#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ১৬|
লাবিবা ওয়াহিদ
রিহাব তার মাকে বাবুদের জন্মের আগেই বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। রিহাবের মা কিছুটা অসুস্থ ছিলেন, এজন্যে রিহাব তার মাকে বেশিক্ষণ হসপিটালে রাখেননি। বাড়ি পৌঁছে রিহাবের মা আনিশার দুশ্চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। ঘুম ভেঙেছে ভোরবেলায়; রিহাবের কলে। রিহাবের মা চটজলদি কল রিসিভ করে খবর জানতে চাইল। রিহাব ভাঙা গলায় বলল,
–“মেয়ে হয়েছে মা!”
কলের এপারে থাকা রিহাবের মাকে কেমন অসন্তুষ্ট দেখাল। কিছুটা নাক কুচকে বলল,
–“বুঝলাম আল্লাহ যা দেয় তা নিয়েই খুশি থাকা উচিত। কিন্তু তুই কেন আগে থেকে বললি না মেয়ে হবে? এখন তো ওই মেশিনে আগে থেকেই সব জানা যায়। শুধু শুধু আমাকে নাতির আশায় রাখলি কেন?”
রিহাব কন্ঠ আরও খাদে নামিয়ে বলল,
–“যেই কাঁথা গুলো বানিয়েছ সেগুলা আমি কিছুক্ষণের মধ্যে নিতে আসব। তুমি আসবে সঙ্গে?”
হঠাৎ রিহাবের মা দমে গেল। এতক্ষণে ছেলের কন্ঠস্বর খেয়ালে এলো তার। রিহাবের মায়ের মন কেমন ছটফট করে উঠল। কিছুটা নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
–“কী হয়েছে আব্বা? গলা এমন শুনাচ্ছে কেন?”
রিহাব কিছুটা সময় নীরব থাকল। রিহাবের মা তখনো ব্যাকুল হয়ে ছেলের উত্তর শোনার অপেক্ষায়। খারাপ কিছু না শুনুক; সেই দোয়াই করছে বেশি বেশি। রিহাব পুণরায় একই গলায় বলতে লাগল,
–“আমাদের জমজ সন্তান হওয়ার কথা ছিল মা। তোমাকে জানানো হয়নি; আনিশাই নিষেধ করেছিল তোমাকে চমকে দিবে বলে। একজন মেয়ে এবং একজন ছেলে। ছেলেটা দুনিয়ার আলো বেশিক্ষণ দেখতে পায়নি মা!”
শেষ বাচ্যে গিয়ে রিহাবের কথা আটকে যাচ্ছিল। একজন বাবার পক্ষে নিজ সন্তানের মৃত্যু সংবাদ কাউকে বলা যে কতটা হৃদয় নিংড়ানো, সেটা রিহাব বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে।
রিহাবের মা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। জবান দিয়ে কোনো কথা বেরুলো না তার। তবে কিছু মুহূর্তের মাঝে এইটুকু অনুভব করল তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। গালেও পানির ভেজা ভাব অনুভব হচ্ছে। রিহাব হঠাৎ কাঁদো গলায় বলল,
–“বাড়ির পেছন দিকটায় কী আমার সন্তানটাকে দাফন করা যাবে আম্মা? আনিশা তো তাকে দূরে রাখতে দিবে না। বাড়িতে আমাদের সাথেই নাহয় আমাদের সন্তানটাকে রেখে দেই?”
এবার রিহাবের মা কান্না থামাতে পারল না। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল। মায়ের কান্না শুনে রিহাব চোখ বুজে ফেলল। ভেতরটায় ক্রমাগত কেউ যেন ছুরি চালনা করছে। রিহাবের মা আনিশার কথা বেশি কাঁদছে। প্রথমে অবুঝের মতো কী বাজে কথাই না বলে ফেলেছে আনিশাকে নিয়ে। একটা ছেলে সন্তানের আশায় মেয়েটাকে সে দোষ দিতে নিচ্ছিল, অথচ মেয়েটা তাকে চমকে দেওয়ার জন্যে এতটা দিন চুপ থেকেছে। নারী ছেড়া ধনের একজনকে মেয়েটা তার সন্তানকে এভাবে হারিয়ে ফেলল। তাকে কাছেও পেল না। অথচ রোজ কতশত স্বপ্ন দেখেছে। রিহাবের মা তার কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল,
–“আনিশা কেমন আছে?”
–“ভালো আছে। তবে জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার বলেছে কয়েকঘন্টা লাগবে। আমি গেলে তুমি কী সঙ্গে আসবে আম্মা?”
–“আসব!”
—————————–
ঘড়ির কাঁটা বোধহয় এগোটার ঘরে। আনিশা নিষ্প্রাণ হয়ে চেয়ে আছে কাচের মধ্যে থাকা ছোট্ট প্রাণকে। যে আপাতত লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। আনিশা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এই মুহূর্তে তাকে প্রোপার বেড রেস্টে থাকতে বলা হলেও সন্তান হারানোর শোকে আনিশা ভীষণ পাগলামো আচরণ করছিল। এজন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে বেড থেকে নামার অনুমতি দেয়া হয়েছে। রিহাব পাশ থেকে আনিশাকে ধরে বলল,
–“অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছ৷ এবার অন্তত চলো আনিশা!”
আনিশা শূন্য নজরে মেয়ের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক গলায় বলল,
–“আমার ছেলেটাকে কেন এক নজর দেখতে দিলে না রিহাব? আমার ছেলেটা একটুও তো তার মায়ের আদর পেল না। উপরে গিয়ে তো নালিশ করবে; তার মা তাকে ভালোবাসেনি, একটুও আদর করে বিদায় দেয়নি। সন্তানের কাছে কী করে আমাকে অপরাধী করে দিলে?”
মানুষ কতটা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়লে এই ধরণের কথা বলে। তার জ্ঞান ফিরেছে সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ। সেই থেকে টানা এক ঘন্টা কেঁদেছে সন্তানকে হারিয়ে। আনিশার জ্ঞান ফেরার আগেই বাচ্চাটাকে দ্রুত দাফন করেছে। দেরী করাটা উচিত নয় বলেই করেছে। এখন মনে হচ্ছে আনিশাকে না দেখিয়ে বড়ো ভুল করেছে। তবে মৃত বাচ্চা দেখে আনিশা আরও বেশি ভেঙে পড়ত। কিছুতেই তাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারত না। রিহাব আনিশাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ভাঙা গলায় বলল,
–“কোথাও যায়নি আমাদের সন্তান। আমরা রোজ জানালা খুলে আমাদের সন্তানকে দেখতে পারব। আমাদের খুব কাছেই আমাদের সন্তানকে রেখেছি। আমাদের সন্তানকে কী করে আমরা দূরে সরিয়ে রাখব আনিশা?”
আনিশা অনেকক্ষণ বাদে আবারও কাঁদল। হাউমাউ করে কাঁদল। তাদের এই পথে নার্স, রোগী আসা-যাওয়া করার সময় এই দৃশ্য দেখে তাদের অত্যন্ত খারাপ লাগল, কারো কারো চোখ ঝাপসাও হয়ে এলো। নম্র জানালার দিকে মুখ করে নীরবে কাঁদছে। এমন ভাবে কাঁদছে যেন কেউ তার এই কান্না দেখতে না পায়। আনিশার এই কষ্ট সে একদম নিতে পারছে না। কেন হলো এরকম? সন্তান হারানো এতটা দমবন্ধকর কেন? আনিশার জায়গায় নম্র হলে তো ম/রেই যেত। কোন মায়ের পক্ষে এই তিক্ত সত্যি মেনে নেওয়া সম্ভব?
আনিশার মেয়েটাকে সাতদিন লাইফ সাপোর্টে রাখার পর বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। এই সাতদিন আনিশাও হসপিটালেই ছিল। একদিকে এক সন্তান হারানোর শোক, অপর দিকে যে বেঁচে আছে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। তলপেটের সিলিটায় যখন টান লাগে, কিংবা ব্যথাটা নড়বড়ে করে ওঠে তখনই তার ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায়। সে এমন অভাগা মা যে কী না সন্তানের মুখটাও দেখতে পারেনি। অথচ তার গর্ভ থেকেই তার সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। এই আফসোসে, শোকে আনিশা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। সকলে চেষ্টা করে আনিশাকে সামলানোর। তাকে সবাই বোঝায়, যে যাওয়ার সে গেছে! কিন্তু এখনো একজন আছে। তার জন্যে হলেও তো আনিশাকে সুস্থ থাকতে হবে। মেয়েটাও যে তারই সন্তান।
আনিশাকে তার বাবার বাড়িতেই আনা হয়। এখানে মানুষজন বেশি, আনিশার খেয়াল-ও রাখতে পারবে; এই ভরসায় রিহাব এখানেই আনিশাকে রেখেছে। তবে রিহাবের মা রোজ সকাল থেকে বিকাল অবধি থাকার চেষ্টা করে আনিশার কাছে। আনিশা শোকে পাথর থাকলেও মেয়েকে কিছুতেই দূরে সরিয়ে রাখেনি। বরং পরম মমতায় বুকে আগলে রাখে, তার যত্ন করার চেষ্টা করে। এই মেয়েকেও সে বড়োই সাধনার পর পেয়েছে। নয়তো ডক্টররা তাকে নিয়েও ভীষণ চিন্তায় ছিল। আল্লাহ’র রহমতে তার মেয়েটা এখন সুস্থ। আনিশা তার মেয়ের নাম রেখেছে তোহা, আর ছেলের নাম তাহাফ। রোজ রাতে যখন তোহাকে বুকে আগলে রাখে তখন আনিশা চোখের পানি ঝড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,
–“তোর মাঝেই তাহাফকে খুঁজে পাই তোহা। কখনো এই অভাগা মাকে ভাইয়ের মতো করে ছেড়ে যাস না। আল্লাহ তোকে লম্বা হায়াত দিক। আমার তোহা, আমার তাহাফ!”
এভাবেই এক মাস পেরিয়ে গেল। দু’বাড়ি তখন সময়ের গতিতে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছে। সময় কারো জন্যে থেমে থাকে না। সে তার নিয়মমাফিক চলতে থাকে। নম্র এতদিনে অনার্স ফাইনালে উঠে গিয়েছে। আনিশার এই ধাক্কা নম্রকে আগে থেকেও বেশ শক্ত করেছে বোধহয়। তার ভেতরের সমস্যাগুলো বড়োই ঠুনকো লাগে এখন আনিশাকে দেখলে। আগে থেকেও বেশ কিছুটা ম্যাচিওরিটি লক্ষণীয় নম্রের মধ্যে। রোজ ভার্সিটি যাওয়া, আসা করে। বাড়ি ফিরে কিছু না কিছু রান্না করে আনিশার কাছে চলে যায়। তার সাথে সময় কাটায়, আনিশার আশেপাশে কেউ না থাকলে আনিশাকে ঘুমোতে দিয়ে নম্র এক দুই ঘন্টা বাবুকে সামলায়। এভাবেই তার দিন কাটছে। আর শতাব্দ তার বেকারীর কাজে অল্প পরিসরে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ-ই একদিন আনিশা নম্রকে প্রশ্ন করে বসল,
–“তোমাদের বিয়ের তারিখ এখনো দেয়নি?”
নম্র কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল আনিশার মুখে এরকম প্রশ্ন শুনে। কেউ-ই এখন উৎসবে জড়ানোর মতো অবস্থায় নেই। নম্র আনিশার উদ্দেশ্যে বলল,
–“বিয়ের তারিখ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি আগে নিজের যত্ন নাও আপু!”
আনিশা ভ্রু কুচকে বলল,
–“অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। আমি এতটাও স্বার্থপর নই যে নিজের জন্যে ভাইয়ের বিয়ে ঝুলিয়ে রাখব। তোমাদের বিয়ে এই সপ্তাহের মধ্যেই হবে!”
নম্র কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আনিশার কথা শুনে। কী বলবে, কী বলা উচিত তা খুঁজে না পেয়ে সেদিন ব্যস্ততা দেখিয়ে একপ্রকার পালিয়ে এসেছে নম্র। নম্র পালিয়ে গেলেও সে-রাতে আনিশা বেশ হট্টগোল করল বাবা-মায়ের সাথে। তার জন্যে কেন বিয়ে আটকে থাকবে? বাকি দুনিয়া কী চলছে না? তাহলে এই বিয়েতেই কেন এত অযুহাত? আনিশা ইদানীং বড্ড জেদী হয়ে গেছে। তাই তার জেদের কাছে হার মেনে সে-রাতেই আরিফ সাহেব তার বন্ধুকে বিয়ের কথা জানালো। এবং আগামীকাল-ই তারা বিয়ের তারিখ দিবে বলে জানালো। নোমান সাহেব আপত্তি করলেন না।
পরেরদিন আনিশা নিজে জানালো এই সপ্তাহের মধ্যেই যেন ধুমধাম করে বিয়েটা হগে যায়। তবে এবার এসে শতাব্দ মুখ খুলে। শতাব্দ মুখ কুচকে বলেছে,
–“আমি বিয়ে সাধারণ ভাবেই পছন্দ করি। বিয়ে ঘরোয়াভাবে আর অবশ্যই মসজিদেই আমি বিয়ে করব। নয়তো আমাকে দিয়ে বিয়ের আসা করা ভুলে যান বাবা!”
আনিশা অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলেনি। বিয়ে শতাব্দ করবে, অবশ্যই তার ইচ্ছামতোই হবে। নম্রকে এই ব্যাপারে জানালে সেও আপত্তি করল না। এরপর হঠাৎ-ই শোকের ছায়া কেটে গিয়ে পরিবেশ উৎসবমুখর হয়ে গেল। শপিং, নানান আয়োজন, দাওয়াত সব তো আছেই। আনিশা শতাব্দকে বলেছে বিয়ে ধুমধাম করে না হলেও বাড়িকে মরিচবাতি দিয়ে সুন্দর করে সাজাতে। অন্তত দেখলে যেন এটুকু মনে হয় যে বাড়িটা এখন বিয়ে বাড়ি। শতাব্দ তার বোনের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেনি। দু’বাড়ি রঙিন সাজে সেজে উঠেছে আর আনিশা চোখ জুড়িয়ে সেই সাজ দেখেছে।
ঘরোয়াভাবে হলুদের অনুষ্ঠান হলেও আত্নীয় স্বজনে ভর্তি ছিল। নম্র এটুকুই বড্ড খুশির সাথে উপভোগ করেছে। হলুদের রাতে দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। সুখের অনুভূতিতে সে শুধু কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে শতাব্দের সঙ্গে আগামীকাল তার বিয়ে। শতাব্দের বউ হতে চলেছে সে। শতাব্দের অর্ধাঙ্গিনী হবে। আহঃ, কী সুন্দর অনুভূতি।
~[ক্রমশ]