প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৯

0
601

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৯
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
_________________________________
সূচনাদের সাথে আরেকটা মেয়ে থাকে, মেয়েটার নাম সিন্থিয়া। সিন্থিয়ার বাবা মা ঢাকাতেই থাকেন কিন্তু কিছু সংগত কারণে সে নিজের বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে উঠেছে। প্রথম কথোপকথনের পর সূচনার কাছে মেয়েটাকে তেমন ভালো লাগলো না। আড়ালে ইরাকে ও বললো মনের কথা, অতঃপর বুঝতে পারলো দুইজনের মত আসলে একই। পরের দিন সকাল থেকে দুইজন মিলে নিজেদের জিনিসপত্র আস্তে আস্তে বের করে যেখানে যা রাখার গুছিয়ে রাখে। তাদের ক্লাস শুরু হতে এখনো দুই দিন বাকি। হোস্টেলের পরিবেশ, খাবার, মানুষ জন সবকিছু ই অন্য রকম। মানিয়ে নিতে যে একটু কষ্ট হবে বুঝতে বাকি রইলো না কারোরই। দুজনেই একটু পরপর একে অপরের দিকে করুন দৃষ্টি তে তাকাচ্ছে। কোথায় আসলো!

সেদিন বিকেলে বাসায় যাওয়ার পূর্বে প্রণয় আসলো তাদের সাথে দেখা করতে। দুজনকে নিয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্য বের হলো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে কি-না! সন্ধ্যার দিকে আবার আগের দিনের মতোই দুজনকে নামিয়ে দিয়ে গেল। গতদিনের মতো আজকে ও ইরা আগে আগে ভেতরে চলে গেল। বাকি রইলো সূচনা, প্রণয় রিকশা ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে সূচনার উদ্দেশ্যে বললো,

” ক্লাস শুরু হতে আরও একদিন বাকি, এখনই এত চাপ নেয়ার প্রয়োজন নেই। এখন ঠিকঠাক মতো খাও, ঘুমাও, বিশ্রাম নাও। ইরা কে ও তাই করতে বলো। আর কিছু প্রয়োজন হলে তো আমি আছিই। ”

ধরনীতে তখন সন্ধ্যা নেমেছে, হোস্টেলের মেইন গেটের বাতিটা আজ জ্বালানো হয়নি বিধায় কেমন অন্ধকারে ঢেকে আছে। অন্ধকারের গাম্ভীর্যের ভাব হাতড়ে সূচনা চেষ্টা করলো প্রণয়কে স্পষ্ট ভাবে দেখতে। লাভ তেমন হলো না, তন্মধ্যে ছেলেটা হেলমেট পরিহিত। সূচনা মুখ ভার করে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায় আর ছোট্ট করে বলে,

” আপনি ও নিজের খেয়াল রাখবেন। ”

প্রণয় স্মিত হাসে, সে হাসি অবশ্য সূচনা দেখতে পায় না। সূচনার থেকে বিদায় নিয়ে প্রণয় বাইকে উঠে বসে। হাত নাড়িয়ে বলে,

” যাও। ”

বলার সাথে সাথে ই সূচনা ঘুরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়৷


এরপর দেখতে দেখতেই সপ্তাহ খানেক কে টে যায়। সূচনাদের ক্লাস শুরু হয়েছে ছয়দিন ধরে। আজ শুক্রবার আগামী দিন শনিবার বন্ধ দিয়ে রবিবার ভার্সিটির নবীন বরণ। প্রথমে সূচনা যেতে চাচ্ছিল না। না যাওয়ার বাহানা খুঁজছিল। কিন্তু ইরা মেয়েটা এক প্রকার জেদ ধরেছে, একা একা কেন যাবে! এমনিতে ই তো ভার্সিটির কাউকে তেমনভাবে এখনো চেনেনা
তন্মধ্যে সূচনা ও যদি না যায়! বাধ্য হয়ে সূচনা রাজি হয়েছে। শুক্রবার হওয়ায় ঘুম থেকে একটু দেরিতেই উঠেছে দুইজন। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে সূচনা কিছুক্ষণ বই নিয়ে অযথাই নাড়াচাড়া করে। পাশের বেডে বসে নবীন বরণে কী পরবে, কখন যাবে নিয়ে বকবক করছে ইরা। সূচনার সেদিকে খেয়াল নেই তেমন। ইরা যখন অন্যমনস্ক সূচনাকে লক্ষ্য করে তখন নিজের কথা বন্ধ করে দেয়। ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,

” ভাবী তোমার কী মন খারাপ? ”

প্রথম বারে সূচনা শোনেনা, ইরা ফের জিজ্ঞেস করে, প্রথম বারের তুলনায় এবার একটু উচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করতেই সূচনা হকচকিয়ে তার দিকে তাকায়। প্রশ্নের পরিবর্তে পাল্টা প্রশ্ন করে,

” নবীন বরণে কী পরে যাবে ঠিক করেছো? ”

ইরা আর সেই প্রসঙ্গ উঠায় না। কয়েক মুহূর্ত সূচনার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলে,

” শাড়ী পরব বলে ঠিক করেছি। ”

সূচনা ও প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসে, সম্মতি দিয়ে বলে,

” ঠিক আছে তাহলে। ”


দুপুরে খাওয়ার পর সূচনা ভাত ঘুম দেয়ার উদ্দেশ্যে বিছানায় পিঠ ঠেকাতে নিলেই পাশের বিছানা হতে ইরা এক লাফে তার কাছে আসে। হড়বড়িয়ে বলে,

” তুমি এখন ঘুমাচ্ছো কেন! বিকেলে বের হতে হবে। ”

সূচনা ইরার এমন লাফিয়ে তার কাছে আসার দরুন তাজ্জব বনে তাকিয়েছিল। বিকেলে বের হওয়ার কথা শুনে বিস্ময় ভাব কা টি য়ে জিজ্ঞেস করে,

” কোথায় যাবে? ”

” যখন যাবে তখন দেখো, এখন যাও তৈরি হও। শাড়ী পরবে। ”

সূচনা কয়েক মুহূর্ত বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা পাগল হলো!


বিকেলে তৈরি হয়ে ইরা হোস্টেল থেকে বের হয়। নিচে নামতেই দেখা যায় বাইক নিয়ে প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে। ইরা সূচনাকে নিয়ে এগিয়ে যায় প্রণয়ের দিকে। সূচনাকে প্রণয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,

” আমি যাই তাহলে, সময়মতো পোঁছে দিয়ে যেও। ”

প্রণয় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই ইরা সেই স্থান ত্যাগ করে। সূচনা এই অব্দি কিছু না বুঝলেও এখন সব ই বুঝতে পারে। দুই ভাই বোনের তাহলে এই পরিকল্পনা ছিল! এজন্য ই ইরাকে বারবার জিজ্ঞেস করার পরে ও মেয়েটা মুখ খোলেনি। পাঁ জি মেয়ে।

” সারা বিকেল এখানেই কা টা নো র ইচ্ছে আছে! ”

প্রণয়ের গম্ভীর কণ্ঠে করা উক্তি তে সূচনার ভাবনার সুতোয় টা ন পড়ে। প্রণয় বাইকে উঠে পড়েছে আগেই, সূচনা ইতস্তত করতে করতে এক হাত প্রণয়ের কাঁধে রেখে বাইকে উঠে বসে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। প্রণয় বাইক চালু দিতে দিতে বলে,

” এখানকার রাস্তা কিন্তু বেশ একটা ভালো না। কখন, কোথায় ভাঙা রাস্তা পড়ে, ব্রেক করলাম আর পেছনে তাকিয়ে দেখলাম তুমি নেই। এর দায়ভার কিন্তু আমার না। ”

সূচনা বেশ বুঝতে পারে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলেছে দেখেই যে প্রণয় তাকে এই কথা গুলো বলছে। সে পুনরায় নিজের ডান হাতটা প্রণয়ের কাঁধে রাখে। তারপর যেয়ে দুজন রওনা হয় গন্তব্যে।

প্রায় বিশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছল। কোলাহল পূর্ণ শহর অথচ এখানটায় তেমন কোলাহল নেই। খোলা আকাশ, এক পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী, দুই পাশে ভর্তি বড় বড় গাছ। বসার জন্য দু চারটা কাঠের বেঞ্চ ও আছে। আশেপাশে আরও মানুষ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ ই জুটি অর্থাৎ স্বামী স্ত্রী হবে এমন। সূচনার জায়গাটা ভীষণ পছন্দ হলো। নিজের গ্রাম থেকে আসার পর এমন কোলাহল মুক্ত পরিবেশে মুক্ত ভাবে শ্বাস নেয়া হয়নি, খোলা আকাশ দেখা হয়নি। তার ভীষণ ভালো লাগলো, মন খারাপ, মনের অশান্তি, দুশ্চিন্তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে যেন। সূচনা উচ্ছ্বসিত নয়নে তাকিয়ে চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। হুট করে তার চোখ গেল একটা গাছের মধ্যে। এটা কাঠগোলাপ গাছ না! তাদের বাড়ির ওখানে ও তো আছে! কত ফুল কুড়িয়ে আনত! তার পছন্দের ফুলের মধ্যে একটা এটা। গাছের নিচে ফুল পড়ে থাকতে দেখে তার এখনো ও ইচ্ছে করলো একটা দৌড় দিয়ে যেয়ে সব ফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসতে৷ কিন্তু ইচ্ছে টাকে ইচ্ছে পর্যন্ত ই সীমাবদ্ধ রাখলো।
সেখানে প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো থেকে প্রণয় তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষে ইরার জন্য ও কিছু খাবার নিয়ে আসে। প্রণয় সময় মতোই সূচনাকে হোস্টেলে পোঁছে দেয়। বাইক থেকে নামিয়ে দিয়ে প্রনয় তাকে যেতে বললে ও সূচনা যায় না। তার হাবভাব দেখেই প্রণয় বুঝতে পারে মেয়েটা হয়তো কিছু বলতে চায়। প্রণয় তাই সহজ গলায় বলে,

” কী বলবে নির্দ্বিধায় বলে ফেল। ”

সূচনা একটু অবাক হয়, নির্দ্বিধায় বলতে বললেও দ্বিধা কা টি য়ে উঠতে পারে না। ইতস্তত করে বলে,

” আমাকে দুইটা টিউশনি জোগাড় করে দিতে পারবেন? গ্রামে তো অনেক ছিল, আমি টিউশনির টাকা দিয়েই নিজের অর্ধেক খরচ চালাতাম। এখন ভার্সিটি শেষে ও আমার হাতে সময় থাকে। খালি বসে না থেকে যদি টিউশনি করি তো….

” ভেতরে যাও। ”

সূচনা নিজের কথা পুরো শেষ করার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রণয় এই কথা বলে। সূচনা ফের কিছু বলতে নিলে প্রণয় আবারও একই কথা বলে,

” ভেতরে যাও, পরে কথা হবে। ”

এবার খানিক জোরেই বলে প্রণয়, সূচনা আর কিছু বলতে না পেরে চলে আসে সেখান থেকে। প্রণয় আর দেরি না করে সেখান থেকে চলে যায়। সূচনার মনঃক্ষুণ্ন হয়, পুরো কথা শুনলো না, কিছু বললো ও না! বিকেলের ভালো মন টা নিমিষেই খারাপ হয়ে যায়। রুমে ফিরে এসে খাবারের ব্যাগটা ইরার হাতে ধরিয়ে দেয়। রেগে মেগে হাত থেকে একের পর এক চুড়ি গুলো খুলতে থাকে। তার খোঁপা করা চুলগুলো তন্মধ্যে খুলে পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। তখনই খেয়াল করে মেঝেতে একটা শুভ্র রঙা ফুল। সূচনা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে মেঝে থেকে ফুলটা হাতে নেয়। চিনতে তেমন অসুবিধা হয় না যে এটা কাঠগোলাপ। তার ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ে। এই ফুল কোথা থেকে আসলো? তার খোঁপায় কী করে? উত্তর খুঁজতে গেলে মনে হয় প্রণয় ই দিয়েছে তাহলে? কীভাবে বুঝতে পারলো তার মনের কথা? ছেলেটা কী মানুষের মন পড়তে জানে? আশ্চর্য!

# চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে