#প্রণয়_বর্ষণ
#সূচনা_পর্ব
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
‘মা মা’রা যাওয়ার ৩ দিনের মাথায় যখন বাবা নতুন বউ নিয়ে হাজির হয়েছিলো তখন কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম। সবে কৈশরে পা দেওয়া, চঞ্চল আমি মায়ের মৃ’ত্যুতে যতটা না চুপ হয়েছিলাম ততটাই চুপ হয়ে গেছিলাম বাবার এমন নি’ষ্ঠুর দৃশ্যে। শুনেছিলাম মা আর বাবার নাকি প্রণয়ের বিয়ে ছিলো অথচ আমার মা মা’রা যাওয়ার ৪০ টা দিনও আমার বাবার সহ্য হয়নি! এই কি তবে প্রণয়ের দাম! সেদিন থেকেই প্রণয় ঘটিত বিষয়গুলোর ওপর কেন জানি ঘৃ’ণা আসতে শুরু করলো। মনে হতো এমন প্রণয়ের কি মানে যে প্রণয়ে মানুষটা না থাকলে ভালোবাসার ঘাটতি হয়!’
কথাগুলো একদমে বলেই থামে স্পর্শী। মলিন হেঁসে তাকায় বান্ধবী তানিয়ার দিকে। বান্ধবী তার অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নেয় স্পর্শী। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আবারও বলে,
‘মা নাকি ভীষণ ভালোবেসে আমার নাম রেখেছিলো স্পর্শী। বাবাও খুব ভালোবাসতো। তবে তা মা মা’রা যাওয়ার পরই হারিয়ে গেলো। নতুন বউ নিয়ে আমার বাবা আর দাদী এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে তাদের মাথায়ই ছিলো না আমার মা মা’রা গেছে মাত্র ৩ দিন আগে। আমি মায়ের শোকে কাতর ছিলাম। বাবাকে কিছু না বলে সেদিন চুপচাপ ঘরের এক কোণায় বসে মায়ের ছবি বুকে আঁকড়ে হাউমাউ করে কেঁদেছি। আমার কান্নার শব্দেও কেউ আসেনি সান্ত্বনা দিতে! শুধুমাত্র একটি মানুষ এসেছিলো। কে এসেছিলো জানিস! আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটি রেণু আপা। উনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। নিজের ভাগ্যের ওপর সেদিন আমার মারাত্মক হাসি পেয়েছিলো। টানা ৩৭ দিন আমি ঘরের বাহিরে যায়নি। মা মা’রা যাওয়ার যেদিন ৪০ দিন সেদিন ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। এতো গুলো দিনেও কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। রেণু আপা সময় মতো খাবার দিয়ে যেতো, অনেক সময় খাইয়েও দিতো। রাতে আমার সাথে ঘুমাতো। বাকিটা সময় একা থাকতাম। যেদিন ঘর থেকে বের হয়েছিলাম সেদিন থেকে অন্যরকম হয়ে গেলাম। সহজ, সরল, দুষ্টু প্রকৃতির মেয়েটা হয়ে গেলো গম্ভীর, বুঝদার। বাবার এতেও যায় আসলো না। আমারও তার ওপর তৈরী হলো ঘৃ’ণার এক শহর। তাকে দেখলেই ঘৃ’ণায় আমার গা গুলাতো। মেয়েরা নাকি বাবাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে! অথচ আমি কেবল ঘৃ’ণায় করে গেলাম। যখন দিন দিন সময় এগোতে লাগলো তখন আমার জীবনের চক্রও ঘুরতে লাগলো। বাবার নতুন বউ প্রথম দিকে তেমন কিছু না বললেও পরে গোপনে আমাকে অ’ত্যা’চার করতে থাকলো। প্রথম প্রথম মুখ বুজে সহ্য করতাম সব। একদিন একটা কাজে ভুল হয়েছিলো বলে আমাকে ফেলে নি’র্মম ভাবে আঘাত করেছিলো। সেদিন দাদী ফুপির বাড়ি গেছিলো আর বাবা অফিসে। বাড়িতে রেণু আপা ছিলো। আমাকে র’ক্তাক্ত অবস্থায় যখন ফেলে চলে গেলেন মহিলা তখন রেণু আপা কাঁদতে কাঁদতে বুকে জড়িয়ে নিলেন। দাড়োয়ান কাকার সাহায্যে নিয়ে গেলো হসপিটালে। র’ক্তও তিনিই দিলেন। সেদিন থেকেই আমি তাকে বড় বোনের থেকে বেশি ভালোবাসি। বাবা খোঁজও নিলেন না। আমার জ্ঞান আসার পর থেকে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। বাঁচতে হলে বাঁচার মতো বাঁচবো। এ শহরে, এ নি’ষ্ঠুর পৃথিবীতে চুপ করে থাকলে আরো পেয়ে বসবে এরা। তাই সেদিন থেকে বদলানো শুরু করলাম। বাবার ২য় স্ত্রী যখনই আমাকে কোনো কাজের কথা বলতো সরাসরি ‘পারব না’ বলে দিতাম। উনি একদিন তেড়ে আসলেন আমাকে মা’রবে বলে। আমারও মারাত্মক রাগের চোটে পাশের ডাইনীং টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে তা ফাটিয়ে কাচ সামনে ধরেছিলাম। ব্যস সেদিন থেকেই বাবার চক্ষুশুল হলাম। বাবা একবারও জিজ্ঞেস করলেন না আসল ঘটনাটা কি! আমিও পাত্তা দেয়নি। এরপর থেকে কখনও ওই মহিলাও আমাকে মা’রার সাহস পায়নি। রেণু আপা সব সময় আমার সাথে থাকতেন। এভাবেই চলছে জীবন।’
তানিয়া হুট করেই স্পর্শীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। স্পর্শী নির্বাক। শেষ কবে সে কেঁদে ছিলো তার মনে নেই। আসলে ম্যাচুরিটি মানুষের বয়সের সাাথে সাথে আসে না। আসে পরিস্থিতির সাথে। স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানিয়ার পিঠে হাত রাখে। তানিয়া কিছুটা শান্ত হতেই স্পর্শী মৃদু হেঁসে বলে,
‘তোর কান্না কাটি শেষ হলে চল। আর এসব কথা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। তুই আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। তাই অনেক দিন পর বললাম। প্লিজ তুই এগুলো নিয়ে কারো সাথে ডিসকাস করিস না।’
তানিয়া কান্না করা অবস্থাতেই স্পর্শীকে একটা গাট্টা মারে। তাদের বন্ধুত্ব কলেজ লাইফ থেকে শুরু হয়েছে। তখন থেকেই দেখে আসছে স্পর্শী তার বাবাকে ঘৃ’ণা করে। অনেকদিন জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ হয়নি। আজ অনেক জোড়াজুড়ির পর বললো তার করুণ অতীতের কথা। এতো এতো প্রপোজ পাওয়া স্বত্বেও কেনো মেয়েটা প্রেমঘটিত বিষয়গুলোতে থাকতো না তা বুঝে আসতো না তানিয়ার। আজ সবটাই খুব ভালো করে বুঝলো সে। তানিয়া ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে মুখ মুছে নিলো। স্পর্শীও ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। তারপর ব্যাগ নিয়ে ২ বান্ধবী বেড়িয়ে আসে রুম থেকে। লিভিং রুম কাটিয়ে যখন বের হতে যাবে তখনই কানে আসে তার বাবার গম্ভীর আওয়াজ। স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকায়। শাহাদাৎ শেখ বলেন,
‘তোমাকে তো বলেছিলাম আজ কোথাও যাবে না তুমি। আজ তোমাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। তাও তুমি বের হচ্ছো কোন সাহসে!’
স্পর্শী হাত বগলদাবা করে ভালো মতো দাড়ায়। বাকা হেসে বলে, ‘মি. শাহাদাৎ শেখ আপনি হয়তো কাল শুনতে পাননি আমি আপনাকে বলেছিলাম যে এই সময় আমি কোনো রকম বিয়ে টিয়ে করবো না। আর বাবার দায়িত্ব যখন এতোদিন পালন করেননি তখন এখনও করতে আসবেন না প্লিজ। আপনার এই ন্যাকামো দেখলে আমার ঘৃ’ ণার পরিমাণ বাড়ে বয় কমে না।’
স্পর্শী এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে গটগট করে বের হয়ে যায়। অ’পমানে মুখ থমথমে হয় শাহাদাৎ সাহেবের। তানিয়া হা করে তাকায় স্পর্শীর দিকে। বলে,
‘বান্ধবী তুই এমনে মুখের ওপর কেমনে বলস রে? আমারেও শিখা আমি শিখমু।’
স্পর্শী হাই তুলে বলে, ‘একটু আগে না ছিচকাদুনীর মতো কাঁদছিলি এখনই আবার মুড চেঞ্জ হইলো কেমনে?’
তানিয়া মন খারাপ করে বলে, ‘ধুর। আমি আর কিছুই বলবো না।’
ঠোঁট চেপে হাসে স্পর্শী। একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়ে দুই বান্ধবী। দুজনের হালকা কথোপকথনে চলে আসে ভার্সিটি। দুজনেই ক্যাম্পাসে এসে তাদের বন্ধুদলকে খুঁজতে থাকে। বটগাছের নিচে নাদিম, নীরব, সামিরাকে বসে থাকতে দেখে ওরাও এগিয়ে আসে। স্পর্শী নীরবের মাথায় ব্যাগ দিয়ে মে’রে বলে,
‘কি রে মাথা মোটা তোর সাথের আরেকটা কই?’
নীরব থমথমে মুখে অন্যদিকে তাকায়। বলে, ‘খবরদার আমাকে মাথামোটা বলবি না। আমি মোটেও মাথা মোটা নয়। আর সাফিন গফরে নিয়া কক্সবাজার গেছে।’
সামিরা চোখ বড় বড় করে বলে, ‘এই এই তুই কি বললি! সাফিন গফরে নিয়ে কক্সবাজার গেছে মানে! সাফিন তো বলছিলো ‘ও’ কোনো ট্রিপে যাচ্ছে ক্লাব থেকে।’
নীরব জিভ কাটে। সত্যি কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে ভেবে নিজেই নিজেরে বকতে থাকে। বাকি সকলে তার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আসল সত্য জানার জন্য। নীরব ৩২ টা দাঁত বের করে হাসি দেয়। বাকি সবার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে তাই সবাই নিজেদের মতো ঠিকঠাক হয়ে বসে। নাদিম নাক ছিটকে বলে,
‘আসলেও তুই একটা মাথামোটা। পেটে কোনো কথায় থাকে না। সাফিন আসলে তোর ১২ টা বাজাবে।’
সামিরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নাদিমের দিকে। রাগী স্বরে বলে,
‘তার আগে আম্মু ওর ১২ টা বাজাবে।’
তানিয়া পাশ থেকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘তুই না সাফিনের যমজ বোন তাহলে ওরে এতো হিংসা করস কেন?’
সামিরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলে, ‘তোর এতো দরদ লাগে কেন রে! ‘ও’ যখন আমারে আম্মুর কাছে বকা খাওয়ায় তখন তো দরদ দেখাস না!’
তানিয়া ভেংচি কাটে। স্পর্শী এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে এদের ঝগড়া দেখছিলো। এবার দাঁত বের করে বলে, ‘দোস্ত একটা ডায়লগ বের হয়ছে না! ওই যে ‘জান’স কক্সবাজার যাবা!’ সাফিন দেখি সত্যিি সত্যি গেছে গা। আমাদের বললে তো আমরাও যায়তাম।’
তানিয়া হা হুতাশ করে বলে, ‘ঠিক কয়ছোস বান্ধবী। আহারে সাফিন এখন একা একা গফরে নিয়া আরামে ঘুইরা বেড়াবে।’
‘এটা কি হতে দেওয়া যায় গায়েস!’
একসাথে সবাই ‘না’ বলে ওঠে। স্পর্শী চাপা হেঁসে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল দিতে থাকে সাফিনের নাম্বারে। বেচারা সাফিন হয়তো আগেই টের পেয়েছিলো এমন কিছুর তাই তো সে ঠুস করে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। তানিয়া ঠোঁট উল্টে বলে,
‘শা’লা বেয়া’দ্দব কবে থেকে এতো ট্যালেন্টেড হয়ে গেলো!’
স্পর্শীসহ সবাই খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। তানিয়া নিজেও হেঁসে দেয়। স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে আপনমনে আওড়ায়, ‘তুই আমাদের সাথে কত নরম অথচ নিজের বাড়ির লোকের কাছে কি ভীষণ কঠিন! তোকে মাঝে মাঝে আমিই চিনতে পারি না রে। তুই আসলে কোনটা? খিলখিল করে হেঁসে ওঠা স্পর্শী নাকি গম্ভীর গলায় আওয়াজ তোলা স্পর্শী! তবে তুই ভেতর থেকে ভীষণ ভালো। আজীবন এমনই থাকিস। তোর প্রণয় নিয়ে ভুল ধারণা যেনো ভেঙে যায়। তোর জীবনেও প্রণয় আসুক। তোর সব দুঃখ কে নিজের সুখের ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিক। রঙহীন জীবনকে রঙিন করুক। প্রণয় বর্ষণ হোক তোর জীবনে!’
সবাই গল্পে মেতে ওঠে। সবার গল্পের মাঝেই কেউ পেছন থেকে ডেকে ওঠে, ‘হেই মিস ব্ল্যাক কুইন!’
স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকাতেই দেখে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শীর চোখে মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। তাতে সামনে দাঁড়ানো কারোরই যে কিছু যায় আসে না তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তানিয়া স্পর্শীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,
‘দোস্ত এইটা বডি বিল্ডার রুদ্র না!’
স্পর্শী মারাত্মক বিরক্তি নিয়ে তাকায় তানিয়ার দিকে। তানিয়া ভড়কে গিয়ে সরে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়ানো রুদ্র দাঁত বের করে বলে, ‘আমাকে কি চিনছেন মিস ব্ল্যাক কুইন! নাকি পরিচয় দিতে হবে!’
স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘বাড়িতে তো আপনার নানু, মামা, মামি কেউ শান্তি দেয় না এখন কি ভার্সিটির শান্তিটাও কেড়ে নেওয়ার পণ করেছেন!’
রুদ্রের পাশে দাঁড়ানো তার চ্যালা পান খাওয়া লাল দাঁতে হেঁসে বলে, ‘আফামনি বস তো আপনার শান্তি কাইড়া নেওয়ার জন্যই আছে। ঠিক কইছি না বস!’
রুদ্র বাঁকা হাসে। হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘তোকে নাকি আজ দেখতে আসবে কোন পাত্রপক্ষ! তুই সেসব বাদ দিয়ে ভার্সিটিতে কেন?’
‘তাতে আপনার কি? আমার লাইফ আমি বুঝবো আপনার বা আপনাদের না ভাবলেও চলবে।’
রুদ্রর কপালের রগ ফুলে উঠলো। নিজেকে সামলে বলে, ‘তোর সাথে ঝামেলা করতে আসিনি পর্শী। বাড়ি যা।’
‘ডোন্ট কল মি পর্শী! আ’ম সায়ন্তিকা স্পর্শী।’
রুদ্র বাঁকা হেঁসে বলে, ‘সায়ন্তিকা স্পর্শী শেখ। রাইট?’
স্পর্শী জ্বলে উঠলো। সে নিজের নামের সাথে কখনোই তার বাবার নামের টাইটেল যুক্ত করেনি আর করবেও না। ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায়। রুদ্র ত্রুর হাসে। নীরব বিরবির করে বলে,
‘যুদ্ধ এবার সমানে সমানে লাগছে। না জানি ভার্সিটি উড়ে যায়!’
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ❤️)