#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৪
#নাজিয়া_শিফা( লেখনীতে )
________________________________
সূচনা বাসায় ফেরে যখন তখন প্রায় সন্ধ্যা। সূচনা কে দেখতেই ইরা ও বিদায় নিয়ে চলে যায়। দিশা বেগম সূচনাকে কিছু বলেন না। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না ওনার। আসলে খুঁজে ও পাচ্ছেন না কি বলবেন। এর মধ্যে সূচনাই নিজ থেকে বললো,
” মা একটু চা দিবে! মাথা ধরেছে। ”
দিশা বেগম অবাক হন, সাথে খুশি ও হন। মেয়ে যে রাগ না করে নিজে থেকে কথা বলেছে! দিশা বেগম চট জলদি রান্নাঘরে চলে গেলেন। ফরিদা চা বানিয়ে দিবে বললেও দিলেন না। মেয়ের জন্য নিজেই চা বানাবেন। সূচনা নিজের রুমে চলে আসে। বিছানায় বসে ফোন হাতে নিয়ে সময় পরখ করলো। আযান দিয়ে দিবে একটু পরই। সূচনা রুমে থেকেই গলা উঁচিয়ে বললো,
” মা চা দিও না এখন৷ নামাজ পড়ে দিও। ”
দিশা বেগম তাড়াহুড়ো করছিলেন, মেয়ের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করলেন না আর৷ সূচনা ওযু করার জন্য বাথরুমে যেতে নিলে ফরিদা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” আপা মণি কী কী কথা হইলো? ”
সূচনা ভ্রু কুটি করে, প্রশ্নের মানে বুঝলেও সে জিজ্ঞেস করে,
” কীসের কথা বলছিস? ”
” আরে ভাই জানের লগে কথা কইবার গেলেন যে! ”
সূচনা এবার খানিকটা শক্ত হলো, বললো,
” ফরিদা তুই বয়সে ছোট, আমাকে এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবিনা। এইসব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা ও বলবিনা। ”
সূচনা আর দেরি করেনা, বাথরুমে ঢুকে পড়ে। ফরিদা মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার আপা ও দিশা আম্মা যখন তাকে ব কা দেয় তার একটুও ভালো লাগেনা।
।
।
” আমি কী কারণে তোমার কাছে এসেছি সেটা নিশ্চয়ই জানো! ”
” জ্বি জানি। ”
” তোমার বাবা আমার বন্ধু ছিল৷ আমার ওপর ওর অনেক ঋণ। সেগুলো শোধ করতে না পারি অন্তত বিপদে পাশে দাঁড়ানোর সূযোগ টা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তুমি যদি রাজি হতে..! ”
” বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন, ওনার তখন সামর্থ্য ছিল সেজন্য আপনার বিপদে দাড়াঁতে পেরেছেন। আপনিও তো আমাদের জন্য অনেক কিছু করেন। এখানে ঋণের কিছু নেই। ”
” তোমার কাছে না থাকতে পারে আমার কাছে অনেক কিছু। আমি পারলে তোমাকে বুঝাতাম, কিন্তু তা সম্ভব না। আর আমার ছেলে যদি খারাপ হতো তাহলে এই প্রস্তাব আমি কখনো রাখতাম না। আমার ছেলে তোমার জন্য পা গ ল থাকলেও কখনো রাজি হতাম না আমি। কিন্তু আমার ছেলে খারাপ না, আমি ওর বাবা, আমার থেকে ভালো তো জানবে না কেউ। আর মেয়ে হিসেবে তোমাকেও আমার জানা৷ সব বিবেচনা করে এই প্রস্তাব দেয়া। তুমি একটাবার ভেবে দেখতে পারো। তুমি আমার মেয়ের মতোই, এখন শুধু মেয়ে বানাতে চাইছি। ”
এহতেশাম সাহেব নিজের কথা শেষ করে সূচনার দিকে তাকালেন। সূচনা নীরব ই রইলো৷ এহতেশাম সাহেব ব্যথিত হন, মেয়েটা একবার ভেবে দেখতে পারে না! উনি সূচনার মাথায় হাত রেখে শেষবারের মতো বলেন,
” একবার ভেবে দেখিও মা, আমি অপেক্ষায় থাকব। ”
সূচনার চোখ জোড়া টলমল করতে থাকে এহতেশাম সাহেবের মুখে মা ডাক শুনে। কী আদুরে লাগলো তার কাছে শুনতে! ওনার হাত মাথায় রাখার পর সূচনার কেবলই মনে হলো ওনার মাথায় হাত রাখার মধ্যে সে ভরসা পাচ্ছে। কিন্তু কেন! এহতেশাম সাহেব চলে যান তার রুম হতে। উনি চলে যেতেই টলমল করা চোখ জোড়া হতে পানি গড়িয়ে পড়ে সূচনার৷ মেয়েটা ভারি বিপাকে পড়ে যায়। কী করবে, কী না করবে নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে।
।
।
এহতেশাম সাহেব বাড়ি ফেরার পরই নুরাইয়া ছুটে আসেন ওনার দিকে। হাতে পানির গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
” কী বললো? কী কথা হলো? ”
এহতেশাম সাহেব পানি পান করে গ্লাসটা পুনরায় স্ত্রীর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। কিছুটা হতাশ হয়ে বললেন,
” কিছু বলেনি, আমার যা কথা ছিল বললাম কিন্তু মেয়ে কিছু বললো না। ”
” কথাবার্তায় কী মনে হলো? ”
” নুরাইয়া মাত্র ই তো বললাম মেয়ে কিছু বলেনি। ”
” ও…ওহ। আচ্ছা আচরণে, মুখের ভাবে কী মনে হলো? ”
” জানিনা আমি। কিছু বলেনি, তবে যেটাই বলুক তা ই হবে। ”
” তা তো হবে। আচ্ছা আমরা কী ঠিক করছি? মানে প্রণয়ের পছন্দ টা.. ”
” বেঠিক করছি! তোমার ছেলে ভালো মেয়ে খুঁজে পাবে? ”
নুরাইয়া এই প্রশ্নে কিছুটা দমে যান। আসলে তো প্রণয় পাবেনা, তার পছন্দ তো আর পাঁচটা ছেলের মতো না। এই খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছেলের সর্বগুণ সম্পন্ন মেয়ে লাগবে। এক মেয়ের মধ্যে সব গুণ কীভাবে থাকবে! আদোও থাকে! থাকেনা তো৷ মানুষ কী সব দিক হতে সম্পন্ন হয়! খুতঁ তো একটা না একটা থাকেই, সেটা নিয়েই তো মেনে নিতে হয়। অথচ ছেলেটা কেন যে বোঝেনা! এদিকে স্বামীর কাছে ছেলের বিয়ের প্রসঙ্গ উঠালেই ওনাকে এই খোঁচা শুনতে হয়৷ ব দ ছেলে।
।
।
বিকেলে বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকেছিল প্রণয়। এরপর আর বের হয়নি। নুরাইয়া এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন, প্রণয় না আসায় উনি নিজেই তার রুমে গেলেন। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল প্রণয়। নুরাইয়া পিঠে চাপড় মে রে তাকে উঠালেন৷ প্রণয় হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বিরক্তি নিয়ে বলে,
” আমি বড় হয়ে গেছি মা আর কত মা র বে! ”
” সময়ে অসময়ে ঘুমিয়ে থাকলে মা র ব না তো কী করব! ”
নুরাইয়ার বিরক্তি মাখা কণ্ঠ। প্রণয় তার দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বললো,
” এই বাড়িতে আমার কোনো ইজ্জত ই নেই। এতদিন পর এসেছি শান্তি তে ঘুমানো ও যায় না। ”
” তাড়াতাড়ি ওঠ। তোকে ঘুমানোর জন্য এখানে আনা হয়নাই। ”
” কীসের জন্য আনা হয়েছে শুনি! ”
” বিয়ে করার জন্য। ভুলে গেছিস! ”
প্রণয়ের মস্তিষ্ক সজাগ হয় এবার, এতক্ষণ ঘুমের ঘোরে কীসব বলছিল! সে আমতা আমতা করে বলে,
” ও..ওহ হ্যাঁ। ”
নুরাইয়া চোখ বাঁকিয়ে তাকান, প্রণয় ও অধর বাঁকিয়ে বলে,
” যার বিয়ের জন্য পা গ ল হয়েছো তার কী বিয়ের চিন্তা আছে! ”
নুরাইয়া ফের বিরক্ত হলেন, এই ছেলের ধৈর্য এত কম কেন! উনি ধ ম কে র স্বরে বলেন,
” তোর ধৈর্য এত কম কেন হ্যাঁ! মেয়েটাকে একটু সময় তো দিবি! ”
প্রণয় চুপসে যায়, কিছু বলতে নিলেও বলে না। তার মতে পরিস্থিতি এখন তার অনুকূলে। সে যা বলবে, তার দাম দেয়া হবেনা। উল্টো অপমানিত হবে৷ তাই চুপ ই রইলো।
।
।
এশার নামাজ পড়ে সূচনা জানালার ধারে এসে বসে। দুপুরের বৃষ্টির পর থেকে আবহাওয়া গুমোট। কেমন থম মে রে আছে যেন। সূচনার মন কেমন কেমন করে, সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছিল সে। তার মন বলে যে হাত মাথায় রাখতে সে ভরসা পেল সে মানুষটাকে বিশ্বাস করতে। মস্তিষ্ক বলে অন্য কিছু। বিশ্বাস নাহয় সে মানুষটাকে করলো কিন্তু তার ছেলে! ছেলে কেমন হবে? উনি যে বললেন, ওনার ছেলে, আর নিজের ছেলের ওপর ওনার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে, ভালোভাবে চেনেন। এখনকার যুগে নিজের সন্তান কে নিয়ে কয়জন বাবা মা এত বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে পারে? বিয়ে করবে কী করবে না সেটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করছেনা। বিয়ে করবে সে সিদ্ধান্ত তো আগেই নিয়েছিল। কিন্তু এখন! এখন কাকে বিয়ে করবে? প্রণয় কী সঠিক সিদ্ধান্ত হবে? সূচনা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। দিশা বেগম তার রুমে এসে দেখেন সূচনা জানালার ধারে বসে আছে। উনি কাছে যেয়ে তার মাথায় হাত রাখতেই সূচনা ওনার দিকে তাকায়। উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে,
” মা আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা কেন! ”
মেয়ের উদ্বেগের কারণ উনি নিজেকেই মনে করলেন। অপরাধী কণ্ঠে বললেন,
” তোর এমন পরিস্থিতির কারণ আমিই। আমার জন্য ই এস…
” মা যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন কী করব! কী সিদ্ধান্ত নিব! ”
দিশা বেগম নিজের আবেগ সামলে নেন, নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেন,
” দেখ এবার আমি আমার কোনো সিদ্ধান্ত দিবনা। তোর মন যা বলে তুই তাই কর। আমি তোর সাথে আছি। ”
সূচনা মায়ের কথা শোনে, বেখেয়ালি হয়ে যায়, আনমনে বলেও ফেলে,
” মন তো বলে ওনার কথা বিশ্বাস করতে..”
নিজের কথায় থতমত খায় মেয়েটা, প্রসঙ্গ পাল্টানোর সময় পায়না। তার আগেই দিশা বেগম বলেন,
” মন যেহেতু বলছে তাহলে তাই কর। ”
সূচনা অবাক চোখে তাকায়, দিশা বেগম মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
” ভাত বাড়ছি আয় খেতে আয়। ”
দিশা বেগম চলে যান, পেছনে সূচনা মৃদুস্বরে কয়েকবার আওড়ায়,
” মন যা বলে তা করো। ”
।
।
রাতে খাওয়ার সময় এহতেশাম সাহেব প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমি যে সূচনার সাথে বিয়ের কথা বলেছি তোমার তাতে সমস্যা আছে? ”
বাবার সামনে সে এমনিতেও কথা বলবেনা, বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার প্রশ্ন তো আসেনা। সুতরাং প্রণয় সহজ গলায় ই বললো,
” না বাবা, সমস্যা নেই। ”
প্রণয়ের উত্তর পাওয়ার পরপর ই এহতেশাম সাহেব গলা উঁচিয়ে নিজের স্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন। নুরাইয়া একপ্রকার ছুটেঁ আসলেন। জানতে চাইলেন কী হয়েছে! এহতেশাম সাহেব বরাবরের ন্যায়ই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” তোমার ছেলেকে বোলো এত অধৈর্য না-হতে। এবার একটু ধৈর্য শীল হতে বলো। দায়িত্ব নিতে হবে আমার মেয়ের। ”
প্রণয় সবে ভাতের লোকমা টা মুখে দিয়েছিল, এহতেশাম সাহেবের কথা শুনে গলায় আ টঁ কে কাশি উঠে গেল তার। পাশ থেকে ইরা পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। প্রণয় পানি পান করতে করতে ইরার উৎসুক কণ্ঠে করা উক্তিটুকু শুনলো,
” তার মানে আপু বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে! ”
প্রণয়ের কাছে মনে হলো তার কানে আর কোনো কথা আসছে না। শুধু ঐ একটা কথাই কানে বাজছে। মেয়েটা তাহলে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল!
#চলবে