#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|২য় পর্ব|
লাবিবা ওয়াহিদ
নোমান সাহেব খুবই থমথমে গলায় ডাকল নম্রকে। নম্র’র বাবার ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার কাছে বাবাকে দেখতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। আমতা আমতা করে কিছু জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করতেই নোমান সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–“ফ্রেশ হয়ে লিভিং-রুমে এসো!”
নোমান সাহেব গম্ভীর মুখেই চলে গেল। আর নম্র চিন্তায় পড়ে গেল। পাশে তাকাতেই দেখল নিঝুম হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। নম্র কী ভেবে নিঝুমের গালে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিতে দিতে বলছে,
–“বোন আমার, স্কুলের জন্যে দেরী হয়ে যাচ্ছে। উঠ! নিঝুম? এই মেয়ে!”
শেষ ধমকের সাথে খুব জোরেই থাপ্পড়টা দিল নম্র! যার ফলে নিঝুম ভয়ে উঠে বসল। চোখ বড়ো বড়ো করে নম্র’র দিকে তাকাতেই নম্র ফিক করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে বাথরুমের দিকে হাঁটা দিল সে। যেতে যেতে শুনতে পেল নিঝুমের চেঁচামেচিঁ।
–“আপু! তুমি মোটেও ঠিক করোনি আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে! আমি এক্ষুণি বাবার কাছে বিচার দিব!”
নম্র বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখল মুখ ফুলিয়ে বিছানার কোণে বসে আছে নিঝুম। বিছানা আগের মতোই এলোমেলো। নম্র বেরিয়ে আসতেই সে বাথরুমে ঢুকে গেল। নম্র আবার হেসে দিয়ে বিছানা গুছিয়ে বাহিরে এলো।
নম্র লিভিং-রুমে গিয়ে দেখল নোমান সাহেব পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছে। নম্র মাথার ওড়নাটা আরও ভালো করে টেনে সালাম দিল। নোমান সাহেব পত্রিকা নামিয়ে মেয়েকে সোফায় বসার অনুমতি দিল। নম্র চুপ করে গিয়ে বসতেই নোমান সাহেব থমথমে স্বরে বলল,
–“তুমি কী কিছু লুকাচ্ছ আমার কাছে? যা আমাকে জানতে দিতে চাচ্ছ না?”
নম্র’র হঠাৎ গতকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে কিছুটা ঘাবড়েও গেল সে। গতকালকের ঘটনার পরপর আজ হঠাৎ তার বাবা এই ধরণের প্রশ্ন কেন করছে? কিছু আঁচ করতে পেরেছে কী? নম্র তবুও বিব্রত হয়ে ব্যাপারটা অস্বীকার করল। নোমান সাহেব নম্র’র ভয়ার্ত মুখে অস্বীকার শুনে কিছুটা ক্ষেপে গেল বটে। চাপা রাগ দেখিয়ে ধমকাল মেয়েকে!
–“বাবার কাছে কথা লুকিয়ে ভাবছ আমি কিছু টের পাব না? তুমি গতকাল এত বড়ো ঘটনা ঘটালে আর আমি চোখে পর্দা দিয়ে ঘুরব? কোনো খবর আমার কানে আসবে না? গতকাল তুমি যা করেছ সেটা সীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। তুমি জানো গতকাল কাকে আহত করেছ? শতাব্দকে। নিঝুমের টিউটরকে।”
নম্র’র মনে হলো মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল বাবার কথা শুনে। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। শতাব্দ ভাইয়া? তাকে তো শেষ দেখেছে বোধহয় প্রায় পাঁচ-ছয় বছর আগে। শুনেছে ভাইয়া অন্য জেলায় গিয়ে পড়াশোনা করত। এখানে কবে এসেছে তার জানা নেই।
এতদিনে শতাব্দ’র চেহারা তার মস্তিষ্ক থেকে বেশ মুছে গিয়েছে। তবে তাড়াহুড়োয় চেহারাটাও সেভাবে লক্ষ্য করেনি সে। তার দ্বারা এত বড়ো ভুল হয়ে গেল? শেষমেষ কি না শতাব্দ ভাইকে? গা কাঁপছে নম্র’র। ভয়ে, অনুশোচনায়। বাবার সামনে কিছু বলার মুখও রইলো না তার। এত বড়ো লজ্জাজনক কান্ড ঘটে গেল। বকা তো তার প্রাপ্য। তবুও মনের কোণে নিজেকে নির্দোষ বলার একটা প্রতিবাদমুখী চেতনা এলো। সে এই অপবাদ পুরোপুরি ভাবে নিতেও পারছে না। তার পেছনের গল্প নোমান সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু নোমান সাহেব সে কথা অবজ্ঞা করে খুব কড়া গলায় বলল,
–“ছেলেটার সামনে আমার সম্মান আর রাখলে না। ছেলেটা নিঝুমকে পড়াতে চায় না, নিষেধ করে দিয়েছে। জানো আমি কতটা লজ্জিত হয়েছি তার সামনে? তোমার এই অকাজের শাস্তিস্বরূপ তুমিও কোনো টিউশনি করতে পারবে না। লুকিয়েও করবে না, যদি আমাকে তোমার বাবা ভেবে থাকো তো!”
নম্র’র মাথায় এবার যেন আকাশটা ভাঙল। নোমান সাহেব তার সিদ্ধান্তি শুনিয়ে উঠে যেতে নিলে নম্র তাকে থামালো। অস্থিরচিত্তে বলল,
–“এটা আমার সাথে অন্যায় করা হবে বাবা। মানলাম ছোটো একটা ভুল আমার দ্বারা হয়েছে। এ জন্যে এরকম একটা সিদ্ধান্ত কেন শোনাচ্ছ? শাস্তি ছাড়া অন্য কোনো সমাধান নেই! প্লিজ বাবা, বুঝতে চেষ্টা করো। আমাকে এগুলা বলিও না! আমি সত্যি এতটাও ইনভলভ ছিলাম না এই ঘটনায়। বিশ্বাস করো।”
নোমান সাহেব তেঁতে উঠে বলল,
–“তুমি ভুল করোনি, অন্যায় করেছ। আমার কাছে সলিউশন না চেয়ে শতাব্দের সাথে যা অন্যায় করেছ সেটার জন্য মাফ চাও। শতাব্দকে মানিয়ে টিউশনি করতে আনাও। নয়তো তোমার টিউশনির কথা ভুলে যাও। সামনে নিঝুমের পরীক্ষা, এই বিষয়টা মাথায় রেখো!”
নোমান সাহেবের কল বেজে উঠল। ড্রাইভার কল দিয়েছে। নোমান সাহেব নম্র’কে এড়িয়ে চলে গেল ঘরের দিকে। তার স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে, তৈরি হতে হবে! আর এদিকে নম্র শক্ত হয়ে বসে আছে। সাবরিনা অর্থাৎ নম্র’র মা মেয়ের পাশে এসে বসল। তৎক্ষণাৎ নম্র তার মায়ের কাঁধে হেলে পড়ল। শূন্য চোখে কোথাও চেয়ে আনমনে বলল,
–“শতাব্দ ভাইয়ের সাথে অন্যায় বুঝলাম, কিন্তু আমি শতাব্দ ভাইকে এতকিছুর পরেও নিঝুমকে পড়ানোর কথা বলব কীভাবে? আমার স্টুডেন্টদেরও তো সামনে পরীক্ষা আম্মা। বাবা জেদ ধরল কেন এমন?”
সাবরিনা আশ্বাস দিয়ে বলল,
–“শতাব্দের বাবা আর তোর বাবা অনেকদিনের বন্ধু, তুই শতাব্দের সাথে এমন একটা কাজ করেছিস বলেই তোর বাবা ক্ষেপে গেছে। তাও তুই চেষ্টা কর, শতাব্দ ভালো ছেলে। ছেলেটাকে ওভাবে বুঝিয়ে মাফ চাইলে ছেলেটা মাফ করে দিবে। তুই আবার বেশি আহত করাসনি তো?”
–“না আম্মা। ঘটনা জটিল হওয়ার আগেই আমি ঘটনাস্থলে চলে এসেছিলাম! নিরানব্বই শতাংশ ভুল ভাইয়াদের-ই ছিল। কেন আমি পা ধরে মাফ চাইব বলো তো?”
–“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়েছে। সব আবার আগের মতো হোক এটাই কামনা। তবে এটা সবসময় মনে রাখবি, নিজের ভুলে কারো কাছে মাফ/ক্ষমা চাইলে কেউ-ই ছোটো হয় না। বুঝলি?”
নম্র আলতো করে ইতিবাচক মাথা নাড়াল। পরে কী যেন মনে হতেই নম্র আবার প্রশ্ন করল,
–“শতাব্দ ভাইয়া কেন আমাদের ঠিকানা রাস্তার মানুষের কাছে জানতে চাইল? তার তো আগে-ভাগেই সব জেনে আসার কথা।”
প্রশ্নটা সাবরিনার মনেও এসেছিল। স্বামীর থেকে যা শুনেছে তাই বলল সে,
–“আমাদের আগের বাড়িটা তো একটু ভেতরে ছিল। শতাব্দ যেই বছর চলে গেল তখনই তো ওই বাড়ি বিক্রি করে আমরা এটাতে আসলাম। শতাব্দ’র ঠিকমতো এখানে আসা-যাওয়া ছিল না দেখেই এই ব্যাপারটা তার জানা ছিল না। সে ভেবেছিল আগের ঠিকানাতেই থাকব বলে জিজ্ঞেস করেনি। আগের বাড়িতে গিয়ে ফিরে এসেছে সে। বাড়িতে গিয়ে যে আবার জিজ্ঞেস করবে সেই সময় ছিল না, হাতেও ফোন ছিল না। মানে বিপদ যখন আসে তখন সব দিক থেকেই আসে। এরকম-ই হয়েছে ব্যাপারটা। তুই বেশি কিছু ভাবিস না। আয়, নাস্তা করবি। দেরী হচ্ছে!”
————————
–“মা হইছে দর্জি, আর ছেলের ভূত চাপসে চা-বিস্কিটের দুকান দিব। মান-সম্মান কী এডি আর রাখত না?”
পান খেতে খেতেই কথাগুলো আক্রোশের সঙ্গে আওড়াল দীপালি বেগম। তার পাশেই কপালে দুই আঙুল চেপে চোখ বুজে বসে রয়েছে আরিফ রহমান। তার কপালে বেশ কিছু ভাঁজ পড়েছে। যা তিনি দেখাতে চাচ্ছেন না মায়ের সম্মুখে। দু’দিন যাবৎ শতাব্দ বাড়ি আসেনি। বন্ধুদের সাথে নাকি কোথাও গিয়েছে। এদিকে দীপালি বেগম যেন থামার মানুষ নন, সে আরিফ সাহেবকে পেলেই আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে তার তিক্ত কথা দ্বারা। আরিফ সাহেব হঠাৎ চটে গিয়ে বলল,
–“আম্মা, দয়া করে চুপ থাকেন। রোজ রোজ এসব শুনতে আর ভালো লাগছে না!”
দীপালি বেগম নিজেও তেঁতে উঠলেন। ছেলেকে ধমক দিয়ে বললেন,
–“ভালো লাগে না বলে বলেই তো কপাল এমুন ফুটা করলা। বউরে এত বছরেও সামলাইতে পারলা না, এহন পোলা এত পড়ালেহা শেষ কইরা কী না কয় চা-বিস্কুট বেঁচব। বাপের ইট, সিমেন্ট, বালির ব্যবসা আর পুলার এমন ভিমরতি। ওরে কী খাইতে দেস না?”
মায়ের মুখের উপর এবারও কিছু বলতে পারলেন না আরিফ রহমান। দীপালি বেগম কয়েক বছরের ব্যবধানে ভীষণ রাগচটা খিটখিটে মেজাজী হয়ে গিয়েছেন। হয়তো বয়সের ভারেই। কারণ, এত খিটখিটে স্বভাবের মানুষ দীপালি বেগম ছিলেন না। নয়তো তার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বউকে বাহির সামলাতে দেওয়া কখনোই সম্ভব না। একসময় সে-ই বলে গেছে রুমা অর্থাৎ শতাব্দের মায়ের এই গুন মানুষের মুখে মুখে ছড়াবে। আজ সেই ক্ষণ এলেও দীপালি বেগম বদলে গেছে। এজন্যে একপ্রকার মুখ বুজেই শুনে যান মায়ের এসব কথা। কিন্তুর ছেলের ব্যাপারটা সে মোটেও হজম করতে পারছে না। ছেলে মাস্টার্স করে কী না শেষমেষ ব্যাকারি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে? চারপাশের মানুষ কী বলবে? এত জেদী কেন ছেলেটা?
~[ক্রমশ]