#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৩
#নাজিয়া_শিফা( লেখনীতে)
_______________________________
ভেজাঁ জামা কাপড় নিয়ে ই সূচনার রুমের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। তার হাতে একটা গামছা, সূচনা দিয়েছে। তাকে বসতে বলা হলেও সে বসেনি। গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ইতিমধ্যে বসার রুমে হওয়া সব কথা ই প্রণয় বলে ফেলেছে। তা শুনে আরেক দফা অবাক, হতভম্ব হয়ে গেছে সূচনা। মেয়েটা মুখ ফুটে এবার বলেই ফেলে,
” একদিনে আর কত চমক পাবো! পরের দিনের জন্য ও কিছু বাকি থাকুক। ”
কথাটুকু বলেই সূচনা নিজেই থতমত খায়, প্রণয়ের সময় লাগেনা বুঝতে কথার মানে। তার নিজের ও কিছু টা খারাপ লাগে। সত্যি ই তো, কিছু সময়ের ব্যবধানে মেয়েটার সাথে কতকিছু হয়ে গেল! অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়ায় সূচনা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
” আপনি বাইরে যাবেন কীভাবে! ”
” কেন পা দিয়ে যাব৷ ”
অসময়ের মজা সূচনার পছন্দ হয়না, চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
” বা জে ছেলে, একে তো কিছু বোঝেননা, তার ওপর হাত ধরে টে নে নিয়ে এনে ঠাট্টা করছেন! ”
” বা জে ছেলে কে? ”
” আপনি। ভালো ছেলেরা নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের হাত ধরে টা না টা নি করেনা। ”
” গেলাম বাঁচাতে আর এখন নাকি বা জে ছেলে! দুনিয়ায় ভালো মানুষের ভাত নেই। ”
চোখ ছোট ছোট করে উক্ত বাক্যখানি করতেই সূচনা ফুঁসে ওঠে বলে,
” বাঁচানোর জন্য হাত ই কেন টা ন তে হবে! ”
” ভদ্র ভাবে বলেছিলাম, সোজা কথা তো কারো মাথায় ঢুকে না। ”
সূচনা এবার একটু চুপসে যায় তবে চুপ থাকে না কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিবে তার আগেই ফরিদা এসে জানায়, তাদের বাইরে যেতে বলছে। এবার দুজনের মাথায়ই যেন বা জ পড়ে। সূচনা তো ঠিক আছে কিন্তু প্রণয় বাইরে যাবে কীভাবে এই ভেজাঁ কাপড় নিয়ে!
সূচনা ফরিদা কে বাইরে যেতে বলে প্রণয়ের দিকে তাকায়। প্রণয় আগে থেকে ই তাকিয়ে ছিল তার দিকে, সূচনা তাকাতেই যেন ছেলেটা তেতিয়ে উঠে,
” মেয়ে মানুষ মানেই ঝামেলা, আশেপাশে থাকলেও ঝামেলায় ফেলে দেয়। সাহায্য করতে যেয়ে নিজেই বিপদে পড়লাম আবার তাকে বিয়ে করব! ”
শেষোক্তি তে সূচনা ভ্রু কুটি করে, বিরক্তিতে ছেয়ে যায় অবয়ব। ততক্ষণে প্রণয় ও বুঝতে পারে মুখ ফসকে ভুল কথা বেরিয়ে গিয়েছে। এভাবে বলাটা মোটেও উচিত হয়নি। কিন্তু সূচনার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আর বিরক্তি তে ছেয়ে যাওয়া মুখ দেখে আর কিছু বলতে পারে না। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সেই অবস্থাতেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় প্রণয়। সূচনার নিজের ও আর কিছু বলার ইচ্ছে হয় না। মস্তিষ্ক বি ষি য়ে ওঠে তার। রা গে দপদপ করে, হাতের সামনে টেবিলের ওপর থাকা ফুলদানি টা স্ব শব্দে ভেঙ্গে ফেলে। পরমুহূর্তেই খেয়াল হয় বাইরে শব্দ পোঁছায় নি তো আবার! সে এক প্রকার দৌড়েঁ যেয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে কেউ আসছে কিনা! কোনো শব্দ না পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন। ভেঙ্গে যাওয়া ফুলদানির টুকরো গুলো এক এক করে উঠায়। একটা কাগজের মধ্যে জমা করে টেবিলের ওপর রাখে। তার এখন আফসোস হয়, শুধু শুধু ই ভেঙ্গে ফেললো না! এখন তো চাইলেই জুড়ে দেয়া যাবেনা। ভাঙা জিনিস সহজে জোরা লাগে? লাগে না তো। লাগলেও আগের মতো কী আর হয়!
।
।
।
” ভাইয়া তুমি ভিজঁলে কীভাবে? ”
বাসায় এসে গোসল সেরে বসেছিল প্রণয়, ইরা চা দিতে এসে উক্ত প্রশ্নটা করে। এমনিতে মেজাজ চ টে আছে তার ওপর ইরার প্রশ্ন যেন আ গু নে ঘি ঢালার ন্যায় ছিল। উত্তর দেয়ার বদলে ইরাকে কড়া কথা বলতে নিলেও মাথা ঠান্ডা রাখলো। ইরার কী দোষ, সে তো আর জানেনা কোন দস্যি রাণীর সাথে তার ভাইয়ের পাল্লা পড়েছে। প্রণয় আ গু ন হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
” তেমন কিছু ই না, ঐ মেয়ের রুমের সাথে দরজা ছিল। সেখান দিয়ে উঠোনে যাওয়া যায়। আমি ও একটু গেলাম এর মধ্যে বৃষ্টি বেড়ে গেল। তাই ভিজেঁ গেছিলাম। ”
ইরা চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করে,
” এত বা জে মিথ্যা কীভাবে বলো ভাইয়া! মিথ্যা বলবে যখন লজিক্যালি বলো। ”
” যা তো এখান থেকে। ”
ইরা কথা বাড়ায় না আর। সে জানে তার ভাই মিথ্যা বলছে, সত্যি টা বলতে চাইছে না। তাই আর না ঘাটিয়ে রুম হতে প্রস্থান করে। ইরার মুখে বা জে শব্দটা শুনে প্রণয়ের ফের মনে পড়ে সূচনার কথা। তার মোটেও উচিত হয়নি মেয়েটাকে এমন কথা বলা। বলে আবার চলে ও এলো, সরি ও বললো না! এমনিতেই বা জে ছেলে বলে দিয়েছে, এখন অসভ্য, অভদ্র সবই বলবে। এক মেয়ে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার সব উলোটপালোট করে দিচ্ছে। কী আশ্চর্য কথাবার্তা!
।
।
বিকেলে নুরাইয়া এসে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করেন, সূচনার সাথে তার কী আলাপ হলো! কিন্তু যুতসই কোনো জবাব তিনি প্রণয় থেকে পেলেন না। কীভাবে পাবেন, আলাপ তো তেমন হয় ই নি। উল্টো ঝ গ ড়া আর মনোমালিন্য হলো শেষে। নুরাইয়া হয়তো কিছু আচ করতে পারলেন। প্রণয়কে ফের বললেন সূচনার সাথে দেখা করতে। বললেন,
” তুই একা যেয়ে এবার দেখা করে ঠান্ডা মাথায় কথা বল। দেখ কী হয়! ”
প্রণয় রা গ দেখালো, বিরক্তি নিয়ে বললো,
” মা তখন আমার নিজেকে ছ্যা চ রা মনে হবে। মনে হবে যে ঐ মেয়ের জন্য আমি দেওয়ানা হয়ে গেছি। তার পেছনে লাট্টু হয়ে ঘুরছি। ”
নুরাইয়া দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
” গা ধা তোকে পেছনে ঘুরতে বলছে কে! বলছি যেয়ে দেখা করে সামনাসামনি কথা বলে আয়। ”
” তুমি আমাকে অপমান করছো মা! এই ছাব্বিশ বছরে এই প্রথম বার এমন অপমান! ”
” ইদানীং ছবি টবি বেশি দেখিস মনে হচ্ছে! যা এখনই যা। ”
নুরাইয়া ভীষণ স্বাভাবিক, ওনার কথাগুলো স্বাভাবিক। কিন্তু প্রণয়ের কাছে আপাতত ওনার বলা কথা পালন করা সম্ভব মনে হচ্ছে না। দুপুরে যা হলো তারপর আবার হুট করে তার সাথে দেখা করতে যাওয়াটা মোটেও শোভা পায়না। কিন্তু নুরাইয়া একবারেই স্বাভাবিক গলায় প্রণয়কে বলে গেলেন। আদেশ করে গেলেন, যেতে বলেছি মানে যেতে হবে। প্রণয় ফের বিপদে পড়ে, নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরে। বিরক্তির সুরে আওড়ায়,
” কি মেয়ের সাথে দেখা হলো, বিয়ে না হতে ই ঝামেলার পর ঝামেলায় ফেলছে। ”
।
।
ইরাকে সাথে নিয়ে প্রণয় সূচনার সাথে দেখা করতে এসেছে। সূচনাদের বাড়ির পাশের পদ্ম বিলে এসেছে তারা। ইরা সূচনাদের বাড়িতে, প্রণয় অপেক্ষা করছে সূচনার জন্য। বিলের টলমলে সবুজ পানিতে ফুটেঁ আছে পদ্ম ফুল। বিলের একপাশের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য, মুক্ত বাতাস, অরণ্য এসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে যেকোনো মানুষের মন ই জুড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার মধ্যে এখন তেমন কিছু ই কাজ করছেনা। তার সঙ্কোচ হচ্ছে, অস্বস্তি তে মাথা নুইয়ে পড়ছে যেন। এর মধ্যে ই কারো পায়ের শব্দে প্রণয়ের মস্তিষ্ক সচকিত হয়। সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে সূচনা দাঁড়িয়ে আছে। প্রণয় উহুম শব্দে গলা পরিষ্কার করে, সূচনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সূচনা সালাম দেয়, কণ্ঠ তার স্বাভাবিক হলেও কেমন ভারিক্ষি স্বর। প্রণয় সালামের জবাব দেয়। জিজ্ঞেস করে,
” কেমন আছেন? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি? ”
” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। ”
সূচনা নীরব থাকে, তার দৃষ্টি প্রণয়ের দিকে না, অন্য দিকে। প্রণয় ফের তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে, গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে,
” দুপুরের কথার জন্য দুঃখীত, আমি সেভাবে বলতে চাইনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছিল। ”
” মনে যা থাকে মুখ ফসকে তো তাই বের হয়, সমস্যা নেই। ”
” আমার মনে এমন কিছু নেই। হ্যাঁ এই পরিস্থিতি ভিন্ন, এভাবে হুট করে বিয়ের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলাটা ও অন্য রকম। আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু তাই বলে কোনো মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে আর সেটা নিয়ে মজা করার মানুষ আমি নই। ”
” আজকে বিলে অনেকগুলো পদ্ম ফুল ফুটেছে। অনেকদিন পর এত গুলো দেখলাম। ”
” কথা ঘোরাচ্ছেন! ”
” খারাপ কথা আর স্মৃতি মনে রাখতে নেই। দুঃখ ছাড়া কিছু ই দেয় না। ”
” আপনি সরি কবুল না করলে আমি বারংবার মনে করাব। দুঃখ পেলে দোষ দিতে পারবেন না। ”
” হু ম কি দিচ্ছেন! ”
” ঐসব বা জে ছেলেরা দেয়, আমি আবার ভালো ছেলে। ”
প্রণয়ের কথা শুনে এবার তার দিকে তাকায় সূচনা। প্রণয় খেয়াল করে না, অধরে তার দুষ্ট হাসি। সূচনা ও হেসে ফেলে, তবে হাসি চেপে টিপ্পনী কে টে বলে,
” বেশি ভালো ভালো না। খারাপ হওয়া ভালো আর আপনি ভালো ছেলে ও না। বা জে ছেলে যে সামনের মেয়েদের হাত ধরে টা না টা নি করে। ”
সূচনার মজা বুঝতে পারলেও, প্রণয় ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলে,
” ফর আ কারেকশন মেয়েদের না মেয়ে, শুধু এক মেয়ের হাত ই ধরেছি, হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছি। ”
” ঐ একই, বা জে ছেলে। ”
” কথায় কথায় বা জে ছেলে বলছেন, কেউ শুনলে ভাববে না জানি কী করেছি আপনার সাথে। ”
” মানুষ তো কত কিছু ই বলে, তাদের মুখ্য কাজই বোধহয় এটা। ”
সূচনার গলার স্বরে পরিবর্তন আসে, কেমন গম্ভীর শোনায় কথাটুকু। প্রণয় তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
” পদ্ম ফুল লাগবে? ”
” আপনি এনে দিবেন? ”
” হ্যাঁ লাগলে এনে দিব। ”
” সত্যি আনতে পারবেন? ”
সূচনার বিস্ময় দেখে প্রণয় খানিক অপমানিত বোধ করে। কথা না বাড়িয়ে সে বিলের একেবারে সামনে ফুটে থাকা একটা পদ্ম ফুল তুলে সূচনার সামনে দাঁড়ায়। সূচনা তখনো অবাক, প্রণয় হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলে,
” এত অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমি গ্রামেই বড় হয়েছি। ”
সূচনা অবাক ভাব কাটায়, ফুলটা হাতে নেয়। তারপর ভেংচি কে টে বলে,
” এনেছেন তো একেবারে সামনের ফুলটাই। ”
” দূরের গুলো আনতে গেলে অর্ধেক ভিজেঁ যেতাম। একদিনে আর কয়বার ভিজঁব! ”
সূচনা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না, হেসে ফেলে৷ তার হাসি দেখে প্রণয় ও হেসে ফেলে। প্রণয় পূর্ণ দৃষ্টি তে মেয়েটার দিকে তাকায়। তার কেবলই মনে হয় পদ্ম ফুল হাতে আরেকটা ফুল দাঁড়িয়ে হাসছে। প্রণয় তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়। সূচনা খেয়াল করে অবশ্য, সে কিছু টা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” যে কারণে পাঠানো হয়েছে আপনি সে কথা এখনো বলেননি। ”
” অস্বস্তি হচ্ছে। ”
প্রণয় চট করেই সূচনার কথা বুঝে যেয়ে উত্তর দেয়। সূচনা ও ফটাফট জবাব দেয় যেন উত্তর আগে থেকে ই ঠিক করা ছিল। সে সহজ গলায় ই বলে,
” আপনাকে নিয়ে ট্রেনে ও কোনো খারাপ ধারণা আসেনি৷ এখনো আসছেনা শুধু দুপুরের কথায় একটু… তবে আপনি অতটাা ও খারাপ না। ”
” মানে আপনার পছন্দ হয়েছে না মনে মনে! ”
প্রণয়ের দাঁত কেলানো দেখে সূচনা চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
” আপনি সত্যি ই বা জে ছেলে। মনে মনে পছন্দ হতে যাবে কেন! একটু প্রশংসা করলেই হয়েছে.. ”
সূচনার এহেন কথায় মুখ চুপসে যায় প্রণয়ের। কিছুটা মুখ ভার করে ই সূচনাকে বলে,
“আচ্ছা এবার বাসায় যান, সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ”
সূচনা মাথা নাড়ায়, যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। প্রণয় পেছনে ঘুরে একবার তাকে দেখে ফের বিলের পানিতে চোখ স্থির করে। পানিগুলো টলমলে, ওপরের পানিগুলো কেমন স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। ফুলগুলো কী অদ্ভুত সুন্দর!
” আপনাকে এখন অপছন্দ হচ্ছে না বা জে ছেলে। ”
প্রণয় চমকায়, চকিত ঘাড় ঘুরায়, সূচনা বাড়ির রাস্তায় পা বাড়িয়েছে। যেতে যেতে বলে গেছে কথাটা। সত্যি ই সে বলেছে নাকি কান বাজছে তার! বললে তো আগেই বলতে পারত। কীভাবে দ্বিধায় ফেলে গেল। কী আশ্চর্য মেয়ে!
#চলবে