#প্রণয়_বর্ষণ (১১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____________
ভোর রাত থেকে ধুম জ্বর স্পর্শীর। ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে ভেজার ফলে জ্বরের জন্য গা পু’ড়ে যাওয়ার জোগাড়। সকাল থেকে জ্বর, ঠান্ডা, মাথা ব্যাথার জন্য বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না। এই অবস্থায় রেখে তানিয়াও ভার্সিটি যায়নি। রেণু আপা ঠান্ডার মধ্যেই ২ বার জলপট্টি দিয়েছে। ওষুধ খাওয়ার পর থেকে ঘুমাচ্ছে। সামিরা তানিয়ার কাছে কল দিয়েছিলো। তানিয়া স্পর্শীর কথা বলায় সবগুলো ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে চলে এসেছে তানিয়ার বাড়ি। একেই তো ফাঁকিবাজ তারওপর আবার স্পর্শীর জ্বর! তাই কি আর কেউ ক্লাস করে! সাফিন, সামিরা, নীরব, নাহিদ সবাই এসে বসে আছে। সাফিন তানিয়াকে বলে,
‘তুই কি আমাদের এমনে খালি মুখে বসায় রাখবি? অন্তত চা বিস্কুট তো দে!’
তানিয়া একটা কুশন ছুড়ে মে’রে বলে, ‘হা’রা’ম’জা’দা তুই কি এখানে চা বিস্কুট খায়তে আসছিস?’
‘লে বাবা! আমরা আসছি তোর বাড়ি আর তুই চা বিস্কুট দিবি না?’
রান্নাঘর থেকে রেণু আপা চা, নাস্তার ট্রে আনতে আনতে বলে, ‘আপনের চা বিস্কুট এইহানে ভাইজান।’
সাফিন গদগদ হয়ে বলে, ‘এই তো। তুমি কত্তো ভালো রেণু আপা! তুমি না থাকলে এই ডা’ই’নী তো আমাদের না খাইয়েই রাখতো।’
তানিয়া আরেকটা কুশন ছু’ড়ে মা’রে। সামিরা ঠা’স করে একটা কি’ল বসায় সাফিনের পিঠে। কটমট করে বলে, ‘রা’ক্ষ’স কোনকার! বাড়ি থেকে খেয়ে আসিস নাই? এখানে আসছিস স্পর্শীকে দেখতে আর তুই খাওয়া খাওয়া করতেছিস!’
সাফিন নিজের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘আরেহ ওকে দেখতে আসছি বলে কি খাবো না বল!’
সামিরা কপাল চাপড়ায়। স্পর্শী চেঁচামেচি শুনে দুর্বল শরীর নিয়েই ধীরে ধীরে লিভিং রুমে আসে। স্পর্শীকে দেখে এগিয়ে আসে রেণু আপা। কাঁধ আঁকড়ে নিয়ে এসে ধরে বসায়। সাফিন ব্যস্ত গলায় বলে,
‘এই শরীর নিয়ে তুই এখানে আসলি কেন?’
স্পর্শী জবাব দেওয়ার আগেই সামিরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তোর মাইকের মতো গলা নিয়ে এমন চিল্লাইলে কি রুমে থাকতে পারবে?’
নাহিদ বলে, ‘আসলেই! আমি বুঝি না ওর গার্লফ্রেন্ডরা ওরে টলারেট করে কেমনে?’
নীরব দাঁত বের করে বলে, ‘ওর অনেক টেকনিক আছে তাই না বন্ধু?’
সাফিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। নীরব কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে। স্পর্শী হেঁসে বলে, ‘তোরা সবাই এখানে কেন?’
সামিরা বলে, ‘আমাদের কথা বাদ দে। তোর জ্বর কমছে? ডক্টরের কাছে গেছিলি?’
তানিয়া পাশ থেকে বলে, ‘হ্যাঁ। আমি ওষুধ আনছি।’
সাফিন স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলে, ‘তোর জ্বর কেমনে আসলো? কাল তো সবই ঠিক ছিলো।’
কাল সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে যায় স্পর্শীর। মুহুর্তেই হার্ট বিট বেড়ে যায়। শ্বাস নিতে থাকে বার বার। রুদ্রের কথা গুলো বার বার যেনো ভেসে আসে। স্পর্শীকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ বলে,
‘কি হয়ছে বল তো?’
স্পর্শী নিজেকে সামলে মাথা নিচু করে বলে, ‘আসলে কাল বৃষ্টিতে ভিজে গেছিলাম।’
সাফিন ঠোঁট চেপে হেঁসে বলে, ‘ওহ আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার! বলি এতো তাড়াতাড়ি প্রেম শুরু হয়ে গেলো?’
স্পর্শী চমকে তাকায়। বাকি সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সামিরা কপালে ভাজ ফেলে বলে, ‘হয়ছে টা কি?’
সাফিন ভ্রু নাচিয়ে স্পর্শীকে ঈশারা করতে থাকে। স্পর্শীও মাথা নাড়িয়ে ‘না না’ করে। তানিয়া ঠা’স করে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয় সাফিনের গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘বলবি নাকি আরো দেবো!’
সাফিন গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে তাকায়। মিনমিনে স্বরে বলে, ‘কাল রুদ্র ভাই আসছিলো।’
সবাই হা করে তাকায়। স্পর্শী চোখ মুখ খিচে বসে থাকে। নীরব গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলে, ‘বডি বিল্ডার আসছিলো! এতোদিন পর? কিন্তু এর সাথে ওর প্রেমের কি সম্পর্ক?’
নাহিদ কপাল চাপড়ায়। বলে, ‘গা’ধা চুপ কর। এই স্পর্শী তুই একবারও আমাদের বললি না কেন?’
স্পর্শী কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় সাফিনের দিকে। বলে, ‘ওয়েট! এক মিনিট। এই তুই তো আমার আগে চলে গেছিস তাহলে কেমনে জানলি রুদ্র ভাইয়ের কথা? তার মানে আগে থেকেই জানতি?’
সাফিন দাঁত কেলায়। স্পর্শী নিজের কপালে ২ টা চাপড় দেয়। বলে, ‘তাই তো বলি তুই হঠাৎ করে আমারে রেখেই চলে গেলি কেন? সবগুলা ব’দ’মা’য়ে’শ।’
সাফিন মাথা চুলকায়। এরপর সবাই দুপুর পর্যন্ত সেখানেই থাকে। অনেক আড্ডা গল্পের মধ্যে সময় কেটে যায়। দুপুরের পর সবাই লাঞ্চ করে যে যার বাড়ি চলে যায়৷ স্পর্শী সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমায়৷ সন্ধ্যার পর ঘুম থেকে উঠে কিছু খেয়ে আবার শুয়ে থাকে। জ্বর কমার বদলে বেড়েই চলেছে। দুর্বল শরীর নিয়ে চুপ করে শুয়েই থাকে।
রাত ৮ টার দিকে তানিয়া স্পর্শীকে জলপট্টি দিচ্ছিলো সে সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। তানিয়া ভাবে বাড়িওয়ালা আসছে তাই বিরক্ত হয়। রেণু আপাকে বসতে বলে নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপারে অস্থির রুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকায় তানিয়া। রুদ্র তানিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছুট লাগায় ভেতরে। তানিয়া কোনো রকমে দরজা লাগিয়ে দৌড়ে আসে। রুদ্র ততক্ষণে স্পর্শীর রুমে ঢুকে গেছে। হুট করে রুদ্রকে দেখে রেণু আপাও চমকায়। রুদ্র কিছু না বলেই স্পর্শীর পাশে বসে পড়ে। কপালে, গালে হাত ছোঁয়ায়। ব্যস্ত গলায় বলে,
‘ওর এতো জ্বর কিভাবে আসছে? ডক্টর দেখাইছো আপা?’
তানিয়া পেছন থেকে বলে, ‘কাল বৃষ্টিতে ভিজার জন্য জ্বর আসছে। আর ওষুধ তো আমি আনছিলাম।’
রুদ্রর আওয়াজ পেয়ে চোখ পিটপিট করে তাকায় স্পর্শী। রুদ্রকে সামনে বসে থাকতে দেখে ঠোঁট চওড়া করে হাসে। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
‘জ্বর আসছে দেখে কি মাথাটাও খা’রাপ হয়ে গেছে তোর? শুধু শুধু বো’কার মতো হাসছিস কেন?’
স্পর্শী দুর্বল গলায় কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। রুদ্র রেণু আপার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওকে কিছু খাইয়েছো?’
‘সইন্ধ্যা বেলা শুধু একটু আপেল খাইছিলো।’
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রেণু আপাকে খাবার আনতে বলে নিজেই পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করে। তানিয়া হাসে। দরজার পাশ থেকে হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘শেষ পর্যন্ত বান্ধবী আমার প্রণয়ে জড়ালো৷ তবে যত যায় হোক বলতে হবে বডি বিল্ডারের ধৈর্য প্রচুর। নয়তো কি প্রণয়ে বিদ্বেষী মেয়েটার জীবনেও প্রণয় বর্ষণ হতো! আসলেই সঠিক মানুষ পেলে বোধহয় ভালোবাসা সুন্দর হয়।’
দুজনকে একা ছেড়ে দিয়ে তানিয়াও সরে যায়। রেণু আপা খাবারের প্লেট দিয়ে নিজেও রুম থেকে বের হয়ে যায়। এই ঠান্ডার মধ্যে জলপট্টি দিতে নিজেই কেঁপে উঠছে রুদ্র। সারাদিন কাজের পর শরীর ভীষণ ক্লান্ত। স্পর্শীকে তুলে বসায় সে। খাবার মুখের সামনে নিতেই স্পর্শী খাবে না বলে জিদ করে। জ্বরের জন্য সবটাই তিতকুটে লাগছে। রুদ্র জোড় করিয়ে খাইয়ে দিয়ে শুইয়ে দেয়।
______
ভোর বেলা ঘুম ভেঙে যায় স্পর্শীর। জ্বর পুরোপুরি না ভালো হলেও কমেছে বেশ অনেকটা। শরীর ব্যাথায় হাত পা নাড়াতেই কষ্ট হচ্ছে। কোনোরকমে উঠে বসতেই হাতে টান পড়ে। পাশ ফিরে তাকিয়ে রুদ্রকে দেখে চমকায় স্পর্শী। ঘুম পুরোপুরি চলে যায়। স্পর্শীর হাত রুদ্রের হাতের মধ্যে দেখেই টাস্কি খায়। কোনো রকমে ঢোক গিলে আশে পাশে তাকায়। হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উঠে যায় রুদ্র। ঘুম ঘুম চোখেই স্পর্শীর কপালে হাত ছুঁইয়ে বলে,
‘জ্বর কমেছে! এখন কি কষ্ট হচ্ছে তোর?’
স্পর্শী উত্তর না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় চটপট। দ্রুত উঠে রুদ্রের সামনে আসে। ব্যস্ত গলায় বলে, ‘আপনি এখানে কি করছেন? রেণু আপা কই? আর আপনি কি সারা রাত এখানেই…’
রুদ্র হাত বগলদাবা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্পর্শীর দিকে৷ তারপর উত্তর না দিয়েই চুপচাপ স্পর্শীর বিছানায় শুয়ে পড়ে৷ লেপ গায়ে জড়িয়ে গুটিসুটি মে’রে শুয়ে বলে, ‘আমি এখন ঘুমাবো। সারা রাত ঘুম হয়নি। যা প্রশ্ন করার ঘুম থেকে উঠার পর করিস। এর আগে একটাও কথা না।’
স্পর্শী কিছু বলতে নিলে রুদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘নো মোর ওয়ার্ডস।’
স্পর্শীও চুপ করে যায়। এই ঘা’ড়’ত্যা’ড়া লোক যে তার প্রশ্নের উত্তর দেবে না সেইটা সে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে। দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়৷ পাশের রুমে তানিয়া আর রেণু আপাও ঘুমাচ্ছিলো। দরজা খুলা দেখে কিছু না ভেবেই চটপট রুমে ঢুকে পড়ে। তানিয়াকে টেনে তুলে বসিয়ে গড়গড় করে বলে,
‘রুদ্র ভাই এখানে কি করছে? তাও আমার রুমে কেন? কখন আসছে? আর উনি..উনি কি সারারাত আমার রুমেই ছিলো?’
তানিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে আবার ঠা’স করে শুয়ে পড়ে। স্পর্শী কপাল চাপড়ে রেণু আপাকে তোলে। রেণু আপা উঠে চোখ ভালো করে ডলে বলে, ‘এত্তো হক্কাল হক্কাল উঠছো ক্যারে আপা? জ্বর কমছে নি?’
স্পর্শী বলে, ‘ধুর জ্বর ছাড়ো। তুমি বলো রুদ্র ভাই আমার রুমে কেন? আর তুমি এখানে কেন?’
‘শান্ত হও আগে। হারারাত আমরা তোমার রুমোই আছিলাম৷ আযানের দিক দিয়া এই রুমো আইছি। আর রুদ্র ভাইজান কালকা রাইতে আয়ছে। তোমার জ্বর অনেক বাইড়া যাওয়ার কারণে আর বাড়ি যায় নাই।’
স্পর্শী আর কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। রেণু আপা হেঁসে বলে, ‘তুমিও না আপা! বাইরে গিয়া বসো আমি চা আনতাছি তোমার লাইগা।’
স্পর্শী মাথা নাড়ায়। তারপর নিজে গিয়ে বসে থাকে লিভিং রুমের সোফায়। রেণু আপা ফ্রেশ হয়ে চা এনে দেয়। স্পর্শী একটু খেয়েই রেখে দেয়৷ চিন্তায় তার দম যাওয়ার মতো অবস্থা। বাড়িওয়ালা যদি জানে রুদ্র আসছে তাহলে তো নিশ্চিত বাড়ি থেকে বের করে দেবে। টেনশনে রুমের এক মাথা থেকে আরেক মাথা চড়কির মতো ঘুরতে থাকে। তানিয়া ঘুম থেকে উঠে স্পর্শীর এ অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
‘এমন পাগলের মতো করছিস কেন?’
স্পর্শী জবাব দেয় না। সকাল ৯ টার দিকে রুদ্রের ঘুম ভাঙে। ফ্রেশ হয়ে এসেই লিভিং রুমে বসে। স্পর্শী তার কাছে এগিয়ে এসে বলে, ‘আপনি আর কতক্ষণ থাকবেন? বাড়িওয়ালা দেখলে ঝা’মেলা করবে। দ্রুত চলে যান না!’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘বাই এনি চান্স তুই আমাকে বের করে দিচ্ছিস!’
স্পর্শী কিছু বলার আগেই তানিয়া বলে, ‘একদমই নাা। ওই খা’রুশ বাড়িওয়ালা যা বলে বলুক একদম কান দিবেন না।’
চলবে..