প্রণয় পাড়ে সন্ধি পর্ব-১৩

0
524

#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ১৩|
লাবিবা ওয়াহিদ

–“শতাব্দ ভাইয়াকে আমার জন্মদিনের কথা কী তুই বলেছিস নিঝুম?”

নিঝুম ঘাবড়ে গেল বোনের কাঠকাঠ গলা শুনে। শুকনো একটা ঢোঁক গিলে মিনমিন করে বলল,
–“স্যরি আপু। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছিল। ভাইয়ার সাথে অন্য টপিকে কথা বলতে গিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল।”

নম্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শতাব্দ অন্তত মিথ্যে বলার মানুষ নয়। তবুও অর্ণার খোঁচানোতে কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল। অর্ণার আবোলতাবোল কথাতে কান দেওয়াটা উচিত হয়নি। শতাব্দ তাকে কী করে পছন্দ করবে? নম্র এবং শতাব্দ দুজনেই তো দুই মেরুর মানুষ। যাকে ভাই ডেকে এতদিন পার করে ফেলেছে তাকে চাওয়াটা বাইরের মানুষের কাছে হাস্যকরই হবে। এজন্যে নম্র নিজের পছন্দকে আরও লুকিয়ে ফেলল নিজের মধ্যে। নিঝুম হঠাৎ তার ধ্যানে ফোড়ন কেটে বলল,
–“শতাব্দ ভাইয়া কী তোমাকে উইশ করেছে আপু?”

নম্র চোখ গরম করে বলল,
–“এত আজেবাজে না ভেবে পড়তে বস!”

কিছুদিন পর নম্রের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। এজন্যে সে হুট করেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, পরীক্ষার প্রস্তুতি সব মিলিয়ে নম্রের নাকে-মুখে অবস্থা।

নোমান সাহেব ভুলেই গিয়েছিলেন সামনে তার মেয়ের ইয়ার ফাইনাল। যখন ব্যাপারটা মাথায় আসল, তখনই সে বিয়ের কথা গিলে নিল। নাফিজের সাথেও আর আলোচনা করেনি। মেয়ে পরীক্ষা দিক, নয়তো এই মুহূর্তে বিয়ের কথা উঠলে নম্রের পড়াশোনার ওপর বাজে প্রভাব পড়তে পারে। এজন্যে সে এই ব্যাপারে সাবধান থাকল।

মেয়েকে এভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখে নোমান সাহেবের চোখে ভেসে উঠে কিছু পুরানো স্মৃতি। যখন তিনি সাধারণ স্কুক শিক্ষক ছিলেন তখন নম্র খুব চটপটে ছিল। কৌতুহলবশত এমন অনেক কিছুই প্রশ্ন করত যা তাদের দম্পত্তিকে হাসতে বাধ্য করত। এমনই এক সময় পরীক্ষা এল। রাতে নোমান সাহেব কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিলেন। সাবরিনা তার আশেপাশেই ছিল। তখন নম্র পড়া ছেড়ে মায়ের কাছে আসে। নোমান সাহেবের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
–“আম্মা শুনো। পরীক্ষার সময় বাবাকে রাগিয়ে দিবে না। আমার বান্ধবীরা বলে যেই স্যার পরীক্ষায় কঠিন গার্ড দেয় সেই স্যার’রা নাকি বাসা থেকে তাদের বউয়ের সাথে ঝগড়া করে আসে। তুমি বাবার সাথে ঝগড়া করলে বাবাকেও ওরা এসব বলবে।”

সাবরিনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে মেয়ের এহেম কথা-বার্তায়। কান সচল ছিল বিধায় এসব কথা নোমান সাহেবের কানেও পৌঁছায়। তিনি না হেসে থাকতে পারেননি ছোটো নম্রের বোকা বোকা কথায়। সেই থেকে মেয়ের ভ্রান্তি ভাঙাতে নোমান সাহেব যতবারই পরীক্ষার হলে গিয়েছে, ততবারই যথেষ্ট নরম থেকেছেন। তেঁতো আচরণ করেননি কারো সঙ্গেই। তবে নকল কিংবা দেখাদেখি করার বিরুদ্ধে সদা কঠোর ছিলেন।

সেই ছোট্ট মেয়েটা চোখের পলকেই বড়ো হয়ে গেল। এতই বড়ো হয়ে গেল যে এখন নিজের আনন্দ, দুঃখ সবটাই নিজের মধ্যে পুষে রাখে। প্রাণখুলে হাসতে শোনা যায় না, বাবার অবাধ্য হয় না, বাবাকে শাসন করে না, এখন যেন বাবাকেই ভয় করে চলে। ঠিক ভয় না, সমীহ করে চলে। তার ছোট্ট উড়নচন্ডী নম্রটা হঠাৎ-ই নিজেকে শক্ত খোলসে বন্দি করে নিয়েছে। নয়তো একটা ছেলে দীর্ঘদিন তাকে বিরক্ত করছিল, সেটা একবারও মুখ ফুটে বলল না?

অনিকের ব্যাপারটা নম্রের মহল্লার বড়ো ভাইদের থেকেই জেনেছে। পুরো আপাদমস্তক। এও শুনেছে অনিককে ধোলাই দিয়ে হাসপাতালেও ভর্তি করিয়েছিল। যার বদলা নিতেই অনিক নম্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। নোমান সাহেবের ভেতরটা আঁতকে উঠে এটা ভাবলে যে বড়ো মেয়েকে বিশ্বাস না করলে মেয়েটার উপর দিয়ে কী যেত? নোমান সাহেব কত বড়ো অন্যায় করার থেকে বেঁচে গেছেন ভাবলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। অন্তত নিজের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা মেয়েকে বাইরের দশ মিনিটের পরিচয়ের ছেলের কথায় অবিশ্বাস করা উচিত নয়। নোমান সাহেব তার জীবনে দারুণ শিক্ষা পেয়েছেন।

———————————-
শতাব্দের বাড়িতে প্রায় প্রত্যেকদিন ঘন তুফান হয়। আরিফ সাহেব কয়েকদিন সময় নিয়েই শতাব্দকে জানান বিয়ের ব্যাপারে। পাত্রী কাকে নির্বাচন করেছেন সেই ব্যাপারে আগে-ভাগে জানাননি। ছেলে বিয়ে করবে, অবশ্যই ছেলের মতামত তো আগে নিতে হবে। পরে নাহয় আসে পাত্রীর বিষয়।

কিন্তু সেদিনের পর থেকে বাপ-ছেলের দ্বন্দ্ব আবার নতুন করে শুরু হলো। শতাব্দ কোনোক্রমেই বিয়ে করতে রাজি নয়। সে বারংবার তার ক্যারিয়ারের কথা বলছে। ক্যারিয়ারের মাত্র প্রথম ধাপে, আর এখনই বিয়ে? অসম্ভব! যেদিন তার মনে হবে প্রতি মাসে বউয়ের সকল চাহিদা মেটাতে পারবে তখনই সে বিয়ে করবে এর আগে না। কিন্তু আরিফ সাহেব মানতে নারাজ। সে ভালো করে জানে শতাব্দ তার বিজনেসে ভালো প্রফিট কামাচ্ছে। সঙ্গে এও জানে শতাব্দ এই মুহূর্তে টাকা জমাচ্ছে তার ব্যাকারীর নতুন শাখা খোলার জন্যে৷ কোন জায়গায় খুলবে তাও সে জানে। নারায়ণগঞ্জে। শতাব্দের স্বপ্ন এটাই, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার প্রাণপ্রিয় বেকারীর শাখা দেখবে। বিয়ের জন্যে স্বপ্নগুলো অপূর্ণ রাখতে চাচ্ছে না। কিন্তু আরিফ সাহেবও শতাব্দের বাপ। শতাব্দের ঘাড়ের দুই রগ ত্যাড়া থাকলে তারও এক রগ ত্যাড়া আছে। দরকার পড়লে আরেকটা রগও ত্যাড়া করবে, তবুও ছেলেকে বিয়ে থেকে ছাড় দিবে না।

রুমা এবং আনিশা, দুজনেই সমানতালে ক্লান্ত এই বাপ-ব্যাটাকে সামলাতে সামলাতে। পুরো ঘটনা শুধু উপভোগ করে দীপালি বেগম। এই মুহূর্তে এই দ্বন্দ্ব দেখতে বড্ড ভাল লাগে তার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না দেখুক, অন্তত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ তো দেখতে পারছে, এ-ই বা কম কিসের?

—————————–
নম্র একমনে ভেবে চলেছে শতাব্দের কথা। এই মুহূর্তে সে লেকের পাড়ে বসে আছে। মন ভালো নেই তার, এজন্যই চোখ-মুখের উজ্জ্বলতা আজ বিলুপ্ত। বিষণ্ণ মনে লেকের পানির মৃদু দোলাটা দেখছে। পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। দীর্ঘ এক মাস পর। এই এক মাস বড্ড পরিশ্রম করেছে। পরীক্ষার জন্যে চোখ-মুখ বেশ শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচেও কালো ছাপ পড়ে গেছে।

তবে নম্রের বিষণ্ণতা পরীক্ষাকে ঘিরে নয়। শতাব্দকে নিয়ে। শতাব্দকে বড্ড মনে পড়ছে তার। রিকশা নিয়ে বেকারীতে গিয়েছিল সে। কিন্তু শতাব্দকে না পেয়ে হতাশ হয়ে এখানে এসেছে। কিছুদিন যাবৎ শতাব্দ পড়াতেও আসছে না নিঝুমকে। তাই আরও দেখা হয় না। মন খারাপের আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। আজ যখন টিউশনি করিয়ে বাড়ি ফিরল তখন দেখেছে বাবা-চাচার গুরুতর বৈঠক। কান সচল করে যখন কথা শুনতে যায় তখনই তার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

বাবা তার বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে। এবং নম্রের বিয়ের ব্যাপারেই আলোচনা করছিল দুই ভাই। তখনই হুট করে শতাব্দের কথা মনে পড়ল তার। শতাব্দের জায়গা অন্যকাউকে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না সে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, দেহ অসাড় হয়ে আসে, বুকের বা পাশটায় অসম্ভব ব্যথা হয়, চোখ জ্বালা করে। এত এত যন্ত্রণা কী করে সইবে সে? সেই কিশোরী মনের ভালোবাসা সে কী করে কয়েক মুহূর্তে-ই বিসর্জন দিবে? অসম্ভব। তাইতো নম্র হঠাৎ-ই অবাধ্য হয়ে গেল। তাদের কথার মধ্যে বৈঠকঘরে হাজির হলো। বাবা, চাচার দিকে চেয়ে ধরা গলায় বলল,
–“আমি বিয়ে করতে চাই না!”

এরপর আর তাদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। ছুটে বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। নোমান সাহেবের পিছু ডাকও শুনেনি। হাত-পা প্রচন্ড কাঁপছিল তার।

–“এই অসময়ে লেকের পাড়ে কী করছ?”
হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে নম্র চমকে উঠে। আশেপাশে নজর বুলাতেই বুঝল সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাগরিবের আযান দিবে দিবে ভাব। নম্র ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়। শতাব্দ দাঁড়িয়ে। কোথাও যাচ্ছিল বোধহয়, নম্রকে দেখে থেমে গেছে। নম্র মিনমিন করে বলল,
–“বাসায় ভালো লাগছিল না, তাই এখানে সময় কাটাচ্ছি।”

শতাব্দ বোধহয় বিশ্বাস করে উঠতে পারল না নম্রের বলা কথাটা। সে যতদূর নোমান আঙ্কেলকে চিনেছে, তাতে নম্রের এই সময়ে বাইরে থাকাটা বড্ড অস্বাভাবিক। তবে নম্রের কথা শুনে এইটুকু উপলব্ধি করল, নম্রের মন বিষণ্ণ। এজন্যে শতাব্দ না চাইতেও নম্রের পাশে বসল। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে ব্যঙ্গ করে বলল,
–“কী ব্যাপার? বিয়ের কথা উঠেছে নাকি যে কনের মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ?”

শতাব্দ তার স্বভাবতই কথাটা বলেছে। সে ভেবেছিল নম্র রেগে যাবে, কড়া কথা বলবে। কিন্তু শতাব্দের ভাবনা অনুসারে কিছুই হলো না। পরিবেশও বদলালো না। নম্র নীরব থেকে বলল,
–“হ্যাঁ। তেমনই ব্যাপারটা!”

শতাব্দ বিস্মিত চোখে তাকাল নম্রের পানে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরকম কিছু আশা করেনি। লেকের ধার ঘেঁষে সারি সারি ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। সেই ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোতে লেক এবং লেকের পাড় ঘেঁষে লম্বা সরু পথটা বড্ড সুন্দর লাগছে। মোটামুটি এটা ঘুরাফেরা করার মতো স্পট। নিয়ন আলোয় শতাব্দ স্পষ্ট দেখতে পেল নম্রের চোখে পানি জ্বলজ্বল করছে। নম্রের এই তিনটি বাক্য বলতেই কতটা দম বন্ধ হয়ে আসছিল। শতাব্দের কাছে সবকিছুই ঠাট্টার মতো লাগবে। সে অন্যত্রে বিয়ে করে চলে গেলেও তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে না। নম্রের জন্যে শতাব্দ মনের মানুষ হলেও শতাব্দের জন্যে নম্র তো তেমন নয়। তাহলে এই মুহূর্তে শতাব্দের কাছে সে কী আশা করছে? কিছুই না। নম্র ভালো করেই বুঝে গিয়েছে, আশা করলে যন্ত্রণা আরও বাড়বে।

শতাব্দ গলা খাঁকারি দিল। থমথমে গলায় ডাকল,
–“নম্র?”
নম্রের গলা ফেটে কান্না আসছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কান্না আটকে বহু কষ্টে এলোমেলো নজর ফেলল চারপাশে। ভাঙা গলায় জবাব দিল,
–“হ্যাঁ?”
শতাব্দ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,
–“আমায় বিয়ে করবে?”

~[ক্রমশ]।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে