#প্রণয়ের_রংধনু 🖤
#পর্ব-২৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যা ফারিশ এসেছে ভেবে পিছনে ঘুড়ে অভিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। অভি কেমন অসহায় পানে অনন্যার দিকে চেঁয়ে আছে। অভি থমথমে গলায় শুধালো, ‘ ওই লোক কেন আসবে? আমি এসেছি অনন্যা! আমি তোমার অভি। তোমার ভালোবাসার মানুষ। ‘
‘ তুমি? তুমি এখানে এতো রাতে কি করছো? তুমি এই বাড়িতে ঢুকলেই বা কী করে?’
অভি মাথা নিচু করে, নিচু গলায় জবাব দেয়, ‘ দেয়াল টপকে, অনেক কষ্টে বাগানের দিক থেকে এই স্টোর রুমে ঢুকেছি। খবর নিয়েছিলাম আজকে গার্ডসরা পাহাড়া দিচ্ছে না কোন কারণে। তাই সুযোগ হাতছাড়া না করে, একপলক তোমাকে দেখতে ছুটে এসেছি, এতো রিস্কের মধ্যেও। ‘
অভির আচরণে অবাক না হয়ে পারে না অনন্যা। অভির রাতারাতি এতো পরিবর্তন হলো কীভাবে? তা ঠিক মতো ঠাওড় করতে পারছে না সে। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, আচমকা অভি অনন্যার হাত ধরে, অনুতাপের সুরে বলে, ‘ আমি সব জেনে গিয়েছে। কী করে দিনের পর দিন জুঁই এবং ওই নিকৃষ্ট ফারিশ খান ষড়যন্ত্র করে এসেছে, তোমার বিরুদ্ধে। এতো বাজে মিথ্যে ভিডিও বানিয়েছে শুধুমাত্র আমার চোখে, পুরো সমাজের চোখে তোমাকে চরিত্রহীনা প্রমাণ করার জন্যে, শেফালি আমাকে সবকিছু বলেছে। এমনকি জুঁই এবং শেফালির কলের রেকর্ডিংও আমার কাছে আছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না অনন্যা। ফারিশ খান এবং জুঁইয়ের এমন অবস্হা করবো, ওদের জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়বো আমি।কিন্তু তার আগে তোমাকে আমি মুক্ত করবো। অনন্যা আমার সাথে এসো। আমাদের এখুনি বের হতে হবে। ‘
বলেই অনন্যার হাত ধরে এগোতে নিলে, থেমে যায় অভি, কারণ অনন্যা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। মুখস্রী শক্ত। আখিজোড়ায় অশ্রু এসে ধরা দিচ্ছে তার। হয়তো এখুনি টুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে যাবে। অনন্যা নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে, অভির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলে,
‘ তোমার আজ মনে হলো অভি? আমি সম্পূর্ণ নির্দোশ? কই সেদিন যখন তোমাকে আমার সবার মধ্যে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিলো তখন তো তুমি ছিলে না। আমাকে জাস্ট ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলে। আমার কথার উপর কোন বিশ্বাস নেই তোমার, অথচ শেফালি কথা শুনে এবং সামান্য রেকর্ডিং দেখে এখন তুমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলে যে, হ্যা আমি নির্দোশ! সেদিন আমার আর্তনাদ তোমার কানে পৌঁছায় নি। ভরা বিয়ের আসরে আমার গাঁয়ে হাত তুলে, তুমি বারংবার আমাকে অপমান করেছো অভি। তোমার দেওয়া অপমান সহ্য না করতে পেরে, আমার বাপির এতো খারাপ অবস্হা হয়েছে, যার ফলে আজ আমি এখানে। সেদিন যদি একটু আমায়
বুঝতে। ভালোবাসো? তো সেদিন কোথায় ছিলো তোমার ভালোবাসা?’
‘ আসলে…অনন্যা….’
অভিকে থামিয়ে অনন্যা আবারো বলতে থাকে,
‘ এতোকিছুর পরেও আমি তোমার কাছে বাধ্য হয়ে সাহায্যের জন্যে ছুটে গিয়েছিলাম। আমার বাপির তখন মরণঅবস্হা। টাকার জন্যে আমি চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম, বিয়ের বেনারশি পরে। কত অসহায়ত্ব, কত হাহাকার! তুমি আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলে, অভি। এমনকি কালকেও তুমি আমার পাশে ছিলে না, যত বাজে ভাবে অপমান করা যায়,সবকিছু করেছিলে তুমি। অপমানে লজ্জায়
ম/রে যেতে চেয়েছিলাম,সেই তুমি আজ আমাকে মুক্ত করতে এসেছো? ওয়াট আ ফানি জোক!’
অভি হাটু গেড়ে বসে পরে। অত:পর অনন্যার হাতজোড়া পুনরায় আকড়ে ধরে বলে, ‘ আমি জানি আমি যা করেছি তার কোন ক্ষমা নেই তবুও বলছি আমাকে মারো, বকো যত খুশি শাস্তি দাও অনন্যা,তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিও না। বিচ্ছেদের যন্ত্রনা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি জানো? আমি প্রতি ক্ষনে ক্ষনে তোমায় মনে রেখেছি। আমার একটা দিনও তোমায় হীনা কাটেনি। আমি তোমায় ভালোবাসি, অনন্যা। প্লিয ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! ‘
‘ অভির বিয়ের দিনের সেই কথাগুলো মনে আছে? যা আমি তোমায় বলেছিলাম?’
অনন্যার কথা শুনে, অভির মনে পরে যায়, অনন্যার বলা সেই কথাগুলো,
বিয়ের আসরে,অভির মা ছেলেকে এবং বাকি বরপক্ষকে নিয়ে, চলে যেতে উদ্বত হলে, পিছন থেকে অভিকে উদ্দেশ্য করে, অনন্যা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
‘ মি: অভি শিকদার, কে বলতে পারে? এই নষ্ট মেয়ের কাছেই হয়তো আপনাকে একদিন ফিরে আসতে হবে, কিন্তু সেদিন চাইলেও আপনি আর ফিরতে পারবেন না। সমস্ত পথ আজ নিজ হাতে আপনি বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছেন। যেই কঠিন মুহুর্তে আপনার সঙ্গ আমার যেখানে সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয়, সেখানে আপনি আমাকে একা করে চলে যাচ্ছেন। আজ না হয় কাল, বিরাট বড় এক ধাক্কা আপনি খাবেনই। মনে রাখবেন, কিন্তু। ‘
সেদিনের কথাগুলো মনে পরতেই, অনন্যার হাত ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে অভি। কত বড় ভুল করে ফেলেছে সে। নিজের গালে নিজেরই ঠাটিয়ে চর বসাতে ইচ্ছে করছে তার। অনন্যাও তার আখিজোড়ার অশ্রুটুকু মুছে, শক্ত গলায় বলে,
‘ যেই বিচ্ছেদের তীব্র আগুনে আমি প্রতিনিয়ত জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়েছি, সেই আগুন এতে সহজে তুমি নিভিয়ে দিতে পারবে না। বিশ্বাস একটি সম্পর্কের ভিত্তি। সেখানে অবিশ্বাস নামক বিষাক্ত শব্দকে তুমি আমাদের সম্পর্কের মাঝে এনে, আমাদের সম্পর্ককে সম্পূর্ন ভিত্তিহীন করে তুলেছো আজ! ‘
বলেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে ঘুড়ে দাঁড়ায় অনন্যা। অভি উঠে দাঁড়ায়। অসহায় পানে চেয়ে আছে সে। অনন্যা অভির দিকে না তাঁকিয়েই বলে,
‘ তুমি দয়া করে চলে যাও অভি। আমি জানি কীভাবে নিজেকে প্রটেক্ট করতে হয়।কীভাবে এই বাড়ি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হয়। আমি ঠিক বের হবো কিন্তু তার জন্যে তোমার কোনপ্রকার সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই। তুমি বেশিক্ষন থাকলে, যদি আবার কেউ এসে পরে তাহলে সেই চরিত্রহীনার ট্যাগ কিন্তু আমার দিকেই ধেঁয়ে আসবে। এইসব সো ক্লড পুরুষশাসিত সমাজে, তোমাদের দোষ কিন্তু কখনোই কেউ দেখবে না। ‘
অভি বুঝতে পারছে না বর্তমানে তার কি করা উচিৎ! সে কী করে থাকবে তার অনন্যাকে ছেড়ে? অভি আর কিছু না ভেবে তড়িৎ গতিতে বেড়িয়ে যায়। অভি বেড়িয়ে যেতেই, হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্যা। তখনি রুমা খান দরজায় কড়া নাড়ে। রুমা খানের ডাক শুনে অনন্যা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে বলে,
‘ দাদি! তুমি এতো রাতে? এখনো ঘুমাও নি?’
রুমা খান অস্হিরতার সুরে বললেন, ‘ কীভাবে ঘুমাবো? ফারিশ যে এখনো বাড়ি ফিরে নি। মিষ্টি বাপি বাপি বলে খুঁজছে। মেয়েটাও ঘুমাচ্ছে না। কত রাত হয়ে গিয়েছে! এতো রাত অব্দি তো ফারিশ বাইরে থাকে না। কি হয়েছে ওর কে জানে? আমার বড্ড চিন্তা হচ্ছে রে। ‘
রুমা খানের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় অনন্যার। যে মানুষটি তাকে সেবা যত্ন করে সুস্হ করলো, তাকেই সকালে এতো বাজেভাবে অপমান করলো অনন্যা, তার জন্যেই কি সে বাড়ি ফিরছে না? তবে অনন্যার মতো সামান্য কাজের লোকের কথা তার কেন গাঁয়ে লাগবে? আগেও তো কত কথা শুনেয়েছি সে কিন্তু কই? ফারিশ তো গাঁয়ে মাখেনি তেমন তবে আজ কি হলো তার?
‘ উনার অফিসে থেকে খবর নিয়েছিলেন দাদি?’
‘ নিয়েছিলাম, আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়েছে ছেলেটা কিন্তু কোথায় গিয়েছে কেউ কিচ্ছু জানে না। এমন রাত অবদি বাইরে থাকার ছেলে তো আমার ফারিশ না, বুঝতে পারছি না, কী হয়েছে!’
অনন্যা রুমা খানকে শান্ত করতে বলে, ‘ তুমি শান্ত হও দাদি। আমি দেখছি বিষয়টি। তুমি চিন্তা করো না, উনি ঠিক ফিরবে। আচ্ছা উনার মেনেজারের কি নাম যেন? ‘
‘ শফিক?’
‘ হ্যা! হ্যা। শফিক ভাইয়ের নাম্বার আমায় একটু দিবে দাদি?’
‘ আচ্ছ, দিচ্ছি। ‘
শফিকের নাম্বার পেয়ে, অনন্যা শফিকের নাম্বারে ডায়াল করে, কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর পরেই, শফিক নাম্বার টা রিসিভ করে বলে, ‘ হ্যালো! কে বলছেন?’
‘ আমি অনন্যা। ‘
‘ অনন্যা ম্যাম! আপনি এতো রাতে? ‘
‘ আসলে মি: ফারিশ এখনো ফিরেনি। বাসার সবাই বেশ চিন্তা করছে। দাদি, মিষ্টি কেউ ঘুমাচ্ছে না। আপনি কী দয়া করে বলতে পারবেন উনি কোথায়?’
‘ আমি সঠিক বলতে পারবো না কিন্তু স্যার বোধহয় হপ্স নামক বারে গেলেও যেতে পারেন। ‘
‘ বারে? এইসময়ে? ‘
‘ আমি সিউর না কিন্তু যেতে পারেন হয়তো ‘
‘ আচ্ছা, আপনি কী আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবেন? ‘
‘ আপনি এতো রাতে বের হবেন ম্যাম? কিন্তু স্যার জানলে অনেক রাগ করবে। পরে আবার আমার চাকরী নিয়ে টানাটানি পরবে।’
‘ আমি দাদির পার্মিশন নিয়ে বের হবো, আপনি শুধু আমাকে সেখানে নিয়ে যান। আপনার কোন সমস্যা নেই, আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি। ‘
__________________
শহরের একটি নামে দামে বারে বসে একের পর এক বিয়ারের বোতল শেষ করে দিচ্ছে ফারিশ। ফারিশ বিয়ারের দিকে তাঁকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ আমি অনেক খারাপ! আইম দ্যা গ্রেট হার্টলেস! সবার শুধু আমার রাগ, জেদ, আমার ইগো চোখে পরে। কিন্তু আমিও যে একজন রক্তে মাংসে মানুষ। কারো আমার যন্ত্রনা, আমার বেদনা চোখে পরে না। ‘
বলেই নিজের বুকে হাত রেখে আখিজোড়া বন্ধ করে, ফের বিড়বিড়িয়ে ফারিশ বলতে থাকে, ‘ আমারোও ঠিক বুকের এখানে অনেক জ্বলে! ছোটবেলা থেকে সেই যন্ত্রনাগুলোকে বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে বড় হয়েছি, কিন্তু সেই যন্ত্রনা কখনো কেউ উপলব্ধি করেছে?আমারোও অনুভুতি আছে। দিনশেষে আমি বড্ড একা! ‘
দূরে ডান্স ফ্লোরে ছোট ছোট জামা পরিহিত মেয়েরা দূর থেকে ফারিশকে একপ্রকার চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে এমন অবস্হা! ফারিশ তা দেখে সামান্য বাঁকা হেসে আবারোও বিয়ারের বোতলে চুমুক দেয়।তখনি একজন মেয়ে, ফারিশের সামনে বসে, হাত এগিয়ে বলে, ‘ হ্যাই! আম নেন্সি! ইউ আর ফারিশ খান রাইট? ডু ইউ ওয়ান্ট টু ডেট ইউথ মি রাইট নাও হ্যান্ডসাম? ইউ নো? আমি আপনার অনেক ম্যাগাজিন দেখেছি, আপনার সব ইন্টারভিউ আমার দেখা। ইউ আর মাই চার্ম পিন্স! প্লিয ডোন্ট টার্ন মি এওয়ে। ‘
ফারিশ মেয়েটার দিকে ঝুঁকে, ফিসফিস করে বলে,
‘ ফারিশ খান সেকেন্ড হ্যান্ড পছন্দ করে না। বিকজ আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ! অনলি ব্রেন্ড ইজ রিয়েল। ‘
ফারিশের কথা শুনে নেন্সি ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ‘ তুমি আমাকে সেকেন্ড হ্যান্ড বললে? তুমি জানো কত ছেলে এই ন্যান্সির জন্যে পাগল? আমি শহরের নামকড়া মডেল এন্ড তুমি আমাকে অপমান করলে? এইভাবে রিযেক্ট করলে?’
ফারিশ ন্যান্সিকে ভালো করে পর্যবেক্ষন করে, সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বললো, ‘ সেসব ছেলেরা অন্ধ হবে নাহলে তাদের চোখ ট্যারা। নাও গেট লস্ট!’
ন্যান্সি রাগে অপমানে চলে যায় সেখান থেকে।
‘ যত্তসব! ‘ বলে আবারোও বিয়ারে চুমুক দিতে গেলে, কেউ এসে ফারিশের হাত ধরে বলে। ফারিশ এইবার ক্ষেপে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ এতো অপমান করার পরেও, আবারোও এসেছো?স্টুপিড ওমেন…..’
চলবে কী?
শব্দসংখ্যা- ১৫০০
#প্রণয়ের_রংধনু 🖤
#পর্ব-২৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যাকে এতো রাতে বারে দেখে কিছুটা চমকে উঠে
ফারিশ। সে বারবার চোখ কচলিয়ে ভালো করে তাঁকায়, তার ধারণা সে ভুল দেখছে! অনন্যা কেন এতো রাতে বারে আসবে? তার খোঁজে নিশ্চই আসবে না তবে? সে নিজের মনের ভূল করে আবারোও টেবিলে বসে, বিয়ারের বোতলে চুমুক দিলো। অনন্যা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! মানুষটা এতো অদ্ভুদ কেন? অনন্যার ধারণামতে, এতো রাতে অনন্যাকে বারে দেখে নানা প্রশ্ন করবে ফারিশ, নাহলে চিৎকার, চেচামেচি করবে অথচ ফারিশ সম্পূর্ণ শান্ত!অনন্যা নামক রমনী তার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে অবদি খেয়ালও নেই তার। অনন্যা ফারিশের পাশের চেয়ারে বসে বললো, ‘ আপনি ড্রিংক করেন? ‘
ফারিশ অনন্যার দিকে না তাঁকিয়েই বললো, ‘ আপনি আমার এতো বাজে অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছেন, যার ফলে আজকাল আপনি আমার কল্পনাতে এসেও হানা দেন। বড্ড জ্বালাতন করেন।’
‘ আমি আপনাকে জ্বালাতন করি?’
‘ করেন না বুঝি?’
‘ উহু! আমার ধারণামতে আপনি আমাকে জ্বালাতন করেন, শাস্তি দেন কঠিন, কঠিন! ‘
‘ আমি কি আপনাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলি?’
ফারিশের এমন প্রশ্নে কিছুটা থেমে গেলো অনন্যা। ফারিশ হঠাৎ অনন্যার হাত ধরে ঠোটজোড়া উল্টো করে বিড়বিড়িয়ে বললো,
‘ কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমিও অনেক কষ্ট পেয়েছি ছোটবেলা থেকে। আমি হার্টলেস নই! আমাকে খারাপ বানানো হয়েছে। আমার থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছে ওরা। ‘
ফারিশের থেকে তার মাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে কথাটি মস্তিষ্কে প্রবেশ করতেই, অনন্যা ভাবতে থাকে ফারিশ খান কিসব বলছেন? উনার মাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে মানে? তবে উনার মায়ের মৃত্যু কি স্বাভাবিক নয়? তবে এর পিছনের রহস্যে কী? সেই মৃত্যু কে ঘিড়েই তবে আজ এই পরিস্হিতি? ফারিশ আবারো ক্লান্তমাখা গলায় বলে উঠলো,
‘এখন আমি আপনাকে চাইলেও কঠিন শাস্তি দিতে পারি না। জানেন? কেন যেন মায়া হয় আপনাকে দেখলে। আপনি খুব মায়াবতী! আপনাকে দেখলে বুক কেঁপে উঠে। কেন হয় এমন? ‘
ফারিশ আখিজোড়ায় অদ্ভুদ অস্হিরতা! কন্ঠে রয়েছে জড়তা! অনন্যার বুক ধক করে উঠলো! কি বলে যাচ্ছে মানুষটা? ফারিশের কথা শুনেই সে বুঝলো ফারিশ নেশাগ্রস্ত অবস্হায় কথাগুলো বলছে। কোথায় যেন অনন্যা শুনেছিলো মানুষ নেশাগ্রস্হ অবস্হায় অনেকসময় সত্যি কথা বলে। অনন্যা সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে, ফারিশের হাত ধরেই, ফারিশকে উঠানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
‘ আপনি এখন উঠুন! বাসায় যেতে হবে। ‘
ফারিশ উঠে দাঁড়িয়ে অভিমানের সুরে বললো, ‘ কিন্তু আমি কেন যাবো? আমি তো খারাপ লোক, বাজে লোক! হার্টলেস! আমি না গেলে কি এমন মহাভারত অশাদ্ধ হয়ে যাবে? ‘
ফারিশের এমন কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো অনন্যা। লোকটা বাইরে থেকে যতটা শক্ত, কঠোর কিংবা নিজেকে খারাপ দেখানোর চেষ্টা করুক, ভিতর থেকে মানুষটা একদম অন্যরকম। আজ তা গভীরভাবে উপলব্দি করছে অনন্যা। অনন্যার হাত ধরতে গিয়ে কী ভেবে যেন পরক্ষনে নিজের হাত সরিয়ে, ফারিশ বলে উঠে, ‘ ফারিশ খান নিজেই নিজেকে সামলাতে পারেন। আপনি এখন যান। আমার কল্পনাতে আসবেন না প্লিয! ‘
অনন্যা মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘ হায় খোদা! মি: খারুশ থুরি ফারিশ খান আমি আপনার কল্পনা না, আমি বাস্তবে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। ‘
‘ আপনি বাস্তব হন বা কল্পনা হন ফারিশ খান কেন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে হাঁটবে? সে একাই নিজেকে সামলাতে পারে সেই ছোট বেলা থেকে।’
বলেই ফারিশ একপা এগোতে নিলে, হোচট খেয়ে পরে যেতে নিলে, অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে ফারিশের হাত নিজের কাঁধে রেখে, ফারিশকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় বলে, ‘ খারুশ বেটা এক নাম্বারের! হাঁটতে পারছে না নেশারঝোঁকে অথচ তার এটেট্যুয়েড ল্যাভেল এক পার্সেন্ট ও কম নেই। ‘
বলেই ফারিশকে নিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো অনন্যা, যদিও সেখানে মেয়েরা কেমন করে তাঁকাচ্ছিলো অনন্যা এবং ফারিশের দিকে। ফারিশের থেকে রিযেক্টেড ন্যান্সিও রাগে ফুসফুস করে তাদের দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। তার মতে এই মেয়েটার জন্যেই আজ হয়তো ফারিশ খান তাকে এতো বাজেভাবে রিযেক্ট করলো।
______________
অভি বাসায় আসতেই, অভির মা তড়িৎ গতিতে এসে বললেন, ‘ কি অবস্হা অভি? তোমার মুখস্রী এমন দেখাচ্ছে কেন? সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি? কালকের থেকে লক্ষ্য করছি, তুমি যেন নিজের মধ্যে নেই। ‘
‘ আমি অনন্যার কাছে গিয়েছিলাম মা!’
‘ অনন্যার কাছে গিয়েছিলে মানে? তুমি ওই চরিত্রহীনা…..’
নিজের মায়ের কথাকে সম্পূর্ন শেষ করতে না দিয়ে, অভি হাত জোড় করে বললো, ‘ মা! দয়া করে, অনন্যার সাথে কোনপ্রকার অসম্মানজনক শব্দ যুক্ত করবে না। আমাদের বিশেষ করে আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। ‘
‘ কিসের ভুল হয়েছে? অভি আমাকে সব খুলে বলো। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে কোন গন্ডগোল হয়েছে। ‘
অভি শুরু থেকে সবকিছু তার মাকে খুলে বলে। সবকিছু শুনে অভির মায়ের মাথায় হাত! এতো বড় ভুল কী করে করলেন তারা? অভি কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে ধপ করে বসে, তার মায়ের পা আকড়ে ধরে বলে, ‘ মা! যেইভাবেই হোক! আমার অনন্যাকে আমার কাছে এনে দাও! তুমি তো জানো, আমি অনন্যাকে কতটা ভালোবাসি। অনেক বড় ভুল করেছি আমি জানি, তার জন্যে শাস্তি পেতে আমি রাজি কিন্তু শাস্তিস্বরূপ আমি অনন্যাকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমার অনন্যাকে এনে দাও না মা। আমি আর পারছি না। ‘
ছেলের এমন অনুরোধে অভির মায়ের আখিতেও অশ্রুে এসে ধরা দেয়। ছোট্ট বাচ্চা ছেলে যেমন তার সবথেকে পছন্দের খেলনা পাওয়ার জন্যে কেঁদে কেটে বাবা- মায়ের কাছে বায়না ধরে সেই খেলনা এনে দেওয়ার জন্যে তেমনি আজ অভিও তার ভালোবাসার মানুষকে পেতে ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় অনুরোধ করছে। অভির মা ঝুঁকে ছেলেকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নেন।
_________________
ফারিশকে কোনমতে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে, নিজেও গাড়িতে বসে পরে। গাড়িতে শফিক ও ছিলো। শফিক ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ছিলো।
সে পিছনে তাঁকিয়ে বলে, ‘ স্যারের অবস্হা তো ভালো না, ম্যাম! ‘
‘ হ্যা! উনি ড্রাংক! আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বাড়ি গিয়ে উনাকে লেবুর পানি খায়িয়ে দিবো। আমাদের সবার আগে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। ‘
শফিক মাথা নাড়িয়ে, ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে। অপরদিকে ফারিশ বিড়বিড়িয়ে বলছে,
‘ দিনশেষে আমি বড্ড একা! আমারও কষ্ট হয়। আমার অন্তরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায় কিন্তু সেই খবর কে রাখে? আমি খারাপ নই…! ‘
বাকিটুকু শুনতে পেলো না অনন্যা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অত:পর বাড়িতে ফোন করে রুমা খানকে জানিয়ে দিলো, তিনি যেন মিষ্টিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়, বর্তমানে ফারিশ নেশাগ্রস্ত অবস্হায় রয়েছে, এমন অবস্হায় ফারিশকে দেখলে মিষ্টি হয়তো অন্যকিছু ভাবতে পারে। ফোনটা কেটে অনন্যা জানালার দিকে তাঁকাতেই, ফারিশ অনন্যার কাঁধে ঘুমিয়ে পরে। ফারিশের গরম নি:শ্বাস অনন্যার কাঁধে উপচে পরছে। অনন্যারও নি:শ্বাসের গতি বাড়ছে ঘন ঘন! সে ভাবলো হয়তো ফারিশকে সরিয়ে দিবে কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবে সরালো না বরং ফারিশের কোকড়া চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিলো।
_____________________
সকালে বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো ফারিশের। সে আড়মোড় করে বিছানা থেকে উঠলো। তার ব্লেজার টা বিছানার এক কোনে যত্ন করে রাখা এবং জুতা ও ঠিক জায়গায় রেখে দেওয়া! কালকের রাতের কথা ঠিক করে মনে করার চেষ্টা করতে করতে, দরজা খুলতেই দেখতে পায়,ছোট্ট অনন্যা গোল্ডেন পারের সাদা শাড়ি পরে, সাদা চুলের উইক পরে এবং চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে , লাঠি হাতে নিয়ে, গলার স্বর কিছুটা ভারি করে, খেক খেক গলায় বলছে,
‘ কিগো নাতী? কালকে রাতে কোথায় ছিলে তুমি? তুমি কী জানো না? রুমা খানের বাড়িতে লেট করে ফেরা নট এলাও। ‘
মিষ্টি একদম রুমা খানের মতো সেঁজেছে যেন সে আরেকজন ছোট্ট রুমা খান। মিষ্টিকে দেখে ফারিশ ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে বললো,’ মা! তুমি দাদি সেঁজেছো?’
মিষ্টি ফোঁকলা দাঁত দিয়ে হেসে বললো, ‘ হ্যা! যেমন খুশি, তেমন সাঁজোর কম্পিটিশনের জন্যে। মা সাঁজিয়ে দিয়েছে।’
পিছনে অনন্যাও দাঁড়িয়ে ছিলো। সে এই প্রথমবার ফারিশকে এতো প্রানখুলে হাসতে দেখলো। সে ফারিশের হাসি দেখে মুগ্ধ গলায় বললো, ‘ আপনার হাসি বড্ড সুন্দর, তবে সবসময় ঘুমড়ো মুখে থাকেন কেন? আপনাকে হাসলে সুন্দর লাগে। ‘
চলবে কী?