প্রণয় পাড়ে সন্ধি পর্ব-১৯

0
581

#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ১৯|
লাবিবা ওয়াহিদ

পূর্বাকাশে অল্প অল্প করে সূর্যের দেখা মিলছে। পৃথিবীবাসীকে জানান দিচ্ছে এক নতুন দিনের সূচনা ঘটেছে। নম্রের নতুন জীবনে, নতুন পরিচয়ের নতুন সুচনা। এখন সে একজন মেয়ে হওয়ার পাশাপাশি একজন স্ত্রী হয়ে তার নতুন জীবনের সূচনা করবে। অর্ধাঙ্গের হাতটি ধরে নতুন করে চলবে নম্র। এই সুন্দর দিনটির সূচনায় নম্র শতাব্দের বুকে লেপ্টে রয়েছে৷ যা তার কাছে যেমন অবিশ্বাস্য, তেমনই ভালো লাগার। ছাড়া পাওয়ার খুব চেষ্টা করেছে। কিন্তু শতাব্দ তোয়াক্কা করেনি। সারা-রাত বুকে লেপ্টে থাকলেও ঘুম ভাঙার পর তো তাকে ছাড়বে? নম্র আলতো স্বরে ডাকল শতাব্দকে। শতাব্দ তখন ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
–“ডিস্টার্ব করো না তো। রাগ উঠলে জানালা দিয়ে ফেলে দিব তোমাকে। কিন্তু এত নরম বউকে তো ব্যথা দিতে পারি না৷ তাই ছটফট না করে নিজেও একটু ঘুমাও!”

নম্রের ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। এখন ঘুমাতেও পারছে না সে। এজন্যে শতাব্দের পেটের ডান পাশে চিমটি কাটল। শতাব্দ ঘুমের মধ্যে ছিল, যার ফলস্বরূপ শতাব্দ কিছুটা অপ্রস্তু হয়ে যায়। তার হাত আলগা হয়ে এলেই নম্র ঝট করে সরে আসে। শতাব্দের হাতের নাগালের বাইরে। শতাব্দ চোখ খুলে উঠে বসে বিরক্তির সাথে নম্রের দিকে তাকাল। থমথমে গলায় বলল,
–“বিয়ের প্রথম দিনটা চিমটি দিয়ে শুরু করাটা উচিত ছিল?”

নম্র আলতো হেসে বলল,
–“মোটেই চিমটি দিয়ে দিন শুরু হয়নি!”
শতাব্দের ভ্রু আরও কুচকে গেল। ভাবুক গলায় বলল,
–“তাহলে ঘুমন্ত আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়াটা দিনের শুরু ছিল নাকি?”

নম্র কিছুটা চমকে যায় শতাব্দের কথা শুনে। কিছুটা লজ্জায়ও পড়ে গেল। মানুষ হবে না লোকটা। ঘুমের মধ্যেও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে কেন? সবসময় দুই কাঠি বেশি বলতেই হবে তার। ঠোঁটকাটা লোক একটা। শতাব্দ নম্রের উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার শুয়ে পড়ল। শুতে শুতে বলল,
–“থাক! গিলে খাও কিংবা হজম করে নাও সেটা তোমার ব্যাপার। একমাত্র বর বলে কথা। এটুকুতে আমার বারণ নেই!”

বলেই নম্রের বালিশটা বুকে নিয়ে অন্য পাশে ফিরে চোখ বুজল। নম্র বাথরুমের দিকে যাওয়া ধরলেই শতাব্দ বলে ওঠে,
–“নয়টার আগে খবরদার জাগাবে না৷ ঘুমে ডিস্টার্ব করা একদম পছন্দ করি না আমি। তুমি বউ বলে একটু কম্প্রোমাইজ করেছি!”

মানে কী? নম্র কখন তার ঘুম ভাঙাল? সে অবশ্যই চিমটির জন্যে ঘুম থেকে উঠেনি সেটা নম্র বেশ ভালো করে জানে। আগে থেকেই জেগে ছিল। নম্র চোখ গরম করে তাকাল শতাব্দের দিকে। বিড়বিড় করে বলল,
–“অসভ্য লোক!”

ফ্রেশ হয়ে নম্র বারান্দায় এসে বসেছে। মধুময় সকালের আরম্ভ দেখছে সে। আকাশের দিকে আনমনে চেয়ে থাকল সে। অধরে হাসি, প্রাপ্তির হাসি। গত বছরের এই সময়েও বোধহয় ভাবতে পারেনি শতাব্দ তার হবে। পুরো এক রাত শতাব্দের গা ঘেঁষে ঘুমাবে। সকালে উঠে খুনশুটি করবে। তখনো কী জানত শতাব্দ তাকে ভালোবেসে বিয়ে করবে; শতাব্দ তার অসভ্যপণা, ভালোবাসা সব তার বউয়ের জন্যে জমিয়ে রেখেছিল? নম্র বিশাল আকাশের পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
–“দেখো আকাশ, আমার প্রণয় পাড়ের সন্ধির পবিত্র নাম হয়েছে।”

নম্র অতীতে ডুবে গেল। তখন বোধহয় সে ক্লাস এইটে পড়ত। বড্ড উড়নচণ্ডী এবং চঞ্চল ছিল নম্র। শতাব্দদের সঙ্গে তখন তাদের খুব ভাব। নম্র সবাইকে দেখলেও শতাব্দকে কখনোই দেখেনি। তখন শতাব্দ সবে ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ছে। এইচএসসি ভোক থেকে৷ সে মোটেও ঘরমুখো ছিল না। সারাক্ষণ কোথায় থাকত তাও বলা দায়। এজন্যে দেখত না বললেই চলে। এর মাঝে দুই পরিবার মিলে একটি পিকনিকের প্ল্যান করল। পিকনিক করবে শতাব্দের দাদূর গ্রামে। এক রাতের জন্যে। নোমান সাহেবের সপ্তাহিক ছুটি ছিল দেখে সে বারণ করেনি। সেই পিকনিকে সবচেয়ে বেশি খুশি ছিল বোধহয় নম্র। পুরো রাস্তা সে খুশি উদযাপন করেছে। তবে বেশি দীর্ঘ হয়নি সেই খুশি। দুই ঘন্টা রাস্তা পার হতেই নম্র অসুস্থ হয়ে পড়ে, বমি করে তার কাহিল অবস্থা। এরকম জার্নি প্রথম ছিল বিধায় তার জীর্ণশীর্ণ ছোটো দেহখানা এই চাপ নিতে পারেনি। খুশির মহল হঠাৎ-ই এমন গুমোট হয়ে যায়। শতাব্দ সবচেয়ে পেছন সিটে শুয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল। তাই বলা বাহুল্য, গাড়িতেও নম্র শতাব্দকে খেয়াল করেনি।

দুপুর নাগাদ তারা গ্রামের বাড়ি পৌঁছায়। কোনোরকমে খেয়ে-দেয়ে নম্র ছোট্ট নিঝুমের পাশে শুয়ে পড়েছিল। এক ঘুমে ওঠে বিকাল নাগাদ। তখন নিঝুম তার পাশে ছিল না। তবে ততক্ষণে সে ভীষণ সুস্থবোধ করছিল। এজন্যে বাইরে গিয়ে সবার সাথে আশপাশ দেখল। বাবার হাত ধরে গ্রাম ঘুরে বেরিয়েছে। শতাব্দ যেন গ্রামে এসে আরও হারিয়ে গিয়েছিল। শতাব্দকে দেখার জন্যে হঠাৎ-ই নম্রের মাঝে কৌতুহল দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শতাব্দ নেই শুনে চরম হতাশ হয়েছিল নম্র।

চেনা গ্রামে আসলেই পুরোনো স্মৃতির স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়াতে সে বড্ড পছন্দ করে। আগে যখন দাদা বেঁচে ছিল তখন শতাব্দ দাদা-দাদীর সাথে গ্রামেই থাকত। দাদা মূর্ছা যাবার পর আরিফ সাহেব মা এবং ছেলেকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে। দীপালি বেগম তো প্রথমে কিছুতেই স্বামীর ভিটা ছেড়ে যাবেন না, তার স্মৃতি গুলোকে আকড়ে ধরে বাকিটা জীবন বাঁচবেন। কিন্তু আরিফ সাহেব বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে নিয়ে আসেন। তবে ইট-বালুর ব্যবসাটা আরিফ সাহেবের বাবারই ছিল। ছেলেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে এসেছেন মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য, মাটিতে জুতো ছাড়া হাঁটার জন্যে। প্রকৃতিকে বড্ড ভালোবাসতেন তিনি। শতাব্দও হয়েছে একদম দাদার মতো। প্রকৃতি প্রেমী।

রাতে খাওয়ার সময় শতাব্দকে দেখেছিল প্রথম। শতাব্দ তাকে প্রথম দেখেছিল কী না নম্রের জানা নেই। শতাব্দ খাওয়ার সময় কয়েক পলক নম্রের দিকে তাকালেও কোনো কথা বলেনি। অথচ নম্র ভেবেছিল নম্রের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলবে শতাব্দ। কিন্তু ছেলেটা বড্ড চুপচাপ স্বভাবের।

পরেরদিন ভোরবেলা উঠে নম্র খালের পাড়ে চলে গেছিল। বাড়ির থেকে খালটা বেশ কাছেই। বাবার সাথে ঘুরতে এসে জায়গাটা এত ভালো লাগছিল যে আরেকবার না এসে পারল না। নম্র হঠাৎ বিলের পাশেই কিছু শাপলা ফুল ফুটতে দেখে। নম্র এক মুহূর্তের জন্যে সেখান থেকে অন্তত একটা ফুল নেওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু আশেপাশে কেউ ছিল না। এজন্যে বুকে অদম্য সাহস নিয়ে খালের পাড়ে এগিয়ে যায়। হাতে একটা লাঠি। সেটা দিয়েই নাহয় টেনে আনবে। নম্র কিছুটা পানিতে নেমে একটু ঝুঁকে শাপলা একটা আনার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু বোঝার আগে সিঁড়িতে পা পিছলে গিয়ে নম্র ধপ করে খালে পড়ে যায়। সঙ্গে খুব জোরে শব্দও হয়। নম্র সাঁতার জানত না। এজন্যে পড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে যায় সে। অত্যন্ত ছটফট করে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু সেই চিৎকার খুবই ক্ষীণ ছিল। নম্র হতবুদ্ধি হয়ে পাড় অবধি পৌঁছানোর চেষ্টা করতেও ভুলে যায়। শুধু মনে হচ্ছিল যদি সে ম/রে যায়? ভয়ে তটস্থ হয়ে খুব করে বাঁচতে চাচ্ছিল, কিন্তু পানিতে চুবানি খেয়ে তার বেশ বাজে অবস্থা হয়ে যায়। এমন মুহূর্তে আবার কেউ যেন ঝাপ দিল, তার খুব কাছে। কিন্তু ততক্ষণে নম্র অর্ধেক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। হাতে হঠাৎ হাতে হেঁচকা টান খায় তখনই আবার মস্তিষ্ক সচল হয় তার। দেখতে পায় শতাব্দ তার দুই হাত টেনে খাল পাড়ের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে।

খাল পাড়ে বসে নম্র খুব কাশছিল। গলা, নাক, কান দিয়ে পানি ঢুকে গেছে। শতাব্দ ভ্রু কুচকে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্ত গলায় বলল,
–“তুমি কী শুধু সমস্যাতেই পড়তে পছন্দ করো? সাঁতার পারতে না?”

নম্র থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। শতাব্দ আর কিছু বলল না। যেই গামছা নিয়ে খাল পাড়ে এসেছিল সেটা নম্রের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
–“কী জন্যে এসেছিলে এখানে?”

নম্র কাঁপা গলায় বলল,
–“শা..শাপলা!”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে শতাব্দ। কী ভেবে আবারও খালে নেমে দুইটা শাপলা ফুল ছিঁড়ে আনে। নম্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“এরপর থেকে ফুল চাইলে কাউকে ডেকে নিও।”

নম্র ভীষণ চমকে যায় ফুল দেখে। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে রয় শতাব্দের দিকে। সেদিনই খুব মনোযোগ দিয়ে ভোরের আলোতে শতাব্দকে দেখেছিল নম্র। শতাব্দের সুচেহারা দেখে কিশোরী নম্রের ভেতরটা কেমন ধ্ক করে উঠেছিল। ফুলটা নিতেই শতাব্দ আবারও খালে ডুব দিয়ে বলল,
–“ভেতর থেকে আরেকটা গামছা নিয়ে আসো!”

সেদিনের পর থেকে নম্রের মধ্যে নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। কিশোরী মনে তখন ছুঁয়ে গেছিল ভালো লাগার ছোঁয়া। শতাব্দকে দূর থেকে দেখতে দেখতে তা অভ্যাসে পরিণত হলো। শতাব্দ যখন বিএসসি করতে অন্য বিভাগে চলে গেল তখন তার সে কী কান্না। সবার অগোচরে রাতের বেলায় খুব কাঁদত। দুঃখে দুইদিন জ্বরেও ভুগেছিল সে।

সেই দিনগুলো স্মৃতিচারণ করতে করতে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল নম্র। রুমে এসে ঘুমন্ত শতাব্দকে কিছুক্ষণ মন ভরে দেখে নিল। পরমুহূর্তে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজেকে অনেকক্ষণ দেখল। নাকটা তার খালি পরে আছে। নথের কথা ভাবতেই মনে পড়ল রাতে শতাব্দ তাকে তিনটা জিনিস উপহার দিয়েছিল। একটা ছোটো ডায়মন্ডের রকেট, নথ আর আংটি। নম্র সেগুলো বের করে পরে নিল। এবার বোধহয় বউ, বউ লাগছে তাকে। শতাব্দের বউ।

ঠিক নয়টা বাজে দরজায় কড়া পড়ল। শতাব্দ তখন উঠে ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকেছে। নম্র তড়িঘড়ি করে মাথায় শাড়ির ঘোমটা তুলে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই রুমার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি নজরে এলো নম্রের। নম্র লাজুক হেসে সালাম দিল। রুমা হাসি-মুখে সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
–“ঘুম কেমন হলো?”
–“জি ভালো!”
–“শতাব্দ উঠেছে?”
–“হ্যাঁ। উনি ফ্রেশ হতে গেল!”
–“ঠিক আছে। তবে শতাব্দকে নিয়ে নাস্তা করতে আসো। দশটার পর বোধহয় প্রতিবেশিরা তোমাকে দেখতে আসবে।”
–“আচ্ছা ঠিক আছে আন্টি। আমি আসছি!”

রুমা চলে গেল। শতাব্দ ফ্রেশ হয়ে আসতেই নম্র বলল,
–“আপনি আসুন, আমি আন্টির কাছে যাচ্ছি। চোখ লেগে গেছিল কখন যেন, নয়তো আগেই আন্টির কাছে গিয়ে বসতাম!”
শতাব্দ মুখ মুছতে মুছতে ভ্রু কুচকাল। বলল,
–“আন্টি কী? এক্ষুণি মা না বললে খবর খারাপ আছে!”
–“এতদিনের অভ্যাস, ভুল হতেই পারে!”
–“তবে আগে থেকেই প্রেক্টিসে থাকা উচিয় ছিল। এত কিছু বুঝি না। মাকে মা না বললে সত্যি-ই তোমাকে নিউজে ছাপাব। বরকে প্রথম দিনেই চিমটি দিয়েছ।”

সূক্ষ্ম এক খোঁচা দিয়ে শতাব্দ আলমারি থেকে টি-শার্ট নিয়ে নিল। নম্র মুখ বাঁকাল শুধু। পেয়েছে এক টপিক। সারাদিন রেডিও’র মতো বাজাবে। নম্রের ঘোমটা বোধহয় সরে যাচ্ছিল, শতাব্দ নম্রের কাছে এসে তার মাথায় আবারও ঘোমটাটা তুলে দেয়। নরম গলায় বলল,
–“এইতো, শতাব্দের পরিপূর্ণ বউ।”

বলেই নম্রের ডান হাতের উলটোপিঠে চুমু খেল শতাব্দ। নম্র তখন লজ্জায় কাবুম তা দেখে শতাব্দ বাঁকা হেসে বলল,
–“চলো; একসাথে, স্ব-পরিবারে নাস্তা করি।”

~[ক্রমশ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে