবির হাসান নিলয়
…
সিফাত আর শেফা অর্নদের বাড়িতে এসে পৌছেছে। বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে মেইন দরজার সামনে। শুধু একজনই নেই। সে হল অবনি। অর্নের মা তাকে ডেকেছে অনেক্ষণ হয়েছে। অবনি আসছি বলে এখনো আসেনি। সিফাত আর শেফা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে এসে, দাদুকে সালাম করে। তারপর অর্নের বাবাকে। সব শেষে অর্নের মাকে সালাম করার আগে তিনি জড়িয়ে ধরে বলে..
– তোরা বুকে আয়। কত বছর পর আসছিস বলতো? কত ছোট্ট দেখেছিলাম তোদের। মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিস একদম তাইনা? (আরিনা বেগম)
– না বড় আম্মু। ভূলবো কেনো? চলে এসেছি। তোমার রান্না খাইনা কত বছর সেটা কি জানো? আনাফ ভাইয়া কোথায়? অর্নকেও তো দেখছিনা। (সিফাত)
– আছে সবাই। শেফা.. কিরে তুই এত মিষ্টি দেখতে হয়েছিস কবে হুম? দেখিস ছেলেগুলোকে আবার পাগল বানিয়ে দিয়ে যাস না।(আরিনা বেগম)
অর্নেরমা কথাটা বলে, শেফার গাল টেনে ধরে। শেফা সিফাতের থেকে তিন বছরের ছোট। শেফা বেশ আদুরী দেখতে। কথা বলার ধরনটাও অন্য সব মেয়েদের থেকে একটু আলাদা। প্রথমবারই শেফার কথা বলার ধরন দেখে তাকে মিষ্টি বলতে বাধ্য হবে যে কেউ। চুলগুলো তেমন বড় না। সোনালী রঙের চুল, বেশ গুছিয়েই রাখা। শেফা লজ্জা পেলো বড় মায়ের কথায়। অর্নের মাকে জড়িয়ে ধরে নেয় কিছু সময়। সবাই ভিতরে প্রবেশ করে। অর্নের মা ওদেরকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজের লোককে ডাকে। কিন্তু সিফাত বলে..
– বড় আম্ম.. আমি তো চিনি সব। আমি একাই যাচ্ছি। ঐ শেফু আয়। (সিফাত)
– তুমি যাও। আমি বড়আম্মুর সাথে থাকবো একটু। (শেফা)
– আচ্ছা। (সিফাত)
সিফাত সিঁড়ি ডিঙিয়ে দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে উপরের দিকে। শেষ সিঁড়ি পার হয়ে ডান পাশের ঘর গুলোতে তাকালো। ঠিক তখনি বাম পাশ থেকে কে যেন এসে সিফাতকে বেশ জোরে সরেই ধাক্কা দেয়। সিফাত পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সিফাত লক্ষ্য করে যে এসে ধাক্কা দিয়েছে, সে নিজেই সিঁড়ির দিকে হেলে পড়ছে। সিফাত ক্যালকুলেশন করে নিল, যদি তিনি নিচে পড়ে তাহলে আর হাঁড়গুলো সোজা থাকবেনা। সিফাত আর দেরি করে না। সে নিজের ডান হাত বাঁড়িয়েই, পড়ে যাওয়া তাকে ধরলো। সিফাতের গায়ে কয়েকগুলো বালিশ হুড়মুড় করে এসে পড়া শুরু করে। মুখটা ভেসে ওঠে সিফাতের সামনে।
যে সিঁড়ি দিয়ে নিচে পড়তে যাচ্ছিল, সে হল অবনি। আর অবনি বেডসিট, আর কয়েকটা বালিশ একসাথে পাঁজকোলা করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল পাশের রুমে। অবনি এতক্ষণ রুম পরিষ্কার করছিল সিফাতদের জন্য। সব রেডি, কেবল বালিশ এনে রাখলেই ফুলফিল হয়ে যাবে। এদিকে অর্নের মা তাকে বারবার ডাকছিল বিধায়, সে একসাথে তিনটে বালিশ পেঁচিয়ে ধরে বের হয়েছিল স্টোর রুম থেকে। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে একটা বালিশ হঠাৎ ওর চোখের সামনে চলে আসে। সরাতেই পারছিল না। তবে আন্দাজের ভারে এগিয়ে যাচ্ছিল অবনি। হঠাৎ কারো সাথে ওর ধাক্কা লেগে যায়।
সে সিঁড়ির দিকে হেলে পড়ছিল। কিন্তু তখনো বালিশ ধরেই রাখে বর্ষা। তাই যখন পড়ে যাবে, এমন সময় একটা হাত অবনিকে টেনে ধরে। সেই হাতটা হল সিফাতের। সিফাত হাত টেনে ধরতেই অবনির কোল থেকে বালিশগুলো ছুঁটে যেয়ে দুটো সিফাতের উপর এসে পড়ে। আরেকটা নিচের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকে। সিফাত হাত ধরেই অবনির মুখের দিকে তাকায়। সিফাত অবনির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনিমেষ ভাবে। এভাবে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে দুজন একে অপরের দিকে। অবনি বলে “আমি পড়ে যাচ্ছি।”
সিফাত কথাটা শুনেই এক ঝটকায় টেনে নেয় নিজের কাছে অবনিকে। অবনি টাল সামলাতে না পেরে সিফাতের বুকে এসে থামে। সিফাত ডান হাত দিয়ে অবনির কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। ছোট্ট একটা খামছি দিয়ে ধরে রাখে অবনিকে। অবনি সিফাতের চোখের দিকে তাকায়। সিফাতও অবনির চোখের দিকে তাকালো। অনিমেষ দৃষ্টি। এ চাহনির বর্ণনা যেন নিমজ্জিত। অবনির হঠাৎ শুনতে পেলো নিচ থেকে অর্নের মা তাকে ডাকছে। সে স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে নিজেকে সিফাতের থেকে ছাঁড়িয়ে নেয়। প্রশ্ন করে..
– কে আপনি? এখানে কি করেন?
– হ্যালো… আমি সিফাত। আর এটা আমাদের বাড়ি বলা যাই। কিন্তু আপনি কে? (সিফাত)
– ওহ, আপনিই সেই সিফাত? (অবনি)
– হুমম। কিন্তু আপনি কে? (সিফাত)
– আমি অ***
অবনি থেমে যায়। অর্নের কথা মনে পড়ে ওর। অর্ন তাকে বউ হিসেবে মানে না। অর্নের কাছে ঘেষতে বারণ তার। অর্নের বউ হিসেবে পরিচয় দিতে অর্নের খারাপ লাগে। এ জন্য অর্নের কোনো সম্মান নষ্ট না হয়, তাই অবনি অর্নের নাম নিতে যেয়েও থেমে গেলো। সে বলতে চেয়েছিল, অর্নের বউ। কিন্তু এখন এটা সে বলবে না। অবনি বলে..
– আমি অবনি। আর অর্ন ভাইয়ার আম্মুর বোনের মেয়ে।
অবনি কথাটা বলে বালিশগুলো হাতে তুলে নিল। রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পিছন থেকে সিফাত বলে..
– শুনুন…
– হুম। (অবনি)
– একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন? (সিফাত)
– কি প্রশ্ন বলুন। (অবনি)
– আপনার চোখ দুটো এত সুন্দর কেনো? এত মায়াবী কেনো? এত আকর্ষনীয় কেনো? সত্যিই বলছি, এত আকর্ষণীয় মায়াবী চোখ আমি কখনো দেখিনি। চোখের মায়াতে যেকোনো পুরুষ আটকাতে বাধ্য।
অবনি হা হয়ে গেলো সিফাতের থেকে কথাগুলো শুনে। এই প্রথমবার অবনিকে এই ভাবে কথা বললো। ওর গা কাঁপা শুরু করেছে। ওর পা যেন চলছেই না। অর্নের এতটা কাছে আসার পরও অর্ন কোনোদিন অবনিকে কিছু বলেনি। অথচ মাত্র পরিচিত হওয়া ছেলেটা অবনির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে এতকিছু বলে ফেললো। যা অবনির গায়ের লোমগুলো যেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ উত্তরের একটা দমকা বাতাস অবনির মাথার চুলে এসে লাগে। ওর এলোমেলো করা চুলের খোঁপা খুলে যায়। দীঘল কালো চুল অবনির প্রায় পায়ের নিচে এসে ঠেঁকতে শুরু করেছে। সিফাদ নিস্তব্ধ, নীরব, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অবনি আর দাঁড়ায় না। এক দৌড়ে গেষ্ট রুমে যেয়ে দরজা আটকে দিল।
দরজার সাথে হেলান দিয়ে, বালিশ একসাথে বুকের মধ্যে চেপে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো অবনি। আয়নাতে তাকে দেখা যাচ্চে। সে বালিশগুলো বিছানায় ফেলে দৌড়ে আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। প্রথমবার আয়নার সামনে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়ালো। নিজের চোখের দিকে তাকালো সে। মনে মনে বললো “এই ছেলেটা নিশ্চয় পাগল। আমার চোখ সুন্দর? মাথায় তার সমস্যা আছে। কিন্তু এভাবে তো কেউ বলেনি আমাকে। এত ভালো লাগছে কেন আমার? উফ.. এই ছেলে কি ম্যাজিশিয়ান নাকি? এক ঝটকায় আমার ভাবনাগুলো সব গোলমেলে করে দিয়েছে। দূরে থাকতে হবে ছেলেটার থেকে।”
অবনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলো। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে থেকে সরে এসে বিছানা গোছাতে শুরু করে। চুলগুলো খোলায় আছে তার। অবনি বিছানা গুছিয়ে দরজা খুললো। সিফাত দরজার পাশে হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। অবনিকে দেখে বললো..
– এবার বলুন, আপনার চোখ দুটো এত সুন্দর কেনো? আর এত লম্বা চুল। আমি মনে হয় বাঙালী মেয়ের প্রেমে পড়বো বলে বিদেশি কারো প্রতি আকৃষ্ট হইনি। (সিফাত)
– এটা আপনার রুম। রেস্ট করেন। (অবনি)
– অবনি….শু.. (সিফাত)
– নাহ, কিছু শুনবো না। যান।
অবনি কথাটা বলেই সেখান থেকে দৌড়ে চলে আসে। অবনি সিফাতের কথা আরো শুনতে চাইছিল। কিন্তু কিনা কি হবে ভেবে দৌড়ে চলে আসে। নিচে এসে সোজা রান্না ঘরে যেয়ে, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাফাতে থাকে। অর্নের মা আরিনা বেগম বলে..
– কি ব্যাপার কোথায় ছিলি? আমি তোকে এত ডাকাডাকি করেও পাচ্ছি না কেনো? আর হাফাচ্ছিস কেনো? (আরিনা বেগম)
– ঐ রুমগুলো পরিষ্কার করছিলাম। বিছানা সাজিয়ে তবেই এলাম। (অবনি)
– ওহ, সিফাত আর শেফা এসেছে দেখেছিস? (আরিনা বেগম)
– হুমম দেখলাম। কথা হয়েছে। (অবনি)
– ওহ, ভালো করেছিস। একটু রেস্ট নে যা। না হয় রান্নার কাজে হেল্প কর। (আরিনা বেগম)
– আচ্ছা করছি হেল্প। তুমি যাও। (অবনি)
– একসাথে করি আয়। অর্ন আসবে এখনি।
ওরা দুজন রান্না করতে থাকে। ও দিকে অর্ন ছোটনের মাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সবকিছু ঝামেলা মেটাতে মেটাতে বিকেল হয়ে গেছে। অর্ন একটা রিকশা নিল। এই সময়ের রিকশায় অর্ন কখনো একা ঘোরেনি। পাশে ইরা থাকতো। ইরার কথা মনে পড়তেই ওর কেমন যেন কষ্ট হতে থাকে। অর্নের মুখে রোদ এসে পড়ছে। কেমন যেন জ্বর জ্বর অনুভব হচ্ছে ওর। সে হুডটা তোলার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ চোখ আটকে যায় দূরে একটা ফুসকার দোকানে। ইরা দাঁড়িয়ে আছে। অর্ন বলে..
– মামা.. ফুসকার দোকানের সামনে চলেন তো।
– আইচ্ছা।
অর্ন ইরার পিছনে এসে দাঁড়ালো। ইরা খেয়াল করেনি কে এসেছে। হঠাৎ পিছন থেকে অর্ন বললো..”আজ প্রথমবার একা ফুসকা খেতে চলে এলে যে?” ইরা পিছনে ঘুরে তাকায়। অর্ন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ইরা রাগ নিয়ে বললো..
– একা আসছি নাকি? আর আপনি এখানে কেনো? আমাদের ভাবীকে নিয়ে এসেছেন নাকি? (ইরা)
– ইরা, আমি অবনিকে ভালোবাসিনা। আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি। মানছি সে আমার বউ। কিন্তু আমি তোমাকেই চাই। আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি। তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। তোমাকে চাই। (অর্ন)
– এক নাটক আর কতো? আমি তোমাকে ভালোবাসি না। (ইরা)
– আমাকে ভালোবাসো না? সত্যিই? (অর্ন)
– হুম, সত্যিই। সে তোর মত স্বার্থপরকে ভালোবাসবে কেনো? (শিহাব)
– ওহ। তার মানে ইরাকে সাথে নিয়ে তুই ফুসকা খেতে এসেছিস। বাহ ভালো। (অর্ন)
– হুমম। যা তুই এখান থেকে। আর ইরার পিছু ছেঁড়ে দে। (শিহাব)
– যদি না ছাঁড়ি? (অর্ন)
– ইরা বললে তোকে মেরে ফেলতেও পারি। (শিহাব)
– একটা মেয়ের জন্য বন্ধুকে মারবি? (অর্ন)
– এই একটা মেয়ের পিছনে কেনো পড়ে আছিস? আর দরকার হলে মারবোই। ইরা তুমি কি অর্নকে চাও? (শিহাব)
– নাহ, কখনো না। তাকে চিনিনা। আর ওর মত একটা ছেলেকে আমি কখনো ভালোবাসবো না। চাওয়াটা তো দুরের কথা। দেখুন মি. অর্ন। আপনার কাছে হাতজোড় করে মাফ চাচ্ছি, অনুরোধও করছি। আমাকে প্লিজ শান্তিতে থাকতে দেন। আমাকে আমার মত করে থাকতে দেন। আমার জীবন থেকে চলে যান। আমি আপনাকে চাইনা।
ইরার কথাগুলো শুনে অর্ন মাথা নিচু করে নিল। ইরা এগুলো বলবে, অর্ন তা কোনোদিন ভাবেইনি। ইরা তো এমন ছিল না। তাহলে কেনো এমন হয়ে গেছে? ইরা তো অর্নের সাথে ভালোবেসেই কথা বলতো। ইরা সত্যিই বদলে গেছে। অর্ন চলে আসার প্রস্তুতি নিল। পিছন থেকে শিহার বললো “শূনেছিস তো, ইরা তোকে চায়না। এরপর কখনো ইরার আশেপাশে যেন না দেখি তোকে। যা.. ভালোভাবে বললাম। এরপর আর বন্ধুত্ব দেখাবো না।” অর্ন চুপচাপ সেখান থেকে চলে আসলো।
.
অবনি আরিনা বেগমের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। অবনি মাথা নিচু করে বললো..
– খালামনি, একটা কথা রাখবে?
– হুম বল। রাখবো না কেনো? (আরিনা বেগম)
– আসলে, তুমি তো দেখলেই ঐ আনটিটা আমাকে কতকিছু বললো। শুনে অনেক খারাপ লাগছে। সিফাত আর শেফার কাছে আমার ব্যাপারে কিছু বললে ওরা যদি এমন করে? তাহলে আমি বাড়ি থেকে চলে যাবো। (অবনি)
– কি বলছিস? ওরা কেনো তোকে অপমান করবে? (আরিনা বেগম)
– আমি জানিনা। তবে বলবা না কিছু। আমি অর্নের বউ এই বাড়িতে, বাকিদের সামনে এটা প্রকাশ করবো না। তুমিও করবা না। প্লিজ.. যদি করো আমি চলে যাবো এখান থেকে। (অবনি)
– আচ্ছা ঠিক আছে। এখন মন খারাপ করিস না। (আরিনা বেগম)
দুজনে গল্প করতে থাকে। সিফাত আসে রান্না করে। আরিনা বেগম সিফাতকে দেখেই অবাক হয়। সিফাত রান্না ঘরে এই প্রথমবার আসলো। সিফাত আরিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো..
– বড়মা, একটু কফি খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই ভাবলাম নিজে এসে বানিয়ে নিই। (সিফাত)
– আরে কি বলো.. তুমি কেনো বানাবা। আমি আছি, অবনি আছে। তোমার এত কষ্ট করতে হবে না। (আরিনা বেগম)
– তাহলে তো এক কাপ কফি পাচ্ছি। (সিফাত)
– বসো তুমি। আমি আসছি।
আরিনা বেগম কথাটা বলে কিচেন থেকে বের হলো। অবনি কফির মগ নিয়ে কফি বানাতে শুরু করেছে। সিফাত বসা থেকে উঠে অবনির পাশে, সামনের দিকে ফিরে দাঁড়ালো। অবনি তাকাচ্ছে না সিফাতের দিকে। কিন্তু সিফাত যে অবনির দিকে তাকিয়ে আছা, এটা অবনি জানে। অবনি প্রশ্ন করে..
– কি দেখছেন?
– বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ অনুভুতি জাগিয়ে তোলা মুখ..
দেখছি আমি, ঐ মুখে মায়াবী দুটি চোখ। (সিফাত)
– আমি দেখতে কালো। মজা নিচ্ছেন? (অবনি)
– আমেরিকাতে এটা কোনো ব্যাপার না। আর কথায় আছে তো, বাঙালী মেয়ে কালো মানে সে লক্ষী। আর আমার তো সবসময় মায়াবী জিনিসটাই পছন্দের ছিল। যা এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি। (সিফাত)
– কি টের পাচ্ছেন? (অবনি)
– এই যে, আপনার এত সুন্দর ভ্রু যুগল, এত লম্বা কালো চুল, এত মায়াবী দুটি চোখ। আমাকে আকর্ষণ করছে অনেক। (সিফাত)
– আমি কে এতকিছু না জেনেই এত আকর্ষণ কিভাবে হচ্ছে? (অবনি)
– জানার আগে তৈরী হয় আকর্ষণ। জানার পর তৈরী হয় ভালোবাসা। যদিও অজানাতে ভালোবাসা আরো গাঢ় হয়। জানার দরকার কি? (সিফাত)
দুজন কথা বলছে। ও দিকে অর্ন রিকশা থেকে বাড়ির সামনে এসে নামলো। ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। একটা অপরিচিত প্রাইভেট গাড়ি ওর চোখে পড়ে। কিন্তু এসব কিছু নিয়ে ভাবছে না। ভাবনাতে এখন অবনি। সে ভাবছে “এখনি কলিং বেল বাজাবো। অবনি আসবে দৌড়ে দরজা খুলতে। আমি বুঝিনা, এতকিছু বলার পরও সে কেনো এভাবে ভালোবাসে আমাকে? সে তো জানে আমি তাকে চাইনা। তাহলে কেনো এমন করে? কি অদ্ভুত নিয়ম, মানুষ যখন যাকে চায়, তাকে পাইনা। আবার যখন চাওয়া হয় তখন অপর পাশের মানুষটাও চায়না কিছু। চাওয়া আর না চাওয়ার এই পরিপ্রেক্ষিতে কত যে ভালোবাসা নষ্ট হয়। কিন্তু মানুষ কখনো মনের কথা শোনেই না। মানুষ শোনে মস্তিষ্কের কথা, মানুৃষ শোনে রাগের কথা, মানুষ শোনে অবিমানের কথা। মন কি চায় তা যদি মানুষ সঠিকভাবে বুঝতে পারতো। তাহলে মানুষ কখনো কষ্ট পেতো না।”
অর্ন কলিং বেলে চাপ দেয়। অবনি দরজা খুৃলবে এটা ভেবেই সে সামনের দিকে তাকালো। অবহেলায় ভালোবাসাগুলো কেমন যেন নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। অবনি কফি বানিয়ে সিফাতের দিকে বাড়িয়ে দিল। কলিং বেলের শব্দ কানে আসে ওর। অর্নের সাথে বিয়ে হওয়ার পর যত কলিংবেল হয়েছে। প্রতিবার অবনিই দরজা খুলেছে। সে অর্নের জন্যই এটা করতো। যদি অর্ন আসে, সে দৌড়ে ছুটে গিয়েছে দরজা খুৃলতে। কিন্তু আজ অবনির কানে কলিংবেলের শব্দ আসার পরও কোনো সাড়া নেই। সিফাতের দিকে কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সিফাত কফির মগ নিচ্ছে না। অবনির দিকে তাকিয়ে আছে। অবনি কালো হলেও, তার হেয়ার স্টাইল, তার হাঁটাচলা অন্য সব মেয়েদের থেকেও অনেক বেশি এগিয়ে। সে যদি দেখতে পরিষ্কার হতো, তাহলে এতদিনে যে কত ছেলে ওর পিছনে ঘুরতো এটার কোনো গননা থাকতো না।
সিফাত কফির মগ হাতে নিতে যেয়ে অবনির হাতের সাখে হাত এক করে মগটা ধরলো। অবনি প্রথমে ছাঁড়িয়ে নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু সিফাতের হাত উপরে, কফির মগ শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। অবনি ছাঁড়ানোর আর চেষ্টা করলো না। দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদিকে অর্ন কলিং বেল বাজিয়েই চলেছে। শেফা এগিয়ে আসে। কলিংবেল বাজার শব্দে সে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। অর্ন জানতোই এটা অবনি হবে। কিন্তু শেফাকে দেখে চমকে যায়। কিছুটা অবাক হয়েই বললো..
– শেফা… তুমি? কখন আসছো? আমি জানতাম না। সারপ্রাইজ দিয়েছো নাকি? (অর্ন)
– জ্বি মি. সারপ্রাইজ। তা আপনি কোথায় থাকেন হু? সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজে আপনার কোনো হদিস মিললো না। আজব… (শেফা)
অর্ন শেফার আদুরে আদুরে বাচ্চা স্টাইলের কথাগুলো শুনে চুপ হয়ে গেলো। অর্নের বাবার বন্ধু + ভাইয়ের মেয়ে শেফা। হঠাৎ করে দেশে এসেছে। অর্ন জানতোই না ব্যাপারটা। হয়ত অর্নের বউ দেখার জন্য নয়ত অন্য কিছু থাকতে পারে। আরিনা বেগমের থেকে না হয় জানা যাবে। অর্ন ভিতরে প্রবেশ করলো। বাড়িটা ফাঁকা লাগছে। অর্ন যে অবনিকে খুজছে, অর্ন নিজেই তা নিজের কাছে ধরা দিচ্ছে না।
– সিফাত কোথায়? আচ্ছা দাঁড়াও আমি একটু পানি খেয়ে আসি। গলা শুকিয়ে গেছে। খাবা নাকি? চলো রান্না ঘরে ফ্রিজ আছে। (অর্ন)
– মাত্র খেলাম কিছু। এখন এত পানি খেতে পারবো না। আপনি যান। আর রান্না ঘরে আমি কোনোদিনও যাইনি। রান্না ঘর কেমন দেখতে হয় তাও জানিনা। (শেফা)
– আচ্ছা বসো, আসছি।
অর্ন রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে আসতেই।
চলবে,,