#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ০৫|
লাবিবা ওয়াহিদ
নম্র বাসস্ট্যান্ডে আনমনে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্দিষ্ট বাস আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বোধহয় নম্র আজ বাসা থেকে আগেই বেরিয়ে গেছে। আনমনে পনা থেকে বেরিয়ে হাত ঘড়িতে চোখ বুলালো। নম্রের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো এক ভাবনায় সে কাবু। হঠাৎ অনিক ছেলেটার কন্ঠস্বর কানে এলো নম্রের। পিলে চমকে উঠল তার। রোজকার মতো ইঙ্গিতপূর্ণ নানান কথা-বার্তা বলছে সে।
“আমার প্রিয়তমার সাথে কতদিন পর দেখা।”
“মিস করেছ বুঝি?”
“থাক, আর মিস করতে হবে না। খোকন নাম তো বাইক থেকে। আজ আমার পাখিটাকে নিয়ে বাইক রাইড দিব।”
“কী জান পাখি? লজ্জা পাচ্ছ কেন? চলে এসো। দেখো, খোকন নেমেছে!”
গা ঘিনঘিন করে উঠল নম্রের। ভেতরটাও অস্বস্তি এবং বিতৃষ্ণায় মাখোমাখো হয়ে গেল। অনিককে যথা-সম্ভব এড়িয়ে গিয়ে আশেপাশে এলোমেলো নজর ফেলল। রাগে মস্তিষ্কের রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে তার। এই বখাটেটার জন্যে তার শতাব্দ ভাই বিনা-দোষে মার খেয়েছে, শতাব্দ’র সামনে নিজে ছোটো হয়েছে। এত বছর পর শতাব্দের এখানে ফিরে আসার খুশিটাও সে পুরোপুরি ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। সাহস থাকলে কিংবা অস্বস্তি না থাকলে হয়তো অনিকের মাথায় আস্ত এক ইট ছুঁড়ে মা’র ত। কিন্তু অদম্য ইচ্ছে-খানাসে প্রকাশ্যে পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
হঠাৎ শতাব্দকে চোখে পড়ল নম্রের। নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে আলাদা শক্তি পেল, স্বস্তি অনুভব করল। নম্র কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা শতাব্দের দিকে পা বাড়াল। পেছন থেকে অনিক তাকে ডাকল স-শব্দে। আশেপাশের লোকজন, যারা পথচারী কিংবা বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে তারা প্রত্যেকেই অনিকের বখাটেপণা এবং নম্রকে কোণা চোখে দেখছে। কিন্তু এই অল্পসংখ্যকের মধ্যে একজনও গলা উঁচিয়ে প্রতিবাদ করেনি। এ-কারণেও নম্রের মনে চাপা ক্ষোভ জন্মেছে। এজন্যে এই মুহূর্তে তার ভরসা বলতে একমাত্র শতাব্দ ভাই।
শতাব্দ কলে কারো সঙ্গে কথা বলছিল বাসস্ট্যান্ডের একপাশে দাঁড়িয়ে। দোকান দিতে সে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছে। বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশেই তার বড়ো ব্যাকারীটা হবে। কথা বলার মধ্যে অনুভব করল পিঠের একাংশ কেউ একজন খামচে ধরে আছে। শতাব্দ মোবাইল কানে দিয়েই চমকে পিছে ফিরল। নম্র মুখ তুলে চাইল শতাব্দের দিকে। মুহূর্তে-ই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। এই চোখাচোখি’র বেশিক্ষণ স্থির হলো না। নম্র আড়ষ্টতায় নজর নামিয়ে ফেলেছে। শতাব্দ ভ্রু কুচকাতেই নম্র হাত দিয়ে সামনে ইশারা করল। লম্বা দম নিয়ে বলতে শুরু করল,
–“বাইকে বসা ছেলেটা খুব বিরক্ত করছে। একেই আপনি ভেবে সেদিন বড়ো ভাইয়ারা আপনার গায়ে হাত তুলেছিল। সেদিনের জন্যে আমি দুঃখিত। আর প্লিজ এদের থেকে আমাকে বাঁচান!”
শতাব্দ কিছুক্ষণ একমনে নম্রের মুখশ্রী পানে নজর বুলিয়ে কল কেটে দিল। পরক্ষণে নম্রের ইশারা করে স্থানে তাকাল। শতাব্দ তাকাতেই অনিক তার বন্ধুকে নিয়ে দ্রুত বাইক নিয়ে পালাল। তা দেখে নম্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এর মাঝে শতাব্দ হঠাৎ ভারী বলায় বলে ওঠে,
–“ওরা তো চলে গেছে। এখনো কী আমার শার্ট ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে মিটেনি?”
নম্র বিষম খেল যেন শতাব্দের এই ধরণের কথায়। চট করে ছেড়ে দিল শতাব্দের শার্ট। এতক্ষণ খামচে ধরে রাখা হাত-খানা অস্বাভাবিক কাঁপছে। অত্যন্ত লজ্জায়, অস্বস্তিতে হাবুডুবু খেয়ে ফেলল সে। আমতা আমতা করে বলল,
–“স্যরি। সত্যি খেয়াল করিনি।”
শতাব্দ বিশেষ কিছু বলল না। এর মাঝে বাস চলে এলো। নম্র যাওয়ার আগে শতাব্দকে বলল,
–“আপনার রাগ কমেছে তো? প্লিজ নিঝুমকে পড়াতে আসবেন।”
শতাব্দ ফোনের দিকে চেয়ে বলল, “রাগ ছিল না!”
নম্র চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল শতাব্দের দিকে। অবাক কন্ঠে বলল, “রাগ নেই সেটা আগে বললেই পারতেন। শুধু শুধু আমাকে দিয়ে এত দৌড়-ঝাপ করালেন কেন?”
শতাব্দ ফোন থেকে নজর তুলে বলল, “দেখতে চাচ্ছিলাম কিছু। দেখা হয়ে গেছে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। পরবর্তী বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে না চাইলে আমার সাথে এসো। ভার্সিটির দিকেই যাচ্ছি আমি!”
নম্রের সব মাথার ওপর দিয়ে গেল। বাক্যহারা হয়ে বাসের চলে যাওয়া দেখল নম্র। শতাব্দ কী দেখতে চেয়েছে? এছাড়া নম্রের প্রতি এত নরম? পরমুহূর্তে সব পাশে ফেলে শতাব্দের সাথে ভার্সিটি যাওয়ার ব্যাপারটা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই অনুভূতিতে অবশ হয়ে গেল নম্র। শতাব্দ সিএনজি ডেকে রিজার্ভ করল। শতাব্দ সিএনজিতে নম্রকে উঠতে ইশারা করলে নম্র বাধ্য মেয়ের মতো উঠে বসল। নম্র বসতেই শতাব্দও উঠল সিএনজিতে। নম্র এবং শতাব্দ পাশাপাশি বসেছে। এইটুকু ব্যাপার-ই নম্রের জন্যে অধিক উপভোগ্য। অসংখ্য সুখ উড়ছে তার অন্তঃস্থল জুড়ে। যা তার চোখ-মুখে ফুটে ওঠেছে নিজের অজান্তেই। শতাব্দ হয়তো কখনো জানবে না, তার পাশে বসা মেয়েটা শতাব্দকে হৃদয়খানা দিয়ে বসেছে।
———–
গালজুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে স্যান্ডউইচ মুখে পুরছে নম্র। শতাব্দের সাথে একসাথে ভার্সিটি এসেছে সে। শুধু পার্থক্য এটুকুই, নম্র ভার্সিটিতে প্রবেশ করেছে। আর শতাব্দ তাকে বিদায় দিয়ে তার কাজে চলে গিয়েছে। অর্ণা অর্থাৎ নম্রের বান্ধুবী চা খেতে খেতে ভ্রু কুচকে নম্রের হাব-ভাব লক্ষ্য করছে। দুই বান্ধুবী বর্তমানে ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছে। অর্ণা হুট করে বলে ওঠে,
“এত লাল হচ্ছিস কেন তুই? সামথিং সামথিং নাকি?”
অর্ণার কথা শুনে নম্র তার ভাবনা ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে বসল। স্যান্ডউইচে আরেক বাইট বসিয়ে স্বাভাবিক গলায় শুধালো, “তেমন কিছু না!”
“কিছু তো একটা অবশ্যই আছে। এই, কী লুকাচ্ছিস আমার কাছে?”
“তোকে বলার মতো কিছুই লুকাচ্ছি না!”
অর্ণার উৎসুক ভ্রু জোড়া মুহূর্তে-ই কুচকে গেল। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“বান্ধুবীকে তোর ভরসা নেই? এভাবে কথা পেটে রাখবি বান্ধুবীকে না বলে? তুই কী আদৌ পারিস আমাকে কিছু না বলে থাকতে?”
হেরে যাওয়ার নিঃশ্বাস ফেলল নম্র। আসলেই নম্র পারে না অর্ণার কাছে কোনো কথা লুকোতে। সব যেন অর্ণার সাথে শেয়ার করতেই হবে। তবে এতদিন তো দিব্যি লুকিয়েছে। এখন ফাঁস করাটা কী ঠিক হবে? এবার কিছুটা দোটানায় পড়ে গেল নম্র। এতদিন অর্ণা ধরতে পারেনি। আর আজ ধরে ফেলল। শেষে না পেরে বলতে লাগল,
“বোধহয় সামথিং সামথিং!”
অর্ণা খুশিতে মৃদু চেঁচিয়ে উঠল। দ্রুত বিল দিয়ে নম্রকে ক্যান্টিন থেকে টেনে-টুনে নিয়ে এলো। গন্তব্য কোনো এক সুন্দর, স্বচ্ছ, জনমানবহীন স্থান। যেখানে নম্রের কথা শুনে অর্ণার মন-প্রাণ গলে পানি হয়ে যাবে। এসব কথার জন্যে ক্যান্টিন কিছুতেই উপযুক্ত নয়।
নম্র তার মনের কুঠুরিতে আগলে রাখা মানুষটাকে নিয়ে প্রথমবার কারো সামনে মুখ খুলল। অর্ণাকে জানাল বহুদিন যাবৎ একজন তার হৃদয় জুড়ে শক্তপোক্ত বাসস্থান গড়েছে। এ-কথা শুনে অর্ণা ভীষণ খুশি। অর্ণা এ-অবধি দু’বার সম্পর্কে জড়িয়েছে। তবে নম্রকে এই ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন দেখত সে। কখনো নম্রকে চেয়েও এইদিকে আনতে পারেনি। তারও ইচ্ছে করে বান্ধুবীর প্রেমের গল্প শুনতে। অবশেষে নম্রের কথা শুনে বুঝল এতদিন কেন নম্র নিজেকে এমন গুটিয়ে রাখত।
অর্ণা উচ্ছাস ভর্তি কন্ঠে বলল,
“ও মাই গড নম্র! তুই প্রেমে পড়েছিস? কত বছর? জানতে দিসনি অপর মানুষটাকে?”
নম্র এবার ভাবনায় পড়ে গেল। আঙুলের কড় গুণে বলল, “হবে হয়তো পাঁচ বছর! জানাতে ইচ্ছে হয়নি কখনো।”
অর্ণা মুখ খুলে হা করে রইলো। এই মুহূর্তে এসে অর্ণার কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগল। কোনো মেয়ে মানুষ গোপনে পাঁচ বছর কাউকে ভালোবাসতে পারে? এত গভীর অনুভূতি দিয়ে? নম্র আনমনে হঠাৎ বলল,
–“জানিস অর্ণা। ভেবেছিলাম অনুভূতি গুলো মূর্ছা গিয়েছে। আবেগের বশে শতাব্দ ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু এখনো সেই আবেগ আমার পিছু ছাড়েনি। এতদিন পর এসে সেই একই অনুভূতি দারুণ ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে এবার। তবে কেন যেন এবার অনুভূতিগুলো মাটি-চাপা দিতে চাচ্ছি না। অনুভূতির দ্বন্দ্ব চলুক নাহয়।”
–“তখন তোর বয়স কত ছিল?”
নম্র মুখ ছোটো করে বললো, “সতেরো!”
–“কত লাকি ভাইয়াটা। সৌভাগ্যবান ভাইয়াটাকে দেখার খুব ইচ্ছা। না জানি কোন ছেলের জন্যে আমার এই বান্ধুবীটা এতগুলা বছর কুমারী থাকল!”
নম্র এবার অর্ণার পিঠে চাপড় মেরে চাপা গলায় বলল, “যাহ!”
অর্ণা এবার খিলখিলিয়ে হেসে দিল।
ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে আসতেই নোমান সাহেব কল করলেন নম্রকে। বাবার কল দেখে নম্র ভীষণ চমকিয়েছে! কল রিসিভ করে সালাম দিতেই অপরপ্রান্ত থেকে সালামের জবাব এলো।
–“কিছু বলবে বাবা?”
–“তুমি তোমার টিউশনি চালাতে পারো। শতাব্দ আজ থেকে নিঝুমকে পড়াতে আসবে বলেছে!”
নম্রের মন নেচে উঠল এ-কথা শুনে। কন্ঠে উচ্ছাস প্রকাশ করে বলল, “সত্যি বাবা?”
ফোনের অপরপ্রান্তে মেয়ের উচ্ছাস অনুভব করলেন নোমান সাহেব। মুহূর্তে-ই তার মন জুড়ে শান্তি নেমে এলো। সন্তানের ছোটো-খাটো খুশিতেও বাবা-মায়ের হৃদয় পুলোকিত হয়। নোমান সাহেবও ব্যতিক্রম নন। কন্ঠস্বর অত্যন্ত নরম করে বলল,
–“হ্যাঁ মা। তোমার ক্লাস শেষ?”
নম্র অধরে হাসি ঝুলিয়ে বলল, “জি বাবা।”
–“ঠিক আছে। তাহলে সাবধানে বাসায় যাও। আমি একটু কাজে ব্যস্ত। রাখছি!”
~[ক্রমশ]