প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৮

0
610

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৮
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
_______________________________
হাত-মুখ ধুয়ে এসে সূচনাকে রুমে পায়না প্রণয়। মুখ মুছতে মুছতে সে ঘর থেকে বের হয়। পানি পান করার উদ্দেশ্যে খাবার ঘরে যায় সে৷ সেখানে গেলেই দেখা মেলে সূচনার। সূচনা মেঝেতে মাদুর পেতে খাবার নিয়ে বসে আছে। প্রণয় ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে,

” এত আয়োজন কার জন্য? ”

সূচনা সহজ গলায় জবাব দিল,

” আপনার জন্য ই হবে, আর কার জন্য হবে! ”

প্রণয় ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করলো, জিজ্ঞেস করলো,

” আমার প্রতি এত যত্নশীল কবে হলে? ”

সূচনা এবারও স্বাভাবিক স্বরে ই জবাব দিল,

” যেই মুহূর্ত থেকে আপনি আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। ”

” আমি কবে থেকে ভাবতে শুরু করলাম তোমাকে নিয়ে! ”

সূচনা জবাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে নিলেও চুপ হয়ে গেল। প্রণয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। প্লেটে ভাত বাড়তে থাকে, তাড়া দিয়ে বলে,

” তাড়াতাড়ি আসুন নাহয় ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”

প্রণয় এগিয়ে যায়, আসন পেতে বসে মাদুরে তারপর জিজ্ঞেস করে,

” ইরা শুয়ে পড়েছে? ”

সূচনা ভাত সমেত প্লেট এগিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

” হ্যাঁ শুয়ে পড়েছে। ডাল আর তরকারি গরম করে দিয়েছি, তরকারি কম আছে তাই ডিম ভাজি করে দিয়েছি। চলবে? ”

” দৌড়াবে, এমনিতেই ক্ষুধা পেয়েছে এখন যতটুকু পাব ততটুকুই চলবে। ”

” আপনি যে আসবেন ইরা জানতো? ”

” না ও জানতো না, আমি পোঁছে ওকে ফোন করেছিলাম সদর দরজা খুলে দেয়ার জন্য। ”

” জানিয়ে আসলে কী হত? ”

” যে চ ম ক টা পেয়েছো তা পেতে না। ”

সূচনার দিকে তাকিয়ে বলে প্রণয়, সূচনা মুখ ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকায়, আর কিছু বলে না। মনে মনে অবশ্য এটাই ভাবে, যদি তাকে জানিয়ে আসতো তাহলে মধ্যরাতে এভাবে চমক টা সে পেত না। অভাবনীয় ব্যাপার হুটহাট ঘটে গেলেই মজা পাওয়া যায়। স্বাভাবিক নিয়মে ঘটলে সেই মজা পাওয়া যায় না।
খাওয়ার সময় আর দুজনের মধ্যে তেমন কথা হলো না। প্রণয়ের খাওয়া শেষ হলে সবকিছু গুছিয়ে রেখে দুজন একসাথে ই ঘরে আসতে নিয়েছিল৷ এর মধ্যে ই হুট করে সূচনার কিছু মনে হলো। পিছনে ফিরে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো,

” চা খাবেন? ”

প্রণয় ফোনে কিছু একটাা করতে করতে আসছিল সূচনার পেছন পেছন ই৷ তার প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে বলে,

” হ্যাঁ খাওয়া যায়। ”

” আপনি যান আমি নিয়ে আসি৷ ”


প্রণয় ঘরে যায়নি, পুরো সময় রান্না ঘরেই বসে থাকে। অবশ্য রান্নাঘরে বসে থাকলেও তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ফোনের মধ্যে ই থাকে৷ সূচনা চা বানিয়ে দুই টা কাপের মধ্যে নেয়। একটা নিজের জন্য নিয়ে প্রণয়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় আরেকটা। প্রণয় হাতে নিয়ে ই চায়ে চুমুক বসায়, কিছু বলে না। সূচনা কোনো মন্তব্যের আশা করছিল কিন্তু ছেলেটা চা নিয়ে কোনো মন্তব্য করে না। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,

” দস্যি রাণীর রা গ কী কমেছে? ”

সূচনা প্রথমে একটু অবাক হয় সম্বোধনে, অন্যরকম লাগে তার কাছে। ইতস্তত করে বলে,

” হ্য.. হ্যাঁ হয়তো। ”

” মানে কমেনি! ”

সূচনা কিছু বলে না, প্রণয় মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বলে,

” চলো। ”

সূচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

” কোথায় যাব? ”

” তোমাকে বেচেঁ দিব। ”

প্রণয় মুখ বাঁকিয়ে এই কথা বলতেই সূচনা ও হেয়ো স্বরে বলে,

” দিন, সমস্যা নেই কিন্তু আমায় বেঁচতে গেলে আপনার বিশেষ কোনো লাভ হবেনা। ”

” হবেনা কেন! ”

” মানুষ কী টাকা দিয়ে আরেকজনের ব্যবহৃত জিনিস কিনবে? অবশ্যই কিনতে চাইবেনা। ”

” তুমি ব্যবহৃত? “কবে কীভাবে ব্যবহার করলাম? ”

সূচনার সাদা মনে বলা কথার পৃষ্ঠে ডান ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন দুইটা করে প্রণয়। সূচনা প্রথমে বুঝতে পারেনা তাই প্রণয়কে বোঝানোর জন্য বলে,

” আরে আমি বিবাহিতা এখন তো..

” তো! ছুঁয়ে তো দেখিনি এখনো সুতরাং ভালো লাভ হবে আমার। চলো। ”

সূচনা চুপসে যায়, তার ভারি লজ্জা লাগে। মনে মনে খানিক ব ক তে ইচ্ছে করে, ছেলেটা এমন করলো কেন!

প্রণয়ের কথা মত তার সাথে আসে সূচনা, প্রণয় বাড়ির সদর দরজা খুলে সিড়ির মধ্যে এসে বসে। সূচনা বসে না প্রথমে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রণয় ফের ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

” তাকিয়ে আছো কেন? বসো! ”

সূচনা প্রণয়ের পাশেই বসে, জিজ্ঞেস করে,

” তোমার পছন্দের রঙ কী? ”

” সবুজ। ”

” পছন্দের ফুল কী? ”

” কাঠগোলাপ। ”

” পছন্দের খাবার? ”

” তেমন করে পছন্দ নেই কোনো। ”

” আচ্ছা। ”

প্রণয় আরও কিছু প্রশ্ন করতো, কিন্তু করলো না। একদিনে সব জানার কী দরকার! হারিয়ে তো যাচ্ছে না। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করে সেখানেই, ঝগড়া ছাড়াও তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কিছু কথোপকথন হয়। সবশেষে দুজনেই অনুধাবন করে তাদের দুজনের ই আসলে সময় দরকার, নিজেদের জানতে, বুঝতে।
রাতে ঘুমানোর সময়ও প্রথম দিনের মতো ঝগড়া হয় না৷ খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রণয় মাঝে একটা কোল বালিশ রেখে শুয়ে পড়ে। সূচনা প্রথম উসখুস করছিল তা দেখে প্রণয় মৃদুস্বরে বলে,

” দস্যি রানী এখন আবার উসখুস করছে, ঘুমাও। খেয়ে ফেলবনা তোমাকে। ”

সূচনা চোখ মুখ কুঁচকে প্রণয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে একপাশে যেয়ে শুয়ে পড়ে। মাঝে কোলবালিশ থাকা স্বত্তেও সে একেবারে খাটের শেষ প্রান্তে যেয়ে শুয়ে আছে। প্রণয় সাবধানী কণ্ঠে বলে,

” আরেকটু এদিকে এসো নাহয় পড়ে যাবে। ”

সূচনা শোনে না, কাছে আসার পরিবর্তে আরও দূরে সরতে গেলে খাট থেকে পড়ে যেতে নেয়। প্রণয় তড়িঘড়ি করে তার বাম বাহু চেপে ধরে নিজের দিকে টে নে নিয়ে আসে। সূচনার চোখ জোড়া স্থির হয় প্রণয়ের চোখ জোড়ায়। আকস্মিক ঘটনায় সূচনা হতভম্ব হয়, পড়ে গেলে মাথা ফা ট তো নিশ্চিত! প্রণয় ধ ম কের স্বরে বলে,

” মেয়ে মানুষ বোঝে বেশি। ”

সূচনা চোখ জোড়া নামিয়ে নেয়, মুখ চুপসে যায়। প্রণয় তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে।


তার পর আরও দুইদিন কে টে যায়। সূচনা ও ইরা আগামীকাল ঢাকা চলে যাবে। প্রণয়ই নিয়ে যাবে দুজনকে। সূচনার মন খারাপ ভীষণ, এর আগে মা কে ছেড়ে কোনোদিন ও এত দূরে যাওয়া হয়নি। গত কালকে দিশা বেগমের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সে। মেয়ে মন খারাপ করে থাকলেও দিশা বেগম যথেষ্ট শক্ত ছিলেন। হাসিমুখে কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় দিয়েছেন। সূচনা ও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। সূচনা যে হোস্টেলে থাকবে তাতে প্রণয়ের আপত্তি না থাকলেও সূচনার চিন্তা অন্য জায়গায়। অবশ্য এই চিন্তা সূচনার মাথায় নিজ থেকে ই আসেনি। দিশা বেগম ই বলেছেন, গত কাল সূচনা বাসায় যাওয়ার পর দিশা বেগম উৎকণ্ঠা নিয়ে বলছিলেন,

” শোন মা, বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়টা দিন। এর মধ্যে তুই থাকবি হোস্টেলে, জামাই থাকবে তার বাড়িতে। মানে তোদের বিয়েটা হলো যেই পরিস্থিতি তে! তার মধ্যে বিয়ের পরপরই দুজন আলাদা থাকবি! ”

সূচনা তখন পাত্তা না দিলেও পরবর্তী তে সে ও বিষয়টা নিয়ে ভাবে। ভাবতে না চাইলেও বারবার মাথায় এসেই পড়ে। প্রথমত তাদের দুজনের ই আগে নিজেদের জানতে হবে, বুঝতে হবে। আর তার জন্য একসাথে থাকাটা জরুরি না!


পরের সকালে সবার থেকে বিদায় নিয়ে সূচনা আর ইরাকে নিয়ে প্রণয় রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পোঁছাতে পোঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। দুইজনকে হোস্টেলে রেখে প্রণয় নিজের বাসায় যায়। একটা ফ্লাটের মধ্যে চারজন মিলে থাকে তারা। সূচনা ও ইরা হোস্টেলে ফিরেই একে একে গোসল করে নেয়। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে প্রণয় আবার যায় হোস্টেলে। দুপুরে খাওয়া হয়নি কারোর ই, দুজনকে নিয়ে আবার বাইরে বের হয় সে। ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল হয়, ইরা রিকশা থেকে নেমে আগেই ভেতরে ঢুকে পড়ে। সূচনা রিকশা থেকে নামতে নামতে প্রণয় বাইক থেকে নেমে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিকশা ভাড়া চুকিয়ে দেয়, সূচনা ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে প্রণয়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। প্রণয় ফোন সমেত হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। সূচনা প্রথমে খেয়াল করে না দেখে প্রণয় ই বলে,

” তোমার ফোন। নিয়ে যাব সাথে? ”

সূচনার খেয়াল হয়, মনে পড়ে খাওয়ার সময় তার ফোনটা প্রণয়কে দিয়েছিল রাখতে। সূচনা হাত বাড়িয়ে ফোন নিতে গেলে প্রণয় হাত ধরে ফেলে। মিষ্টি, কোমল সুর বলে,

” নিজের খেয়াল রেখো, কিছু লাগলে আমাকে জানাবে আগে। ইরাকে ও দেখে রেখো, সম বয়সী পরে তার আগে তুমি তার ভাবী। সেদিকে লক্ষ্য রেখো। আম্মাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না আমি আছি। ”

সূচনা এক ধ্যানে শুনে যায়, ঘোর গ্রস্তের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে ‘ হু ‘ বলে। প্রণয় হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

” আসি তাহলে! ”

সূচনা আগের ন্যায়ই ঘাড় নাড়ায়, প্রণয় বাইকে উঠে বাইল স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। সূচনা তাকিয়ে থাকে যতক্ষন অব্দি দেখা যায়। তার হুট করে কেমন যেন নিজেকে ফাঁকা ফাঁকা লাগে, বুক ভার হয়ে আসে। কিন্তু কেন!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে