#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ২৪
ছোট্ট ছোট্ট আলোকিত প্রদীপ ও রঙবেরঙের বেলুন দিয়ে কক্ষ টা সুন্দর করে সাজানো।কক্ষের বিছানার উপর বিভিন্ন রঙের চিরকুট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আছে গোলাপ,কাঠগোলাপ ও শিউলি ফুলও।পুরো কক্ষ জুড়ে একটি মিষ্টি ঘ্রাণ নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।এ এক অদ্ভুত নেশা ধরানো পরিবেশ, রোমান্টিকতায় ভরপুর!
খাবার ও সেই সাথে কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রিসোর্টের কক্ষে ফিরে নিজের কাছে থাকা চাবি দ্বারা দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করতেই চমকে যায় আর্শ।পুরো কক্ষে চোখ বুলোতেই মুগ্ধতায় ভরে ওঠে তার হৃদয়।তবুও এতোসব সৌন্দর্য উপেক্ষা করে তার আঁখিযুগল নিজের হৃদহরণি কন্যার সন্ধানে ব্যস্ত।
নিজ স্ত্রীর দেখা পাবার মনোবাসনা নিয়ে এক কদম আগাতেই বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই চিরকুটগুলোর দিকে আবারও নজর যায় আর্শের।প্রতিটি চিরকুটে মিয়ামির ব্যক্ত করা অনুভূতি গুলো পড়বার লোভ সামলাতে না পেরে বিছানার দিকে অগ্রসর হয় আর্শ।বিছানার এক কোণে বসে হলুদ রঙের একটি চিরকুট নিজের হাতে তুলে নেয় সে।অতঃপর তার ভাঁজ খুলে তাতে লেখা অক্ষরগুলোয় চোখ বুলিয়ে নেয়।
“অপ্রিয় ভাইটু,
আজ আমার ক্লাস সেভেনের ক্লাস পার্টি ছিলো।তাই অনেক কান্নাকাটি করে আম্মুকে রাজি করিয়ে তার নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে কলেজে গিয়েছিলাম।গিয়ে দেখি তুমি আর্শিকে স্কুল অব্দি দিতে এসেছো কিছুটা হলদে রঙের পাঞ্জাবি পরে।আচ্ছা,এভাবে নীল-হলুদ রঙ মিলে যাওয়াটা কি উপরওয়ালার কোনো ইশারা?এমন নয়তো যে,তুমি আমার হিমু আর আমি তোমার রুপা?”
চিরকুটটি পড়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আর্শের।এ চিরকুটটি সে আরো ২ বার পরে আবারও ভাঁজ করে বিছানার উপর রেখে লাল রঙের একটি চিরকুট হাতে তুলে নেয়।
“অপ্রিয় ভাইটু,
অপ্রিয় হলেও তুমি না আমার খুব প্রিয়! জানি না আজকাল তোমায় দেখলে কেমন যেনো লজ্জা লজ্জা লাগে।লুকিয়ে লুকিয়ে তোমায় দেখতে ভালো লাগে,তোমায় নিয়ে রাত-দিন ভাবতে ভালো লাগে, তোমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে, তোমার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে ভালো লাগে আরো অনেক ভালোলাগা মিশে আছে তোমাতে।আগেও তোমায় ভালোই লাগতো।তবে এখনের অনুভূতিগুলো কেমন যেনো ভিন্ন।”
ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে আর্শের।প্রেমের শুরুর দিকে এইযে অনুভূতিগুলোর কোনো নাম দিতে চেয়েও না পারা,কেমন এক বিভ্রান্তির সম্মুখীন হওয়া এই সময়টা উপভোগ করার মতো।প্রেমে এই সময় টাই বেশি সুন্দর।মিয়ামির চিরকুটটি পড়ে আর্শেরও ঐ সময়টার কথা মনে পরে যাচ্ছে।সেই সুন্দর অনুভূতিরা আরো একবার তার হৃদয় ছুঁয়ে দিচ্ছে।
মিয়ামির এ চিরকুটটি পরে আর্শ বুঝতে পারছে যে,এ চিরকুটটি লেখার সময় থেকেই মিয়ামি ধীরে ধীরে আর্শের প্রতি তৈরি হওয়া তার অনুভূতিগুলোকে বুঝতে আরম্ভ করেছিলো।
লাল চিরকুটটি রেখে এবার একটি কালো চিরকুট হাতে নিলো আর্শ।এতে কিছুটা রুপালি রঙের কালি দিয়ে লেখা আছে,
“অপ্রিয় অপ্রিয় অপ্রিয়,
জানতে চাও কেনো এতো অপ্রিয় তুমি আমার?
সবসময় গম্ভীর মুখ রাখো,কথা তো মুখ দিয়ে বাইর হয় না আর হইলেও শুধু বকা।এতো বকো কেন হ্যা?করল্লা কোথাকার!”
এবার একটু বেশিই হেসে ওঠে আর্শ।এমনিও সে একটু কম কথা বলে,যা তার স্বভাব।ছোটবেলা দিয়েই চাপা স্বভাবের সে।আর অন্য সবার সাথে মোটামুটি ভালোভাবে কথা বললেও মিয়ামির সাথে কমই বলতো,মেয়েটি সামান্য ভুল করলেও বকতে ছাড়তো না আর্শ।ঐ যে কথায় আছে না,চোরের মন পুলিশ পুলিশ! ভালোবাসাটাকে লুকোতেই তার এই একটু রুক্ষ ব্যবহারটা।
এভাবেই আরো অনেক চিরকুটের মাঝে লাভ আকৃতির হরেক রঙের একটি চিরকুট রাখা আছে।আর্শ আর সময় অপচয় না করে সেই চিরকুটটি নিজের তুলে নেয়।ভাঁজ খুলে তাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।
“প্রিয় অর্ধাঙ্গ,
জানো,আজ একটি বিশেষ দিন!আজ থেকে ঠিক ৩১ দিন আগে দুটা অর্ধেক হৃদয় এক হয়ে পূর্ণতা লাভ করেছিলো।এ প্রাপ্তি টা ছিলো অনেক বড়!ঠিক তেমনই আজও একটি প্রাপ্তির দিন।আজ পুরো ৩০ দিন তুমি নেশার জগৎ থেকে দূরে ছিলে।ড্রাগস ভুলে তুমি মিয়ামিতে আসক্ত ছিলে।আর বেশি দিন নয়, আর্শ।২-৩ মাসে তুমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।আমি জিতে গিয়েছি আর্শ।আমার আর্শ আসক্তি জিতে গিয়েছে।”
চিরকুটটি পড়তেই চোখমুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে আর্শের।ঠোঁটে এক বৃহৎ হাসি তার।তার বিন্দু পরিমাণ খেয়াল ছিলো না যে আজ এক মাস যাবত সে ড্রাগস সেবন করেনি।যে ছেলে দুটো দিন ড্রাগস না নিলে তৃতীয় দিন পাগলের মতো আচরণ করতো সে আজ এক মাস ড্রাগস নেয়নি! সত্যিই এ বিজয়টি আর্শের একার নয় বরং মিয়ামিরও।মেয়েটি সকাল ৯-১০ টার আগে কোনোক্রমেই ঘুম থেকে উঠতে চাইতো না।সেই মেয়ে এই একমাস ভোর ৫ টায় উঠেছে।আর্শ না উঠতে চাইলেও তাকে জোর করে উঠিয়ে আগে নামাজ তারপর মেডিটেশন করিয়েছে।কত রাত আর্শ ঘুমোতে পারেনি,ছটফট করেছে আর মিয়ামি রাত জেগে আর্শকে সামলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গিয়েছে।আসলে মানসিকভাবে একটা মানুষকে সহযোগিতা প্রদান করলে একটি মানুষ নিজের মনোবল দিয়েই অনেক অসাধ্যকে সাধন করে নিতে পারে।কিন্তু এই মানসিক সহায়তা প্রদান করাটাই যথেষ্ট কষ্টসাধ্য কাজের মাঝে একটি।আর এ কাজটিই মিয়ামি নিজের জায়গা থেকে বিনা কোনো ত্রুটিতে করতে সক্ষম হয়েছে।সত্যিই তার আর্শ আসক্তি জয়ী।
!!
সখ করেই আজ রাঁধতে ইচ্ছে করছে আর্শির।তাই আর সময় ব্যয় না করে ফ্রিজ থেকে গরুর মাংসের একটি প্যাকেট বের করে তা পানিতে ভিজিয়ে রেখে আবারও নিজের কক্ষে ফিরে আসে সে।বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবছে,মাংস টা কিভাবে রান্না করবে?আগে একবার রেঁধেছিলো সে তাও ইউটিউব দেখে।কিন্তু এখন তো রান্না টা মনে নেই।
ভাবনার মাঝেই ফোনে ম্যাসেজ আসার শব্দ কানে আসে আর্শির।ফোনটি হাতে নিতেই দেখতে পায় বিহান ম্যাসেজ দিয়েছে।
“কি করো?”
উত্তরে আর্শি লিখে পাঠায়,
-শুয়ে শুয়ে ভাবছি,গরুর মাংস কিভাবে রাঁধবো!
-ওহ আচ্ছা।
বিহানের ম্যাসেজের উত্তরে আর্শি কিছু বলার জন্যে টাইপিং শুরু করেও থেমে যায়।হঠাৎ তার মনে পরে বিহান নিজের রান্না নিজে করে তাও ছাত্র জীবন থেকেই।ছেলেটির হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ তো আর্শির হয়নি তবে ছেলেটির রেসিপি নিয়ে নিজে তো রেঁধে খেতেই পারে।যেই ভাবা সেই কাজ!আর্শি দ্রুত লিখে ফেলে,
-এই,আমাকে গরুর মাংস রাঁধা শিখাবেন?
-গরুর মাংস তো অনেকভাবে রান্না করা যায়।কোন ভাবে শিখবা?
-সব থেকে সহজ যেটা।
-উম,সবই তো সহজ।আসলে,মাংস রান্না করা অনেক সহজ।
-হ,নিজে পারেন তো তাই সহজ লাগে সব।আমার দিক থেকে ভেবে বলেন কোন পদ্ধতি সহজ।
-সব মশল্লা একবারে দিয়ে তার সাথে সামান্য পানি যোগ করে একটু সময় নিয়ে মশল্লা কষাবা।মশল্লা যত সময় নিয়ে জ্বাল করবা তরকারির টেস্ট তত ভালো হবে।মশল্লা প্রায় ৫ মিনিট কষানোর পর মাংস দিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে মাংস দিয়ে যে পানি বের হবে তা শুকিয়ে ফেলে বারতি ১-২ বার পানি দিবা যাতে মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ হয়ে যায়।আর অবশ্যই সিদ্ধর জন্যে যে পানি দিবা তা আগে আলাদাভাবে গরম করে নিবা।
-আচ্ছা।কিন্তু মশল্লা কি কি দিবো?
-পিয়াজ কাটা ও দিবা আর কিছু পরিমাণ বাটা টাও,আদা ও রসুন বাটা,জিরা আস্তো কিছুটা দিবা আর বাটাও দিবা,জায়ফল আর জয়ত্রী একটু ভেজে তারপর বেটে নিবা,গরম মশল্লাগুলো আর ভাজা লাগবে না তা এমনিই বেটে নিয়ে তরকারিতে দিবা।আর হলুদ,মরিচের গুঁড়া,লবন,তেল এগুলো তো দিবাই।
-ব্যাস আর কিছু লাগবে না?
-এই পদ্ধতি টা হচ্ছে একদম সহজ। তাছাড়া তুমি টক দই,টমেটো,সস আরো অনেক উপাদান আছে যা তরকারিতে দিয়ে তরকারির স্বাদ আরো মজা বানাতে পারো।
-কোনো দরকার নেই।আমি সহজ টাই রাঁধবো এতো মজা হওয়া লাগবে না।
-হু।
-আচ্ছা রাঁধতে যাই।
-যাও।
বিহানের রিপ্লাই পেয়ে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হয় আর্শি।মাংসের মশল্লা গুলো আগে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে এক একটি মশল্লা বের করে করে হাতের কাছেই রাখছে সে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো,সে তো জায়ফল আর জয়ত্রীই চিনছে না।মশল্লা সব খুলে খুলে দেখার সময় ছোট ছোট কয়েকটি গোল আকৃতির কালচে কোনো ফলের মতো দেখতে মশল্লাটিই হয়তো জায়ফল তা আন্দাজ করে সেটির ছবি তুলে নেয় আর্শি।ছবিটি বিহানকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে নেয় এটিই জায়ফল কিনা।ছেলেটি সম্মতি দেয়।এই জায়ফলের ঝামেলাটা মিটলেও আরেটি ঝামেলা রয়ে গিয়েছে তা হলো গরম মশল্লায় কি কি মশল্লা থাকে!এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আর্শি আবারও ম্যাসেজ দেয় বিহানকে। ছেলেটিও সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয় তাকে।
আর্শির অনেক আগের থেকেই ইচ্ছে ছিলো,সে নিজের বরের কাছ থেকে রান্না শিখবে।তাই তো কখনো রান্না শিখা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না।তার একটাই কথা ছিলো,”আমার জামাই অনেক ভালো কুক হবে আর আমি তার কাছ থেকে রান্না শিখবো।”
বলতে গেলে আর্শির সেই ইচ্ছে টা আজ পূরণ হয়েছে।বিহান হয়তো তার প্রেমিক বা বর কোনোটিই নয় তবে তার হৃদয়ে বসবাস রত একমাত্র পুরুষ তো বিহানই।ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি যে অনুভূতিতে একটা অপরিচিত মানুষ এমন একজনে পরিণত হয় যে মানুষ টাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়া টাও যেন বিষাক্ত লাগে।ঠিক তেমনই ভালোবাসলে আমরা ভুলেই যাই মানুষ টা আমাদের বিয়ে করা বর বা বউ নয়।আমরা ঐ মানুষটাকেই নিজেদের অর্ধাঙ্গ বা পরিপূরক ভাবা শুরু করে দেই।ঠিক এমনই আর্শির বেলায়ও।তার কাছে,বিহানই তার পরিপূরক।
আজ ছেলেটির কাছ থেকে গরুর মাংস রান্না শিখে তার একটা ইচ্ছে পূর্ণ হলো।আর্শি তো আজ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে যে,সে বিহানের কাছ থেকে আরো অনেক রান্না শিখে নিবে।
চলবে