প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
662

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_১৩
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
______________________________
সংসার, পড়ালেখা, টিউশনি নিয়ে সূচনার সময় বেশ ভালোই কা ট ছে। প্রণয়ের সাথে নিজের সম্পর্ক টাও আগের চেয়ে আরো ভালোমতো গুছিয়ে নিয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে ঝগড়া ঝাটি হয়। তাও ছোটখাটো বিষয়ে, দুজনেই রা গী কি-না! অল্পতেই রে গে যাওয়া যেন প্রণয়ের স্বভাব। নুরাইয়া তা দেখে প্রায়ই বলেন,

” ছেলেটার মেজাজ যে এমন তা জানতাম কিন্তু ইদানীং যেন একটু বেশি ই। ”

সূচনা কিছু বলেনা, বলার কিছু নেই ও। যখন ঠান্ডা থাকে তখন সব ঠিক, দুনিয়া শান্তি। অথচ ছোট একটা বিষয় নিয়ে ই মাঝেমধ্যে এমন রে গে যায় যে তাকে অবাক হতে বাধ্য করে। মেজাজ ঠান্ডা হলে তখন আবার আফসোসের শেষ নেই। সূচনা আড়ালে আধ-পাগল উপাধি দিয়ে দিয়েছে আগেই। বা জে ছেলে যেমন প্রণয়ের জন্য তেমন প্রযোজ্য না এই আধ-পাগল উপাধি টা একদম খাপে খাপ।

সূচনা আজকে ভার্সিটি থেকে একা একা ই বাসায় ফিরেছে। ইরার কিছু বই কিনতে হবে, বাসায় এসে আবার যাওয়া ঝামেলা হয়ে যায় বলে ভার্সিটি থেকে বাসায় আসেনি। সূচনার বিকেলে পড়াতে যেতে হবে। সপ্তাহ খানেক পর বাচ্চা দুটোর পরীক্ষা। এর মধ্যে বন্ধ দেয়াটা ঠিক হবে না বলে সূচনা ইরার সাথে যায়নি। বাসায় ফিরে গোসল সেরে সূচনা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। প্রণয়কে দিয়ে কিছু গাছ আনিয়েছে সে। তার অতি শখের কাঠগোলাপ গাছটা বেড়ে উঠছে আস্তে আস্তে। সূচনা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসলো। দুইদিন ধরে তার দিশা বেগমের সাথে কথা হয়না। গতকালকে প্রণয়ের সাথে ও ছোটখাটো একটা ঝগড়া হ’য়েছে। এরপর থেকে আবার সেই মান অভিমান, কথা বন্ধ। সূচনা কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় থেকে মায়ের নাম্বারেই ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ কথা বলে ফের কল করলো প্রণয়ের নাম্বারে। কিন্তু সবসময়ের মতোই ফোন রিসিভ করলো না প্রণয়। সূচনা গতকালকের কথা গুলো আবার মনে করলো। বুঝতে চেষ্টা করলো তার দোষটা কোথায় ছিল! গতকাল কে প্রণয় অফিস থেকে ফেরার পর গোসল করতে গেলে তার ফোনে কল আসে। সূচনা রুমেই ছিল, অনবরত কল আসছিল বিধায় না পারতেই সূচনা ফোন রিসিভ করে। রিসিভ করার পর ওপাশ হতে মেয়েলি কণ্ঠ শোনা যায়, সূচনাকে প্রণয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে সূচনা জানায়, প্রণয় ওয়াশরুমে আসলে কল ব্যাক করবে। মেয়েটা ফের প্রশ্ন করে সূচনার পরিচয় জানতে চাইলে সূচনা নির্দ্বিধায় ই বলে,

” আমি প্রণয়ের ওয়াইফ। ”

মেয়েটা বোধহয় একটু না বেশ অনেকটাই অবাক হয়। আশ্চর্য নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

” প্রণয় বিয়ে করলো কবে! কাউকে বললো না! আমাকে ও তো বলেনি৷ সত্যি বিয়ে করেছে! তুমি সত্যি ই ওর বউ! ”

সূচনার খানিক রা গ হয়, কে এই মেয়ে যাকে প্রণয় বিয়ের কথা না বলায় এত প্রশ্ন করছে! আবার জিজ্ঞেস করছে সত্যি ই তার বউ কি-না! সে বেশ রা গি কণ্ঠে ই বলে,

” কেন! প্রণয় বিয়ে করতে পারে না? সারা জীবন কী ব্যাচেলর ই থাকবে! আর আপনি কে যাকে জানিয়েই প্রণয়ের বিয়ে করা উচিত ছিল। ”

মেয়েটা সম্ভবত জবাব দিতে নিয়েছিল সেই সময়ই কেউ সূচনার কান থেকে ফোন ছিনিয়ে নেয়। সূচনা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে এই কেউ টা আসলে প্রণয়। ফোন নিয়েই সে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। সূচনা পূর্বের ন্যায় ই রা গি কণ্ঠে বলে,

” কা ট লে ন কেন আমি কয়েকটা কড়া কথা বলতাম। ”

” তুমি ফোন রিসিভ করেছো কেন! ”

সূচনার ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়, বলে

” বারবার কল করছিল তাই রিসিভ করেছি। কেন! ”

” কল করছিল করতো৷ রিসিভ করার প্রয়োজন ছিল না। ”

” রিসিভ করায় কী হয়েছে? এত রিয়েক্ট কেন করছেন আর এই মেয়ে কে? ”

সূচনার এহেন প্রশ্নে প্রণয় আরও রে গে যায়, পাল্টা প্রশ্ন করে,

” সন্দেহ করছো আমাকে? ”

” সন্দেহ তো এতক্ষণ আমি করিনি, এখনো করতে চাচ্ছিনা। কিন্তু আপনার ব্যবহার ভাবতে বাধ্য করছে আমায়। ”

সূচনা আর এক সেকেন্ড ও দেরি করেনি, রুম ত্যাগ করেছে। আর কিছু তো বলেনি, তার দোষটা আসলে কোথায় সেটা আজকে ও খুঁজে পেলনা। আর খুঁজতে চেষ্টা ও করলো না৷ আসুক বাসায় তার থেকেই জানবে।


” ইরাবতী! ”

বইয়ের দোকান থেকে বের হয়ে ইরা রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। তন্মধ্যেই চেনা স্বরে, সম্বোধনে তার নাম ধরে ডেকে উঠলো কেউ। ইরা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখা গেল চেনা মানুষটা কে। বরাবরের মতোই পরিপাটি রূপে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ। ইরা এই সময়ে এখানে তার দেখা পেয়ে অবাক তার চেয়ে বেশি ভীত। সেদিন সূচনার কথা মতো মুগ্ধ কে বলেছিল সব। এরপর থেকে দুজনের যোগাযোগ একদম ই বন্ধ। ভার্সিটি তে দেখা হলেও দুজন দুজন কে না দেখার ভান করে। কারো কাছে কারো ফোন নাম্বার পর্যন্ত নেই। এমতাবস্থায় মুগ্ধ রাস্তার মধ্যে দেখে তাকে ডাক দেয়া তে ইরা খানিক বিব্রত বোধ করছে। মুগ্ধ একটু এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,

” এখানে একা একা কেন? তোমার ভাবি কোথায়? ”

ইরা মৃদুস্বরে প্রতুত্তর করলো,

” কিছু বই কেনার ছিল সেগুলো কিনতে এসেছিলাম। ভাবির কাজ ছিল তাই বাসায় চলে গেছে। আপনি এখানে? ”

” আমার ও কাজ ছিল একটু। ”

” মাঝ রাস্তায় ডেকে দাঁড় করালেন কেন! ”

” পরিচিত মানুষকে হুট করে দেখলে মানুষ ডাক দিয়ে কথা বলে না! আমি ও সেজন্য ডাক দিলাম। ”

” আমরা যোগাযোগ রাখবো না কথা ছিল। ”

” তো যোগাযোগ কে রাখছে! ”

” এই যে ডেকে দাঁড় করালেন, এখন কথা হবে, দেখা গেছে নাম্বার ও আদান-প্রদান হবে। তারপর রোজ রোজ কথা হবে, কথা হতে হতপ তারপর… ”

ইরা হড়বড়িয়ে কথাগুলো বলতে বলতে থেমে যায়। মুগ্ধ এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,

” তারপর? ”

মেয়েটা থতমত খেয়ে যায়, কী বলতে যেয়ে কী বলে ফেলছিল ভেবে ঈষৎ লজ্জা ও পায়। মুগ্ধ আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ায়। কিয়ৎক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে মায়া স্বরে বলে,

” তুমি ভীষণ বোকা ইরাবতী। ঐসব করার হলে আমি প্রথম থেকেই জোর দিতাম। আর না হয় তোমার সামনেই আর আসতাম না। আমার জন্য মেয়ের অভাব হবে না এটা মানো নিশ্চয়ই! ”

ইরা মৃদু স্বরে ‘ হু ‘ বলে শুধু। মুগ্ধ ফের বলে,

” আজকেও সামনে আসতাম না, কিন্তু পরে মনে হলো যে একটু মনে করিয়ে দিই। ”

” কী? ”

” এটাই যে এই বোকাসোকা মেয়েটা শুধু আমার। আমি যেমন তার জন্য অপেক্ষা করতে পারব তেমন তার ও অপেক্ষা করতে হবে৷ ”

ইরা ভীষণ লজ্জা পেল মুগ্ধর কথায়, লাজুক দৃষ্টি মুগ্ধর থেকে লুকাতে মাথা নিচু করে নিল। মুগ্ধ মৃদু হেসে বললো,

” এমন মাঝেমধ্যে মনে করিয়ে দিতে সামনে আসব আমি৷ বুঝেছো! ”

ইরা নত দৃষ্টি ওপরে তোলে, লাজুক ভাব কা টি য়ে সহজ গলায় বলে,

” রবী ঠাকুরের একটা কথা আছে, কী বলুন তো! ”

” কী? ”

” এটাই যে,

❝ যদি তুমি কাউকে ভালোবাসো তবে তাকে মুক্তি দাও, যদি সে ফিরে আসে তবে সে তোমার আর যদি ফিরে না আসে তবে সে কোনোদিন তোমার ছিল না হবেও না। ❞

” যথার্থ বলেছেন কিন্তু এটার সাথে আমাদের সম্পর্ক কী? ”

ইরা মুখ বাকাঁয়,

” একটু আগে তো বলছিলেন আমি বোকা। শুনুন আমি আপনাকে মুক্তি দিয়েছি, আজ হোক, কাল হোক কিংবা বছর পর ই হোক আপনি যদি আমার নিকট ই ফিরে আসেন তবে আপনি আমার। আপনার ক্ষেত্রে ও তাই। আর এমন টা না হলে বুঝতে হবে আমাদের জন্য সেটাই ভালো। ভাগ্যে যেটা আছে সেটা হবেই। ”

” লাইক যদি থাকে নসিবে আপনা আপনি আসিবে এই কথায় বিশ্বাস করা! ”

” ইঞ্জেক্টলি। আমি এখন আসি! ”

কথার মাঝে ই ইরা যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়। মুগ্ধ পেছন থেকে তার হিজাবের একাংশ টে নে ধরে। ইরা সাথে সাথে ই পেছনে ঘুরে তাকায়। ভীত চোখে তাকিয়ে বলে,

” কী করছেন? ছাড়ুন। ”

মুগ্ধ ছেড়ে দেয়, ভ্রূদ্বয়ের মাঝে ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,

” রবী ঠাকুর কাউকে ভালোবাসলে তাকে মুক্তি দিতে বলেছেন। তুমি আমাকে মুক্তি দিয়েছো তার মানে…

ইরার বোধগম্য হয় মুগ্ধর কথা, মুহূর্তেই গাল জোড়া তার লালাভ বর্ণ ধারণ করে৷ তার অভিব্যক্তি তে মুগ্ধ হেসে ফেলে। নরম স্বরে বলে,

” যাও, সাবধানে যেও। ”



আসরের নামাজ পড়ে ইরার সাথে কথা বলছিল সূচনা। পড়াতে যাওয়া হয়নি তার, অন্তিম নাকি অসুস্থ সেজন্য যেতে নিষেধ করেছে তার মা৷ ইরা বাসায় ফিরেছে আধ ঘন্টা মতো। সূচনার একা একা ভালো লাগছিল না বিধায় সাত পাচঁ না ভেবে ইরার কাছে চলে এসেছে। ইরা নতুন বইগুলো নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে তার সাথে কথা বলছিল। এর মধ্যে প্রণয় ঝড়ের বেগে ই তার রুমে প্রবেশ করে। তাকে দেখতে মোটেও স্বাভাবিক লাগে না দুজনের কারোর ই। প্রণয় সোজা যেয়ে ইরা কে প্রশ্ন করে,

” ছেলে টা কে ছিল ইরা? ”

কণ্ঠে কাঠিন্যতা, ইরা ভয় পেয়ে যায়। তার ভাই তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, কিন্তু তার রা গ যেন আকাশ ছোঁয়া। হুটহাট রে গে যায় কিছু বোঝার আগে ই। ইরা বেশ ভালোমতোই তা জানে। ইরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে,

” কোন ছেলে ভাইয়া? ”

” ভান করিস না ইরা, বই কিনতে গিয়েছিলি না-কি ঐ ছেলের সাথে দেখা করতে! ”

প্রণয় তাকে মুগ্ধর সাথে দেখে ফেলেছে ভাবতেই চাপা ভয় খামচে ধরলো হৃদপিণ্ডটা। কিছু বলতে আর পারলো না স্বাভাবিক ভাবে। মিনমিনে কণ্ঠে শুধু বললো,

” দেখা করতে যাইনি, দেখা হয়ে গিয়েছিল। ”

সূচনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব ই দেখছিল। এতক্ষণ বোধগম্য না হলেও এখন বুঝতে পারছে প্রণয় হয়তো মুগ্ধর কথা বলছে। এদিকে ভাইয়ের ভয়ে ইরা মেয়েটা একদম সিঁটিয়ে গেছে। সূচনার রা গ বেড়ে গেল আরও। মানুষ এত বদ মেজাজি কীভাবে হয়! মেয়েটাকে ভালো করে ও তো বলা যেত। বসে সুন্দর করে জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু তা না, সবকিছু তেই রা গ! সূচনা ইরার কাছে যেয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

” তোমার ভাইয়া কী বলছে? কোনো ছেলের কথা বলছে? ”

ইরা প্রায় কেঁদে ই ফেলে,

” মুগ্ধর কথা বলছে ভাবি। ”

” তুমি মুগ্ধর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে! যাওনি তাই না। ”

” আমি দেখা করতে যাইনি ভাবি, বই কেনা শেষে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন ই দেখা। ”

সূচনা হাফ ছাড়ে, সে জানতো ইরা তার কথার অমান্য করবেনা। এতটুকু বিশ্বাস তার ছিল। সে প্রণয়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্রণয় তাকে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি মুগ্ধ নামের ঐ ছেলে কে চেনো কীভাবে? ”

সূচনা জবাব দিতে নিয়ে ও থেমে যায়, প্রণয়ের কণ্ঠে আগের থেকে ও বেশি রা গ। ঠিক কীভাবে বললে বুঝবে সূচনার জানা নেই। সে নিচু স্বরে বলে,

” দেখুন প্রণয়, আপনি রুমে আসুন আমি বুঝিয়ে বলছি। ”

প্রণয় এক পলক ইরার দিকে তাকায়, সূচনাকে কিছু বুঝে ওঠার আগে ই তার হাত চে পে ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে নিজেদের রুমে। স্ব শব্দে দরজা বন্ধ করে। রুমের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে সূচনা, প্রণয় দুই হাত বুকে ভাজ করে দাঁড়িয়ে বলে,

” বলো কী বলবে বুঝিয়ে৷ ”

সূচনা ভয় পায়, কণ্ঠ খসে শব্দ বের হতে চায় না। তার চুপি দেখে প্রণয়ের মেজাজ যেন আরও খারাপ হয়। এক ঝটকায় সূচনার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে।আসে। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে বলে,

” আমার বোন কোনো ছেলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সেটা জেনে তুমি তাকে সাপোর্ট করেছো। ভালো করোনি। ”

সূচনার চোখজোড়ায় অশ্রুদের আনাগোনা বাড়ে। অশ্রুসিক্ত চোখে, ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে বলে,

” সম্পর্ক টেকাতে বিশ্বাস থাকতে হয় প্রণয় অথচ আমাদের মধ্যে সব থাকতেও এটার বড় অভাব। আমি ভাবতাম সম্পর্কে টেকাতে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা টাই যথেষ্ট। কিন্তু আমার ভালোবাসা আপনার রা গ, জেদের কাছে দুর্বল। আপনার জন্য বা এই সম্পর্কের জন্য তা যথেষ্ট না। ”

প্রণয়ের হাত ঢিলে হয়, তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সূচনা। তৎক্ষনাৎ রুম হতে প্রস্থান করে।


সেদিন সূচনা আর রুমে যায় না। রাতে ও ইরার সাথে ই ঘুমায়। সে রাতে ফের হঠাৎ ই সূচনার জ্বর ওঠে। দিক দিশা ভুলে যাওয়ার মতো জ্বর। তবে প্রণয়কে নয়। তীব্র জ্বরেও প্রণয়কে মনে পড়ে তার। বিকেলের ঘটনা গুলো পুরোপুরি মনে পড়ে। জ্বরের কষ্ট থেকে বেশি প্রণয়ের আচরণ গুলো মনে করলেই ভীষণ কান্না পায় তার। ইরা কী করবে বুঝতে না পেরে নুরাইয়া কে ডাকলো। নুরাইয়া এসে মাথায় পানি ঢাললেন, জল পট্টি দিলেন কিন্তু লাভ তেমন হলো না। পর দিন ইরাকে সাথে নিয়ে সূচনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল প্রণয়। একগাদা ওষুধ সমেত নেতিয়ে পড়া সূচনাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে। সূচনার এহেন অবস্থা আর নিজের অনুশোচনা দুইয়ে মিলে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে প্রণয়।
নয়দিনের জ্বরের পরে সূচনার ছোট হৃদয়ের যন্ত্রণাগুলো আরো ভয়াবহ হয়। নয়দিনে ছেলেটা একটা বার পারলো না একটু কথা বলে সব ঠিক করে নিতে! পড়ন্ত বিকেলে হুহু করা হৃদয় নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় একটা।


অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই খুলছিল প্রণয় সেসময় ই তার চোখ যায় আয়নার একপাশে হলুদ রঙের ছোট্ট একটা কাগজ লাগানো। চিরকুট মতো তা। প্রণয় কাগজ টা হাতে নেয়। ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,

” আপনার অতি ঠান্ডা মেজাজের কাছে, হুটহাট রে গে যাওয়ার কাছে, রে গে যেয়ে সন্দেহ করার কাছে এই ক্ষুদ্র মেয়ের ঠুনকো ভালোবাসা হেরে গেল প্রণয়। ”

প্রণয় একবার দুইবার অতঃপর কয়েকবার পড়ে লেখাটা। বুকে মোচর দিয়ে উঠে প্রণয়ের। কাগজটার দিক ফ্যালফ্যালে চোখে চেয়ে থেকে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার। বারকয়েক চুলে হাত বুলিয়ে শান্ত করে নিজেকে। গলা উঁচিয়ে ইরাকে ডাকে। প্রথম ডাকেই ইরা ছুটে আসে। প্রণয় সূচনার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলে,

” ভাবি দুপুরের খানিক পরে ই বেরিয়েছি। চট্টগ্রাম যাবে বিকেলের ট্রেনে। ”

প্রণয় ভাঙা কণ্ঠে বলে,

” যাবে বললো আর তোরা যেতে দিলি! ”

” তো কী করতাম ভাইয়া? এভাবে কষ্ট পাওয়ার মানে আছে! তোমার সমস্যা তুমি না বললে কেউ বুঝবেনা। ভাবির সাথে শেয়ার করবে মিলে সমাধান বের করবে তা না করে সারাক্ষণ মেজাজ দেখাও। এসব কী! এত রা গ থাকলে কোনো সম্পর্ক ই ভালো যায় না ভাইয়া। ”

ইরা প্রথমবারের মতো আজকে তার ভাইয়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বললো। অনেকদিন ধরে এই কথাগুলো বলতে চাইলেও বলতে পারেনি। আজকে বলতে পেরে যেন শান্তি লাগছে তার। প্রণয়কে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে তাড়া দিল সে,

“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”

প্রণয় সম্ভিৎ ফিরে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটঁ লাগায়।


রেল স্টেশনের এক পাশে যাত্রীদের জন্য রাখা বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে সূচনা। সে কান্না করছে না, হাত ঘড়িতে সময় পরখ করছে বারবার। আশেপাশের মানুষের ব্যস্ততা ছিল এতক্ষণ, শব্দ ছিল। কিন্তু এখন তপমন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ সূচনার কানে আসছেনা। ধুপ করে কেউ পাশে এসে বসলে তার মনোযোগ ক্ষুণ্ণ হয়, সে তাকায়। প্রণয়কে পাশে দেখেও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। বৃষ্টিতে ভিজেঁ একাকার প্রণয় তার উপেক্ষা পেয়ে অবাক হয়। মুখ বাঁকিয়ে বলে,

” এই ছিল ভালোবাসা! বিশুদ্ধ প্রেম কিনা এত দ্রুত ই ছেড়ে চলে যায়! ”

” আমার ভালোবাসা নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই কারো। ”

” আমি বলবো কারণ তোমার ভালোবাসার হকদার আমি। ”

উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে প্রণয়, সূচনা নিশ্চুপ থাকে। প্রণয় ফের বলে,

” কে যেন বলেছিল সে আমাকে ভালোবাসে! ”

সূচনা প্রণয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলে,

” আমিই বলেছিলাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা অত তীব্র না। ”

প্রণয় তাকিয়ে থাকে, সোজা হয়প বসে বেঞ্চিতে। নিচু দৃষ্টিতে অপরাধী কণ্ঠে বলে,

” তুমি ঐদিন যার কল রিসিভ করেছিলে সেই মেয়েটা আমার কলিগ। অফিস জয়েন করার পর থেকেই আমার পেছনে পড়েছিল। কার থেকে যেন শুনেছিল আমি বিয়ে করেছি তারপর থেকে জা লি য়ে মা র ছিল। আমি চাচ্ছিলাম ওর একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে। ও চাচ্ছিল কোনো একটা ঝামেলা করতে। এসব নিয়ে এমনিতেই চিন্তিত ছিলাম তার মধ্যে ই তুমি সেদিন ওর ফোন রিসিভ করেছো, এরপর দিন ইরাকে ঐ ছেলেটার সাথে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আরও। তুমি নাকি আবার আগে থেকে ই চেনো। সেটা শুনে আমি আরও..আগে থেকেই ডিস্টার্বড ছিলাম। ”

” এর মধ্যে একদিন ও পারলেন না কথা বলে সব পরিষ্কার করে নিতে! ”

সূচনার চাপা অভিমান, প্রণয় আগের ন্যায় ই বললো,

” আমি ভাবছিলাম কথা বলতে গিয়ে আমি আবার রে গে গিয়ে সব ওলটপালট করে ফেলব। সাহস হয়নি। ”

পরপরই বলে,

” এজন্য এত বড় কদম ওঠাবে! ছেড়ে যেতে হবে একটু ঝগড়া হলেই! ”

কথার পৃষ্ঠে সূচনা স্মিত হাসে, ক্ষীণ স্বরে বলে,

” ছেড়ে কে যাচ্ছে! ”

” মানে! এসব কী আর কেন? ”

” আমার সাথে ব্যাগ বা লাগেজ দেখতে পাচ্ছেন? ”

এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে প্রণয় অবাক স্বরে বলে,

” না মানে..”

সূচনা আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ে পা তুলে বসে বলে,

” মানে আমি যাচ্ছি না। আপনাকে শিক্ষা দেয়ার একটু প্রচেষ্টা। ”

এগিয়ে এসে প্রণয়ের ওপর ঝুঁকে সুর দিয়ে গায়,,

” লোকে পাগল বলুক, মাতাল বলুক আমিই তোমার পিছু ছাড়ছি না। ”

প্রণয় তখন তাজ্জব বনে গেলেও এবার হেসে ফেলে। তার ধারণার বাইরে ছিল এসব। সব দ্বিধাদ্বন্ধ, ভাবনা ভুলে সে আলগোছে দুই হাত রাখে সূচনার গালে। সন্তপর্ণে ঠোঁট ছোঁয়ায় সূচনার কপালে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। সূচনা কিছু টা লজ্জা পেয়ে বলে,

” তাকিয়ে আছেন কেন? ”

” তোমাকে দেখি। ”

” দেখার কী আছে! ”

” চোখের শান্তি। ”

” ওমা, দিন দুয়েক আগে ও তো আপনার চোখের বি ষ ছিলাম। অমনিই শান্তি হয়ে গেলাম! ”

” হ্যাঁ হয়ে গেলে তো! ”

” চা পে পড়ে বিয়ে করেছেন প্রেমে নিশ্চয়ই পড়েননি! পড়ার কথা ও না, ঐসব প্রেম আপনার জন্য না। ”

” তুমি পড়োনি! তুমি তো ভালোবাসো৷ বিয়ের আগের প্রেম আমার জন্য না, বিয়ের পরের প্রেম আমার জন্য। আমার সবটুকু প্রেম আমার স্ত্রীর প্রতি, প্রণয়ীর প্রতি, তোমার প্রতি। ”

” এখন ভালোবাসা আসছে অনেক। ”

” আসছে তো। মানুষ ভালোবেসে বিয়ে করে আমি বিয়ে করে ভালোবাসছি৷ ”

সূচনা বেশ কৌতুহলি কণ্ঠে বলে,

” প্রথম দেখা ট্রেনে ই হয়েছিল না! ”

প্রণয় মাথা নাড়িয়ে বলে,

” তারপর দ্বিতীয়বারের সাক্ষাৎ এ ঝুম বৃষ্টি, তৃতীয়বার পদ্ম বিলে পদ্মফুল হাতে জীবন্ত পদ্মফুল কে দেখে চতুর্থ বারের সাক্ষাৎ এ একেবারে নিজের করার জন্য #প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি তাকে। সে পদ্মফুল এখন আমার বুকের মধ্যিখানে থাকে। ”

কথার পৃষ্ঠে সূচনা নিজেকে আবদ্ধ করে প্রণয়ের বাহুডোরে, প্রণয়ও আবেশে জড়িয়ে নেয় তাকে। শীতল বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছাটঁ ছুয়ে দেয় তাদের।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে