#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ০৬|
লাবিবা ওয়াহিদ
টিউশনি শেষ করে নম্র বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়। আকাশে তখন নিভু নিভু হলদেটে আলো। ক্লান্ত এবং ঘামে জর্জরিত নম্র রুমে যেতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। নম্রের রুমেই শতাব্দ নিঝুমকে পড়াচ্ছে। রুমে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে শতাব্দ এবং নিঝুম দুজনেই দরজার দিকে চাইল। শতাব্দের সাথে চোখাচোখি হতেই নম্র চোখ নামিয়ে সালাম দিল শতাব্দকে। এরপর ড্রয়ার থেকে জামা নিয়ে সে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। শতাব্দ তখন নিঝুমকে আবারও অংকে মনোযোগ দিতে বলল।
নম্রের ধারণা ছিল শতাব্দ বিকালে এসে পড়িয়ে চলে যাবে। তাই বোধহয় একদমই আশা করেনি শতাব্দকে। ফ্রেশ হওয়ার সময় নানান চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রথম শতাব্দ তার ঘরে এসেছে। এরপরেই আবার মনে পড়ল রুমের কথা। চোখ বড়ো বড়ো আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, রুম আবার অগোছালো নেই তো? নিঝুমের রুমে জামা-কাপড় ছড়িয়ে রাখার অভ্যাস। সাথে জায়গার জিনিস জায়গায় কখনোই রাখে না। নম্র গোছালো স্বভাবের হলেও নিঝুম সম্পূর্ণ বিপরীত। দু’বোনের মেজাজ, চাল-চলন কোনোটাতেই মিল নেই। শুধু মিল বোধহয় খাবারের দিকে।
এই মুহূর্তে না চাইতেও নম্র ওভার থিংকিং-এ ডুবে গেল। জামা-কাপড় বা গামছা কী খাটে রেখেছে? বালিশ ঠিক আছে? কাঁথা কী ভাঁজ করেছে নাকি সেটাও এলোমেলো? বিছানার চাদর কুচকে নেই তো? টেবিলটাও তো ঠিক থাকে না। দুশ্চিন্তায় নম্র ঘামতে শুরু করল। শতাব্দকে দেখে এতটাই এলোমেলো হয়ে গেছিল যে রুমটাতে ভালো করে নজর বুলিয়ে দেখেনি। পছন্দের মানুষটার কাছে ছোটো হতে কে চায়? শতাব্দ তাকে কী ভাববে এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই নম্র’র গলা শুকিয়ে এলো। তড়িঘড়ি করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেও শব্দ করল না। বাথরুমের ছিটকিনি লাগিয়ে নম্র রুমটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিল। নাহ, নম্র অতিরিক্ত ভাবছিল। সব তো ঠিকঠাক-ই আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নিশ্চয়ই মা গুছিয়ে দিয়েছে আগেই। শতাব্দের দিকে চোখ যেতেই দেখল শতাব্দ তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। নম্র হালকা হাসার চেষ্টা করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
রুম থেকে বের হতেই দেখল সাবরিনা অর্থাৎ নম্রের মা নাস্তা সাজাচ্ছে শতাব্দের জন্যে। নম্র সেই নাস্তা থেকেই একটা বিস্কুট মুখে পুরে নিল। এতে সাবরিনা চোখ গরম করে তাকাল। নম্র সেটা তোয়াক্কা না করে চানাচুরও কিছুটা খেয়ে নিল। এবার সাবরিনা চাপা স্বরে ধমক দিল। নম্র এবারও সেরকম পাত্তা না দিয়ে খাবার মুখে নিয়েই বলল,
–“যার দু’দিন পর বেকারি হবে, তাকে এসব বিস্কুট আর চানাচুর দিয়ে কী হবে? তার যদি ভালো না লাগে?”
–“সেসব তোর ভাবতে হবে না। আমি তো জানতাম-ই না শতাব্দ আজই আসবে। তোর বাবা শতাব্দ আসার কিছুক্ষণ আগে কল করে জানিয়েছে। এইটুকু সময়ে আয়োজন করা যায় বল? তাই হাতের কাছে যা ছিল তাই দিচ্ছি। এখন তুই এসব পাগলামি করছিস কেন?”
নম্র যেই প্লেট থেকে বিস্কুট আর চানাচুর নিল সেই প্লেটে থেকেই আবার শতাব্দ খাবে, এই চিন্তা করে নম্র ছোটো-খাটো পাগলামি করেই ফেলল। বরং তার এই ধরণের পাগলামি করে ভালো লাগছে। তাই করেছে, এটা তো আর মাকে সরাসরি বলা যায় না। এজন্যে শেষ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে নম্র পালটা প্রশ্ন করল, “এসেছে কখন?”
–“আধঘন্টা হবে। এখন থাক, আমি দিয়ে আসি নাস্তা!”
নম্র আর কথা বাড়ালো না। সে চুপচাপ লিভিং রুমে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসল। ব্যাগটা কোনোরকমে টেনে ফোনটা বের করে ফোনে মনোযোগ দিল। আর যাইহোক, সে তো চাইলেই তার রুমে গিয়ে শতাব্দের সামনে বিছানায় শুয়ে পড়তে পারবে না। বিষয়টা কটু লাগে। এজন্যে নম্র ক্লান্ত হলেও শতাব্দের জন্যে এটুকু সেক্রিফাইজ করল। নম্রের তো ভাবতেই দারুণ লাগছে, শতাব্দ তার বাসায়। তারই ঘরে। নম্রের শতাব্দকে নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল মায়ের কথা। হঠাৎ কী মনে করে নম্র নির্দিষ্ট একটি রান্নার রেসিপি বের করে দেখতে লাগল। শতাব্দের জন্যে স্পেশাল কিছু বানাতে চাচ্ছে নম্র। রান্না-বান্না পারে মোটামুটি। স্পেশাল মানুষের জন্যে রান্না করার আনন্দটাই বোধহয় ভিন্ন। কিংবা রান্নার মাধ্যমে সহজেই প্রিয় মানুষটার প্রশংসা পাওয়া যেতে পারে।
ঘন্টা দেড়েক পড়িয়ে শতাব্দ চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। সাবরিনা কুশল বিনিময় করল মিনিট দুয়েক, শতাব্দের সাথে। শতাব্দও হাসি-মুখে কথা বলেছে। আর নম্র দেখাচ্ছে সে ফোনে মশগুল, কিন্ত এমনটা নয়। নম্র আড়চোখে শতাব্দকেই লক্ষ্য করছিল। শতাব্দ সাবরিনাকে বিদায় দিয়ে চলে যেতেই নম্র উঠে হাত জোড়া দুদিকে দিয়ে টানটান করল। অতঃপর হাই তুলতে তুলতে রুমে যাওয়ার সময়ে শুনল সাবরিনার কথা।
–“কাল থেকে শতাব্দকে লিভিং রুমেই বসতে বলব। তুই তো জমিদারের নাতি। নিজের রুম ছাড়া অন্য রুমে শুলে গায়ে কাঁটা ফুটে!”
ব্যাপারটা ঠিক এরকম না। নিজের ঘরে নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে। এটা নম্রের ভাল লাগে। এছাড়া এটা বাজে অভ্যাসও বলা যায়। রুমে গিয়ে নম্র দেখল নিঝুম বিছানার মাঝখানে বসে ফোন টিপছে। ফোনটা সাবরিনার। নম্র উঁকিঝুঁকি মেরে বলল,
–“কী করছিস?”
নিঝুমের অধরে যে হাসি লেপ্টে ছিল তা নম্রের নজর এড়ায়নি। নিঝুম মুখে হাসি নিয়েই বলল,
–“সামিয়াকে জানাচ্ছি, আমার স্যার কত হ্যান্ডসাম!”
তড়াক করে নম্রের মাথাটা জ্বলে উঠল যেন। ছোঁ মেরে নিঝুমের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিল সে। গর্জে উঠে বলল, “এগুলা কী ধরণের কথা?”
নিঝুম কপাল কুচকে বলল, “কী এমন বললাম? স্যারকে ভালো লেগেছে তা বলতে পারব না?”
হাঁটুর বয়সী মেয়ের এই ধরণের কথা শুন নম্রের জ্বালাটা মাথা থেকে এবার সারা শরীরে ছড়াতে শুরু করল। তার শতাব্দকে নিয়ে এগুলা কী ধরণের কথা? তাও কি না ছোটো বোনের মুখে? নম্র নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“তোদের বয়সে থাকতে স্যারদের বাপের আসনে বসিয়েছি। এখনো বাপ-ই ভাবি তাদের। আর তুই কী না হেড মাস্টারের মেয়ে হয়ে এসব চিন্তা করিস? দেখ নিঝুম, আমি ফারদার যদি এই ধরণের কিছু শুনেছি বা তোর মনেও উলটো পালটা কোনো চিন্তা আসে তাহলে তোর স্যারকে তো বাদ দিবই সাথে মেরে তোর পিঠের ছালও তুলে নিব। বেয়াদব মেয়ে!”
নিঝুমের সব কথা মাথার ওপর দিয়ে গেল যেন। কী এমন বলল যে নম্র এরকম উগ্র আচরণ করছে? নিঝুমের তো মনে পড়ে না সে আদৌ রাগ করার মতো কিছু বলেছে নাকি? নিঝুম আর কিছু বলল না। নম্রের ধমক খেয়ে মনমরা হয়ে পড়তে বসল। আর নম্র নিঝুমের চ্যাট পড়ে ডিলিট করে দিল।
রাতে ঘুমানোর সময় নম্র নিঝুমকে আলতো গলায় ডাকল।
–“নিঝুম, ঘুমিয়ে গেছিস?”
–“না, ঘুমাইনি!”
নম্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “শতাব্দ তোর দুলাভাই হয়। সামনে থেকে কথা-বার্তা ভেবে-চিন্তে বলিস।”
নিঝুম লাফ দিয়ে উঠে বসল। অবাক হয়ে বলল,
–“সত্যি বুবু?”
নম্র হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। তবে নিঝুম উচ্ছ্বাসের সাথে বলল, “এজন্যই তো বলি তুমি হঠাৎ এত রেগে গেলে কেন?”
–“ব্যাপারটা সিক্রেট রাখতে হবে কিন্তু!”
–“কিসের সিক্রেট? আমি তো কালকেই স্যারকে বলে দিব সব। দুলাভাইও ডাকব!”
নম্র লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠল। পড়ার টেবিলেই সে ঘুমিয়ে গেছিল। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল স্বপ্ন দেখছিল। ঘাড়ে চিনচিন ব্যথা করছে। ছোটো ঘড়িতে চেয়ে দেখল এখন প্রায় মাঝরাত। নিঝুম বিছানায় ঘুমে কাত। নম্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় চলে গেল। ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশি ভাবছে। শুনেছে যেই ঘটনা নিয়ে বেশি ভাবা হয় সেটাই স্বপ্নে দেখে। বারান্দার গ্রীল ধরে অদূরে অনিমেষ চেয়ে রইলো সে। এখান থেকে শতাব্দদের বাড়িটা দেখারও ব্যর্থ চেষ্টা করল।
———–
অর্ণা নম্রকে নিয়ে আজ শপিংমলে এসেছে। তার কিছু কেনাকাটা করার আছে। কেনাকাটার কথা শুনে নম্র অর্ণাকে শতাব্দ’র মায়ের আউটলেটে নিয়ে গেল। “চৈতালি” নামে রুমার নিজস্ব ব্রেন্ড রয়েছে। এটা মোটামুটি ভালো পর্যায়ে আছে। রুমা অর্থাৎ শতাব্দের মা আউটলেটে তেমন থাকেন না। তিনি প্রোডাক্ট তৈরির দিকে বেশি খেয়াল রাখেন। আউটলেটে শতাব্দের খালাতো ভাই ইমন দেখা-শোনা করে। সে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করছে। সাথে খালার আউটলেটেও রোজ আসা-যাওয়া করে। তাই এদিকটা ইমন-ই দেখে বলা চলে।
অনাকাঙ্খিত ভাবে আউটলেটে শতাব্দ ছিল, তাকে দেখেই নম্রের হুঁশ উড়ে যায়। কল্পনাও করেনি এভাবে শতাব্দকে পেয়ে যাবে এখানে। শতাব্দ ইমনের সাথে কাউন্টারের পাশে হেলান দিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। সে একবার শুধু তাকিয়েছে নম্রের দিকে। পরবর্তীতে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ব্যতিব্যস্ত হতে দেখা যায়নি তাকে। নম্রও নিজেকে সামলে অর্ণাকে জামা দেখতে বলল। সাথে নিজেও টুকিটাকি এটা, সেটা দেখছে৷ ইমন নম্রকে দেখে কাউন্টার ছেড়ে উঠে এলো।
–“হ্যালো নম্র!
নম্র পিছে ফিরে ইমনের দিকে চেয়ে অমায়িক হাসি দিল৷ দুজনেই বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করল। তাদের কথা-বার্তাতেই বোঝা যাচ্ছে, দুজনে অপরিচিত নয়। এর মাঝে শতাব্দ এগিয়ে এল। ইমন নম্রকে দেখিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল,
–“আয় তোকে রেগুলার কাস্টমারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ভাই!”
নম্র শতাব্দের দিকে একপলক চেয়ে নিজ মনে আওড়াল,
–“কিছুদিন পর আপনার বেকারির রেগুলার কাস্টমার হয়ে যাব শতাব্দ ভাইয়া। অপেক্ষা করুন!”
~[ক্রমশ]