#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
হসপিটাল থেকে রুমা খানের জরুরী তলবে ডেকে পাঠানো হয়েছে রাশেদ খান, ইশিকা খান, খালেদ খান এবং রেশমি খানকে। এনা, ইয়ানা ও ইরাশ ও এসেছে। ফারিশের সাথে অনন্যা দাঁড়িয়ে ছিলো। ফারিশের সাথে অনন্যাকে দেখেই রুমা খানের কাছে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে, রেশমি খান বলতে থাকে, ‘ এই কালনাগিনী এখানে কি করছে মা? আজ শুধুমাত্র ওর জন্যে আমার ছেলের এই অবস্হা! ওর কথায় ইনফুলেয়েন্স হয়ে ফারিশ তার ভাইয়ের আজ এই অবস্হা করেছে। আপনারা কীভাবে এই মেয়েকে এলাও করছেন এখনো? কেন ঘা/ড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছেন না মেয়েটাকে? ওহ! তাহলে তো আমাকেই এই মেয়েকে বের করতে হবে তাইনা?’
কথাটি বলেই রেশমি খান অনন্যার দিকে তেড়ে যেতে নেয়, পিছন থেকে খালেদ খান এবং এনা তাকে আটকাতে চাইলেও সে শুনে না বরং অনন্যার হাত খপ করে ধরে চিৎকার করে বলে,
‘ চরিত্রহীনা মেয়ে, আমার ছেলেকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে, এখন ভালো সাঁজতে চাইছিস? প্রথমে ফারিশকে, তারপর ফারিশের ভাইয়ের সাথে! লজ্জা করে না তোর? আজকে আমি তোকে বের করেই ছাড়বো।’
রেশমি খান কথাটি বলেই অনন্যার হাত ধরে টানতে চাইলে, পিছন থেকে অনন্যার হাত শক্ত করে ধরে রাখে ফারিশ এবং রেশমি খানের থেকে জোড় করে অনন্যার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘ ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ হার। নাহলে আপনার ছেলেকে হসপিটালে গিয়েই এমন অবস্হা করবো যেন সরাসরি উপরে চলে যায়।এতোদিন ধরে মিস অনন্যার চরিত্রে অনেক কাঁদা ছুড়াছুড়ি করেছেন আপনারা, আনফরচুনেটলি আমার জন্যেই, কিন্তু আজকে প্রমাণ হবে কে আসল চরিত্রহীন! ‘
কথাটি বলেই রক্তচক্ষু নিয়ে ইশিকা খানের দিকে তাঁকায় ফারিশ। তা দেখে ভয়ে শিউরে উঠে ইশিকা। রুমা খান ফারিশের কাছে গিয়ে বলে, ‘ কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, তুমি কি প্রমাণ করতে আমাদের এখানে ডেকেছো ফারিশ দাদুভাই?’
ফারিশ রুমা খানের প্রশ্নের জবাবে ইশিকা খানের সামনে দাঁড়িয়ে, পকেটে হাত রেখে বাঁকা হেসে জবাব দেয়,
‘ দাদি, আজ অনেক অতীতের রহস্য উন্মোচন করা হবে। আমার মায়ের গাঁয়ে যেই চরিত্রহীনার কলঙ্ক লেপ্টে রাখা হয়েছে তার সত্যতা আজ প্রমানিত হবে। আর ইউ এক্সাইটেড মিসেস খান?’
ইশিকা খান ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়, ‘ ফারিশ তুমি আমার দিকে তাঁকিয়ে কথাগুলো বলছো কেন? মনে হচ্ছে তুমি আমাকে মিন করে বলছো?’
‘ মিসেস ইশিকা খান, আমি তো আপনাকে এখনো কিছুই বললাম না, কিন্তু কথায় আছে না? চোরের মন পুলিশ, পুলিশ! ওকে লেটস সি! আপনারা এইবার ভিতরে আসুন। ‘
ফারিশের কথা শুনে অনন্যার মা শেফা বেগম, লতিফ হাওলাদারকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেন। এমন মুহুর্তে লতিফ হাওলাদারকে দেখে রক্তশূন্য হয়ে যায় ইশিকা খানের মুখস্রী। এতোদিন পরে, নিজের বাবা- মাকে দেখে কিছুটা আবেগঘনিত হলেও, নিজেকে সংযত রাখে, কারণ তার মা তাকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো একটা সময়ে। এতোকিছুর পরেও, নিজের বাবাকে হুইলচেয়ারে দেখে, অনন্যা নিজেকে সামলাতে না পেরে, মায়ের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ‘ বাবার কি হয়েছে মা? বাবার কি ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি?’
‘হয়েছে রে মা! কিন্তু ভাগ্য! ভাগ্য আজ তোর বাবাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আজ তোর এই অবস্হার জন্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তোর বাবাও সমান দায়ী। তাই আজ তোর বাবার পা দুটো প্যারালাইসড হয়ে, অকেজো হয়ে গেছে। ‘
অনন্যা মুখে হাত দিয়ে বলে, ‘ এইসব কি বলছো মা?’ অনন্যা খেয়াল করছে তার বাবার চোখে জল! হয়তো কঠিন অনুতাপের ফল আজ এই জল ঝড়ছে! কিন্তু কিসের অনুতাপ? তার বাবা অতীতে কি এমন করেছে? কথাগুলো মাথায় ঢুকতেই, ভয়ে শিউরে উঠে অনন্যা।
ফারিশ পকেটে হাত গুজে অনন্যার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ আমি জানি মিস অনন্যা, আপনার মনে অনেক প্রশ্ন। তবে আমি সব বলি। ‘
ফারিশ চলে যায় তার অতীতের স্মৃতিতে,
রাশেদ খানের তখন ব্যাবসায় রমরমা অবস্হা। ফারিশের তখন কেবলমাত্র পাঁচ বছর। মায়ের কোলে সারাদিন ঘুড়ে বেড়াতো। ফারিশের মা জয়াও ছেলেকে সারাদিন নিজের বুকের মধ্যে ঝাপ্টে রেখে দিতো। ছেলে তার বড্ড আদরের। রাশেদের সাথে জয়ার প্রেমের বিয়ে ছিলো বিধায়, রাশেদের ভালোবাসার কোনপ্রকার ত্রুটি পেতো না জয়া। তার মধ্যে রুমা খান ও তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। জয়ার বাবা- মা কেউ ছিলো না, মামার সাহায্যে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ হয় জয়ার, সেখানেই রাশেদের সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো, রাশেদ তার ব্যাচম্যাট ছিলো। দুজনের প্রেমের পূর্নতা পায় তাদের বিয়েতে। জয়া তার গ্রেজুয়েসন শেষ করছিলো বাচ্চা সামলানোর সাথে সাথে এবং রাশেদ পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের ব্যাবসা দেখছিলো। তার কিছুদিনের মধ্যেই, খালেদের বিয়ে হয় রেশমির সাথে। রেশমি তখন নববধূ। তাদের বিয়ের ধূমধাম ভাবে হয়নি তবে রুমা খান ঠিক করেছিলেন তাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে বড় করে অনুষ্টান করে, শহরের সকল নামি দামি ব্যাক্তিবর্গকেও দাওয়াত করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। দিনটি ছিলো শুক্রবার।
খালেদ এবং রেশমির বিয়ে উপলক্ষ্যে সেদিন ইশিকা এবং লতিফ হাওলাদার ও এসেছিলেন। ইশিকা ছিলো রাশেদ খানের ফুপাতো বোন! এতো বছর পর বিদেশ থেকে এসে রাশেদ এর পাশে জয়াকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না অপরদিকে লতিফ ছিলেন জয়া এবং রাশেদ খানের ব্যাচম্যাট! সে বরাবরই জয়াকে ভালোবাসতো কিন্তু জয়া তাকে বিয়ে না করে, রাশেদকে বিয়ে করায়, তার জয়ার প্রতি বেশ গভীর ক্ষোভ ছিলো। তখনো লতিফ বিয়ে করেনি। লতিফের সেই ক্ষোভ টাই সেদিন কাজে লাগিয়েছিলো ইশিকা। অনুষ্টানের এক পর্যায়ে, জয়া ফারিশকে কোল থেকে নামিয়ে, রুমা খানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো, ‘ মা! বাবাকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম। আপনে একটু দেখিয়েন। আমি একটু ঘরে যাচ্ছি।’
‘ এই সময়ে ঘরে কেন? তুমি ঠিক আছো মা?’
‘ হ্যা, মা! আমি ঠিক আছি কিন্তু মাথা প্রচন্ড ধরেছে। আমি বরং ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে থাকি।’
বলেই জয়া নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তখনি ইশিকা লতিফের কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
‘ এখনো সুযোগ আছে লতিফ ভাই! নিজের প্রতিশোধ পূরণ করুন। ওই মেয়ে আপনার ভালোবাসাকে প্রত্যাক্ষ্যান করে, স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখে আছে। অথচ আপনি কি করছেন? আমি কি বলতে চাইছি, আপনি বুঝতে পারছেন?’
লতিফ গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে, ‘ তাহলে কি করা যায়?’
‘ জয়াকে আমরা চরিত্রহীনা প্রমাণ করবো, তাহলে সে কীভাবে রাশেদের সংসার করবে? তখন রাশেদ তাকে নিজ দায়িত্বে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে।’
ইশিকার কথা শুনে লতিফ বাঁকা হেসে, ‘ বুঝেছি ‘ বলে জয়ার রুমের দিকে চলে যায়।
জয়া নিজের রুমের দরজা বেরিয়ে শুয়ে ছিলো তখনি লতিফ তার রুমে প্রবেশ করে এবং এসেই জয়াকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরে। লতিফের এমন আচরণে জয়া স্তব্ধ হয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে, লতিফ তার শাড়ির আঁচলেও টান মারে এমন মুহুর্তেই ইশিকা রাশেদ এবং রুমা খানকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে! সকলেই স্তম্ভিত হয়ে যায়! সেদিন জয়ার সাথে লতিফের অবৈধ সম্পর্কে আছে বলে ইশিকা প্রমাণ করার চেষ্টা করে এবং লতিফ ও তা সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে কিন্তু রুমা খান জয়াকে বিশ্বাস করলেও, রাশেদ খান জয়ার গালে থাপ্পড় মে/রে বলেছিলো, ‘ চরিত্রহীনা মেয়ে- মানুষ কোথাকার! এতো নোংরা মহিলা তুমি? কিসের অভাব রেখেছিলাম আমি তোমায়? নিজের শরীর এইভাবে বিলিয়ে দিচ্ছো? ছিহ! তোমার থেকে একজন পতিতাও বেটার, আমি মনে করি। ‘
সেদিন জয়া নিজের আত্মসম্মান ভুলে বার বার রাশেদ খানের পায়ে ধরে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো, ‘ তুমি দয় করে আমাকে বিশ্বাস করো। আমি এমন কাজ করি নি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। ‘
‘ জয়া প্লিয! তোমার মতো মেয়ের মুখে ভালোবাসি কথাটি মানায় না। কীভাবে আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি? তোমার জায়গায় অন্য কেউ মেয়ে হলে, এতোদিনে গলায় দ/রি দিতো। ‘
বলেই নিজের পা সরিয়ে চলে যায় রাশেদ খান। জয়া সেদিন বিড়বিড়িয়ে বলেছিলো, ‘ একদিন তুমি খুব আফসোস করবে রাশেদ! একরাশ আফসোা নিয়ে তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। ‘
জয়া সেদিন নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো, ছোট্ট ফারিশ তখন সারারাত তার মায়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, ” মা, ও মা! তুমি আমাকে কোলে নিবে না? দরজা খুলো, আমি তোমার কাছে ঘুমাবো। আমার তো তোমাকে ছাড়া ঘুম আসে না। ‘
সেদিন জয়া দরজা খুলেনি। সারারাত ছোট্ট ফারিশ তার মায়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সকালে দরজা ভেঙ্গে সকলে তার মায়ের ঝুলন্ত মরদেহ বের করে। ছেট্ট ফারিশ বড় বড় নয়নে তার মায়ের ঝুলন্ত মরদেহ এর দিকে তাঁকিয়ে থাকে।
চলবে….
#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ৪১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশের মুখ থেকে তার অতীতের ভয়াবহ বর্ননা শুনে, অনন্যার আখিজোড়া থেকে টুপটুপ করে জল গড়িয়ে পরে। ততক্ষনে সেখানে অভি এসেও উপস্হিত হয়েছে। জুঁই উপরে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিলো। পরিবেশ থমথমে! ইশিকা খান বারবার ঘামছে। অনন্যার ভাবতেও অবাক লাগছে, তার বাবা এমন জঘন্যকাজটি করেছে তবুও সে বাবার দিকে এগিয়ে, বাবার কাছে হাটু গেড়ে বসে বলে, ‘ বাবা তুমি কী সত্যিই এই কাজটি করেছো?’
লতিফ হাওলাদার কোনপ্রকার জবাব না দিয়ে, মাথা নিচু করে বসে থাকেন। তার আখিজোড়াতেও জল। অনন্যা তার উত্তর পেয়ে গেছে। সে শব্দ করে কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে, ‘ বাবা তুমি! তুমি এই জঘন্য কাজটি করতে পারলে? তোমার জন্যে বাবা! তোমার জন্যে, একজন নির্দোশ মহিলার সংসার ভেঙ্গেছে, একজন ছোট্ট বাচ্চা তার মাকে হারিয়েছে বাবা! তুমি কী করে পারলে! প্রতিশোধপরানতা তোমাকে এইভাবে ধ্বংশের দিকে ধাবিত করলো?’
এতোকিছুর মাঝে ইশিকা খান হঠাৎ চেচিয়ে বলে, ‘ সব মিথ্যে! এই ছেলে তার চরিত্রহীনা মায়ের চরিত্র ঢাকতে, এতোবছর পরে, সব মিথ্যে নাটক সাঁজিয়ে প্রেশেন্ট করছেন। ‘
ফারিশ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘ আমি মিথ্যে বলছি না তা আপনি ভালো করেই জানেন। তাছাড়া আমি তখন সব ছোট এবং মা মারা যাওয়ার আগে আপনার এবং লতিফ হাওলাদারের সমস্ত কৃর্তী তার ডাইরিতে লিখে গিয়েছিলেন তা থেকেই আমি জানতে পেরেছি। একজন মৃত্যু মানুষ কখনো ম/রার আগে মিথ্যে কিছু লিখে যায় না মিসেস ইশিকা এবং সবথেকে বড় প্রমাণ আজ লতিফ হাওলাদার নিজে!’
রুমা খান মাথা ঘুড়ানোর অবস্হা তিনি নিজেকে কোনপ্রকার সামলে বললেন, ‘ ইশিকা! তুমি রাশেদকে বিয়ে করার জন্যে, এতোকিছু করলে? আমার ফারিশ আজ তার মাকে পায়নি, বাবাকে পেয়েও পায়নি, সব তোমার জন্যে। ডাইনি, রাক্ষসি একটা! রাশেদ- জয়ার সংসার খেয়ে এইভাবে খেয়ে ফেললে তুমি!’
ইশিকা খান রাশেদের হাত ধরে আকুতির সুরে বললেন, ‘ দেখো না! সবাই কি বলছে! তোমার ছেলে আমাকে ফাঁসাতে এইসব করছে। সবাই আমাকে ভুল বুঝলেও, তুমি তো জানো আমি এমন না। ‘
রাশেদ খান একপ্রকার ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু সবকিছু শুনে তিনি ইশিকা খানের গালে থা/প্পড় মা/রেন। ইশিকা খান রাশেদের এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে পরেন। রাশেদ খান বললেন,
‘ না না! ভেবো না সেদিনের কান্ডের জন্যে আজ তোমায় মা/রলাম। তোমার মে/রেছি, শুধুমাত্র আজকে এতোকিছুর পরেও এতোগুলো মিথ্যে বলার জন্যে। অন্যায় করেছো কিন্তু তা অন্তত স্বীকার করো। তোমার থেকে সবথেকে বড় পাপি আমি! আমার জয়া আমাকে কতকরে বুঝিয়েছে, সেদিন যদি একটু ওকে বুঝতাম। তোমরা তো বাইরের মানুষ, তোমাদের আচরণে এতোটা কষ্ট আমার জয়া পায়নি যতটা পেয়েছে আমার অপমানে, আমার অসম্মানে, আমার অবিশ্বাসে। শুধুমাত্র আমার জন্যেই আমার ছোট্ট ছেলেটা তার মাকে হারিয়েছে, আমি হারিয়েছি আমার জয়াকে। ‘
ফারিশের আখিজোড়াতেও জল। রুমা খান এগিয়ে এসে বললেন, ‘ তুই আমার ছেলে, তবুও তোকে বলছি রাশেদ। মানুষ সবথেকে বড় দোষ হলো, তারা অপাত্রে ভালোবাসা দান করতে পারে। জয়া মেয়েটা অপ্রাত্রে ভালোবাসা ঢেলেছিলো, তার শাস্তিস্বরুপ বিনাদোষে তাকে মর/তে হয়েছিলো। তোকে ভালোবেসে ঘর বাঁধাই তার সবথেকে বড় ভুল ছিলো। ‘
অনন্যা ফারিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ আমার বাবার জন্যে, আপনার মা/কে মরতে হয়েছে, তাই আপনি এতোদিন সেই প্রতিশোধ নিতে, আমাকে আপনার কাছে বন্দী রেখেছিলেন?’
ফারিশ তার আখির জলটুকু মুছে বলে, ‘ জ্বী হ্যা! আজ থেকে কয়েকবছর আগে, আমার মা যেই পরিস্হিতি থেকে গিয়েছিলো, সেই একি পরিস্হিতিতে আমি আপনাকে ভরা বিয়ের আসরে দাঁড় করিয়েছিলাম এবং সেদিন অভি সাহেব ও আমার বাবার মতো আপনাকে সকলের সামনে অপমান করে বসে! আপনাকে অবিশ্বাস করে। ‘
ফারিশের কথা শুনে অনুতপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অভি। কি করতে যাচ্ছিলো সে? হ্যা সে ও তো রাশেদ খানের মতো সমান দোষী। ফারিশ আবারোও বলে,
‘আমি ভেবেছিলাম সেই লজ্জায়, অপমানে আপনিও হয়তো সুইসাইড করবেন এবং লতিফ খান বুঝবে আপন মানুষকে হারানোর সেই কঠিনতম অনুভুতি। যা আমি পাঁচ বছর বয়সে উপলব্দি করেছিলাম। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে, আপনি নিজের মনোবলের জোড়ে, টিকে ছিলেন শেষ অবদি। ‘
‘ আমি তো আপনার বাড়িতে ছিলাম, তবে আমাকে আপনার বাড়িতে এনেও অনেক ক্ষতি করার সুযোগ ছিলো আপনার, তখন কেন ক্ষতি করে নিজের প্রতিশোধ নেন নি আপনি মি: ফারিশ খান?’
ফারিশ অনন্যার এমন কথা শুনে, মুখ ঘুড়িয়ে বলে,
‘ কারণ দিনশেষে আমি লতিফ হাওলাদার কিংবা ইশিকা খানের মতো অমা*নুষ নই। আমি মানুষ। সেই মনষ্যত্বের খাতিরেই, আজকে আপনাকে আমি সকলের সামনে নির্দোশ করে, মুক্ত করে দিচ্ছি। ‘
অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলে,’ সবকিছুই কি আপনার মনষ্যত্ব ছিলো মি: ফারিশ খান? এতো উদার মনের মানুষও বুঝি হয়? ‘
অন্যদিকে,রাশেদ খান এতোকিছুর মধ্যে চেচিয়ে বলে,
‘ আমি আমার অন্যায়ের শাস্তি আমি নিজেকে দিবো, আমি অনেক অনেক দূরে চলে যাবো, যেখানে আমি কেউ পাবে কিন্তু তার আগে ইশিকা আমি তোমায় ডিভোর্স দিবো এমন কোর্টে এমন ব্যাবস্হা করবো যাতে তোমার জেল হয় আমি কিন্তু তোমাকে কিছুতেই ছাড়বো না। ‘
‘ ডিভোর্স দিবো মানে? রাশেদ তুমি কি বলছো এইসব?’
ফারিশ হঠাৎ বলে উঠে, ‘ আপনাকে এতো কষ্ট না করলেও হবে মি: রাশেদ খান। অনেক উপকার করেছেন আপনি। আমি আমার উকিল কে দিয়ে, আমার মায়ের সেই সুইসাইড কেইস পুনরায় ফাইল করিয়েছি এবং লতিফ হাওলাদারের স্বাকীরক্তিকে, পুলিশ লতিফ হাওলাদারকে এবং ইশিকা খানকে এরেস্ট করবে এবং মামলাটা কোর্টে তুলা হবে।’
ইশিকা খান দেখতে পায় সত্যিই পুলিশ চলে এসেছে
ইশিকা খান দ্রুত তার মেয়ে ইয়ানা এবং ছেলে ইয়াশের কাছে গিয়ে বলে, ‘ তোরা দেখছিস? তোর বাবা নাকি আমাকে ডিভোর্স দিবে এবং পুলিশ নাকি আমাকে ধরেও নিয়ে যাবে। তোরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কেন কেউ কিছু বলছিস না?’
ইয়ানা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ এতোকিছুর পরেও কীভাবে বুক ফুলিয়ে আছো মা? ভাইয়ার মন সত্যিই উদার। আমি ভাইয়ার জায়গায় হলে, নিজের হাতে নিজের মায়ের খু*নিকে শেষ করে, প্রতিশোধ নিতাম। ‘
ইয়াশ তার হাত থেকে নিজের মায়ের হাত সরিয়ে বললো, ‘ জাস্ট শেইম অন ইউ মা! তোমাকে মা বলতেও আমার ঘৃণা লাগছে। ‘
ইরাশ কথাটি বলে উপরে চলে যায়। পুলিশ এসে ইশিকা খানকে নিয়ে যায় এবং লতিফ হাওলাদারকে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে, লতিফ হাওলাদার ফারিশ এবং অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ জানি, আমি ক্ষমার যোগ্য নই। তবুও বলছি,বাবা পারলে আমাকে ক্ষমা করো, মারে, তোর পাপি বাপটারে মাফ করে দিস। ‘
অনন্যা ঘৃণায় মুখ ঘুড়িয়ে ফেলে। শেফা বেগম আচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকেন। পুলিশ তাদের নিয়ে চলে যায়। রাশেদ খান তার গভীর অনুতাপে কাঁদতে কাঁদতে একপ্রকার ভেঙ্গে পরেন, খালেদ খান এসে তাকে কোনরকমে ধরে ফেলেন। সবকিছুর মাঝেই, অভি এসে হঠাৎ অনন্যার হাত ধরে বলে,
‘অনন্যা আমি জানি, মি: রাশেদ খানের মতো আমিও সমান দোষী কিন্তু অনেক তো হয়েছে! আমি প্রতিপদে পদে নিজের অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছি অনন্যা। এইবার অন্তত আমার সাথে ফিরে চলো! আমরা দুজন এইবার বিয়ে করে, এইবার একসাথে সংসার শুরু করবো।’
অভির কথা শুনে অনন্যা ফারিশের দিকে তাঁকায়। ফারিশের বুকটা কষ্টে জ্ব/লে যাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। অনন্যা ফারিশের সামনে আসতেই, ফারিশ নিজে থেকেই থমথমে গলায় বলে,
‘ মিস অনন্যা অন্যের দোষের জন্যে, আমি আপনাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি, আমি অনেক খারাপ মানুষ আপনার কাছে কিন্তু এই খারাপ মানুষটাই বলছে আপনি অভি সাহেবের সাথে সুখে সংসার করুন। আজ থেকে আপনি মুক্ত! উনি যা শিক্ষে পেয়েছেন, তাতে মনে হয়না উনি কখনো সেই ভুল দ্বিতীয়বার করবেন।’
‘ মুক্তি দিয়ে দেওয়া বুঝি এতোটাই সহজ ফারিশ খান?’
‘ যে মুক্ত হতে চায়, তাকে মুক্তি করা দেওয়াই ভালো!’
‘ মিষ্টির কি হবে? ‘
‘ ওকে আমি সামলে রাখবো, আপনি নিশ্চিন্তে যান। ‘
‘ আপনি কি কাঁদছেন মি: ফারিশ খান?’
‘ উহু! আমি কাঁদবো কেন? আপনিও কিন্তু আমাকে কম জ্বালাননি মিস অনন্যা! প্রচুর বকবক করে মাথা খেয়েছেন। ইউ নো, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। হা হা।’ বলেই হুট করে হেসে আবারোও চুপ হয়ে যায়।
অনন্যা শুকনো হেসে, ছলছল নয়নে ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে, কী ভেবে যেনো অভির কাছে গিয়ে বলে, ‘ অভি আমি তোমার গাড়িতে গিয়ে বসছি। তুমি কষ্ট করে মাকে নিয়ে এসো। ‘
বলেই অনন্যা ফারিশের দিকে না তাঁকিয়েই, চলে গেলো। অপরদিকে, ফারিশও তীব্র নি:শ্বাস ফেলে উপরে চলে গেলো। রুমা খান নিজের নাতির দিকে তাঁকিয়ে বুঝতে পারছেন, আজ তার ফারিশ ভালো নেই! ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা তবুও সে তার ভালোবাসাকে আজ মুক্ত করে দিয়েছে।
চলবে।।