#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৭
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
______________________________
রাতে খাবার টেবিলে ইরা ভার্সিটির প্রসঙ্গে কথা বললো। সাথে নিজের পরিকল্পনার কথা ও এহতেশাম সাহেবকে জানালো। এহতেশাম সাহেব খুশিই হলেন, মেয়ের পরিকল্পনা তার পছন্দ হয়েছে। এই সুবাদে ওনার দুই মেয়েই একসাথে থাকবে আর বেশি দিনের কথা ও না৷ উনি বললেন আগামীকাল ঢাকা যেয়ে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আসবেন। সূচনার চিন্তা কিছু সময়ের জন্য পিছু ছাড়লো৷ রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ফ্রেশ হয়ে ইরার রুমে গেলে ইরা হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো,
” ভাবি, ভাইয়া কথা বলবে ধরো। ”
ফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে আর রুমে দাঁড়ালো না, বাইরে বেরিয়ে গেল। ভাই ভাবি কথা বলবে এর মধ্যে থাকাটা শোভা পায় না৷ এই জ্ঞান মেয়েটার আছে অবশ্যই। সূচনা ফোন হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড থম মে রে রইলো। ওপাশ থেকে প্রণয়ের আওয়াজ শুনলে তার ঘোর কা ট লো। যত রা গ ই থাকুক প্রথমে প্রকাশ না করেই সে বিনয়ী ভঙ্গিতে সালাম দিলে প্রণয় সালামের জবাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছো? ”
সূচনা পূর্বের ন্যায় জবাব দিল,
” এই তো আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো আছি। ”
পাল্টা প্রশ্ন করলো না প্রণয় কে। প্রণয় সেদিকে পাত্তা না দিয়ে টুকটাক কথা বলে গেল। মেয়েটা হু হা শব্দ করে গেল শুধু। প্রণয় না পেরে সেদিনের প্রসঙ্গ তুললো। জিজ্ঞেস করলো,
” আমি ঢাকা এসেছি দুইদিন হয়ে গেল অথচ তুমি একদিন খোঁজ ও নিলে না! ”
” খোঁজ নেয়ার রাস্তাটা ছেড়ে যাননি। ”
” ইরার ফোন দিয়ে করতে! ”
” ইরা যখন জিজ্ঞেস করতো আমার ফোনের কথা তখন কী বলতাম! তোমার ভাই ভেঙে ফেলেছে! ”
প্রণয় থতমত খায়, সে এমনিতেই অনুতপ্ত হচ্ছিল ফোনটা ভেঙে ফেলায়। সেদিন কেন যে তার মাথা এত গরম হয়ে গিয়েছিল! ভাবলে ই রা গ লাগছে এখন। প্রসঙ্গ দ্রুত পরিবর্তন করে সে। ঠাট্টার ছলে বলে,
” এভাবে ঢাকায় যদি পড়ে থাকি তাহলে দেখা যাবে তোমার বরকে নিয়ে অন্য মহিলা পালিয়ে গেছে। তখন কী করবে! ”
” ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখলে সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে না। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা নেই, বিয়েটা স্বাভাবিক না তাই তৃতীয় ব্যক্তির কথা আসছে। ”
সূচনা সহজ গলায় কথা বললেও প্রণয়ের কাছে ভালো লাগলো না। সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
” এখনো রা গ করে আছো! সেদিন মাথা গরম ছিল কী থেকে কী বলে ফেলেছি বুঝিনি তখন। পরে বোঝার পর মনে হলো এখন তোমার সাথে থাকলে এর চেয়ে খারাপ আচরণ করে ফেলতে পারি। সেজন্য পরের দিন ই কাজের বাহানা দিয়ে ঢাকা চলে এসেছি। ”
সূচনা চুপচাপ শুনলো কিছু বললো না, তার নীরবতা দেখে প্রণয় ফের বললো,
” রা গ করে না বউ। ”
এহেন বাক্যে, প্রণয়ের গলার স্বরে মেয়েটার কী যেন হয়ে গেল। কেমন অন্য রকম কিছু অনুভূত হলো। দুইদিন আগে তো সহ্য করতে পারতনা আর দুইদিনে পরিবর্তন! মেয়েটা ভাষা হারিয়ে ফেলে যেন। কিছু বলতে গেলেও শব্দেরা কণ্ঠনালি হতে নিঃসৃত হতে চায়না। প্রণয় উত্তরের আশা করে না আর, পরে ফোন দিবে বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে৷ সূচনা তবুও কয়েক সেকেন্ড কানে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
।
।
পরের সকালে এহতেশাম সাহেব যান ঢাকায়, হোস্টেলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আসেন। ওনারা বলেন পরে জানাবেন। এহতেশাম সাহেব ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরেন সন্ধ্যার পরে। ফিরে এসে সূচনার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেন। বলেন যে প্রণয় দিয়েছে। সূচনার ভারি লজ্জা লাগে, ছেলের কান্ড জ্ঞান নেই নাকি! বাবার কাছে কীসের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে! সূচনা নত দৃষ্টিতে মাথা এলিয়ে এহতেশাম সাহেবের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরে যায়। খুলে দেখে না, টেবিলের ওপর রেখে দেয়। রাতে খাবার শেষ করে সব কাজ সেরে সূচনা ঘরে আসে। হাত মুখ ধুয়ে মুছে সে ব্যাগটা নিয়ে বসে। ব্যাগ খুলে দেখে একটা নতুন ফোন৷ নিজে ফোন ভেঙে নিজেই কিনে দিচ্ছে! শুধু ফোন না ফোনের বক্সের মধ্যে একটা ছোট চিরকুট ও পাওয়া যায়৷ সূচনা চিরকুট টা খুলে ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে শব্দ করে চিরকুটের লেখাটা পড়ে,
” রা গ করে না বউ, রা গ টা কমাও। এই ছেলেটার ধৈর্য কম, মাথা সবসময় গরম থাকে। মাথা গরম থাকলে কী থেকে কী বলে নিজেও বোঝেনা৷ সেজন্য বাবা বাউণ্ডুলে নাম দিয়েছে বহু আগে। তুমি বেয়াদব ছেলে বানিয়েছো। তন্মধ্যে তোমার ও যদি এত রা গ থাকে সংসার কে সামলাবে? সময় দাও আমায় একটু ঠিক করে নিই নিজেকে! ”
সূচনা কয়েকবার চিরকুটের লেখাগুলো পড়ে আর প্রতিবার ই বউ শব্দ টায় এসে আঁটকে যায়। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দ তে মনোযোগ ক্ষুণ্ন হয়। তার ফোনটাই বাজছে। দুইবার তিনবার রিং হওয়ার পর সূচনা ফোন রিসিভ করলো। রিসিভ করে কানে তুললো, প্রণয় ঈষৎ ধমকের স্বরে বললো,
” ফোন হাতে পেয়ে সাথে সাথে ফোন দিলে না কেন! ”
সূচনা ধমকে খানিক চমকে ওঠে, পরমুহূর্তে গলা উঁচিয়ে বলে,
” আবার ধমকাচ্ছেন! ”
প্রণয় দমে যায়, ইতিউতি করে বলে,
” ঐ আর কি, কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম তুমি ফোন দিবে৷ দাও নি সেজন্য। ”
” আমি ফোন দিব তা ভাবলেন কেন! ”
” কেন দিতে না? ”
” অবশ্যই না। ”
মুখের ওপর না করে দেয়ায় প্রণয় খানিক অপমানিত বোধ করে। মেয়ের সাহস কত! মুখের ওপর না করে!
মেকি হেসে বলে,
” তুমি না দিলেও আমি অবশ্যই দিতাম। ”
” যদি রিসিভ না করতাম? ”
” সারারাত দিতাম! না উঠিয়ে যাবে কোথায়! ”
” ফোন বন্ধ করে রাখলে! ”
” ইরাকে দিতাম। ওকে বিরক্ত করতাম৷ তুমি নিশ্চয়ই তোমার জন্য ইরাকে বিরক্ত হতে দিতে না। ফোন রিসিভ করতেই। ”
প্রণয়ের ফটাফট জবাব, সূচনা খানিক অবাক হলো৷ প্রথম দিনের প্রণয়ের সাথে এই প্রণয়ের মিল পেল সে। অথচ সেদিন রাতের প্রণয় যেন অন্য কেউ ছিল। সূচনার ভালো লাগে, যাক সোজা মুখে কথা তো বলছে৷ সেরাতে তাদের মধ্যে প্রায় আধ ঘন্টার মতো সময় কথা হয়। স্বাভাবিক কিছু কথা ই হয়। প্রণয় বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে না তাই সূচনাও কিছু বলে না। দিন দুই পরে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের থেকে কল আসে। ওনারা জানান একটা সিট খালি করে দেয়া হয়েছে। ঐ রুমে যে ছিল তাকে অন্য রুমে দিয়ে দেয়া হয়েছে। সূচনার চিন্তা যেন আরেকটু কমে। অবশ্য তার একটু খারাপ ও লাগে তার জন্য অন্য একজনের জায়গা বদল করতে হয়েছে ভেবে৷ ক্লাস যেহেতু সপ্তাহ খানেকের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে তাই এহতেশাম সাহেব বললেন,
” যা যা লাগবে গোছাতে থাকো, দুইদিন আগেই চলে যাবে৷ ওখানে যেয়ে আগে ভাগেই সব গুছিয়ে নিবে। ”
সূচনা আর ইরা তাই করলো পরের দিন থেকেই টুকটাক করে সবকিছু গোছাতে লাগলো। সেদিন আর প্রণয়ের সাথে যোগাযোগ হয়নি মেয়েটার৷ ফোন করে হোস্টেলে সিট পাওয়ার কথা বলবে বলবে করে ও সময় করে উঠতে পারেনি কাজের ব্যস্ততায়। অতঃপর ক্লান্ত শরীরটা রাতে ঘরে যেয়ে বিছানায় এলিয়ে দিতে ই রাজ্যের ঘুম চোখে ধরা দিল। ফোন আর করা হলো না, মাঝরাতে রুমের মধ্যে কারো উপস্থিতি টের পেল, জিনিস পত্র নাড়াচাড়া করার শব্দ ও কানে আসলো৷ মেয়েটা ভয় পেয়ে যায়। ভীত, শঙ্কিত মনে লাফ দিয়ে ওঠে৷ চোখের সামনে প্রণয়কে দেখতে পেয়ে যেন আরও চমকায়। জেগে জেগে স্বপ্ন কেন দেখছে সে! প্রণয় ঢাকাতে তাহলে এখানে কীভাবে আসবে! সূচনাকে এমন করে উঠতে দেখে প্রণয় পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ, হা করে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। প্রণয় যেয়ে বিছানার এক পাশে বসে। সূচনা নিজের চোখকে তখনো অবিশ্বাস করে, অবাক হয়ে বলে,
” আমি সত্যি দেখছি! ‘
প্রণয় ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে,
” সন্দেহ আছে? ”
” কথা ও বলছেন! ”
আরও বিস্ময় নিয়ে বলে সূচনা, প্রণয় বিরক্তি নিয়ে বলে,
” কথা বলবনা কেন! আমি কী বোবা! ”
সূচনা তবুও হা করে তাকিয়ে রইলো, প্রণয় নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
” নাও ছুঁয়ে দেখো বিশ্বাস না হলে। ”
সূচনা সত্যি সত্যি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখলো, শুধু ছুঁয়ে ই দেখলো না রীতিমতো চিমটি কে টে বসলো। প্রণয় চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
” ছুঁয়ে দেখতে বলেছিলাম, মাং স তুলে আনতে বলিনি। ”
সূচনার এবার বিশ্বাস হয়, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় নিজের কাজে। মেকি হেসে বলে,
” আমি তো পরীক্ষা করছিলাম সত্যি আপনি নাকি কোনো জ্বীন টিন। ”
সূচনার কথার পৃষ্ঠে প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” আমাকে জ্বীনের মতো দেখা যায়! ”
” আশ্চর্য জ্বীন কী তার আসল রূপে আসবে! আসবে তো কারো না কারো রূপে। ”
” শিক্ষিত মেয়ে অথচ কীসব বলছো! ”
” তো কী হয়েছে! শিক্ষিত দেখে কী জ্বীন নেই আমার জন্য! ”
” স্ব চক্ষে কখনো দেখেছো? ”
” না। ”
প্রণয় বিছানা থেকে উঠে আলমারির কাছে যেতে যেতে বলে,
” কী বলো! আমি কত দেখেছি! কাল চলো পদ্মবিলে ঐখানেই তো জ্বীনের অভাব নেই। তোমায় নিয়ে দেখে আসব। ”
” খেয়ে কাজ নেই আমার! ”
” ঠিক আছে এবার বলো জ্বীন গবেষণা শেষ হয়েছে? ”
” হয়েছে৷ ”
” যাক। ”
” এত রাতে আপনি কোথা থেকে আসলেন ? ”
নিজের ভয় ভীতি সব কমিয়ে সূচনা প্রশ্ন করলো। প্রণয় টি-শার্ট ট্রাউজার ঠিক করতে করতে জবাব দিল,
” ঢাকা থেকে আসছি। ”
” কিন্তু এত রাতে কেন! ”
” একটা মাত্র বউকে চমকে দিতে। ”
কথাটুকু বলেই প্রণয় বাথরুমে ঢুকে পড়ে। পেছনে সূচনা বিস্ময় নিয়ে বসে থাকে এই ভেবে যে তাকে চমকে দিতে এত রাতে এখানে এসেছে!
#চলবে