প্রণয় পাড়ে সন্ধি পর্ব-০৭

0
567

#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ০৭|
লাবিবা ওয়াহিদ

রোদহীন ফ্যাকাসে বিকাল। শহরজুড়ে উষ্ণ হাওয়া বইছে। ভ্যাপসা গরমে জর্জরিত শহুরে বাসিন্দা। ভ্যাপসা গরম অনেক সময় বৃষ্টির পূর্বাভাস হয়ে আসে। আপাতত গরমে বিরক্ত হয়ে কিছু জন সেই প্রত্যাশাতেই বসে রয়েছে। কেউ-বা বিরস মুখে আকাশের পানে চেয়ে তার কাছে অভিযোগ করছে। কেন আকাশের বুকে মেঘ জমছে না? কেন আকাশ তার দুঃখ লুকিয়ে এমন তীর্যক দ্যুতি ছড়াচ্ছে? সঙ্গে রয়েছে বাতাসের প্রতি অভিযোগ। শীতল হাওয়া দিতে কিসের এত কৃপণতা? কোনো উত্তর নেই। প্রকৃতি তার নিজ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

আকাশ-পাতাল ভাবছিল নম্র। ভ্যাপসা গরমে তার মুখ ঘেমে গিয়েছে। সঙ্গে কপালে বিরক্তির ভাঁজ। রান্না-ঘরে থাকায় কৃত্রিম হাওয়ার-ও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে সে। শতাব্দ আজ বিকালেই চলে এসেছে। শতাব্দ আগে-ভাগেই নোমান সাহেবকে জানিয়ে রেখেছে তার এই এলোমেলো সময়ের কথা। যেহেতু তার বেকারির কাজ চলছে সেহেতু শতাব্দ একটু ব্যস্ত সেদিক নিয়ে। তাই ব্যস্ততার কারণে সে নির্ধারিত সময় ঠিক করতে পারছে না। নেহাৎ-ই নোমান সাহেবের অনুরোধে টিউশনি করাতে রাজি হয়েছে। নয়তো এই মুহূর্তে কোনো রকম টিউশনিতে সময় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। নোমান সাহেব বেশ ভাল করে সবটা বুঝেই শতাব্দকে রেখেছে। কোনোরকম অভিযোগ নেই তার। সে নিজেই নিঝুমকে বলে দিয়েছে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোথাও যেন না বেরোয়। এই সময়ের মধ্যে-ই শতাব্দ আসবে বলে জানিয়েছে।

এদিকে বেশ কয়েকদিন নম্রের টিউশনিতে না যাওয়ার কারণে একটা টিউশনি তার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। এজন্যে এখন সে বিকালেই বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে যখন বিশ্রাম নিতে নিজের রুমে লম্বা করে শুয়ে পড়ে তখনই কলিংবেলের শব্দ। নম্র তখন কাউকে অনুমান করে মুচকি হাসে। এই মুহূর্তে শতাব্দ ছাড়া আর কাউকে অনুমানে আসছে না। এর মাঝে নিঝুম রুমে এসে বই-খাতা নিতে এলে নম্র চোখ মেলে তাকায়। নিঝুমের কাজ নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করে থমথমে গলায় বলল,
–“সাবধানে!”

নিঝুম ভেংচি কেটে বই নিয়ে চলে গেল। আর নম্র চোখ বুজে সেভাবেই শুয়ে রয় মিনিট পাঁচেক। পরে কী যেন হয় তার। চট করে উঠে খোলা চুল খোপা করে মাথায় ওড়না জড়িয়ে রান্না-ঘরে চলে যায়। গিয়ে দেখে সাবরিনা রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কার জন্যে এই প্রস্তুতি চলছে সেটা নম্র বুঝতে পেরে বলল,
–“আমি বানাই মা। তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো!”

–“সে কী কথা? তুই তো সবেই এলি। আমি করতে পারব, তুই যা!”

নম্র একপ্রকার ঠেলে-ঠুলে মাকে রান্না-ঘর থেকে বের করে দিল। অতঃপর দ্রুত হাতে সবজি কেটে নেয়। চুলোয় ততক্ষণে নুডুলস সিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ মা এসে ধাক্কা দিতেই নম্রের ধ্যান ভাঙল। সাবরিনা চুলোর আঁচ কমিয়ে বলল,
–“ধ্যান-জ্ঞান কোথায় থাকে? আরেকটু হলেই তো চা পড়ে যেত। অনেক কাজ বাড়িয়েছিস আমার। এখন গিয়ে বিশ্রাম কর। বাকিটা আমি দেখছি!”

নম্র হাতের উলটোপিঠে কপালের ঘাম মুছে বলল,
–“আমি যেহেতু ধরেছি শেষ করেই যাব। গরমে খেয়াল করিনি!”

বলেই হাতের খুন্তি নাড়াতে লাগল নম্র। এতক্ষণ গরমে বিরক্ত হলেও নুডুলসের দিকে তাকাতেই কপালের ভাঁজ উবে গেল। নিজের অজান্তেই অধর কিছু বাঁকিয়ে মুচকি হাসল। এই রান্না শুধুই শতাব্দের জন্যে। শতাব্দ খেয়ে কীরকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে সেটাই ভাবছে সে।

———
নম্র পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে শতাব্দের খাওয়া দেখছে। সে খাচ্ছে আর নিঝুমের খাতা দেখছে। তার হাত নাড়ানো, খাওয়ার সময় গালের নড়াচড়া, চাহনি, ভাব-ভঙ্গি সবটাই এক নজরে দেখছে সে। নুডুলস মুখে দেওয়ার পরেও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। কেমন হয়েছে কে জানে? শতাব্দ হঠাৎ নিঝুমকে জিজ্ঞেস করল,
–“এটা কে রান্না করেছে?”

প্রশ্নটা সুঁচের মতো নম্রের হৃদয়ে গিয়ে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। পর্দা খামচে চাতক পাখির মতো চেয়ে রইলো শতাব্দের মুখপানে। প্রত্যাশিত কিছু শোনার অপেক্ষায়।
নিঝুম লেখা ছেড়ে মৃদু গলায় বলল, “আপু!”
শতাব্দ ছোটো করে শুধু “ওহ”, এই একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করল। নম্রের সব আশায় জল ঢালার প্রস্তুতি চলছে। নম্র তাও নিজেকে সামলে আরও দু’মিনিট দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু শতাব্দ মুখে ততক্ষণে কুলূপ এঁটেছে।

কিছু মানুষের অন্যকারো গাম্ভীর্য, কথা কম বলা স্বভাবের জন্যে আফসোস হয়। নম্র এই মুহূর্তে সেই আফসোসটাই বুকে লালন করছে। হতাশ হয়ে রুমে চলে গেল সে। কোনো রকম ভাবনা ছাড়া বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে ফেলল। এই গরমে টিকে থাকা যাচ্ছিল না। মায়েরা যে কী করে এত গরম সহ্য করে ঘন্টার পর ঘন্টা চুলোর সংস্পর্শে থাকে সেটা নম্র ভাবতেই পারছে না। মায়েদের বোধহয় আলৌকিক শক্তি আছে। তাইতো তারা দু’হাতে সমস্ত সংসারকে যত্ন, ভালোবাসায় রাঙিয়ে রাখে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি তাদের ক্লান্তহীন পরিশ্রম চলে। নম্রের মাঝেমধ্যে এসব দেখলে চোখ জোড়া জলে ভিঁজে যায়। ইচ্ছে করে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, খুব ভালোবাসি তোমায়। টিউশনির টাকা জমিয়ে গত মাসে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছিল মাকে। সাবরিনা তো কেঁদেই দিয়েছিল খুশিতে। সেই খুশি দেখার পর চোখে যেন সেই দৃশ্যের রেশ এখনো থেকে গেছে। ভালো স্মৃতি হিসেবে মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে যায়।

গোসল সেরে বেরিয়ে আসতেই সাবরিনা বলল শতাব্দের সাথে তাদের বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসতে। আনিশা নাকি শতাব্দকে বলেছে ফেরার পথে নম্রকে নিয়ে আসতে। আবার নোমান সাহেব ফেরার আগে আগেই নাকি শতাব্দই বাসায় দিয়ে যাবে। আনিশা এসেছে বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু নম্র ব্যস্ততায় আনিশার সাথে আর দেখা করে উঠতে পারেনি। ভুলেও গেছে আনিশার আসার ব্যাপারটা, সেটা নম্র নিজেও অস্বীকার করেনি। নম্র ভুললেও আনিশা তাকে ভুলেনি। তাইতো এই আবদার তার সন্ধ্যাবেলায়।

শতাব্দের সাথে যাওয়ার কথা শুনে আনিশার মন নিজের অজান্তেই নেচে উঠল। খুশি প্রকাশ না করে বলল,
–“কাল সকালে গেলে হয় না?”

–“শতাব্দ জানালো কাল সকালেই নাকি আনিশার হাসবেন্ড এসে ওকে নিয়ে যাবে। এজন্যে আজ-ই দেখা করতে চাচ্ছে।”

সাবরিনা থেমে আবার বলল,
–“এই সন্ধ্যাবেলায় বের হতে দিতে চাচ্ছি না। কিন্তু মেয়েটা শতাব্দকে কয়েকবার কল করল। আমাকেও কল করে অনুরোধ করল। চেয়েও না করতে পারিনি। বোরকা পরে নে। শতাব্দ অপেক্ষা করছে!”

সাবরিনা চলে গেল। নম্র ঘড়ির সময় দেখে দ্রুত পায়ে আলমারি থেকে বোরকা বের করল। সেটা পরে তৈরি হয়েছে নিল ঝটপট। বেরিয়ে আসতেই দেখল নিঝুম লিভিংরুমে বসে বসে পা ঝুলাচ্ছে। পরনের ড্রেস দেখে নম্রের বুঝতে বাকি রইলো না, নিঝুমও তাদের সাথে যাচ্ছে। নম্র কিছুটা আহত হলো।

নিঝুম আগে আগে হাঁটছে, আর পিছে নম্র এবং শতাব্দ। শতাব্দ ফোনে ব্যস্ত। নম্র দু’হাত একসাথে চেপে ধরে কম্পিত পায়ে চলছে। সন্ধ্যার পর ভ্যাপসা গরমটা অনুভব হচ্ছে না তেমন। তবে এখন বাতাসের চিহ্ন নেই। প্রকৃতি নীরব। মহল্লায় শুধু রিকশার টুংটাং শব্দ-ই কানে এসে লাগছে।

নম্র মনে কিছুটা সাহস জুগালো। আমতা আমতা করে মৃদু গলায় আওড়াল, “শুনুন!”

শতাব্দ ফোন থেকে নজর সরিয়ে নম্রের দিকে তাকাল। এটা নম্র নিয়ন আলোয় আলোকিত পথের দিকে চেয়ে ঢের বুঝতে পারল। অধর জোড়া জিভ দিয়ে ভিঁজিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে শতাব্দের দিকে তাকাল। কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বলল,
–“নুডুলস কেমন হয়েছে?”

শতাব্দ উত্তর দিতে সময় নিল না। একপ্রকার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, “লবণ বেশি হয়েছে!”
নম্রের মনটা যেন ভেঙে গেল মুহূর্তেই। জীবনে প্রথমবার এত ভালোবাসা দিয়ে প্রিয় মানুষটার জন্যে কিছু রাঁধল। এই রান্না-ই কী না বিফলে চলে গেল? প্রথম পরীক্ষাতেই ফেইল? নম্র রান্না পারলেও সে লবণের পরিমাণ নিয়ে একটু ভেজাল করে সবসময়ই। আজ কেন এই ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল? আগে জানলে মাকে দিয়ে টেস্ট করাতো। মুখটা ছোটো হয়ে গেল তার।

এদিকে মেয়েদের বিদায় দিয়ে টিভির সামনে বসেছে সাবরিনা। সে সিরিয়াল প্রেমী। হাতে তার নুডুলস। সিরিয়ালে মনোযোগ দিয়ে এক চামচ নুডুলস মুখে পুরতেই তার কপাল কুচকে গেল। খেতে খেতে আপনমনেই বলল,
–“লবণটা বেশি হয়েছে। শতাব্দ এই নুডুলস সব খেল কীভাবে? কোনো অভিযোগ-ও করল না?”

পথে নম্র আর একটা কথাও বলেনি। মুখে কুলূপ দিয়ে হাঁটছে সে। শতাব্দ হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বলল,
–“লবণের মতো করে কী সাতারটাও শেখোনি?”

শতাব্দের হঠাৎ প্রশ্নে নম্র চমকে গেল। চোখে ভেসে ওঠে সেই জীবন্ত দৃশ্য। শতাব্দের দিকে ফিরে তটস্থ হয়ে বলল,
–“সাতার শিখেছি। লবণের পরিমাণটা বোঝা বাকি!”
শতাব্দ দূরের থেকে নজর সরিয়ে নম্রের দিকে তাকাল। অধর বাঁকিয়ে বলল,
–“সেদিনের বাচ্চা মেয়েটা আজ রান্না করেছে। এ-ই বা কম কিসের?”

~[ক্রমশ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে