#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ২১
রাতের প্রহর ও ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া,এ দু’য়ের সংমিশ্রণ যেনো প্রশান্তির আরেক নাম।এমন পরিবেশে একলা বসে আকাশ দেখা ও সাথে মৃদু গানের গুনগুন শব্দ কানে এসে লাগার অনুভূতিতে এক অন্য রকমই তৃপ্তি!আর এ অনুভূতিটিই প্রাণ ভরে অনুভব করছে আর্শি।
কিছু কিছু মানুষ আছে যারা একাকিত্বে প্রশান্তি খুঁজে পায় কিংবা বলা চলে,অধিকাংশ সৃজনশীল মানুষেরা একাকিত্বটা বেশ উপভোগ করে।আর্শি এদের দলেরই অন্তর্ভুক্ত।
বারান্দায় পাতানো একটি চেয়ারে বসে এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ উপভোগ করতে করতে তৃপ্তিময় নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিচ্ছে আর্শি।তার দৃষ্টি নিজের লাগানো গোলাপ গাছটির দিকে।এসব গাছ লাগানো তার কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না।কিন্তু একটি বাস্তব অনুভূতি হচ্ছে,প্রিয় মানুষটির প্রিয় প্রতিটি জিনিসই নিজের অজান্তেই আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠে।আর্শির ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে।যে কুকুর জীব টাকে সে ঘৃণা করতো সেই কুকুরের প্রতিই এখন তার মায়া কাজ করে।যার একমাত্র কারণ,বিহানের কুকুর পছন্দ। বিহান রাস্তাঘাটে যেখানেই কুকুর পায় সেই কুকুরগুলোকে খাবার কিনে খাওয়ায়।ছেলেটি রাস্তা থেকে দু’টি কুকুর কুড়িয়ে নিয়ে নিজ বাসায় রেখে পালেও।এমনটি নয় যে বিদেশি কুকুর কিনার যথেষ্ট পরিমাণ টাকা তার নেই।টাকা ঠিকই আছে কিন্তু তার মতে রাস্তার এই অসহায় কুকুরগুলোর সহায় হওয়াটাই শ্রেয়।কারণ স্রষ্টার সৃষ্টির সহায় হলে স্রষ্টা নিজেই তার সহায়ক হোন।
কুকুরের কাহিনিটির মতোই গোলাপের কাহিনিটা।বাড়িতে এসব গাছগাছালি লাগানো আর্শির পছন্দের না হলেও এসব বিহানের অবসরের প্রিয় অভিলাষ হওয়ায় আর্শিও নিজের অবসরে এসব ফুল গাছ লাগিয়ে তার পরিচর্যা করে।
নিস্তব্ধ রাতের এই প্রহরে,নিজের লাগানো গোলাপটির দিকে তাকিয়ে বিহানের বাড়িতে বিহানের লাগানো গাছ গুলোর কথা ভেবে চলছে আর্শি।ছেলেটি এতো এতো গাছের একটি ফুলও ছেঁড়ে না।গাছের ফুল-পাতা ছিঁড়া বিহানের অপছন্দের কাজের মধ্যে একটি।তাই তো ফুল খোঁপায় গুজার সখ থাকলেও একটিও ফুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় না আর্শির।
আর্শির ভাবনার মাঝেই হটাৎ তার ফোনে ম্যাসেজ আসার শব্দ হয়।এতো রাতে বিহান ছাড়া অন্য কোনো ফ্রেন্ড ম্যাসেজ দিবে না তা শতভাগ নিশ্চিত আর্শি।চোখ-মুখে খুশির ঝলক নিয়ে ফোনটি হাতে তুলে নেয় সে।স্ক্রিন অন করতেই প্রিয় নামটি ভেসে ওঠে তার দৃষ্টির সম্মুখে।বিহান ম্যাসেজ দিয়েছে,
-কি করো?
-বসে আছি,আপনি?
-শুয়ে আছি।আজ ওয়েদার টা ফিল করছো?
-হু।
-রোমান্টিক ওয়েদার!
বিহানের এমন কথার উত্তরে কি বলা উচিৎ তা বুঝে উঠতে পারছে না আর্শি।তাই মজা করেই উত্তর দিলো,
-লাভ কি!আপনি তো সিঙ্গেল।
-ভালোই হলো।নাহয় আজ নির্ঘাত অঘটন ঘটিয়ে ফেলতাম।
-মানে?
-বাচ্চা মানুষরা এতো বুঝে না।
বিহানের এমন উক্তিতে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে আর্শি।বিহানের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সে বলে ওঠে,
-আমি মোটেও বাচ্চা না।এ বছরের প্রথমেই আমি ১৮ তে পা দিয়েছি।আমি এডাল্ট!
আর্শির ম্যাসেজটি দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে বিহানের।পাগলকে পাগল বললে যেমন চেতে যায় আর্শির অবস্থাও তেমন।আর্শিকে আরেকটু চেতানোর উদ্দেশ্য বিহান বলে ওঠে,
-তাই জন্যেই তো এখনো এডাল্ট টাইপ কথার মিনিং বোঝ না।
বিহানের কথায় চুপ হয়ে যায় আর্শি।একটু সময় নিয়ে বিহানের ঐ কথাটির অর্থ বুঝতেই লজ্জা লজ্জা লাগতে আরম্ভ করে তার।কথা পরিবর্তন করতে সে বলে ওঠে,
-রাত তো কম হয়নি,ঘুমাচ্ছেন না কেন?
-বুড়ো মানুষ,জাগতেই পারি!তুমি কেন জেগে আছো?বাচ্চাদের রাত জাগা অনুচিত।
বিহান আবারও বাচ্চা বলায় আবারও রেগে যায় আর্শি।তবে এবার রাগ টা আর প্রকাশ করে না।নিজের একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বলে ওঠে,
-বাচ্চারা একা একা ঘুমাতে পারে না।তাদের ঘুম পড়ায়ে দিতে হয়।তা কি আপনার জানা নেই, মিঃবুড়ো?
-উম,জানতাম তো! তা কিভাবে ঘুম পড়াতে হবে আর্শি বাবুকে?
-কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে।
আর্শির কথায় হেসে ওঠে বিহান।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে সে বলে ওঠে,
-বাসায় আসো,দিচ্ছি।
বিহানের এমন কথায় লজ্জায় লাল হয়ে যায় আর্শি।তবে ভালো লাগছে তার।চোখজোড়া বুজে নিয়ে সাথে সাথেই এমনটি কল্পনা করে নেয় সে যে,এমনই একটি রাতে সে বিহানের বুকে চুপটি করে শুবে আর বিহান আদর ও সোহাগ দিয়ে জড়িয়ে ধরবে তাকে।কপালে আলতো ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিয়ে ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকবে।এভাবেই আর্শি হারিয়ে যাবে কোনো এক অজানা সুখানুভূতিতে।
এসব কল্পনা করতেই এক অন্য রকম ভালো লাগার অনুভূতিতে ছেয়ে গিয়েছে আর্শির হৃদয়।যেখানে সে নিশ্চিত যে,বিহান তাকে ভালোবাসে না অর্থাৎ বিহান তার হবে না।তবুও ছেলেটিকে নিয়ে কল্পনার জগৎ সাজানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে অক্ষম সে।
!!
পড়ন্ত বিকেল!
ডায়াবেটিস থাকায় বাড়ির সামনের পার্কে এসে কিছু টা সময় হাঁটবার পর সানিয়া বেগম ও মেহরিন বেগম উভয়ই একটি ইট-সিমেন্টের পাকা বেঞ্চে এসে বসে পরেন।আসার পর থেকেই সানিয়া বেগম লক্ষ্য করছেন যে,মেহরিন বেগমের মনটা কেমন যেনো ভালো নেই।কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে তিনি নিজের বান্ধবী সেই সাথে বিয়াইনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
-কিরে রিনু,মন টা কি কোনো কারণে খারাপ?
উত্তরে কোনো ভনিতা না করে মেহরিন বেগম নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-তোরে মিথ্যে বলবো না।আসলে মিমিকে নিয়ে আমি বড্ড চিন্তিত।একটাই মেয়ে আমার।ওকে এতো দ্রুত বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না কিন্তু তোদের জোড়াজুড়ি আর আর্শের প্রতি মিমির দূর্বলতা দেখে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।এ পর্যন্ত ঠিকই ছিলো। কিন্তু এখন থেকেই মিয়ামির তোদের বাসায় থাকা টা কি উচিৎ হচ্ছে? এতে ওর পড়াশোনায় ও তো কুপ্রভাব পরছে,তাই না?
উত্তরে সানিয়া বেগম ঠোঁটে একটু হাসি টেনে বলে ওঠে,
-বিয়ের পর স্ত্রী,স্বামীর সাথে থাকবে এটিই তো স্বাভাবিক।সাথে না থাকাটা বরং অস্বাভাবিক।সম্পর্কের শুরু থেকেই আলাদা থাকলে সংসারের প্রতি মায়া সৃষ্টি হবে কোত্থেকে?আর পড়াশোনার যে বিষয়টি আছে তা নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। আমার উপর ভরসা রাখতে পারিস।
সানিয়ার বেগমের কথার উত্তরে ঠোঁটে হাসি ফুটালেও মন থেকে বিষয়টি মানতে কষ্ট হচ্ছে মেহরিন বেগমের।মিয়ামির এখন থেকেই আর্শের বাসায় থাকাটা তার মতে অনুচিতই।
!!
বিছানার এক কোণে শুয়ে আছে আর্শ।তার পাশেই পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসে বসে নিজের এতো দিনের জমা হওয়া পড়াগুলো এক এক করে শেষ করায় ব্যস্ত মিয়ামি।
প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বিছানায় শুয়ে থাকবার পরও এক বিন্দু পরিমাণ ঘুমের দেখা পাচ্ছে না আর্শ।বিছানায় বারংবার পাশ বদল করছে সে।নিজের মাঝে এক অসহ্য অস্থিরতা অনুভব হচ্ছে তার।বিহানের সাথে দেখা হওয়ার দিন থেকে এখন অব্দি একবারও ড্রাগস নেয়নি ছেলেটি।প্রথম দু’দিন তেমন কিছু অনুভব না করলেও আজ নিজেকে সামলানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।ছেলেটির নিঃশ্বাস টাও কেমন যেনো একটু ঘন হয়ে এসেছে।
পড়ার মাঝেই আর্শের নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ ও বারংবার বিছানায় পাশ বদল করার বিষয়টি লক্ষ্য করে মিয়ামি।ওমনি ড্রাগসের বিষয়টি মনে পরে যায় তার।তড়িঘড়ি করে বই-খাতা বন্ধ করে মিয়ামি বিছানায় উঠে বসে।আর্শের দিকে চিন্তিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার হাতের উপর হাত রেখে নিম্ন স্বরে সে বলে ওঠে,
-খুব খারাপ লাগছে তোমার?
মিয়ামির প্রশ্নে তার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আর্শ।তার স্থির দৃষ্টি মিয়ামির চাহনিতে নিজের জন্যে চিন্তা,ভালোবাসা,আশ্রয় ও সহযোগিতা করার প্রবল ইচ্ছের ছাপ দেখতে পারছে।তার অসহায়,অস্থির মন একটুখানি ভরসা,আশ্রয়,সহযোগিতারই তো সন্ধানী।নিজের শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিয়ে হুট করেই এক হেঁচকা টানে মিয়ামিকে বিছানায় ফেলে আর্শ।নিজে তার উপর ওঠে শুয়ে মিয়ামির চোখে চোখ রেখে ঘন নিঃশ্বাস ও অস্থির কন্ঠে সে বলে ওঠে,
-আই নিড ইউ,মিয়ু।
আর্শের কথাটি বলতে দেরি হলেও মিয়ামি তার ঠোঁটের আদরমাখা স্পর্শ আর্শের ঠোঁটে মাখতে দেরি করলো না।দু’হাতে আর্শের চুল খামচে ধরে নিবিড়ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় নিজের ভালোবাসাকে।নিজের ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা আর্শের ওষ্ঠদ্বয়ে ভালোবাসা প্রদান করে চলছে সে।এক-দু সেকেন্ড অতিবাহিত পাড় হবার পর আর্শ ও আর চুপ থাকে না।মিয়ামির কোমর আঁকড়ে ধরে শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে সেও ভালোবাসা প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পরে।
কিছু টা সময় এভাবে অতিবাহিত হবার পর আর্শ সরে আসে মিয়ামির কাছ থেকে।জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে ওঠে,
-একটা শান্তির ঘুম চাই,মিয়ু।দিতে পারবা?
মেয়েটির চোখেই সম্মতি দেখতে পারছে আর্শ।উত্তরে মিয়ামি কোনো বাক্য ব্যয় না করে নিজের হাতজোড়া প্রসারিত করে দেয়।এর দ্বারা একটি ভালোবাসাময়, প্রশান্তির স্থানের দেখা পায় আর্শ।ছেলেটিও আর সময় অপচয় না করে মিয়ামির বুকে মাথা রেখে শুয়ে শান্তিতে নিজের চোখজোড়া বুজে নেয়।মিয়ামির হৃদয়ের ধুকপুকানি স্পষ্ট অনুভব করছে আর্শ।এ শব্দ আর্শের মাঝে এক অন্য রকম শান্তি সৃষ্টি করছে।
দু’হাতে আর্শকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় চুলের মাঝেই চুমু দেয় মিয়ামি।এতে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আর্শের।সে আরো নিবিড়ভাবে মিয়ামিকে আঁকড়ে ধরে ঘুমানোতে মনোনিবেশ করে।
চলবে।