#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ১২|
লাবিবা ওয়াহিদ
নোমান সাহেব একসময় শিক্ষকতার জন্যে পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বহুদিন প্রচেষ্টার পর নিজ এলাকারই বেসরকারি স্কুলে প্রিন্সিপাল রূপে ফিরে এলেন। পুরোপুরিও বেসরকারি নয়। অর্ধেক সরকারিও বলা চলে। নম্র’র তখন বারো বছর বয়স এবং নিঝুম মাত্র তিন বছরের বাচ্চা। নোমান সাহেবের ছোটো ভাই নাফিজের তখন এমবিবিএস শেষের পথে। মায়ের সাথেই থাকত সে। এর মাঝে নোমান সাহেব মাকে হারালেন, বছরের পর বছর পরিশ্রমের পর জমানো টাকা এবং পুরাতন বাড়িসহ কিছু জায়গা-জমি বিক্রি করে নতুন করে বসত গড়লেন। এতে করে সমাজের মানুষদের মধ্যে গুঞ্জন ছড়ালো। প্রিন্সিপাল অসৎ পথে রোজকার করে রাতারাতি বড়োলোক হয়ে গিয়েছে। ছ’তলা বাড়ি কী মুখের কথা? মানুষের বলতে সময় লাগে না। তারা কখনোই ভালো দিক দেখে না, তারা অসৎ চিন্তা এবং মানসিকতা রাখতে রাখতে ভালোটাও তাদের নিকট ইর্ষার বস্তু হয়। এজন্যে ভালোর পিছেও খারাপ মন্তব্য করতে থাকে। তবে এই অবধি পৌঁছাতে কতটা পরিশ্রম, উৎসর্গ এবং সাধনা করতে হয় সেটা যে করে সেই বুঝে। নোমান সাহেব সেই থেকে মেয়েদের এমন ভাবে মানুষ করছেন, যেন যেকোনো কটু কথায় তার মেয়েরা না থামে। জীবনের যেকোনো মুহূর্তে পেছন থেকে ময়লা ছোঁড়া মানুষদের টপকে যেন সফলতার শীর্ষে পৌঁছে যায়, এই দোয়াই সবসময় করে এসেছেন নোমান সাহেব।
কিন্তু এরকম একটা মুহূর্তে এসে বড়ো মেয়েকে নিয়ে এমন বিরূপ অভিযোগ শুনবেন তা ধারণা করতে পারেননি নোমান সাহেব। শুধু শুনেননি, দেখেছেনও একটি ছবি। যেই ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার মেয়ে একটি ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সেই ছেলেটি-ই তার কাছে এসে জানিয়েছে তার এবং নম্রের মধ্যে সম্পর্ক চলছে। নম্রকে ছেলেটি বিয়ে করতে চায়। এছাড়াও অবৈধ মেলামেশার মিথ্যে ব্যাখ্যা দিল সে। এই ছেলে আর কেউ নয় অনিক! এতদিন যাবৎ হসপিটালে থেকে মনে যত রাগ, ক্ষোভ পুষিয়ে রেখেছে সব বদলা হিসেবে ঝাড়ল নোমান সাহেবের সম্মুখে। অনিক ভালো করেই জানে নম্র কেমন পরিবারের মেয়ে। এমন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের গায়ে দাগ পড়লে সেই মেয়েকে পরিবারই প্রতিনিয়ত নিঃশেষ করে দেয়। অনিক মূলত অন্ধ হয়ে এটাই প্রতিনিয়ত চাচ্ছে নম্র ধ্বংস হোক। সেটা তো আর নোমান সাহেব বুঝবেন না। সেই ফায়দাই লুটে নিল অনিক। এই মুহূর্তে নোমান সাহেবের মধ্যে কী চলছে সেটাও বোঝা দায়, বিমূঢ় হয়ে বসে আছেন তিনি।
———————
মুষলধারে বৃষ্টিতে নম্র জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোকানের ছাউনিতে। তাতে বিশেষ লাভ হচ্ছে না। বৃষ্টির পানিতে তাতেও ভিঁজে যাচ্ছে। সঙ্গে যেই পরিমাণে ঝড় উঠেছে, রাস্তা-ঘাটে চলাচল করাটাও রিস্কের ব্যাপার। ছাতা নিয়েই বেরিয়েছিল সে। কিন্তু লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে প্রবল বাতাসের সাথে ছাতাটা হাত ফসকে উড়ে গেছে। এই কথাটা বাসায় গিয়ে মাকে কী করে বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না নম্র। বৃষ্টিতে আপাতত মাথা বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই পারছে না সে। সখ করে শাড়ি পরে এসেছিল সে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। তার প্রিয় বৃষ্টিটা সব সখ ঘুচে দিয়েছে।
সরু অধরে লিপস্টিকের ছোঁয়া ছিল। বৃষ্টির পানিতে সেটা ধুঁয়ে মুছে গিয়েছে আগেই। এখন তিরতির করে কম্পিত অধরে কোনোরকম কৃত্রিম রঙের ছোয়া নেই। শুধু অধরে নয়, সম্পূর্ণ মুখের অল্পস্বল্প কৃত্রিম সাজ বৃষ্টির জলে ধুঁয়ে মুছে গিয়েছে। নীল রঙের শাড়িটাও বৃষ্টিতে অনেকাংশে ভিজে গিয়েছে।
নম্র দু’হাত একসাথে বাহুবন্ধন করে বৃষ্টি থামার জন্যে দোয়া করছে। পিটপিট করে চেয়ে আছে বৃষ্টির পানে। রাস্তায় সেরকম গাড়ি নজরে পড়ছে না। রিকশা তো আরও নয়। তারাও বোধহয় রিকশা ফুটপাতের পাশে রেখে কোনো না কোনো ছাউনিতে ঠাঁই নিয়েছে।
বৃষ্টির জোর কিছুটা কমে এলো মিনিট পাঁচেক পর। এমন সময়ই কেউ একজন বাইক থামালো তার সম্মুখে। নম্র কিছুটা ঘাবড়ে গেল। বাইকে বসা মানবটা রেইনকোর্ট পরিহিত। মাথায় শক্ত হেলমেট। সে হেলমেটের ভেতর দিয়ে নম্রের পানে তাকাল। কিন্তু নম্র তার চেহারা দেখতে পারল না হেলমেটের জন্যে। হঠাৎ সেই মানবটি হেলমেট খুলে ফেলল। মানবটার চেহারা দেখতেই নম্র হতবাক হয়ে গেল। এ যে শতাব্দ। শতাব্দ বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা ছেলে ছুটে গেল শতাব্দের কাছে। শতাব্দ তাকে রেইনকোর্ট এবং হেলমেট ফিরিয়ে দিল। সঙ্গে বাইকের চাবিটাও। ছেলেটা বেশ আনন্দ মাখা গলায় বলল,
–“ধন্যবাদ ভাই, এত বড়ো উপকার করে দেওয়ার জন্যে। আয়, তোকে আমি বেকারীতে পৌঁছে দিচ্ছি! যা বৃষ্টির বেগ, কখন থামবে বোঝা দায়!”
শতাব্দ একপলক নম্রের দিকে তাকাল। নম্র তখন সেই ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। চেহারা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে তার। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। ছেলেটা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। শতাব্দের সেই বন্ধুটা। ছেলেটা বোধহয় তখনো নম্রকে খেয়াল করেনি। শতাব্দ নম্রের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে বলল,
–“তুই যা। আমি একা যেতে পারব। এই মুহূর্তে বাইকে যেতে ইচ্ছে করছে না!”
ছেলেটা আর কথা বাড়ায় না। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ তাড়ায় আছে। শতাব্দকে বিদায় দিয়ে চলে গেল। শতাব্দ ততক্ষণে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছাউনিতে চলে আসল। এখন আশেপাশে তেমন মানুষ নেই। পেছনের দোকানটাও বন্ধ। শতাব্দ প্রশ্ন করল,
–“কতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছ?”
নম্র তার আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলল,
–“হবে হয়তো পনেরো মিনিট!”
নম্র আড়চোখে শতাব্দকে দেখছে বারবার। আজ সে সাদা শার্ট পরেছে। সাদাতেও এত সুন্দর লাগে ছেলেদের? শতাব্দ তাকে নতুন করে বারবার প্রেমে পরতে বাধ্য করছে কেন? শার্ট ইন করাটাও কী খুব জরুরি ছিল? শতাব্দের কথায় ধ্যান ভাঙলো নম্রের।
–“ছাতা নিয়ে বের হওনি? সকাল থেকেই তো আকাশে মেঘ ছিল!”
এবার নম্র পড়ে গেল বিপাকে। যেই কথাটা বাসাতে কীভাবে বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না, এখন অস্বস্তির পরিমাণ যেন আরও বেড়ে গেল। অধর কিছুটা চেপে মিথ্যে বলতে নিল এমন সময়ে শতাব্দ ভ্রু কুচকে বলল,
–“কিছু লুকাচ্ছ?”
নম্র তড়িৎ তাকায় শতাব্দের দিকে। পুণরায় চোখ নামিয়ে খুবই ক্ষীণ গলায় বলল,
–“ছাতা উড়ে গেছে!”
শতাব্দ নিঃশব্দে হাসল। আর নম্র লজ্জায় লাল। শতাব্দ হাসি বজায় রেখে বলল,
–“এটুকু বলতে এত লজ্জা পাচ্ছ? কাম অন নম্র, ইট’স প্রিটি নরমাল। ছোটো ছোটো ব্যাপারে লজ্জা, সংশয় ঠিক নয়!”
এই মুহূর্তে নম্রের বলতে ইচ্ছে করল,
–“প্রিয় পুরুষের সম্মুখে কোন মেয়ে সম্মান হারাতে চায় বলুন তো? যেখানে আমার কর্মকান্ড-ই আমায় লজ্জায় ফেলে!”
নম্র মুখে বলল, “সামনে থেকে খেয়াল রাখব।”
নম্র থেমে পরমুহূর্তে আবার বলল,
–“আপনি বন্ধুর সাথে গেলেন না কেন?”
–“তোমাকে এরকম নিরিবিলি জায়গায় একা ছেড়ে যাব? পাগল পেয়েছ?”
নম্র কিছু বলল না। শুধু চাপা হেসে আঁচলখানা মুঠিবদ্ধ করে ফেলল। মিনিটখানেকের মধ্যে নম্রের কানে এলো শতাব্দের গলা,
–“বৃষ্টির বেগ অনেকটা কমে এসেছে। চলো যাই!”
নম্র মুখ ফসকে বলে ফেলল, “কোথায়?”
শতাব্দ এই মুহূর্তে এসে গম্ভীর গলায় বলল,
–“তোমার শ্বশুরবাড়িতে না! তোমার বাড়িতেই নিয়ে যাচ্ছি! চলো!”
নম্র নিজের করা প্রশ্নে নিজেই বেকুব হয়ে গেল। শতাব্দ পরমুহূর্তে ছাউনি থেকে বেরিয়ে গেলে নম্রও দ্রুত তার পিছু নেয়। কিছু দূর হাঁটার পরেই রাস্তা পার হতে হবে। এতক্ষণে কোনো গাড়ি, রিকশা দেখা না গেলেও এখন দেখা যাচ্ছে ভালো।
গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে হঠাৎ শতাব্দ নম্রের হাত ধরল। নম্রের মনে হলো সে ওখানেই নিঃশেষ হয়ে যাবে অনুভূতির স্রোতে হাবুডুবু খেয়ে। বিদ্যুতের তীক্ষ্ণ ঝলকে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল যেন তার। শতাব্দের তখন এতদিকে খেয়াল নেই। সে রাস্তায় গাড়ি দেখছে। সঙ্গে বলে উঠল,
–“রাস্তা পার হব। অনুমতি ছাড়া হাত ধরার জন্যে দুঃখিত। তাড়াতাড়ি পার হতে হবে, চলো!”
বলেই সেই স্নিগ্ধ বৃষ্টিতে ভিঁজে হাতে হাত রেখে, পাশাপাশি কদমের সাথে কদম মিলিয়ে দুজন রাস্তা পার হলো। দিনটা অন্যরকমই সুখময় সুন্দর ছিল, একদম হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো।
————————
নম্র বাড়িতে ফিরে দেখতে পায় নোমান সাহেব ফিরেছেন। বোধহয় শরীর খারাপ করেছে নোমান সাহেবের। এলাকায় আসতেই শতাব্দ তার বাড়িতে চলে যায়, আর নম্রও ফিরে আসে। এক ঘন্টা পরেই নিঝুমকে আবার পড়াতে আসবে শতাব্দ।
নম্রকে ভিঁজে ফিরতে দেখে থমথমে গলায় বলল,
–“বৃষ্টির দিনে বেরিয়েছ কেন? কতবার কল দিয়েছি খেয়াল আছে? ফোন কোথায় রাখো?”
নম্র কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
–“স্যরি বাবা। ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। একটু আগেই তোমার কলগুলো দেখেছি!”
–“কোথায় গিয়েছিলে?”
নম্র কিছুটা নীরব থেকে মুখ খুলল,
–“আজ আমার জন্মদিন ছিল বাবা। অর্ণার সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বৃষ্টির কারণে আর যাওয়া হয়নি। তুমি থাকো, আমি এক্ষুণি গোসল করে তোমায় চা দিচ্ছি।”
বলেই ব্যাগটা সোফার উপর রেখে নম্র ভেতরে চলে গেল। রুমে গিয়ে অত্যন্ত খুশিতে নম্র রুমের এপাশ থেকে ওপাশ হেঁটে বেড়াল। অধর থেকে হাসি যেন সরছেই না। শতাব্দের নিজেরও বোধহয় জানা নেই সে নম্রের জন্মদিনে নম্রকে কতগুলো সুন্দর মুহূর্ত উপহার দিয়েছে।
নোমান সাহেব নিঝুমকে ডেকে নম্রের ফোন বের করালো। নম্রের ফোন উলটে পালটে দেখতে গেলে দেখল ফোনে লক দেওয়া। নিঝুমের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
–“লক জানো?”
নিঝুম বাধ্য মেয়ের মত সত্যিটা জানালো, “জানি!”
নোমান সাহেব এগিয়ে দিল ফোনটা। নম্র সেদিনের পর আর লক বদলায়নি। তবে নিঝুমকে কঠিনভাবে হুমকি দিয়েছে যেন ওই ধরণের আচরণ নিঝুম না করে। নয়তো নম্র নিঝুমের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে। নিঝুম এতে ভয় পায়। নিঝুম যতই নম্রের সাথে বাঁদরামি করুক না কেন, দিনশেষে বোনের সাথে প্রাণখুলে কথা বলতে না পারলে তার কেমন দম বন্ধ লাগে। তাই নম্রের এই কথাটা মেনে নিয়েছিল সে।
নোমান সাহেব জানেন মেয়ের প্রাইভেট ফোন এভাবে দেখাটা অনুচিত। কিন্তু নিজের মনের খচখচানি দূর করতে এই কাজটা করতে বাধ্য হয়েছেন। ফোন ঘেটে নোমান সাহেবের চোখে নেতিবাচক কিছুই পড়েনি। এতে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েকে বিশ্বাস করে ভুল করেননি তিনি। তবে এরকম ছেলে আজ নাহয় কাল, প্রতিনিয়ত আসতেই থাকবে। ব্যাপারটা বেশি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যাওয়ার আগেই নোমান সাহেবকে মেয়ের জন্যে ব্যবস্থা করতে হবে। এতেই মেয়ের মঙ্গল। তিনি তৎক্ষণাৎ ছোটো ভাই নাফিজকে কল দিলেন। বিয়ের বিষয়ে কথা বলার জন্যে। কিন্তু নাফিজ কোনো এক অপারেশনে ব্যস্ত থাকায় কল ধরতে পারেনি।
রাতে যখন নম্র ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন হঠাৎ শতাব্দের মেসেজ এলো। “হ্যাপি বার্থডে” উইশ করেই বার্তাটি পাঠিয়েছে। নম্র চমকে চেয়ে রইলো। শতাব্দের তো জন্মদিনের ব্যাপারে জানার কথা নয়। নম্র ধন্যবাদ জানিয়ে বলল,
–“কী করে জানলেন আজ জন্মদিন আমার?”
–“নিঝুম জানালো। কেন, আমি জানায় তোমার কোনো ক্ষতি হলো নাকি?”
আবারও সেই ত্যাড়া কথা। নম্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তেই নম্রের নজর আপনা-আপনি পাশে ঘুমিয়ে থাকা নিঝুমের দিকে চলে গেল। পড়ার নাম করে শতাব্দের কাছে কী নম্রের সব খবর ফাঁস করা লাগবে? তবে নিঝুম এবার একটা ভালো কাজ করেছে। নম্র অন্তত জানতে তো পারল, প্রিয় মানুষ বিশেষ দিনে উইশ করলে কেমন অনুভূতি হয়?
~[ক্রমশ]