প্রণয় পাড়ে সন্ধি পর্ব-০৮

0
520

#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ০৮|
লাবিবা ওয়াহিদ

মানুষটা রাতারাতি বদলে গেল। নিমিষে, চোখের পলকে। নম্র’র পা জোড়া বারংবার থমকে যেতে চাইলেও অজানা শক্তি তাকে থমকাতে দিচ্ছে না। এ-কারণেই পা জোড়া চলমান। তবুও হাঁটু মৃদু কাঁপছে। এই কম্পনের ফলে বেগতিক হাঁটছে নম্র। মাতালদের মতো। তাদের যেমন এলোমেলো হাঁটে, নম্রও কিছুক্ষণের জন্য এলোমেলো হাঁটছিল।

দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে বুকের বা পাশে। সেই শব্দ তাকে আরও কিছু অপ্রস্তুত করে তুলল। তটস্থ হয়ে সে পাশটায় হাত দ্বারা চেপে ধরল। পরক্ষণে মিনমিনে গলায় বলল,
–“সেদিনের বাচ্চা নয়। মাঝখান দিয়ে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে।”
শতাব্দ ব্যাপারটা উপলব্ধি করে বলল, “তাইতো!”

শতাব্দের নরম, লহু গলার বাক্যটি বিরতিহীন নম্রের কানে তরঙ্গিত হচ্ছে। অন্তঃস্থলের মিশ্র অনুভূতিতে ভেসে ভেসেই শতাব্দের বাড়িতে পৌঁছালো তারা। বাড়ির গেটে আসতেই তার আফসোস শুরু হলো। পথটা আরেকটু দীর্ঘ হলে মন্দ হতো না। শতাব্দ দু’বোনকে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল।

কলিংবেল চাপার কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলল আনিশা। আনিশার অধরে লেপ্টে থাকা হাসিটাই জানান দিল, এতক্ষণ আনিশা তাদের অপেক্ষাতেই ছিল। নিঝুম চোখ বড়ো বড়ো করে আনিশার ফুলে থাকা পেটটা দেখল। আনিশা অন্তঃসত্ত্বা। হাসি-মুখে দু’বোনকে স্বাগতম করে বলল,
–“আরেঃ, এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?”

নিঝুম এবং নম্র একসঙ্গে ভেতরে আসল। আনিশা নম্রকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
–“এইটুকুনি মেয়েটা এত বড়ো হয়ে গেল কবে? সেদিনই তো স্কুল ছেড়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে কলেজে এলি। এখন এক লাফে অনার্সের তৃতীয় বর্ষে।”

ভাই-বোন একই কথা। নম্র কিছুটা লজ্জাও পেল বটে। এখনো সবাই সেই কিশোরী নম্রকেই খুঁজে বেড়ায়। সে নিজেও বুঝতে পারে না কী এমন আহামরি ছিল সে? আহামরি কিছু করেছে কী? প্রিয়’রা বুঝি আদরের ছোটো মেয়েকে বড়ো হতে দেখলে এমনই করে? নিঝুম পাশ থেকে বলল,
–“একদিন আমাকেও দেখবে চোখের পলকে বড়ো হয়ে গেছি আপু!”

নিঝুমের কথা শুনে আনিশা হেসে দিল। গাল টেনে বলল, “অবশ্যই!”
ওদের কন্ঠস্বর শুনে রুমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দীপালি বেগম সোফায় বসে চোখ ছোটো ছোটো করে তাদের কান্ড দেখছে। মুখে তার পান আছে। নিঝুম এবং নম্র তখনো তাকে লক্ষ্য করেনি। দীপালি বেগম হালকা কাশি দিয়ে মুখে পান নিয়েই বলল,
–“দরজার সামনে তামাশা না কইরা দরজাডা লাগাইয়া তামাশা কর। আইতে যাইতে মানুষ দেখলে কী কইবে?”

নম্র এবং নিঝুম ভারী কন্ঠস্বর শুনে সোফার দিকে চমকে তাকাল। নম্র আনিশার বদলে দরজা লাগিয়ে দ্রুত পায়ে দীপালি বেগমের কাছে গিয়ে বিনয়ের সুরে সালাম দিল। লহু কন্ঠে শুধাল,
–“আমাকে চিনেছেন দাদী?”

দীপালি বেগমের মুখের তেঁতো ভাবখানা নেতিয়ে গেল। মুখখানা স্বাভাবিক করে কিছুটা এগিয়ে নম্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অত্যন্ত নরম গলায় বলল,
–“চিনতাম না ক্যান? এতদিন আসোস নাই ক্যান? আমারে মনে পড়ে না নাকি রাখোস না?”

নম্র জিভে কামড় দিয়ে বলল,
–“কী যে বলো না দাদী। দাদীর ঘ্রাণ তো আমি তোমার কাছেই পেয়েছি। তোমাকে সহজে ভুলা যায়?”

ব্যাস! বরফের পাহাড় উষ্ণ তাপমাত্রা পেয়ে গলে জল হয়ে গেল। দীপালি বেগম মাঝেমধ্যে সবার সাথে চেঁচালেও আনিশা, শতাব্দ এবং নম্রকে খুব স্নেহ করেন। ভালোবাসেনও খুব। তবে বয়সের ভারে তার যেই রোগ হয়েছে, তাতে সে যখন তখন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। তখন কাকে কী বলেন নিজেরও হুঁশ থাকে না। এই ব্যাপারটা সবাই জানে, তাইতো এত তিক্ত বাণী শোনার পরেও দীপালি বেগমের প্রতি ভালোবাসা সবার একই রকম রয়ে গেছে।
দীপালি বেগম নিঝুমের দিকে চেয়ে বলল, “তোর ছোটোটায়?”
নম্র ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। নিঝুম চট করে দীপালি বেগমের কাছে এসে ভাব জমাতে শুরু করেছে। ততক্ষণে নম্রকে বোরকা খোলার তাগাদা দিল আনিশা।
নম্র আনিশার রুমে আছে। আনিশা দুই পদের আচার নম্রের সামনে দিয়ে বলল,
–“আমার ফুপি শাশুড়ীর হাতের আচার দারুণ! মুখে স্বাদ লেগে থাকার মতো। খেয়ে দেখ!”

আচার দেখে নম্রের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ল। তবুও সে উত্তেজনা সেরকম প্রকাশ না করে একটুখানি আচার মুখে পুরে নিল। সঙ্গে সঙ্গে দারুণ স্বাদে নম্রের চোখ বুজে এল। আনিশা নম্রের মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পারল তৃপ্তি। আনিশা তার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে, বিয়ের পরের সাংসারিক বিভিন্ন গল্প নম্রকে শোনাতে লাগল। গল্প করতে করতে রাত ন’টা বেজে গেল। কাজে আটকে যাওয়ার কারণে শতাব্দ তখনো ফিরেনি। এদিকে নম্রের মা তাকে কল করে করে অস্থির করে ফেলেছে। নোমান সাহেব বাড়ি ফিরেছেন আধ ঘন্টা আগে। বাসায় এসে রীতিমতো অস্থির হয়ে গিয়েছেন মেয়েদের এই অসময়ে বাড়িতে না থাকার কারণে।

এদিকে আবার হুট করেই আনিশা বেঁকে বসল। আজ নিঝুম, নম্র তার কাছেই থাকবে। সে কোনোরকম বারণ শুনবে না। তখনই আরিফ রহমান এলো। মেয়ের আবদার শুনে সে নিজে প্রাণ-প্রিয় বন্ধুকে আশ্বাস দিল, সঙ্গে বলল আজ দুই মেয়েকে আনিশা রাখতে চাচ্ছে। নোমান ব্যাপারটা মানতে পারল না। শত হোক, বাবা। মেয়েরা যতই বন্ধুর বাড়িতে যাক না কেন, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। আরিফ সাহেব বেশ সময় নিয়ে বুঝিয়ে খুব কষ্টে রাজি করালেন। কিন্তু বাবার মন কী এত সহজে বুঝ পায়? নম্র যুবতী মেয়ে, অবিবাহিত তাগড়া যুবক রয়েছে ও বাড়িতে। শতাব্দ না থাকলেও কথা ছিল। আরিফ রহমান ব্যাপারটা বুঝে নোমান সাহেবকে শান্ত করলেন।

রাতে খাবারের বিরাট আয়োজন। কয়েক পদের রান্না করেছে রুমা আজ। চেয়ার টেনে সকলে খাবার টেবিলে বসেছে সবে, তখনই কলিংবেল বাজল। রত্না কাজ ফেলে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিল। নম্র পিছে ফিরে তাকাতেই শতাব্দকে দেখতে পেল। কিছু মুহূর্তের মধ্যে শতাব্দও তাকিয়েছে। নম্র চট করে সামনে ফিরে তাকাল। রুমা এবং আনিশা ততক্ষণে ভাত এবং তরকারি মেহমানদের পাতে দিতে ব্যস্ত। রুমা ব্যস্ত কন্ঠে শতাব্দের উদ্দেশ্যে বলল,
–“ফ্রেশ হয়ে দ্রুত খেতে আয় বাবা!”

শতাব্দ যেতেই নম্র প্লেটে ভাত নাড়তে লাগল, এবং অল্প করে খেতে লাগল। একে তো ভদ্রতা, তার উপর শতাব্দ’র সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়ার তীব্র বাসনা। শতাব্দ মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এল। বসল মায়ের পাশে। দীপালি বেগম ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। শতাব্দ আসতেই নম্র নড়েচড়ে বসল। অতঃপর শতাব্দকে লক্ষ্য করার পাশাপাশি খাওয়ার গতি বাড়িয়ে দিল। আজ লজ্জায় সরাসরি তাকাতেও পারছে না শতাব্দের পানে। বারবার নুডুলসের ঘটনাটা মস্তিষ্কে খেলে বেড়াচ্ছে।

খাওয়ার মাঝেই আরিফ সাহেব হঠাৎ শতাব্দের উদ্দেশ্যে বললেন,
–“আজকে শতাব্দ চিলেকোঠায় ঘুমিও!”
শতাব্দের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ঘাড় বাঁকিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বাবার দিকে তাকাল। আরিফ সাহেব ততক্ষণে নম্রের দিকে ইশারা করল। বলল,
–“নম্র এবং নিঝুম আজ আমাদের বাসায় থাকবে। তোমার ঘরেই থাকবে। তুমি বরং চিলেকোঠার রুমটায় চলে যেও!”

শতাব্দ যা বোঝার বুঝে নিল। নীরব থেকে আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিল। নম্র নীরবে বাবা-ছেলের কান্ড দেখল। অদ্ভুত ব্যাপার, শতাব্দ কিছুই বলল না। মানুষ তো ঠিক আছে কিংবা আচ্ছাও বলতে পারে। এত গাম্ভীর্যে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে কেন মানুষটা? খাবার টেবিলে আনিশা, রুমা এবং আরিফ সাহেবের গলাই শোনা গেল। মাঝেমধ্যে নিঝুম বেশি কিছু বলতে নিলে নম্র চিমটি মেরে চুপ করিয়ে দিয়েছে।

ভোর পাঁচটায় নম্র ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসল। তার চোখ-গুলো বোধহয় লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। এছাড়াও চোখ জোড়া অস্বাভাবিক লাগছে। যেন সারা-রাত তার ঘুম হয়নি। সত্যি-ই হয়নি। যে ঘরে শতাব্দের ঘ্রাণ আছে, যে বিছানায় শতাব্দের ছোঁয়া আছে সেই বিছানায় নম্রের ঘুম কী করে আসবে? নিঝুম যখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল তখন নম্র লাইট জ্বালিয়ে পুরো ঘরে কয়েকবার করে ঘুরেছে। প্রতিটা জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছে। শতাব্দের রুম বেশ গোছালো, পরিপাটি। আহামরি বড়ো না হলেও ফার্ণিচার, রুমের রঙের ব্যাপার নিয়ে শতাব্দের চিন্তা-চেতনা সুন্দর। শতাব্দের অনুমতি ছাড়া তার পারফিউমের মুখ খুলে নম্র ঘ্রাণ নিয়েছে। ঘাড়ের একপাশে অবশ্য একটু দিয়েছেও। এতেই যেন মনে হচ্ছে শতাব্দ তার খুব কাছে। বিছানার চাদর রুমাকে বদলাতে দেখেছিল। তাই বালিশ বুকে জড়িয়ে রাখার ইচ্ছেটা হয়নি।

সারারাতে করা নিজের পাগলামি গুলো মাথায় আসতেই নম্র আপনমনে হাসল। আবারও পুরো রুমে চোখ বুলালো। দেয়ালে কোনো ছবির ফ্রেম নেই। তবে কিছু মোটিভেট লাইনের ক্যালিওগ্রাফী শতাব্দের টেবিলের ওপার দেয়ালে ঝুলছে। এছাড়া দেয়ালে বিশেষ কিছু নেই।

নম্র নিঝুমকে ফেলে বেরিয়ে এল। চারপাশ নীরব। এখনো সূর্য ওঠেনি বলে কথা। নম্র অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে সুইচ খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে শক্ত কারো সাথে ভীষণ জোরে ধাক্কা খেল। ধাক্কার কারণে দেয়ালে মাথার পেছন দিকটা লেগেছে। যার কারণে মৃদু শব্দও হয়। নম্র সেই ব্যথাতে কপাল কুচকে ফেলল। মৃদু আর্তনাদ করল। খুবই নিম্ন কন্ঠে। যেন সে একটু শব্দ করলেই যে-কেউ বেরিয়ে আসবে। হঠাৎ তার সামনে থেকে ভারী কন্ঠস্বর কানে এলো,
–“তুমি নম্র? ঠিক আছ তো?”

নম্র তাকাল। কন্ঠের মালিককে চিনতে পারলেও কন্ঠের মালিককে দেখতে চাচ্ছে সে। অন্ধকারে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে যখন চোখ সয়ে গেল তখনই শতাব্দের উপস্থিতি দেখতে পেল। শতাব্দ এক ধাপ এগিয়ে এল। বোধহয় নম্রের উত্তর পায়নি বলে। নম্র মৃদু কন্ঠে বলল,
–“ঠিক আছি। কিন্তু আপনি এই সময়ে? আপনার তো চিলেকোঠার ঘরটায় থাকার কথা!”

–“ঘুম ভেঙে গেছে। বাইরে যাব, এজন্যে রান্নাঘরের সামনের দেয়াল থেকে চাবি নিতে এসেছিলাম। এমন সময়ে এই দুর্ঘটনা। তুমি এই সময়ে উঠেছ কেন?”

নম্র সত্যটা বলতে পারল না। কথা ঘুরিয়ে বলল,
–“আসলে নতুন জায়গায় সেভাবে ঘুম হয় না। এজন্যে বাইরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম।”

নম্র থেমে আবার বলল,
–“বাইরে যেহেতু যাচ্ছেন, আমাকেও নিয়ে যাবেন? আমার ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় হেঁটে বেড়ানোর খুব ইচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকে গেছে!”

শতাব্দ চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল। অতঃপর বলল,
–“আসতে পারো আমার সঙ্গে।”

~[ক্রমশ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে