প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৬

0
595

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৬
#নাজিয়া_শিফা( লেখণীতে)
_______________________________
নুরাইয়া সব নিয়ম কানুন মেনেই ছেলে ও ছেলে বউকে ঘরে তুললেন৷ ইরা সূচনাকে নিয়ে গেলো প্রণয়ের ঘরে, কোথায় কী আছে দেখিয়ে দিল। সূচনা নিজের ব্যাগ থেকে খুব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই শুধু বের করে প্রণয়ের আলমারি তে রাখলো। ব্যাগ একপাশে সরিয়ে রেখে সে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো প্রণয় ঘরে এসেছে। বিছানায় আরাম করে হেলান দিয়ে বসে ফোন টিপছে। তাকে এক পলক দেখে সূচনা হাত মুখ মুছে ঘর হতে বের হতে নিলেই প্রণয় কঠিন স্বরে ডেকে ওঠে,

” এই মেয়ে! ”

সূচনা থমকায়, তৎক্ষনাৎ ই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। চোখের ইশারায় জানতে চায়, ” কী হয়েছে? ”
প্রণয় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফের কঠিন স্বরে বলে,

” তোমার জবান নেই! মুখে জিজ্ঞেস করতে পারো না কী হয়েছে! ”

সূচনা ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে মনে মনে ভাবে,

” একে তো আপনি থেকে তুমি তে নেমেছে তারওপর ধমকা ধমকি করছে! ”

” চুপ করে আছো কেন! বোবা তুমি? ”

সূচনা এবার রে গে যায়, কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে,

” বোবা কেন হতে যাব হ্যাঁ! আর ধমকা ধমকি করছেন কেন! ”

” তো কী করব! বাচ্চা মেয়েকে আপনি আপনি বলেছি, বেশি সম্মান করে ফেলেছিলাম তাই তো মাথায় চড়েছো৷ ”

” বেশি বলছেন আপনি। ”

” এখনো কিছু বলিনি, শোনো এই রুমে…

” কী এই রুমে আমি থাকতে পারবনা! ”

প্রণয়ের কথা শেষ করতে দেয়না সূচনা, কথার মাঝখানে ই উক্ত কথা বলে। প্রণয়ের মেজাজ বি গ ড়ে যায়, আরও কঠিন স্বরেই বলে,

” না পারবেনা। এই ঘরে কেন আমার জীবনেও থাকতে পারবেনা। বুঝেছো! ”

সূচনা চুপ হয়ে যায়, কথার পৃষ্ঠে আর কোনো কথা বলতে পারে না। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তখনই। প্রণয় রা গে নিজের মাথা চেপে ধরে। তার হুট করেই সব কিছু তে রা গ লাগছে। সবকিছু বিরক্তি লাগছে। বিয়েতে অমত করেনি, বাবার জন্য রাজি হয়েছে, মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে, বিয়েটা এভাবে হয়ে যাবে সে অবশ্য ভাবেনি। সবকিছু গোলমেলে লাগছে ভীষণ। ছেলেটা এতটুকু বুঝতে পারে তার ধৈর্য ধরতে হবে অনেক। সময় দিতে হবে, নিজেকে আর মেয়েটাকেও। নাহয় এই সম্পর্ক টেকানো সম্ভবত কঠিন। উপরন্তু দুইজন দুই মেরুর, স্বভাবে, আচরণে কোনো মিল নেই। পছন্দ, অপছন্দ মানসিকতা এসব সম্পর্কে তো কোনো ধারণা ই নেই। কীভাবে টিকবে এই সম্পর্ক!


শশুর বাড়ি তে সূচনার প্রথম দিন বেশ ভালো কা টে। নুরাইয়ার সাথে টুকটাক কাজ ও করে দিয়েছে সে। অবশ্য নুরাইয়া করতে দিতে চাননি, সূচনা জোর করেই করেছে। ইরার সাথে ও মোটামুটি কথা হয়েছে, মেয়েটা তার বয়সেরই, তার ওপর একই ভার্সিটি তে সুযোগ হয়েছে দুজনের। এহতেশাম সাহেব সকালে বেরিয়ে গিয়েছেন, রাতে আসার পর দেখা হয়েছে এবং সূচনার সাথে। কথা তেমন হয়নি, খাবার টেবিলে টুকটাক ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সূচনাকে। তার জবাব দিয়েছে শুধু। মায়ের সাথে বিকেলে কথা হয়েছিল সূচনার৷ প্রণয়ের সঙ্গে পুরো দিনে তেমন কথা ই হয়নি। প্রণয় ও কথা বলতে আসেনি৷ সূচনা ঘরে ও যায়নি। কিন্তু রাতে ঘুমাতে যেয়ে বিপত্তি বাঁধে। দুজনের কেউ ই কথা বলছেনা, প্রণয় সোজাসাপটা বলে দিয়েছে তার ঘরে বা জীবনে কোথাও জায়গা হবেনা। দুপুরের সেই কথা মনে পড়তেই সূচনার মনঃক্ষুণ্ন হয় ফের। কী করবে বুঝতে পারে না, বাইরে যেয়ে শোয়া সম্ভব না। কিন্তু এখানে ঘুমাবে? অসম্ভব। সে রা গে, ক্ষো ভে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে প্রণয় আঁটকায়। এতক্ষণ বিছানায় বসে আড়চোখে তাকিয়ে সূচনার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছিল। তাকে ঘর হতে বের হয়ে যেতে দেখলেই তার নাম ধরে ডেকে ওঠে। সূচনার পা জোড়া থেমে যায় ঠিক কিন্তু পিছু ফিরে প্রণয় কে দেখে না৷ প্রণয় নিজেই এগিয়ে যায় তার দিকে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,

” রাত করে বাইরে যাচ্ছো কেন? ”

” কারো ঘরে যেহেতু জায়গা হবে না আমার তো বাইরেই যেতে হবে। আর কোথায় যাব! ”

সূচনার কণ্ঠে রা গ নাকি অভিমান প্রকাশ পেল প্রণয় তা ধরতে পারলো না। সে নরম স্বরে শোধালো,

” দেখো, এখন বাইরে গেলে বাবা-মা ভালো চোখে নিশ্চয়ই দেখবেন না। ”

” তাহলে কোথায় যাব! ”

” এই ঘরেই থাকবে। ”

” কেন! জীবনে ই যেহেতু রাখবেন না ঘরে কেন থাকতে যাব! ”

গলার স্বর এবার খানিক উঁচু হয় সূচনার। প্রণয়ের মেজাজ ফের বি গ ড়ে যায়৷ সে সূচনার ডান বাহুতে জোর দিয়ে তাকে দরজার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। দুই হাতে চে পে ধরে তার বাহু জোড়া। রা গে, দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে হিসহিসিয়ে বলে,

” কী সমস্যা তোমার হ্যাঁ! সোজা কথা কানে যায় না! চেচাঁচ্ছো কেন! সবাইকে জানাতে! ”

সূচনা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চোখ জোড়া নামিয়ে রেখেছে, দৃষ্টি তার বাহুতে থাকা প্রণয়ের হাতের দিকে৷ প্রণয় জবাব না পেয়ে আরও বল প্রয়োগ করতেই সূচনা ব্যথায় মৃদু স্বরে চিৎকার করে ওঠে। সে শব্দ কানে পোঁছাতেই প্রণয় নরম হয়। তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দেয় বাহু জোড়া। কিছু বলতে নিলেও বলে না, সরে যায় সামনে থেকে। ধুপধাপ পায়ে দরজা খুলে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। সূচনার চোখ জোড়া তখন ঝাপসা হয়ে আসে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয় সেখানেই। কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হলে নিজের জায়গা থেকে সরে সে দরজার বাইরে উঁকি দেয়। অন্ধকার ছাড়া কিছু ই নজরে আসেনা। টেবিল থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ঘর থেকে বের হয় সে। ড্রয়িংরুমে কাউকে দেখতে পায়না। সদর দরজা ঈষৎ খোলা দেখে সেদিকেই পা বাড়ায়। দরজা একটু খুলে বাইরে উঁকি দিতে ই দেখা উঠোনে পুরুষালী অবয়ব লক্ষ্য করে। যাক বাইরে কোথাও যায়নি ভেবে চিন্তা মুক্ত হয় খানিক। তার কী যেয়ে কথা বলা উচিত? নাকি এভাবেই থাকবে? সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা মেয়েটা। কিছু সময় ঐভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর সাহস করে এগিয়ে যায়। প্রণয়ের পেছনে যেয়ে দাঁড়ায়, পায়ের শব্দ পেয়ে প্রণয় ও পেছনে তাকায়। সূচনাকে দেখতে পেয়ে মেজাজ বি গ ড়ে গেল আরও! সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। তার অভিব্যক্তি বুঝতে সূচনা ফোনের আলো তার দিকে ধরে এতেই যেন বিরক্ত হয় প্রণয়। ছো মে রে তার হাত থেকে ফোন নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রুঢ় কণ্ঠে বলে,

” কী সমস্যা? ঘর ছেড়ে দিয়েছি না! আবার আসছো কেন! ”

মেয়েটা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এত রুঢ় ব্যবহার যেন নিতে পারে না। সে তো অনুতপ্ত ছিল, সেজন্য বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে এসেছিল। অথচ এই ছেলের ব্যবহার এমন! সূচনা বিস্ময়, রা গ, ক্ষো ভ সবকিছু এক বাক্যে প্রকাশ করে,

” আপনি এত বদমেজাজি প্রথম দেখায় তো বুঝিনি। ”

উক্ত কথা বলে মেয়েটা আর দাঁড়ায় না, এক প্রকার ছুটে ঘরে চলে যায়। পেছনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রণয়। সে আসলেই এত বদমেজাজী! না তো!


পরের দিন দুপুরে কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে প্রণয় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নুরাইয়া বা এহতেশাম সাহেব কেউই যেতে দিতে চাননি কিন্তু প্রণয় এত ব্যস্ততা দেখাচ্ছিল যে শেষে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। যাওয়ার সময়ও সূচনাকে কিছু বলে যায়নি। একবার অবশ্য বলতে গিয়েছিল কিন্তু সূচনা সুযোগটা দেয়নি। প্রণয় ঢাকায় চলে গেলে, সূচনা ইরার সাথে থাকে, প্রণয়ের ঘরে আর ঘুমায়নি। প্রণয় ঢাকা গিয়েছে আজ দুইদিন। দুইদিনে সে যোগাযোগ করেনি আর সূচনার সাথে। সূচনা ও করেনি, করবে কীভাবে! যোগাযোগ করার রাস্তা তো প্রণয় বন্ধ করে দিয়ে গেছে। রাস্তা যেহেতু সে বন্ধ করে দিয়ে গেছে খুলবে ও সেই। প্রণয়ের সাথে ঝামেলা বাদে বাকিসব কিছু ভালো ই চলছে তার। যার পরিচয়ে আসা শুধু মাত্র সেখানেই সমস্যা। সূচনার হাসি পায়, বেশ কিছুক্ষণ হাসি জারি রেখে মৃদু স্বরে আওড়ায়,

” এই সম্পর্কের শেষ কোথায় হবে যদি শুরু ই না হয়! ”

” ভাবি..! ”

সূচনা চমকায়, ইরাকে দেখে নিজেকে সহজ করে জবাব দেয়,

” হ্য..হ্যাঁ। ”

” কী বলছিলে একা একা? ”

” ক..কই কী বলছিলাম! কিছু ই না। ”

” আমি শুনলাম তো আচ্ছা শোনো সামনের সপ্তাহে তো আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। তা কিছু ভেবেছো? ”

সূচনার মস্তিষ্ক সজাগ হয়, মনে পড়ে বিয়ের পর শশুর বাড়ি থেকে পড়ার কথা ছিল তার। কিন্তু এখন! এখন কী করবে?

” ভাবি! ”

” হ্যাঁ বলো। ”

” বললাম তো। আচ্ছা শোনো, আমাদের তো ঢাকাতে বাড়ির কাজ চলছে। কাজ মোটামুটি শেষ প্রায় আর কাজ শেষ হলে বাবা-মা ও ঢাকা চলে যাবে। তখন সবাই সেখানেই থাকতে পারব। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমাকে হোস্টেলে থাকতে হবে। আর ভাইয়াকে তার ব্যাচেলর বাসায়। আর তুমি! আমি ভাবছি বাবার সাথে কথা বলব, যদি কোনোভাবে আমি যে রুমে আছি সেই রুমের একটা সিট খালি করানো যায় তো ভালো হবে। দুজন একসাথেই থাকতে পারব। কী বলো! ”

সূচনা অবাক হয়, এতকিছু সে ভাবেনি, মেয়েটা যে তাকে নিয়ে এতকিছু ভাববে সেটা ভেবেও তার বিস্ময় কাজ করছে। কিন্তু সত্যি ই তার শশুর শাশুড়ী মেনে নিবে? মনের প্রশ্ন টা সে ইরাকে সত্যি সত্যি কর ফেলে,

” আঙ্কেল আন্টি মেনে নিবেন? ”

তার এহেন প্রশ্ন টাকে যেন ইরা হেসে উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললো,

” কী যে বলো! এত ভালো রেজাল্ট তোমার, নিজের যোগ্যতায় সুযোগ পেয়েছো আর বাবা আঁটকাবে! আমার রেজাল্ট ভালো আর সুযোগ হয়েছে দেখেই বাবা নিষেধ করেননি। উল্টো ভর্তি থেকে হোস্টেলে সিট নেয়ার পর্যন্ত সব বাবা করেছেন। আমি ওনার মেয়ে তোমাকেও মেয়ে হিসেবে এনেছেন৷ বুঝেছো! ”

বিনিময়ে সূচনা শুধু মাথা এলিয়ে সম্মতি দেয়। মেয়েটা সত্যি অবাক হয়েছে, তার ভাগ্য এত ভালো কীভাবে হলো যে এমন শশুর শাশুরী পেল!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে