#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|সূচনা পর্ব|
লাবিবা ওয়াহিদ
–“শালা! নম্র’র ওড়না ধরে টেনে উত্ত্যক্ত করে তার এলাকাতেই আসছিস ঠিকানা জানতে? সাহস তো কম না তোর!”
“নম্রতা” নামটি উচ্চারণ করার পরপর এলাকার কিছু বখাটের হাতে বেধড়ক মা*রধরের স্বীকার হয় শতাব্দ। শতাব্দ এত করে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু ওরা বলার কোনো সুযোগ-ই দেয়নি৷ নম্র ঘটনাস্থলে আসতেই শতাব্দকে নজরে আসে তার। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করতেই তৎক্ষণাৎ ছেলেগুলোকে থামিয়ে দেয় নম্র। চেঁচিয়ে বলল,
–“থামো তোমরা! এটা সেই ছেলে না!”
ছেলেগুলো তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়াল। নম্র ওদের দিকে না চেয়ে দ্রুত গতিতে শতাব্দের দিকে এগিয়ে গেল। শতাব্দ মা*র খাওয়ার পরপর ব্যথায় কুঁকড়ে আছে। নম্র শতাব্দের কাঁধ স্পর্শ করতেই শতাব্দ ব্যথাতুর হাত ঝাড়া দিয়ে সরে এলো। নম্র তাও ব্যস্ত কন্ঠে আওড়াল,
–“আপনি ঠিক আছেন?”
শতাব্দ ঠিক নেই, এটা দেখেও মূর্খের মতো প্রশ্নটা করে বসল নম্র। নম্র চটজলদি সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
–“ওনাকে কাছের ফার্মেসীতে নিয়ে চলুন!”
শতাব্দ যেতে না চাইলেও একপ্রকার জোর করেই তাকে কাছেপিঠের ফার্মেসীতে নিয়ে গেল। হাতে ব্যান্ডেজ করার পর একটা মলম এবং পেইনকিলার দিল তাকে। শতাব্দ সেগুলা ফেলেই চলে গেছে। যাওয়ার আগে কাঠ কাঠ গলায় বলে গেছে,
–“জুতো মে*রে গরু দান করার দরকার নেই। গরুটা আপনার কাছেই রাখুন!”
নম্র অবাক হয়ে তার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। নম্রকে স্যরি বলে মাফ চাওয়ার সুযোগটা অবধি দিল না শতাব্দ। যার ফলস্বরূপ বড়ো ভাই সম মানুষটার উপর রাগ ঝেড়ে বসল সে।
–“না জেনে-শুনে কী প্রয়োজন ছিল এভাবে কাউকে মারার? আমি তো সেই ছেলের বর্ণনা দিয়েছি, সেই বদমাইশটা লিকপিকে, চিকন। এনার মতো সুঠাম দেহি নয়!”
–“কিন্তু ছেলেটা তো তোমার ঠিকানা চেয়েছে, তোমার নামও জানে। মাথা ঠিক ছিল না, তাই উলটো পালটা দিয়ে ফেলেছি!”
নম্র’র নাম জানে, সঙ্গে নম্র’র ঠিকানা চেয়েছে, এ-কথা শুনে নম্র অবাক হলেও সেটা প্রকাশ না করে দৃঢ় গলায় বলল,
–“তাও তো জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল, যে সে কেন ঠিকানা চেয়েছে? আমাদের পিরিচিতও তো হতে পারত!”
সেই ভাইয়েরা নম্র’র কাছে স্যরি বলল। এদিকে নম্র মোটেও শান্তি পাচ্ছে না। তিক্ত অনুভূতি নিয়ে সে ফার্মেসী থেকে বেরিয়ে এলো। এবং তার পিছু পিছু বাকিরা। ছোটোবেলা থেকে মহল্লার এই ভাইদের চিনে সে। নম্র যখন ক্লাস থ্রি, ফোরে ছিল তখন এই ভাইয়েরা অনার্স লেভেলের ছিল। কিছু পড়াশোনা করেছে, আবার কিছু পড়াশোনা করেনি। সেই খেলাধুলা করে বেড়ানো ছোট্ট নম্রকে তারা ছোটো বোনের স্থানে বসিয়ে ফেলে। এলাকায় নানান প্রভাব থাকার কারণে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ায়। নেতাদের সাথে উঠে বসে।
নম্র এখন অনার্স পড়ুয়া হলেও এই ভাইয়েদের মধ্যে কয়েকজন এখনো বিয়ে করেনি। কেন করে না কে জানে? হয়তো তাদের এভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘোরাফেরা করার কারণেই। তবে নম্র এটা হলফ করে বলতে পারে তাদের এই প্রভাব বিস্তারের কারণে-ই নম্র স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করে। কখনোই কোনো ছেলে ঘটিত সমস্যা পোহাতে হয়নি। নম্র’র বাবাকে তো তারা প্রায়-ই নম্র, নম্র’র ছোটো বোন নিঝুমের কথা জিজ্ঞেস করে এবং প্রত্যেকবার তারা এক কথা বলবে,
–“আমাদের বোনদের আসতে যেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? হলে অবশ্যই জানাবেন স্যার। কোনো ছেলে বিরক্ত করলে শুধু আমাদের বলবেন, ওকে হাসপাতালে পাঠানোর দায়িত্ব আমাদের।”
নম্র’র বাবা নোমান খান তখন ফিচেল হেসে সম্মতি জানায়। নোমান খান একটি সরকারি স্কুলের হেড মাস্টার হিসেবে আছেন। তাই তার সম্মান পুরো এলাকাজুড়ে। একসময় এই ভাইদের মধ্যে বেশিরভাগ নোমান সাহেবেরই ছাত্র ছিল। নোমান সাহেব যখন বাড়ি ফিরে এই ঘটনাগুলো নম্র’র মা সাবরিনার সাথে বলে তখন নম্র’র শুনতে বেশ লাগে।
এরকমই নম্রকে কখনো বিরক্ত না করা ছেলেদের মধ্যে একটা ছেলে তাকে ভীষণ বিরক্ত করতে শুরু করল। ছেলেটা মূলত ভার্সিটিতেই নম্রকে দেখেছে। সেই থেকে নম্র’র পিছু নেয় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। নম্র যখন বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে তখন ছেলেটা বাইকে বসে বন্ধুর সাথে এটা ওটা বলে নম্রকে উত্ত্যক্ত করত। নম্র’র ভারী অস্বস্তি হয়। এই ধরণের ঘটনার কবলে না পড়া মেয়েরা খুটিনাটি ব্যাপারেও চরম অস্বস্তিতে পড়ে যায়, মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না। কোথাও যেন জড়তা কাজ করে, কথা গুছিয়ে উঠতে পারে না। নম্র’র বেলাতেও হয়েছে তেমন। তবুও সাহস করে কিছু বললেই ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে বলত,
–“চিন্তা করছ কেন? তোমার বাড়ি গিয়ে তোমার বাবাকে আমি মানিয়ে নিব। ঠিক আছে?”
ছেলেটা বাড়িতে চলে আসার নীরব হুমকি প্রায় প্রতিদিন দিতে লাগে। ছেলেটার নাম বোধহয় অনিক। অনিক ছেলেটা এবার তো পুরোই সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে। নম্র অনিককে পাশ কাটিয়ে আসতেই তার ওড়না ধরে টান দিয়েছিল সে। যার ফলস্বরূপ ঠান্ডা মেজাজী নম্র খুব চটে যায়। দিকবিদিকশুন্য হয়ে অনিককে চড় মে*রে চলে আসে সে।
মহল্লায় আসতেই এই ভাইদের সাথে দেখা হয় নম্র’র। নম্র’র চোখে-মুখে ছিল বিষাদের ছায়া। সেটা বুঝতে পেরে তারা প্রশ্ন করতেই নম্র’র মনে পড়ে যায় বাবার বলা কথাগুলো। একপ্রকার ভরসা করেই সব খুলে বলে ওদের। সব শুনে ওরা ভীষণ চটে যায়। নম্র তাদের ঠান্ডা করে জানায়, যদি অনিক নামের চিকন কোনো ছেলে তার বাসার ঠিকানা জানতে আসে তাহলে যেন একটু শিক্ষা দেয়।
কারণ এই ভাইরা এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। অনিক নিশ্চয়ই বড়ো কাউকে নয় বরং এই ধরণের ভাইদেরকেই ঠিকানা জিজ্ঞেস করবে। এটাই নম্রের বোকা মনের ধারণা ছিল। তৎক্ষণাৎ যদি অনিককে খুঁজে বের করে উত্তম-মধ্যম দিত, তবে হয়ত এরকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হত না তাকে। ভেবেই তপ্তশ্বাস ফেলল নম্র। নিজের ভুল ধারণাতে কী করে আরেকজনকে আহত করল?
অত্যন্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে নম্র একটি রিকশায় উঠে বসল। নম্র’র টিউশনি আছে। যাওয়ার সময় সারা রাস্তায় চোখ বুলিয়ে খুঁজল সেই ছেলেকে, যে নির্দোষ হয়েও তার ভুলের কারণেই এত মা*র খেয়েছে। নম্র যখন রিকশায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল তখনই তার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই দেখল নম্র’র বান্ধুবী অর্ণার কল। নম্র কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
–“আমি যার থেকে প্রপোজ আশা করছিলাম সে নাকি অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িত। এটা কোনো কথা নম্র? আমার রাগে-ক্ষোভে কান্না পাচ্ছে!”
নম্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“আগে সব জেনে আগানো উচিত ছিল.. বাদ দে!”
অর্ণার কন্ঠস্বর হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলল,
–“তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?”
আসল বন্ধুত্বের সম্পর্ক বোধহয় এজন্যেই সুন্দর। কন্ঠস্বর বা মেসেজ দেখেই তারা বুঝতে পারে মন ভালো নাকি খারাপ। নম্র ফিচেল হেসে বলে,
–“তেমন কিছু না।”
–“কিছু তো আছে অবশ্যই!”
অর্ণার থেকে কিছু লুকাতে পারবে না, অর্ণা কিছু লুকাতে দিবে না সেটা নম্র জানে। তবে সেও চাইছে না ব্যাপারটা লুকোতে। এই মুহূর্তে অর্ণার সাথে সব শেয়ার করে মনটা হালকা করতে পারবে সে। সঙ্গে এই ব্যাপারে সলিউশন পেলেও পেতে পারে। তবে নম্র এখন বিশেষ কিছু বলল না। শুধু বলল,
–“আমি স্টুডেন্টের বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। আমি বাড়ি গিয়ে তোকে সমস্তটা খুলে বলব!”
অর্ণা না চাইতেও বলল, “আচ্ছা!”
কল কাটার পরপর নম্র স্টুডেন্টের বাসার সামনে পৌঁছে যায়। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে চলে যায়। আজ একটা স্টুডেন্ট-ই পড়াবে সে। আরেকজন স্টুডেন্ট বেড়াতে গিয়েছে বিধায় কয়েকদিন তার ছুটি।
নম্র বাড়ি ফিরতেই দেখল তার মা দরজা খুলে সোফায় বসে আছে। নম্রকে দেখতেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“দরজাটা লাগিয়ে দে!”
নম্র তাই করল। বেসিনে মুখ ধুঁতে গেল। কল ছেড়ে বলল,
–“দরজা খুলে রেখেছ কেন?”
–“নিঝুমের জন্যে তোর বাবা বাসায় টিচার রেখেছে। সে-জন্যই দরজা খুলে রেখেছিলাম!”
নম্র’র কিছুটা চাপা রাগ হলো। সে থাকতে নিঝুমের অন্য কোনো টিচারের কী প্রয়োজন? কারণটা অবশ্য নিঝুম-ই। নিঝুম সবে ক্লাস সেভেনে পড়ে। এই বয়সে এই মেয়ে খুব উড়নচণ্ডী। সে কিছুতেই নম্র’র কাছে পড়তে বসতে চায় না। পড়ার সময়ে প্রশ্ন’র ঝুলি নিয়ে বসে সে। ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল একদিন নোমান সাহেব। তাই বোধহয় টিচারের ব্যবস্থা। নম্র মুখে পানি দিয়ে অল্প করে বলল,
–“ওহ!”
নম্র মুখটা ধুঁয়েই ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো। সাবরিনা মলিন মুখে বলল,
–“ঘন্টাখানেক আগেই তো চলে আসার কথা, এখনো আসছে না কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
সাবরিনার কথাগুলো বোধহয় নম্র’র কান অবধি পৌঁছাল না। ততক্ষণে নম্র তার রুমে ঢুকে গিয়েছে।
~[ক্রমশ]