#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ০৪|
লাবিবা ওয়াহিদ
নম্র নাজুক মনে বসে আছে সোফায়। পা জোড়া গুটিয়ে সোফার নিচে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। হাত দুটি মুঠিবদ্ধ করে হাঁটুর ওপরে রাখা। আড়চোখ বুলাচ্ছে পুরো ঘরটায়। রুমা অর্থাৎ শতাব্দের মা ভেতরের ঘরে। শতাব্দকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন সঙ্গে করে। শতাব্দের তখনকার নীরব কটুক্তিতে নম্র বেশ লজ্জিত হয়ে গিয়েছে। তাই না চাইতেও তাকে ভেতরে আসতে হয়েছে।
নম্রের ভাবনার মাঝে হঠাৎ রুমার কন্ঠস্বর কানে এলো। রুদ্ধস্বরে শতাব্দকে কিছু করতে বারণ করছে যেন। কন্ঠটা যেন আগের চেয়েও কাছাকাছি মনে হলো। এমন সময়ই শতাব্দ পরিপাটি হয়ে নম্রের দিকে না চেয়েই তার সামনে দিয়ে চলে গেল। আর পেছন থেকে রুমা তাকে থামতে বলছে। কিন্তু শতাব্দ শুনলে তো! লিভিংরুমের সামনে এসে রুমা থেমে গেল। কোমড়ে দু’হাত গুঁজে চোখ-মুখে একরাশ ক্লান্তি এবং দুশ্চিন্তা নিয়ে দাঁড়াল। আর নম্র পিটপিট চোখে মা-ছেলের কান্ড দেখল। রুমা ঘাড় বাঁকিয়ে নম্রের দিকে চাইল। পরমুহূর্তে ক্লান্ত-মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলল,
–“দাঁড়াও মা। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে গল্প করছি।”
থেমে আবার ডেকে উঠে রত্নাকে।
–“আপাকে চা-নাশতা দিয়ে যা।”
নম্র হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে আন্টি!”
রুমা চলে গেল। মা-ছেলের মধ্যে কী হয়েছে তা নম্র জানে না। তবে এই মুহূর্তে কীভাবে এখান থেকে পালাবে সেই মতলব এঁটে নিয়েছে নম্র। নম্র রুমার রুমে উঁকি দিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। কিচেনটা লিভিংরুম থেকেই দেখা যায়। পর্দা সরানো বিধায় রত্নাকে স্পষ্ট কাজ করতে দেখতে পেল নম্র। সাবধানতা অবলম্বন করে নম্র কিচেনে গিয়ে পৌঁছালো। রত্না নম্রকে দেখে অমায়িক হাসি দিয়ে বলল,
–“তুমি গিয়ে বসো আপা। আমি এক্ষুণি সব নিয়ে আসতাছি!”
নম্র তৎক্ষণাৎ বারণ করে বলল,
–“আরে না, না রত্না। আমার মাত্রই ছাত্রের বাসা থেকে কল এলো। জরুরি তলব, বুঝতেই পারছিস। তুই প্লিজ আন্টিকে ম্যানেজ করে নিস? আমার এক্ষুণি যেতে হবে!”
রত্না নম্রকে কিছু বলতে পারল না। ছাত্রের বাসা থেকে কল এসেছে, এর প্রতি উত্তরে নম্রকে আটকানোর মানেই হয় না। নম্র নানান কথা বলে বেরিয়ে গেল। বাহিরে আসতেই যেন হাপ ছেড়ে বাঁচল। পরমুহূর্তে টঙের দিকে তাকাতেই নম্রের পা জোড়া থমকে গেল। টঙের ছাউনির বাইরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে শতাব্দ। শতাব্দের ছোটো ছোটো চোখের নজর তার-ই দিকে। নম্র’র গা কেমন শিরশিরিয়ে উঠল। পরমুহূর্তে মনে পড়ল শতাব্দকে তার স্যরি বলতে হবে। কিন্তু আজ যা পরিস্থিতি হয়েছে, তাতে নম্র কেন যেন শতাব্দ’র সামনে দাঁড়াতে পারছে না। নম্র শতাব্দের দিক থেকে নজর সরিয়ে দ্রুত টঙের দোকানে ঢুকল। গিয়ে দেখল চঞ্চল মুখ ভার করে কাঠের বেঞ্চিটায় বসে আছে। তার পায়ের কাছে-ই দুটো চিপসের প্যাকেট পড়ে আছে। আর তার পাশে ছোটো জুসের বোতল।
চঞ্চলের মুখ ভার করার কারণ, নম্র বারতি খরচ করতে নিষেধ করেছে তাকে। এমনকি দোকানদারকেও ভালো ভাবে বলে গেছে, যাতে চঞ্চল কিছু চাইলে তাকে যেন না দেওয়া হয়। নয়তো বারতি একটা টাকাও সে দোকানিকে দিবে না। টঙের চাচা নিতান্তই ভালো মানুষ। নয়তো বিক্রির জন্যে উঠে পড়ে লাগত। কিন্তু তিনি তা না করে ভালো মানুষীর পরিচয় দিলেন বলেই মনে হলো নম্রের। নম্র চঞ্চলকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। শতাব্দের পাশ কেটেই চলে গেল সে। শতাব্দর সামনে দিয়ে আসার সময় অজানা কারণে তার বক্ষঃস্থলে দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছিল। আনমনে থেকে বাস্তবে ফিরল চঞ্চলের কথায়।
–“তুমি মোটেও ভালো নও নম্র আপু। আরও কয়েকটা চিপস বাড়িয়ে দিলে কী হত?”
নম্র তাচ্ছিল্য করে বলল,
–“ওইদিন এতগুলো বাইরের খাবার খাওয়ার পর কী হয়েছিল মনে আছে চঞ্চল ভাই? নাকি পথে-ঘাটে মনে করিয়ে দিব?”
চঞ্চল লজ্জায় কেমন চুপসে গেল। সঙ্গে মায়ের ওপরও চাপা রাগ হলো। তার ঘনঘন বাথরুম যাওয়া-আসার ব্যাপারটা কেন জেঠিদের বাসাতে গিয়ে বলল মা? মায়ের পেটে কী কোনো কথা থাকে না? চঞ্চলের মতো? নম্র চঞ্চলের লজ্জামাখা মুখখানা দেখে অধর বাঁকিয়ে হাসল।
————————–
রুমা কপালে হাত দিয়ে বসে আছে সোফায়। দীপালি বেগম অন্য সোফায় বসে কোণা চোখে ছেলের বউকে দেখছে। রুমার কপালের কোণ বেয়ে চিকন ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। অত্যন্ত চিন্তায় আছে, সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। না জানি, রক্তচাপ কমে গেছে। শতাব্দ তার বেকারির জন্যে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে। তার বাবা থাকতে সে ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ায় ঘরে যে আবার কোন অশান্তি সৃষ্টি হবে সেটাই তিনি ঠাহর করতে পারছে না। ছেলেটা তার বড্ড জেদী। বাবা তার এই ব্যবসায় সঙ্গ না দেওয়ায় জেদ করেই যে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে সেটা রুমার বুঝতে বাকি নেই।
এতক্ষণে নির্ঘাত এই খবর আরিফ রহমানের কানেও চলে গিয়েছে। শতাব্দ বাড়ি থাকতেই রুমা দেখেছে আরিফ রহমান ছেলেকে কল দিচ্ছে। শতাব্দ দেখেও রিসিভ করেনি। বাপ-ছেলে রুমার সব কাজ তুঙ্গে তুলে নিয়েছে। একা সব সামলাতে পারবে না ভেবে অফিস থাকতেই বড়ো মেয়ে আনিশাকে কল করে আসতে বলেছে। মেয়েটাকে দেখলে একটু হলেও শান্তি পাবে।
–“রত্না! তোর খালারে ক এভাবে সঙের মতোন বসে না থেকে আমারে একটু কড়া লিকারের চা কইরা দিতে। বাসায় যে কী তামাশা শুরু হইছে, সেইটা আল্লাহ-মাবুদ ভাল জানে!”
দীপালির কথায় গভীর চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলো রুমা। চমকে তাকাল শাশুড়ির দিকে। পরপর নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়। অধরে হাসি টেনে বলল, “আনছি মা!”
রুমা যেতে যেতে শুনল দীপালি বেগমের কথা।
–“আজকাল নিজে না কইলে কিছুই পাওন যায় না। কিছুদিন পর দেখা যাইব বৃদ্ধাশ্রমে গিয়া শ্রম দিতে হইব। বুড়ো বাপ-মার কদর তো দুনিয়া থেইকাই উইঠা আছে। হেদায়াত দেও মাবুদ, হেদায়াত দেও!”
রুমা রান্নাঘরে ঢুকতেই রত্না বলে ওঠে,
–“আনিশা আপা নাকি আসবে খালা। আজকে কী ভালো-মন্দ রাঁধব!”
রুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাই করো। অন্তত রাতে সবাই নাহয় ভালো-মন্দই খাই। পোলাও’র চাল ধুঁয়ে নাও আর মুরগী বের করে রাখো ফ্রিজ থেকে।”
রত্না মাথা নাড়িয়ে নিজের কাজে লেগে পড়ল।
রাতে শতাব্দ এলো তার বেকারির স্থানে ডেকোরেশনের কাজ লোকদের বুঝিয়ে দিয়ে। এছাড়া বাদ-বাকী কেনাকাটাও সেরে এসেছে। বেকারির কাজ চলছে আজ তিনদিন যাবৎ। আশা করা যায় আর মাত্র সপ্তাহখানেকের মাঝেই কাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে। বাসায় ফিরতেই আরিফ রহমানকে তার জন্যে অপেক্ষা করতে দেখা গেল। এতে শতাব্দ চমকালো না। তার হাবভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছে আগাম ঝড়ের জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত। তবে বাবার পাশে বসা আনিশাকে একদমই আশা করেনি শতাব্দ।
আরিফ রহমান তীর্যক নজর নিক্ষেপ করল ছেলের পানে। রাগের কারণে কপালের এক, দুটো রগ তার ফুলে গেছে। শতাব্দ তা দেখেও না দেখার ভান করে আনিশার জন্যে এগিয়ে গেল। আনিশার উদ্দেশ্যে বলল,
–“কেমন আছিস আপু?”
আনিশা করুণ চোখে চাইল ভাইয়ের দিকে। অর্থাৎ সে এই মুহূর্তে মোটেও ভালো নেই। এই মুহূর্তে কী ঘটবে তা ভেবেই বিচলিত সে। শতাব্দের আনিশার সাথে কুশল বিনিময় করতে দেখে এতক্ষণের চাপা রাগ উপচে পড়ল হুংকার আকারে। দীপালি বেগম রাতের ওষুধ খেয়ে ঘুম দিয়েছেন। কানের কাছে ঢোল বাজালে ঘুম কাচা হতে পারে, এর বেশি না।
–“তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি শতাব্দ! তুমি আমাকে না জানিয়ে এত বড়ো একটা পদক্ষেপ নিলে? শেষমেষ লোন? আমার টাকা কী নেই? নাকি আমাকে নিজের কেউ বলে দাবী-ই করো না?”
–“দাবী তো আপনি করেননি বাবা! আমি যখন আমার ইচ্ছের কথা জানিয়েছি আপনি-ই সাফ বলেছেন কোনো টাকা দিবেন না। আমি যেখান থেকে খুশি টাকা যোগাড় করি। এখন দ্বিমত কেন? আমার কাছে যেইটা সহজ লেগেছে সেইটাই করলাম!”
–“এই! তোমার ব্যাকারির ভূত কী যাবে না? এত পড়াশোনা করে কী চুলোয় খুন্তি গুতাবে? মান-সম্মান কিছু রেখেছ? কই চাকরি-বাকরি করবে, তা না করে এসব বিস্কুট, ফাস্টফুড! এগুলা কোন ধরণের আবদার?”
–“চুলায় খুন্তি গুতানোকেই আমি প্রফেশন ধরে নিয়েছি।”
–“সেসব বাদ। তুমি লোনটা নিলে কোন সাহসে?”
শতাব্দ কিছুক্ষণ নীরব রইলো। রুমা ভীত নজরে ছেলের দিকে চেয়ে আছে। শতাব্দ চারপাশে এলোমেলো নজর ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–“লোন নেইনি। ধার নিয়েছি!”
শতাব্দের কথা শুনে উপস্থিত সকলে হতবাক। রুমা অবাক হয়ে বলল,
–“তাহলে লোনের কথা বললে কেন?”
শতাব্দ কোণা চোখে বাবার দিকে চেয়ে বলল,
–“বাজিয়ে দেখলাম আর কী। তবে তোমরা যদি চাও, আমি সত্যি সত্যি লোন নিব। ভয় দেখাচ্ছি না, প্রয়োজনে আমি সব-ই করতে পারি।”
বলেই বাবার দিকে একপলক চেয়ে পাশ কাটিয়ে রুমের দিকে যেতে লাগে। যাওয়ার আগে বলল,
–“খাবার গরম করো। আমি আসছি!”
——————
নিঝুম বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। নম্র জানালার সাথে লাগোয়া ছোটো বসার স্থানে পা উঠিয়ে বসে আছে। থুঁতনির কাছে তার হাঁটুজোড়া। বসার স্থানে ছোটো ল্যাপ এবং কিছু রঙিন কুশন দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে নম্র। বসার নিচেই পাশাপাশি দুটো তাক। সেখানে টুকটাক ডেকোরেশন করেছে নম্র। ঘর সাজানো নম্রের সুন্দর সখের মধ্যেই পড়ে। থাই গ্লাস খুলে দেওয়ায় রাতের খোলা, নরম হাওয়া নম্রকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বারংবার কিছু অবাধ্য চুল তার মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে সেদিকে নম্রের ধ্যান নেই। সে এক ধ্যানে কোথাও চেয়ে আছে। প্রায় আট-নয় বাড়ির পরে একটি বাড়ির দিকে নজর তার। শতাব্দদের বাড়ি ওটা। সেই বাড়ির দিকে চেয়েই নম্র অম্লান অনুভূতিতে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে।
সেই একই অনুভূতি। সেই একই মানুষটার প্রতি। সময় কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষটার প্রতি অনুভূতির কোনোরূপ পরিবর্তন দেখেনি সে। হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক ওঠা-নামা, চোখে-চোখ না মেলাতে পারা, হাত-পা জমে যাওয়া, মস্তিষ্ক অচল হয়ে যাওয়া, সবটাই পুরোনো দিনের মতো। এক কালে এসবকে আবেগ ভাবত। আজ সে যুবতী, তবুও কিশোরী মনের লালিত অনুভূতি কেন তাকে তাড়া করছে জানা নেই নম্রের। আজ সে স্ব-ইচ্ছায় তাড়া খেতে চাইল যেন, ঘুমকে তোয়াক্কা করল না। চোখ জোড়ায় শতাব্দের মুখ, ভাব-ভঙ্গি, চলার ধরণ সব ফুটে উঠছে। নতুন করে প্রেমে পড়ল কী? হয়তো!
~[ক্রমশ]