#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ২০(অন্তিম)|
লাবিবা ওয়াহিদ
সিয়ামরা শতাব্দ’র দাদুবাড়ির লোক। কাপড় বুননে প্রায় শুরু থেকেই রুমার পাশে ছিল সিয়ামের মা। তাই পারিবারিক সম্পর্কটা তাদের গাঢ় হয়। সিয়ামের বাবা ছিলেন প্রবাসী। তার দেশের বাইরে স্নেকস শপ ছিল। তাই ভিনদেশী স্নেকস, ফাস্টফুড সবকিছুর রেসিপি-ই তিনি জানতেন। দেশে ছুটিতে আসলে অবসর সময়ে ছেলেকে কিছু না কিছু নিজে হাতে বানিয়ে খাওয়াতেন। সবকিছু এত সুস্বাদু এবং মজাদার ছিল। রান্নার ব্যাপারে সিয়ামের বাবা বেশ ট্যালেন্টেড ছিলেন। সেই ট্যালেন্টটা পেয়েছে সিয়াম। বাবার থেকে শিখে নিয়েছে। বাবা হঠাৎ পরদেশ ছেড়ে নিজ মাতৃভূমিতে চলে আসলেন। অসুস্থ ছিলেন কিছুটা। তার মন বলছিল বেশিদিন বাঁচবেন না। এজন্যে সে শেষ সময়টা পরিবারকেই দিয়েছেন। সিয়াম ততদিনে ঊনিশে পা দেয়। বাবার কাজের প্রতি তার আগ্রহ থাকায় বাবার থেকে সব কিছুই ধীরে সুস্থে শিখে নেয় সে। শেখার দু’বছরের মাথাতেই হঠাৎ একদিন গভীর রাতে ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করলেন সিয়ামের বাবা। এরপর কেউ টের পাওয়ার আগেই তিনি পরাপারে গমন করেন। বাবা হারা সিয়াম হয়ে পড়ে বড্ড একা। তখন তাদের মা-ছেলের ঢাল হয়ে দাঁড়ায় শতাব্দ এবং তার পুরো পরিবার। এই ঘটনা বেশি পুরোনো নয়। দেড় বছর আগের ঘটনা।
শতাব্দ সিয়ামের থেকে বছর দুয়েক বড়ো। তবুও দুজনের বেশ ভালো সম্পর্ক। কিছু বন্ধুত্ব আছে না, অত্যন্ত গভীর? মুখে না বললেও অপরজন তার সমস্যা বুঝে ফেলে? সেরকমই। বাবাকে হারানোর পর সিয়ামের দিনগুলো বড্ড কঠিন ছিল। মাকে গ্রামে কিংবা শতাব্দদের সঙ্গে রেখে কোনোরকমে অর্থ উপার্জন করত। পড়াশোনা শতাব্দ তখনো করছিল। আর সিয়াম পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। পড়াশোনার শেষের দিকে শতাব্দ হুট করেই একদিন সিয়ামের সামনে গিয়ে হাজির হয়। সিয়ামকে জানায় তারা দুজন মিলে একটা বেকারী করবে। সিয়ামের লুকায়িত সত্ত্বার সঠিক প্রয়োগ করবে। সিয়াম শতাব্দের মতো এত আত্মবিশ্বাস পায়নি। প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে শতাব্দের একরোখা স্বভাবের কারণে রাজি হতে বাধ্য হয়। এরপর শতাব্দ শুরু করে দেয় তার পরিকল্পনা। সিয়ামও তার কথামতো পুরানো রেসিপিগুলো বানিয়ে বানিয়ে চর্চায় রাখত।
——————————
নাস্তা শেষ করে সিয়ামের মা এসব গল্পই করছিল নম্রের সাথে। এর মাঝেই হঠাৎ প্রতিবেশি’রা হাজির হয় নতুন বউ দেখতে। যদিও নম্র এলাকারই মেয়ে। পথে-ঘাটে প্রায়ই তাকে দেখা যেত। কিন্তু এখন সে শতাব্দের বউ। তাকে নতুন রূপে, নতুন পরিচয়ে দেখতেই প্রতিবেশি’রা আয়োজন করে শতাব্দদের বাড়ি এসেছে। নম্র এত মানুষের ভীড়ে অস্বস্তি অনুভব করলেও তার দমে থাকতে হলো। যতই হোক, নতুন বউ বলে কথা। সবার মাঝ থেকে উঠে চলে যাওয়া মোটেই শোভা পায় না। এজন্যে সে মনে মনে দোয়া করল যাতে কেউ তাকে এখান থেকে নিয়ে যায়! দোয়াটা বোধহয় কবুল হলো। শতাব্দ এসে ডাকল,
–“নিঝুম এসেছে। ভেতরে আসো। এক্সকিউজ আস আন্টিরা!”
বলেই নম্রর দিকে শীতল নজরে তাকাল। নম্র আলগোছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শতাব্দের রুমে আসল। এসেই দেখল চঞ্চল এবং নিঝুম বসে। নম্রকে দেখতেই দুজনে ছুটে এলো তার কাছে। চঞ্চল তো কেঁদে দিবে দিবে ভাব। কাঁদো গলায় বলল,
–“তোমাকে ছাড়া বাসা খালি খালি লাগছিল আপু। আমি আর তোমার সাথে দুষ্টুমি করব না। তাও আমাদের সাথে চলো। আমি রোজ তোমাকে বার্গার খাওয়াব। আর এই বার্গার ভাইয়ার সাথে থাকতে হবে না!”
নিঝুম চঞ্চলকে থামিয়ে দিয়ে নম্রের উদ্দেশ্যে বলল,”তোমাকে বড্ড মিস করছিলাম আপু।”
নম্রের চোখ ভিঁজে উঠে। এই দুটো মানুষ তার কত আপন। কতটা আবেগঘন হয়ে কথা বলছে। পেছন থেকে ভরাট গলায় কেউ বলে উঠল,
–“পিচ্চি’রা কী বোনকে এখনই বাসায় নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছ নাকি?”
শতাব্দের কন্ঠ শুনে তিনজনই পিছে ফিরে তাকাল। নিঝুম দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–“জি না ভাইয়া। এমনিতেও বলছিলাম!”
হাসল শতাব্দ। এর মাঝে আনিশা ওদের জন্যে সরবত নিয়ে আসে। সঙ্গে জানায় নম্রকে তৈরি থাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যে পার্লারের লোকেরা আসবে। আনিশা চলে যেতেই শতাব্দ নম্রের কাছে আসে। নম্রের কানে কানে বলে,
–“আমার তখন নিঝুমদের বলতে ইচ্ছে করছিল, “এই পিচ্চিরা! আমার বউকে নিয়ে কোথাও যাওয়া চলবে না।” কিন্তু আফসোস, বাচ্চাদের সামনে শতাব্দ এসব বলে না।”
নম্র চোখ পাকিয়ে তাকাল। শতাব্দ চোখ টিপ দিয়ে চলে গেল। রিসিপশন হলেও নম্র বেশিক্ষণ থাকেনি প্রোগ্রামে। তার মানুষদের সামনে অনেক অস্বস্তি হয়। শতাব্দ সে ব্যাপারটা দেখেই নম্রকে নিয়ে তাহাফের কাছে চলে আসে। আরিফ সাহেব অর্থাৎ শতাব্দের বাবা কল করে ওদের ঠিকানা জানতে চাইলে শতাব্দ জানিয়ে দেয় তাহাফের কাছে আছে। এ কথা শুনে আরিফ সাহেব আর কথা বাড়াননি। নিজেদের মতো করে অতিথিদের সামলে নেন।
দুজন পাশাপাশি নরম ঘাসের ওপর বসে আছে। কয়েক হাত দূরত্বেই তাহাফের কবর। নম্র তাহাফের কবরের দিকে চেয়েই বলল,
–“আমার কিছু প্রশ্ন ছিল!”
–“তোমাকে আমার পছন্দ কবে থেকে সেটাই তো?”
নম্র মাথা নাড়ায়। শতাব্দ হালকা হেসে বলল,
–“তুমি জানো আমি জীবনে প্রথম ফুল তোমাকেই দিয়েছিলাম?”
নম্র চমকে তাকায়। না চাইতেও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শতাব্দের শাপলা বাড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য। নম্র অস্ফুট গলায় বলল,
–“শাপলা?”
–“হুম। সেদিন ঘুমন্ত বাচ্চা মেয়েটাকে কেন যেন খুব ভালো লেগেছিল। ঝামেলা তৈরি করা মেয়েটা যে সময়ের ব্যবধানে মনে গেঁথে যাবে সেটা বুঝিনি!”
–“আমিও জীবনে প্রথম ফুল আপনার কাছেই পেয়েছিলাম!”
–“সেই এইটে পঁড়ুয়া তুমি কী করেই বা ফুল পেতে?”
বলেই শতাব্দ হো হো করে হেসে ওঠে। পরে হাসি থামিয়ে কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“ক্লাস এইটে পঁড়ুয়া পিচ্চিকে আমার পছন্দ হয়ে গেছিল কীভাবে এটাই আমার বুঝে আসছিল না। আমিও তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। বয়সের কারণে আবেগঘন ছিলাম ভেবেই নিজের প্রতি বিরক্ত ছিলাম। তবুও মন পিচ্চিটার দিকেই টানত। এইচএসসির ঠিক আগে গিয়েই যেন দমে থাকা অনুভূতি গুলা বেড়ে যায়। কিন্তু তুমি তো আমার জন্যে নিষিদ্ধ ছিলে। বারবার মনে হতো বোনসম মেয়েটাকে নিয়ে কী করে এসব চিন্তা করব? এজন্যই হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম অনার্স দূরেই কমপ্লিট করব। এজন্যে হুট করে চলে গেলাম। কিন্তু সেখানেই বিরহে ডুবে থাকতাম। সম্ভবত অনার্স থার্ড ইয়ারে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যত যাই হোক, তোমাকে আমি নিজের করে নিবোই। তুমি শুধু বড়ো হতে থাকো। এই ভাবনার পর থেকে নিজের মনে শান্তি পেতাম খুব। পড়াশোনা শেষ করে এদিক সেদিক ঘুরে ব্যবসায় মনোযোগী হলাম। তবে এখানে এসে দারুণ এক ব্যাপার উপলব্ধি করি। তুমিও কোনো না কোনো ভাবে আমাকে পছন্দ করো। প্রথমে নিশ্চিত ছিলাম না। পরে ইমনের থেকে সবটা শুনে অবাক হই। ইমনকে বোধহয় তোমার বান্ধুবী সব বলে দিয়েছিল। এরপর আর কী? তোমার বাসা থেকেও বিয়ের চাপ আসছিল এজন্যে আর দেরী করিনি!”
নম্র চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইলো শতাব্দের দিকে। যাকে ভেবে ঘুমাতে যেত সে-ই তার জন্যে এতটা ব্যাকুল ছিল? অথচ নম্র ভেবেছিল তার এই অনুভূতি এক পাক্ষিক। আর অর্ণা? এই মেয়েটার পেটে কী কোনো কথা থাকে না? ইমনকেই কেন সব ফড়ফড় করে বলতে হলো? কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে পড়ল নম্র। শতাব্দ নম্রের কপালে টোকা দিয়ে বলল,
–“আরও কিছুক্ষণ থাকবে? নাকি বাসার দিকে যাব?”
–“কোন বাসায় যাবেন?”
–“আপাতত আমার শ্বশুরবাড়িতে। বাবা তোমাকে নিয়ে সেদিকেই যেতে বলেছে!”
সন্ধ্যার পরপর নম্র’রা বাড়ি ফিরল। এসেই দেখতে পেল উপহারের সমাহার। সাবরিনা জানাল এগুলা নম্রের মহল্লার সেই বড়ো ভাইয়ারা পাঠিয়েছে। বিয়ের দিন তো আসতে পারেনি, তবে রিসিপশনে গিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে তখন নম্র ছিল না। এরপর আর কী। বাসাতেই উপহার পৌঁছে দিয়ে গেছে।
নম্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখল শতাব্দ নম্রের বিছানায় বসে আছে। নম্র পুণরায় ঘরের চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি ফেলল৷ কোথাও অগোছালো নেই তো? নিঝুম আবার এলোমেলো করে রাখেনি তো? নাহ, সব ঠিক আছে। নম্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শতাব্দের দিকে তাকাতেই দেখল শতাব্দ তার দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে। পরমুহূর্তে হো হো করে হেসে দিয়ে বলে,
–“তুমি না, এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলে। আন্টি নিশ্চয়ই নতুন জামাইকে অগোছালো ঘরে বসতে দিবে না?”
নম্র অপ্রস্তুত হলো, লজ্জায়ও আড়ষ্ট। ইশ, শতাব্দ ধরে ফেলেছে ব্যাপারটা। নম্র কোনোরকমে বলল, “খেতে আসুন। মা ডাকছে!”
সেদিন রাতে সাবরিনা বেশ জামাই আদর করল শতাব্দকে। এতই খাওয়ানো হয়েছে যে শতান্দ ঘুমানোর আগে রুম জুড়ে পায়চারী করছে। আর নম্র শুয়ে শুয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। শতাব্দ তা টের পেয়ে তড়িৎ নম্রের দিকে তাকাল। ভ্রু কুচকে বলল,
–“স্বামীর দুঃখে হাসতে নেই বউ। এটা কী জানো না?”
শতাব্দের মুখে “বউ” ডাকটা শুনলেই নম্র যেন অনুভূতিতে ভেসে যায়। কেমন থেমে থেমে বুক কেঁপে ওঠে। নম্র কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। শতাব্দ বাঁকা হেসে বলল,
–“খাবারটা হজম হওয়া অবধি যত খুশি কাঁথা মুড়ি দিতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। যখন আসব তখন কিন্তু বালিশ ছেড়ে বুকে ঠাঁই নিবে। একদিনেই আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছ তুমি নম্রতা।”
আনিশা জানালা দিয়ে একমনে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। নজর আটকে আছে তার জানালার বাইরের ঘন ঘাসের মাঝে একটি ছোটো কবরের দিকে। বাইরের সোডিয়াম আলো সেই কবরের উপর পড়ছে। আনিশা রিসিপশনের অনুষ্ঠান শেষ করে শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছে। খাওয়া-দাওয়া সেরে সেই যে জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তারপর থেকে আনিশার যেন হুঁশই নেই। আনিশার কোলে তখন ঘুমে নিভু নিভু তোহা। আনিশা ঝাপসা চোখে তাহাফের কবরের দিকে চেয়ে ভাঙা গলায় বলল,
–“তোহা মা, ওই দেখ! তোর ভাইটা কী সুন্দর করে ঘুমোচ্ছে। ঘুমানোর আগে তোর মাকে দেখে, তোকে দেখে হাসছিল। খিলখিল করে। দেখেছিস তুই?”
আনিশার প্রলেপের মাঝেই রিহাব আসল। আনিশার কাঁধে হাত রেখে বলল,
–“ঘুমোবে না?”
আনিশার চোখে টলমল জল এবার গাল গড়িয়ে টুপ করে পড়ল। ভাঙা গলায় বলল,
–“ছেলেটাকে প্রাণভরে আগে দেখে নেই রিহাব!”
রিহাব ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আনিশার কোল থেকে তোহাকে নিয়ে বিছানার দিকে যেতে নিতেই আনিশা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল রিহাবকে। পুণরায় ভাঙা গলায় শুধাল,
–“ধন্যবাদ রিহাব, আমাদের ছেলেটাকে আমাদের সাথে রাখার জন্যে। চাইলেই যখন তখন আমার ছেলেটার কাছে যেতে পারব। অনুভব করতে পারব।”
–“ধন্যবাদের কিছু নেই আনিশা। আমাদের ছেলেকে দূরে রাখার সাধ্যি আমার ছিল না। আল্লাহ ওকে নিয়ে গেলেও ওর দেহটা আমাদের বাগানেই থাকুক নাহয়। এই ভেবেই আমাদের কাছেই রেখেছি। এখন কেঁদো না। ঘুমাবে চলো!”
–“তুমি আসলেই একজন পারফেক্ট হাসবেন্ড আমার জন্যে, রিহাব। খুব ভালোবাসার তুমি!”
রিহাব মুচকি হাসে। মেয়ের সাথে স্ত্রীকেও নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। তখনই জানালার দিকে চোখ যায়। দমকা বাতাসে পর্দাগুলো উড়ছে। বাহিরেও পাতা ঝাপটানোর শব্দ হচ্ছে। রিহাব কবরের দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো তাহাফ ওখানে বসে হাসছে। রিহাবের চোখটা মুহূর্তে-ই ছলছল করে উঠল।
———————–
পরেরদিন সকালের নাস্তা সেরেই শতাব্দ বেকারীতে চলে যায়। দুপুরবেলা লোক দিয়ে কিছু ফাস্টফুড, মিষ্টান্ন পাঠায় নম্রদের বাসায়। সেসব পেয়ে নিঝুম আর চঞ্চল তো সেইরকম খুশি। রাতে আর শতাব্দ ফিরেনি। তবে ঘুমানোর আগে কল দিয়েছিল নম্রকে। কাতর গলায় বলেছিল,
–“কালকে সকালেই তোমাকে আমি নিয়ে আসব নম্র। এতদিন অনেক থেকেছ বাবার বাড়ি, এবার বাকিটা জীবন আমার সাথে থাকবে। বুঝেছ? তোমাকে ছাড়া আমার চলছে না।”
নম্রের ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে ওঠে। না চাইতেও রাজি হয়ে যায়। তবুও শতাব্দের মুখে ভালোবাসি শুনতে বড্ড ইচ্ছে করছে। নম্রকে অবাক করে দিয়ে শতাব্দ বলল, “ভালোবাসি নম্রতা। দ্রুত ফিরে আসো!”
নম্রের পড়াশোনা চলতে লাগে। শতাব্দ রোজ তাকে দিয়ে আসে আর নিয়ে আসে। এর মাঝে নম্র জানতে পেরেছিল সেদিন অনিকের কথা শতাব্দই বলেছিল ভাইয়াদের৷ মারপিটে শতাব্দ নিজে জড়িত ছিল। তার নম্রকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলেছে, শতাব্দ বুঝি তাকে ছাড় দিবে? নম্র সব শুনে বেশ অবাক হয়েছিল। অথচ শতাব্দ সবসময় এমন ভাব নিয়ে চলত যেন নম্র উচ্ছন্নে গেলেও তার কিছু যায় আসে না। অথচ এখন সরল ভাষায় শতাব্দ একজন বউ পাগল। মানুষের রূপ খুবই বিচিত্র।
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে। এমনই একদিন পরীক্ষা শেষ করে নম্র ভার্সিটি থেকে বেরুতেই শতাব্দকে দেখতে পায়। শতাব্দ নম্রকে দেখতেই তার হাত নিজ হাতে আগলে একটি উবারেরর দিকে হাঁটা দেয়। নম্র অবাক হয়ে বলল,
–“কোথায় যাচ্ছি?”
–“সারপ্রাইজ!”
বলেই শতাব্দ নম্রকে নিয়ে উবারে উঠে পড়ে। শতাব্দ উবারটি বুকড করে রেখেছিল। এজন্যে দুজন উঠতেই উবার চলতে শুরু করল। ঘন্টাখানেক এর মধ্যে দুজন ঢাকার বাইরে এলো। এ এক নতুন শহর নম্রের জন্যে। নম্র বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে শতাব্দকে, যে তারা কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। অতঃপর হাল ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। শতাব্দ হুট করে নম্রের কাঁধে মাথা এলিয়ে আবদার করে বলল,
–“চুলে হাত বুলিয়ে দাও না!”
নম্র চমকে যায়। কম্পিত হাতে কিছুক্ষণ হাত বুলায় শতাব্দের চুলে। আজ শতাব্দকে বেশ পরিপাটি লাগছে অন্যান্য দিনের তুলনায়। নম্র একপলক শতাব্দকে পর্যবেক্ষণ করে চোখ ফিরিয়ে নিল। ছেলেটার থেকে চোখ ফেরানো দায়।
উবার এসে দাঁড়াল কিছুটা ভীড়ের মধ্যে। শতাব্দ ভাড়া মিটিয়ে নম্রের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামল। শতাব্দকে দেখতে পেতেই দুজন ফটোগ্রাফার ওদের ছবি তুলল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে নম্রের চোখ কিছুটা বুজে আসে। ক্ষীণ স্বরে শতাব্দের উদ্দেশ্যে শুধায়,
–“কোথায় এসেছি?”
–“সামনে তাকিয়ে দেখো!”
নম্র মাথা তুলে চাইল। এবং ভীষণ অবাক হলো। নম্র শতাব্দের নতুন শাখা বেকারীর সামনে দাঁড়িয়ে। বেকারীর সামনেই কিছু সংখ্যক মানুষজন। সিয়ামকেও তাদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। নতুন শাখা মানে এখন তারা নারায়ণগঞ্জে আছে? নম্র অস্ফুট স্বরে শতাব্দের উদ্দেশ্যে বলল,
–“এসব কী?”
–“আজ নতুন শাখার উদ্ভোদন হবে। আসো!”
বলেই নম্রের হাত ধরে বেকারীর প্রবেশমুখে এসে দাঁড়ায়। প্রবেশমুখ লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা। একজন মেয়ে নম্রের সামনে গোলাপের পাঁপড়িতে সাজানো এক থালা নিয়ে হাজির হয়। সেই থালাতে একটি সোনালী রঙের কাচি। সেটা দেখে শতাব্দ বলে,
–“হাতে তুলে নাও!”
–“আ..আমি?” নম্রের কম্পিত গলা।
–“তো আর কাকে বলছি? দেরী করো না। তাড়াতাড়ি নিয়ে ফিতাটা কাটো!”
নম্র কাচিটা হাতে নিয়ে কম্পিত হাতে ফিতার দিকে এগোলো। শতাব্দ তার হাতের উপর হাত রেখে একসঙ্গে ফিতা কাটল। সঙ্গে সঙ্গেই তালির শব্দে পরিবেশ মুখোরিত হলো। নম্রের খুশিতে চোখ ভিঁজে ওঠে। ভেতরে আসতেই আবারও কেক কাটল। তবে এবার তিনজন, সিয়ামও ছিল। কেক ভাগাভাগির পর যখন সবাই নানান কথা বলায় ব্যস্ত তখন নম্র শতাব্দের বাহু জড়িয়ে ধরে। মিনমিন করে বলল,
–“ধন্যবাদ শতাব্দ। আমায় এতটা সম্মানীয় অনুভব করানোর জন্য!”
শতাব্দ সবার অগোচরে নম্রের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
–“তুমি অবশ্যই সম্মান ডিজার্ভ করো। হাসবেন্ডের সফলতা ওয়াইফও সমানভাবে উপভোগ করার অধিকার রাখে। তুমি আমার সম্মান, আমার ভালোবাসা নম্র। তাইতো গতবার বাবা-মাকে দিয়ে ফিতা কাটালেও এবার তুমি এলে।”
নম্র দুষ্টুমি করে বলল,
–“পরেরবার কাকে দিয়ে ফিতা কাটাবেন?”
–“কেন, আমার সন্তানের হাত দিয়ে। এরপর বাবা-মা, তুমি আর আমার সন্তানই বারবার রিপিট হবে। বুঝেছ? অনেক দূর যেতে হবে আমাদের!”
নম্র এবার লাজে লাল হল। দূরে সরে যেতেই শতাব্দ ভ্রু কুচকে বলল,
–“লজ্জা পাচ্ছ নাকি? সন্তান নিয়ে কিসের লজ্জা? একদিন না একদিন তো বাবা-মা আমাদের হতেই হবে। থাক, বাসায় গিয়ে লাজ ভাঙিয়ে দিব। দাদীও বলেছে সন্ধ্যার আগে বাসায় থাকতে।”
নম্র কিছু বলল না। নীরবে চেয়ে রইলো শতাব্দের দিকে। শতাব্দকে না পেলে হয়তো জানত না “ভালোবাসা সুন্দর!”
সমাপ্ত~~